দৃশ্যপট ১:
যাক,অনেক ব্যস্ততার ভীড়ে কিছু সময় বের করা গেলো। প্রিয়তমা স্ত্রীকে সময় দেওয়ার আনন্দে মানুষটার ভিতরে শিশুসুলভ একটা আনন্দ দেখা যাচ্ছে। তার স্ত্রীও সবসময় এই সময়টুকুর জন্য মুখিয়ে থাকে। বিয়ের পর নানা ব্যস্ততায় স্বামীর সান্নীধ্যে খুব কম সময়ই সে কাটাতে পেরেছে। চিরায়ত বাঙ্গালী নারীর মতই তার মনের মাঝেও স্বামীকে নিয়ে সবসময় খুনসুটিতে মেতে থাকার একটা অদম্য ইচ্ছা কাজ করে তার মনে। তাই সে তার স্বামীর সাথে কাটানো সন্ধ্যাগুলোকে সবসময় স্মৃতিময় করে রাখতে চায়। আজকে এমনই একটা দিন। আয়নার সামনে বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করা হয়ে গেছে। এখনই বের হতে হবে।
পিজ্জাহাটের সামনে গাড়ি এসে থামলো। লাজুকভাবে স্বামীর হাত ধরে নেমে মেয়েটি গাড়ি থেকে নামলো। সিড়ি বেয়ে উঠে যখন দরজা ঠেলে তারা ঢুকল তখন হঠাৎ করেই অনেকগুলো উৎসুক চোখের কৌতুহলী দৃষ্টি তাদের খুঁজে নিলো। স্বামী- স্ত্রী দুজনেই এমন পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত। সেলিব্রিটি লাইফের যেমন যশ-খ্যাতি আছে তেমনি উপঢৌকন হিসেবে আছে বিড়ম্বনা। যাক, এত কিছু ভেবে লাভ নেই। তারা নিজেদের বসার জন্য খালি টেবিল খুঁজতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ তাদের পাশের টেবিল থেকে ভেসে আসল একটা কটুক্তি। নিজের স্বামীর এমন অপমানে মেয়েটার কান লাল হয়ে গেলো। বেশকয়েকদিন থেকেই তার স্বামীর সাথে এমন আচরণ করা হচ্ছে। প্রায় সময় সে কিংবা তার স্বামী এসব পাত্তা দেয় না। কারণ তারা জানে কোন মানুষ নতুন কিছু করতে গেলে তাকে নিয়ে যেমন আলোচনা হয় তেমনি সমালোচনাও হয়। কিন্তু আজকের কটুক্তিটা মেয়েটা আর সহ্য করতে পারল না। নিজের প্রিয়তম মানুষের এমন অপমানে সে কিভাবে চুপ করে থাকে !! সে প্রতিবাদ করলে এবং একসময় সে মেজাজ হারিয়ে একটা অনভিপ্রেত কান্ডও করে বসল। সে গ্লাস ছুড়ে মারল কটুক্তির উৎস টেবিলের দিকে।
এদিকে স্বামী বেচারাও বসে নেই। সে প্রথমে নিজেই তার উপর করা কটুক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলো কিন্তু পরে নিজের স্ত্রীর আচরণে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। তার নিজের ভিতরের ক্ষোভটুকু চেপে গিয়ে সে উপস্থিত সবার কাছে "স্যরি" বলে সে স্ত্রীকে হাত ধরে টেনে নিয়ে বের হয়ে যায়।
উপরের দৃশ্যপটটি কোন সিনেমা বা নাটকের নয়, একটি বাস্তব ঘটনার কাল্পনিক রুপায়ণ। নায়ক অনন্ত জলিল এবং তার স্ত্রী বর্ষা গতকাল এমনই অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হলেন ধানমন্ডির পিজ্জা হাটে। বিস্তারিত ঘটনা এখানে আছে।[/si]
দৃশ্যপট ২:
লোকটা বেশজোড়েই রিকশা চালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কেন জানি রিকশা যতটুকু এগোনোর কথা তা এগুচ্ছে না। যাত্রী বারবার তার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার বেশ তাড়া আছে। সে একটু বিরক্ত হয়েই রিকশাওয়ালাকে প্রশ্ন করে,"কি ভাই?? সকালে কিছু খেয়ে বের হন নাই??" রিকশাওয়ালা জবাবে কিছু না বলে নিরবে প্যাডেল মেরে যায়। যাত্রী এবার কিছুটা কৌতুহল অনুভব করে। সে রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বলে," প্রশ্নের উত্তর দাও না কেন ?? রিকশা থামাও !!" রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,"না, স্যার কিছু খাই নাই।" যাত্রী এবার নসিহত করা শুরু করে, "না খাইলেতো এমন অবস্থাই হইব। এখন বাজে সকাল ৮টা আর তুমি এখনও কিছু খাও নাই কেন?? কইলাম তোমারে যে আমার জরুরী কাম আছে তাড়াতাড়ি টানতে হবে আর তুমি এখন কইতাছ এই ইতিহাস !!" রিকশাওয়ালা জবাবে কিছু বলে না শুধু মলিন মুখে যাত্রীর দিকে তাকায়। রিকশাওয়ালার মুখের দিতে তাকিয়ে যাত্রীর বুকটা কেমন জানি হাহাকার করে উঠে। সেই মলিন চাহনিতে কিছু একটা লেখা আছে যা যাত্রীর সমস্ত রাগকে পানি করে দেয়। যাত্রী জিজ্ঞেস করে, "কি হইছে??" রিকশাওয়ালা চুপচাপ বলে যায়, "স্যার আমি রিকশা চালাইতে পারি না। আমি গেরামে গেরস্থের কাম করি। কিন্তু আমার ছোড মাইয়াডার অসুখের লাইগা আইজকা ঢাকা মেডিকেলে আইছিলাম। ডাক্তার কইছে মাইয়াডারে বাচাইতে হইলে পেডে অপারেশন করন লাগব। এর লাইগা আমারে ১০টার মইধ্যে ৩০০০ টেহা জোগাড় করন লাগব।তাই স্যার আর খাওয়ার টাইম পাই নাই।" যাত্রী এবার নিজেই নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে,"এখন পর্যন্ত কত টাকা কামাইছ? আগের জমানো টাকা নাই ?" রিকশাওয়ালা মাথা নিচু করে বলে," স্যার, ৬ডা থেইক্কা চালাইতেছি। এহন পর্যন্ত ৪০০ টেকা জমাইছি। আগের টেকা সব কাইলকাই ওষুধ কিনতে খরচ কইরা ফেলছি।" যাত্রী আর কিছু বলে না। সে রিকশা ভাড়া আর সাথে আরও কিছু টাকা লোকটার হাতে গুজে দিয়ে নিজের গন্তব্যে হাটতে থাকে।
এই ঘটনাটি আমার এক ক্লাসমেটের মুখ থেকে শোনা। আমি তার মুখ থেকে ঘটনাটা যখন শুনছিলাম তখন আমার মনে একটা কথাই বাজছিলো,"লোকটা তো রিকশা না চালিয়ে চুরি-ছিনতাই করলেও পারত!! ২৪ রকম মানুষের ঢাকা শহরে টাকা ইনকামের কতই না শর্টকাট উপায় আছে !! তা না করে সে কিনা রিকশা চালাচ্ছে !! নিতান্তই সহজ-সরল আর সৎ বলেই এমনটা করছে।" শুধু এরকম একটি ঘটনা নয়, আরও হাজারো ঘটনা দেখানো যেতে পারে যেখানে একজন পঙ্গু মানুষ ভিক্ষা না করে রিকশা চালাচ্ছে কিংবা বছরের ৬মাস গ্রামে কৃষিকাজ করে বাকি ৬ মাস শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য, পেটের দায়ে। তবুও কারও কাছে তারা হাত পাতছে না।
এবং আমাদের মজ্জাগত অভ্যাসঃ
আমাদের কিছু মজ্জাগত অভ্যাস আছে। আমরা নিজেরা কিছু না করতে পারলেও যাত্রাপথে অন্যের পা টেনে ধরতে ওস্তাদ। সত্যি কথা বলতে নায়ক অনন্ত জলিলের কাঁচা অভিনয় যেকোন সমঝদার লোকের কাছেই চরম হাস্যকর মনে হবে। তাই সে আসলেই সমালোচনার যোগ্য। তাই আমরা তাকে নিয়ে জোকস বানাই, ফেবুতে এডিট করা ছবি শেয়ার করি। (যেটা আমিও করি।) আড্ডাতে তাকে নিয়ে মজাদার কথা হয়। এতটুকু বোধহয় আমরা করতেই পারি। কারণ এই এখতিয়ারটুকু আমার আছে। কিন্তু আমরা সমালোচনা করতে যেয়ে কতটুকু সমালোচনা করতে হয় তা ভুলে যাই। তাকে রাস্তাঘাটে/রেষ্টুরেন্টে কটুক্তি করার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের অধিকার নেই তাকে টকশোতে সাক্ষাৎকার নেওয়ার নামে "জোকার" বানানোর। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে এটা আমরা করতে পারি না।
