‘ফেনী সদর হাসপাতালের এক নম্বর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বিছানায় শিশু হাসিনার কঙ্কালসার দেহটি পড়ে আছে। গায়ের প্রতি ইঞ্চিতে জখমের চিহ্ন। পা থেকে গলা পর্যন্ত নানা স্থানে দগদগে ঘা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরেছে........।’
কয়েকদিন আগে এমনই একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয়। ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী হাসিনাকে এমনভাবে নির্যাতন করেছিল এক সেনাকর্মকর্তার স্ত্রী, তা নিষ্ঠুরতার সকল বিশেষণেও প্রকাশ করা যাবে না। শুধু হাসিনাই নয়। সারা দেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এমন অসংখ্য হাসিনা রয়েছে। যাদের দেহে পচন ধরে গেছে, কঙ্কালসার দেহ নিয়ে হাসিনারা গৃহকর্ত্রীর জুতো-জামা থেকে শুরু করে (...) পর্যন্ত ধুয়ে দিচ্ছে।
আর গৃহকর্ত্রীরা তখন আরাম করে হয়তো স্টার প্লাসের কোনো হিন্দি সিরিয়াল দেখায় মগ্ন। অথবা পাশের বাসার ভাবীর সঙ্গে রসালো আলাপে মশগুল। আর এদিকে শিশু গৃহকর্মীটি তার কোমল দুই হাতে পুরো পরিবারটি সালাচ্ছে। তবু পান থেকে চুন খসলেই তার গায়ে পড়ছে চড়-থাপ্পর, পিটুনি, গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, শরীরে গরম পানি ঢেলে দেয়া, চোখে মরিচের গুঁড়া মারাসহ অভিনব সব নির্যাতন। সব সয়েই হয়তো সে কাজ করে যাচ্ছে দুটি পয়সার আশায়। যতণ না পর্যন্ত তার জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করে অথবা জীবন প্রদীপটাই না নিভে যায়, তার আগ পর্যন্ত আমাদের এই আপাত দৃষ্টির সভ্য সমাজ কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারে না।
এই যে শিশু হাসিনা বা হাসিনারা যে গৃহকর্ত্রীর হাতে (গৃহকর্ত্রীর হাতেই নির্যাতনের সংখ্যাটা বেশি) এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাকে আমরা কী বলে আখ্যায়িত করতে পারি? পশু বললে পশুদের প্রতি অবমাননা করা হয়। হিংস্র জানোয়ার কিংবা হায়েনার চাইতেও তারা আরো বেশি বর্বর। প্রকৃতই তাদের বিবেক বলে কোনো কিছু নেই। অথচ তারাই নাকি এ দেশের শিতি (!) নারী সমাজ।
আমার যতদুর মনে পড়ে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কিংবা কাজ করতে গিয়ে যতটা জেনেছি, যেসব গৃহকর্ত্রীর হাতে গৃহকর্মীরা, আমাদের হাসিনারা এমন নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয় তাদের বেশিরভাগই শিতি। বেশিরভাগই নিউকিয়ার বা একক পরিবার। গৃহকর্মীদের প্রতি তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন, আমাদের মনে করিয়ে দেয় মধ্যযুগীয় দাস প্রথার কথা। যেন তারা মধ্যযুগীয় সময় আবারো ফিরিয়ে আনতে চাইছে।
সেনাকর্মকর্তার বাসায় নিষ্ঠুরতার শিকার হাসিনা।
একটি পরিসংখ্যান বলছে ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৩৯৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। গুরুত্বর আহত হয়েছেন ২৯৯ জন। আর ৭৭ জন মহিলা গৃহকর্মী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু গতবছর এ ধরণের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫৬ জন গৃহকর্মী। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ গৃহকর্মীর।
এই যে প্রতিনিয়ত গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর শেষ পরিণতি আসলে কী? টাকা খেয়ে পুলিশ নির্যাতনের মৃত্যুকে বলছে অপমৃত্যু কিংবা নির্যাতিতের পরিবারও এক সময় মোটা টাকার বিনিময়ে আপস করে ফেলছে। অর্থের কাছে মানবতা আসলে অসহায় হয়ে পড়ছে।
এই মে দিবসের আমাদের ভাবনা হোক একটিই, অর্থের কাছে মানবতা যেন কখনোই বিক্রি না হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১১ রাত ২:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



