somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তৃতীয় চোখ

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিফাতের চোখ প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করছে। তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর মধ্যেও তার কপাল বেয়ে ঘামের ফোঁটা ভ্রু হয়ে চোখের ভেতর। কিন্তু ওসব দিকে তার আপাতত কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই মুহূর্তে একটি হিসাব তার কিছুতেই মিলছে না। রিশার সাথে সম্পর্কটা দারুণ এক জটিল অঙ্কে রূপ নিয়েছে। তাদের সম্পর্কটা তো আর নতুন নয়; এমনও নয় যে একেবারেই গোপনীয় কোনো ব্যাপার প্রকাশিত হয়ে পড়ায় সমস্যা বেঁধেছে। হঠাৎ তাহলে এমন একটা জটিল হিসাব-নিকাশ কেন দাঁড়ালো? দুদিন আগেও সব ঠিকই তো ছিল।

গত রাতে রিশা বলেছে, সম্পর্কটাকে আর এগোতে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে সে জানিয়েছে যে তার বাবা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে গেছেন এবং এমন একটি ‘নোংরা’ ব্যাপার তাঁরা কোনোভাবেই মানতে পারেন না। ঘটনাটা এ পর্যন্তও অতটা জটিল ছিল না যতটা হয়েছে সিফাতের বাবার কানে পৌঁছানোর পর। রিশার বাবার কাছ থেকে জানার পর তিনি প্রথমত সিফাতের সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত এমন একটি ব্যাপার লোকসমাজে প্রকাশিত হলে মানুষের সামনে মুখ দেখাবেন কী করে- এ নিয়ে দারুণ টেনশানে ঘরের জিনিসপত্র সব ভাঙচুর আরম্ভ করেছেন।
সিফাত কিছুতেই বুঝতে পারছে না, রিশার সাথে তার সম্পর্কটা ‘নোংরা’ হবে কেন? তারা একে অপরকে ভালোবাসে, দুটো পরিবারের সামাজিক অবস্থানেও তেমন একটা ব্যবধান নেই। তাছাড়া, দুটো পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো বিরোধের সম্ভাবনাও আঁচ করা যাচ্ছে না। উভয়ের বাবার বক্তব্য একই- এ ধরনের নোংরা একটা ব্যাপার তাদের সন্তানেরা কীভাবে ঘটাতে পারলো? কারণ অনুসন্ধানে সিফাত জানতে পারলো- একজন পুরুষ ও একজন নারী একে অপরকে ভালোবাসবে এবং সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে- এটা অত্যন্ত নোংরা একটা বিষয়। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে ভালোবাসে- এর মধ্যে নোংরামিটা কোথায় সেটা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। সিফাতকে তার বাবা জানিয়েছেন, ‘আমাদের ধর্মে এটাকে অত্যন্ত ‘গর্হিত’ একটি কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কেবল এই একটি নোংরা কাজ করার কারণেই আমাদের পূর্বসুরী একটি জাতিকে স্রষ্টা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।’
কথাটা শোনার পর থেকেই সিফাতের মাথা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেল। তার ধর্ম এমন একটি অমানবিক নির্দেশনা কেন দেবে? তার স্রষ্টা এতটা নিষ্ঠুর কিছুতেই হতে পারেন না। তাছাড়া, এই প্রেম এই ভালোবাসার অনুভূতি তিনিই তো দিয়েছেন; তাহলে? সে যে একটি মেয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে, এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, সে অপরাধ তো তার নয়। সিফাত ভাবে, জ্ঞানবুদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর থেকে তো নারীর প্রতিই সে আকর্ষণ অনুভব করে। এর পেছনে তার নিজের তো কোনো হাত নেই, তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এভাবে। এখানে তার দোষটা কোথায়? যিনি তাকে এ অনুভূতি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন, তিনিই সেটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন- এটা কেমন কথা?

আজ সকালে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সিফাত তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা বাবা, তোমার পছন্দের রং কী?’
বাবা বললেন, ‘রং দিয়ে কী হবে?’
‘আহা, বলোই না বাবা; তোমার পছন্দের রং কী?’
‘আমার পছন্দের রং লাল।’
‘কেন বাবা? তোমার পছন্দের রং নীল হলো না কেন?’
‘লাল হলে সমস্যা কোথায়? আর নীলই বা কেন হতে হবে?’
‘আমার পছন্দের রং তো নীল!’
‘তো?’
‘তোমার পছন্দের রং যেহেতু লাল, আমার পছন্দও কেন লাল হলো না? বা আমার যেহেতু নীল পছন্দ, তোমার পছন্দও নীল কেন হলো না?’
‘কী বোকার মতো কথা বলছো? তোমার মাথাটাথা কি খারাপ হয়ে গেল, না-কি? দুটো মানুষের পছন্দ যে একই হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া কার কোন রং পছন্দ বা অপছন্দ হবে, সেটা তো আমরা নিজেরা ঠিক করি না; এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।’
‘তোমার পছন্দ লাল, আমার নীল- আমাদের মধ্যে কে অপরাধী?’
‘অপরাধী কেন হতে যাবে? যার যার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারবে না?’
এ পর্যায়ে এসে সিফাত বললো, ‘আমিও তো সেটাই বলতে চাচ্ছি বাবা। যার যার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ তো থাকবেই। সবার ভালোলাগা-মন্দলাগা তো আর এক রকম হবে না। এর মানে তো এটা নয় যে তোমার পছন্দটা পুণ্য আর আমারটা পাপ। তাছাড়া, তুমিই তো মাত্রই বললে যে পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো আমরা ঠিক করি না, এগুলো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।’
কোনো যুক্তিতেই কোনো কাজ হয়নি। বাবা শেষ যে বাক্যটি বললেন তা হলো- ‘তুমি যতই যুক্তি দিয়ে তোমার অবস্থান শুদ্ধ প্রমাণের চেষ্টা করো, লাভ নেই। ধর্ম কোনো যুক্তি মানে না। স্রষ্টার নির্দেশই আইন, সেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য যুক্তি।’