ঘটনার সময় বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে একটা ছেলে অনন্তকে "রিকশাওয়ালার বাচ্চা" বলে গালি দেয়। আমাদের কিন্তু "রিকশাওয়ালা" শব্দটাকেও গালি হিসেবে ব্যবহারের এখতিয়ার নেই। "রিকশাওয়ালা" শব্দটা "চোর", "ডাকাত", "ফকির", "শুয়োর" - এসব শব্দ থেকে অনেক উন্নত। হ্যা, শিক্ষাদীক্ষার পার্থক্যের কারণে অনেকের আচরণে পার্থক্য হয়। কিন্তু এর মানে কিন্তু একটা সৎ পেশাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করার অধিকার আমরা পাই না।
কোন এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম অনন্তকে নিয়ে নাকি তার পরিবার অনেক চিন্তিত ছিলো সিনেমাতে আসার সময়। তাদের চিন্তা ছিলো যে সিনেমাতে গেলে যদি পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় !! এবং সেই ঘটনার সময় ছেলেটি অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো,"........তোরা এমন দেখেইতো সিনেমাতে আসিস !!...."। আসলেই ভদ্র হলেতো অনন্ত সিনেমাতে আসত না। সিনেমা হলে যেয়ে বাংলা ছবি দেখার চেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পিসিতে ১৮+ ছবি দেখাই ভদ্রতার লক্ষণ !! মিডিয়া নিয়ে অনেক গুজবই শোনা যায়। অনেক রগরগে ঘটনাও প্রকাশ পায়। কিন্তু কেউ যদি সেই ময়লা সাফ করতে যায় তাহলে তাকেও নোংরা বলাটা কতটুকু ভদ্রতার লক্ষণ !! কেউ ভুল পথে ময়লা সাফ করতে গেলে তাকে শুধরিয়ে দেওয়াটা ভদ্রতা, ময়লা সাফে অনুৎসাহিত করাটা ভদ্রতা নয়।
দৃশ্যপট ১-এ যেভাবে সব বর্ণনা করা হয়েছে হয়তোবা তাদের মনে সেরকম অনুভূতিই ছিলো। এক সাক্ষাৎকারে অনন্ত বলেছিলেন যে তিনি তার স্ত্রীকে ভালোমত সময় দিতে পারেন না। নিজের ব্যবসা আর সিনেমার সব কাজ দেখভাল করতেই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। স্ত্রীর সাথে সময় কাটানো বলতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে ডিনার করতে যাওয়া। অথচ আমরা তাদেরকে সেখানেও মুক্তি দিলাম না !!
সবশেষে অনন্তের Twitter বার্তা যোগ করে লেখা শেষ করছিঃ
"Friends, the incident which occurred last night in Pizza Hut was not acceptable. Barsha just argued with the guys and lastly she broke the plate with excitement. Finally the react which Barsha did was not acceptable too. I just wanted to tell that guys that he is a student and much junior than me. How many languages he knows to speak? I tried to make the environment in normal position.
We must obey each other to get the salutation.
On the other, I wanna say that I don’t bother on the guys who made my pronunciation Pom Gana instead of From Ghana. Definitely we all have the rights to enjoy by ourselves. So, I just continue my works by myself. No time to see what’s going surrounds me. I know who I am and I know what I can do"
(প্রতিটা মানুষের প্রাইভেসি আছে। আশা করি আমরা সবাই একদিন সেই প্রাইভেসির মূল্য দিতে শিখব।)
Source: Facebook
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