সিফাতের কাছে পুরো পৃথিবীটা একটা দুঃসহ গোলকধাঁধার মতো লাগছে। চোখ খুলে তাকালেই যেন সবকিছু গোল গোল ঘুরছে। সে কীভাবে বোঝাবে- যে ঠোঁটে সে ঠোঁট রাখতে চেয়েছে, সেটা একটা নারীর ঠোঁট; কোনো স্রষ্টার নির্দেশই তাকে পুরুষ-ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে বাধ্য করতে পারে না। যে শরীরকে সে জড়িয়ে ধরেছে সহস্র বার, কল্পনায়; কোনো একটি গ্রন্থের কোনো একটি বাক্যের জন্য সে শরীরকে অস্বীকার করা যায় না। সে যাকে ছুঁয়ে থাকতে চেয়েছে, সে তো একজন নারী; যার সাথে আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠতে চেয়েছে, সে তো একজন নারী! ইচ্ছের বিরুদ্ধে, মনের বিরুদ্ধে, শরীরের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন পুরুষকে সে কীভাবে গ্রহণ করবে? কেনই-বা করবে? তাকে এটা করতে বাধ্যই বা করা হবে কেন? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যদি ‘নোংরা’ হবে তো শুদ্ধ-পবিত্র সম্পর্ক কী? এসব ভাবতে ভাবতেই সিফাত মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেল।

২.
চোখ খুলে তাকাতেই সিফাতের কাছে সবকিছু বড় স্বাভাবিক মনে হতে লাগলো। সবকিছু ঠিকঠাক। কোনো হইচই নেই, কোনো অসহনীয় বিশৃঙ্খলা নেই। তাহলে একটু আগেই যেসব তার জীবনে ঘটে গেল, সেগুলো?
কয়েক মুহূর্ত পেরোতেই সে কিছুটা ধাতস্থ হতে শুরু করলো। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে অনুভব করলো- দারুণ বিব্রতকর এবং একই সাথে প্রচণ্ড রকম ভয়ংকর একটি স্বপ্নের পর তার ঘুম ভেঙেছে। সে মনে মনে বেশ স্বস্তি অনুভব করতে লাগলো। বিছানায় শুয়ে থেকেই ঘুম ঘুম চোখে রিশাকে ফোন করলো। না, রিসিভ হলো না; রিং বেজে বেজে কলটি কেটে গেল। তবু সিফাত বড্ড নিশ্চিন্ত! সে জানে, রিশাকে ভালোবাসতে এ পৃথিবীতে তার কোনো বাধা বা নিষেধাজ্ঞা নেই।

৩.
কলেজে গিয়ে সিফাত সবার আগে রাব্বিকে খুঁজে বের করলো। রাব্বিকে দেখামাত্রই তাকে জাপটে ধরে আলিঙ্গন করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রাব্বি খানিকটা বিস্মিত! এক দিন আগেও সিফাত তাকে সহ্য করতে পারতো না একেবারেই; যুক্তি- রাব্বির পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক নয়। অথচ আজ......! কী হলো হঠাৎ করে?
জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই সিফাত বললো, ‘আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তোর কাউকে পছন্দ?’
কী বলবে না বলবে রাব্বি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
সিফাত পুনরায় বললো, ‘আমি তো তবু চিৎকার করে আমার ভালোবাসার মানুষটার কথা বলতে পারি, বলতে পারি ‘আমি রিশাকে ভালোবাসি’; কিন্তু তুই! আমাকে মাফ করে দিস প্লিজ; আমি তোর আবেগটা এখন স্পষ্ট ধরতে পারি জানিস? জাগ্রত অবস্থায় যেটা উপলব্ধি করতে পারিনি, ঘুমন্ত মস্তিষ্কের স্বপ্ন আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে।’
রাব্বির চোখে জল!
সিফাত বললো, ‘আমি যদি তোর হাতটা স্পর্শ করি, তোর ভালো লাগবে?’
অস্ফুট স্বরে রাব্বি বললো, ‘হ্যাঁ!’
সিফাত তার হাত দুটো রাব্বির দিকে প্রসারিত করে দিলো। হাত দুটোকে রাব্বির কাছে বড় বেশি মানুষের হাত বলে মনে হচ্ছে!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৫
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×