- ....... আবার আইছস? হায়া লজ্জা নাই তোর .......???তোরে না, না করছি এই বাইত আইতে?
-খোদাতায়ালা কি ঐ কাইল্লাষাড়ের মত ঐ শরীরডার সাথে সাথে দিলটাও ঘেন্না পিত্তহীন কইরা দিছে তোর?
-দূর হ আমার চোখের সামনে থেইকা।ভালো চাইস তো দূর হ কইতাছি। ভালোয় ভালোয় বিদায় হ......
বিয়ের পর থেকে কত লক্ষ কোটীবার নসিমন শুনেছে তার কালো মোটাসোটা শরীর সর্বস্য রুপের এই অপবাদ। একটাবারও আপত্তি করেনি।খোদাতায়ালার কাছেও নেই তার কোনো অভিযোগ । যেমনটি নেই তার এই বিশ্বাসঘাতক, দুর্ব্যাবহারকারী স্বামীটির প্রতি।
স্বামীর এমন ব্যাবহারের উত্তরে নসিমন কোনো প্রতিবাদ করেনা, একটা বার রুখেও ওঠেনা। নাকি কান্না জুড়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে,
-আইতে চাইনা ঈমানে কইতাছি। শুধু কাইল মাইঝরাইতে পোলাডা ঘুম ভাইঙা উইঠা কান্না জুইড়া দিলো, হেয় স্বপনে দেখছে তার বাবার নাকি ম্যালা অসুখ, তাপে শইলডা পুইড়া যাইতাছে........... ........
এই মিথ্যা যেন কোরবান আলীর আর সহ্য হয়না।রোজ রোজ নিত্য নতুন বানোয়াট গল্প। মনে মনে ভাবে শকুনীটা মরেওনা। দ্বিতীয় বাচ্চাটা জন্মের পরে নসিমনের চেহারাটা দেখতে হয়েছে যেন সাক্ষাৎ ভাগাড়ের শকুন! তেড়ে উঠে এগিয়ে যায় সামনে,
-ফের মিছা কথা ..........চুলের মুঠি ধইরা বাইর কইরা দিমু আর একবার যদি মিছা কান্দন গাইতে আসিস।লাত্থি দিয়া তোর থোতা মুখ ভোতা কইরা দিমু......,বড় ছেলেটা মায়ের সাথে সাথে কান্না জুড়ে দেয়।কোরবান আলির মেজাজ এইবার সপ্তমে উঠে।
দূর হ দূর কইতাছি। এই সব ট্যা ভ্যা নিয়ে এখুনি বাইরা। ছুড়ে দেয় সে দুটি ৫০ টাকার নোট নসিমনের শরীরে। কোলের বাচ্চাটা নিয়েই মাটি থেকে উবু হয়ে তুলে নেয় নোট দুটি নসিমন। উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে পরীবিবিকে। কোরবান আলীর পিছে ঘুম ভাঙা আহলাদী বিড়ালের মত এসে দাড়িয়েছে সে।
ছোট একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর। সেটা চেপেই মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে , বলে- যাই..
বেরিয়ে আসার সময় পেছন থেকে শুনতে পায়, কোরবার আলীর বলছে,
এই যাওয়া যেন শেষ যাওয়া হয়......
রাস্তায় নেমে দ্রুত পা চালায় নসিমন। অভাব অযতন অবহেলায় সেই মোটা তাজা মোষের মত চেহারার পরিবর্তিত আজকের এই শীর্ণ শরীরটা কোলে একটা আর কাঁখে একটা নিয়ে যেন এগুতে চায়না আর! বেলা সাতটার মাঝে গুলশানের বাসার কাজে যেতে হবে। দেরী হলে বিবিসাবের মেজাজটা কোরবান আলীর মেজাজের সাথে কোনো অংশেই অমিল থাকবেনা।
তবুও এত কিছুর মাঝেও পথ চলতে চলতে মনে পড়ে সেই দিনটার কথা।
তার জীবনের সুখের দিন বলতে ঐ একদিনই। তার বিয়ের দিনটা। জন্মেই মাকে খেয়েছে সে। তারপর থেকেই মামার বাড়ীতে বেড়ে ওঠা নসিমনের কপালে সুখ কাকে বলে জানা হয়নি। দিবারাত্রী মামীমার হুকুম, মামাত ভাইবোনদের ফাই ফরমাস আর সংসারের যাবতীয় কাজ করেও কারো খালি মুখের এতটুকু মিষ্টি কথা ওর কপালে জুটেনি কখনও।
সেই নসিমনকে যখন মামীমা একদিন ডেকে নতুন একখানা কাপড় পরালো। এক টুকরো সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে আসতে বললো, পাড়া পড়শী বৌ ঝিয়েরা হলুদ বাটা একটু মুখে ঘসালো। পাশের বাড়ির করম আলীর নতুন বৌটা কথা থেকে একটু দুধের সর যোগাড় করে এনে ওর কালো কালো মোটা মোটা হাত পায়ে ঘসে ফরসা করে তুলতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো। নসিমনের মনে হলো আজ হতে সে রাণী হতে চলেছে। তার দুখের জীবনের বুঝি অবসান ঘটলো। নসিমন জানলো তার ট্যাক্সী ড্রাইভার মামা তারি সুখের জন্য একজন সুপাত্র ট্যাক্সী ড্রাইভার জামাই জোগাড় করেছেন।ঠোটে আলতা, চোখে কাজল, গালে পাউডার বুলানো নসিমনের মনে হলো সে বুঝি সত্যি স্বর্গবাস করতে চলেছে।
বাসররাতে নসিমন তার স্বপ্নের রাজকুমারের লম্বা চওড়া দীর্ঘদেহ, কালো বড় বড় চোখের চাউনী আর কপালের উপর ঢেউ খেলানো চুলের বাহার দেখে অভিভুত হয়ে পড়লো। তার বিশ্বাসই হতে চাইছিলোনা এমন একজন সিনেমার হিরোদের মত চেহারার মানুষ তার স্বামী। কিন্তু কেনো যে নসিমন ওর জান প্রাণ দিয়ে স্বামী সেবা করেও তার মন পেলোনা।আজো সে বুঝলোনা। চেহারাই কি সব এই দুনিয়ায়? বার বার নিজের কাছেই প্রশ্ন করেছে সে।বিয়ের দুদিনের মাথায় ও জানতে পারলো সকাল বেলা এমন কালো মইষের মত চেহারা দেখলে তার স্বামীর নাকি দিনটাই মাটি হয়। নসিমনেরর দুঃখ হল সেদিন খুব। সে তার কালো চেহারাটার জন্য না। দুঃখ তার স্বামীর কষ্টটা।
সেই কারনেই বিয়ের তিন বছরের মাথায় দু দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে হাড় জিরজিরে নসিমনকে যখন ঘর থেকে বের করে দেয় কোরবান আলী। তেমন কোনো আপত্তি করেনি সে। কাঁলাচাঁদপুরের এই বস্তিতে তার এই শহরের একমাত্র আপনজন বলতে যাকে বুঝে সেই ছবিভাবীর কাছে এসে উঠেছিলো সে।তার সহায়তায় গুলশানের এক বাসায় কাজও জুটিয়ে নিয়েছে সে। কোনোমতে দুঃখে কষ্টে জীবনটা চলে তার । শুধু কিছুদিন পরে কোরবান আলীর মুখটা না দেখলে তার দুনিয়া আঁধার হয়ে আসে।
কোরবান আলী ভালোই আছে পরীবিবিকে নিয়ে। কোথায় পরীর মত চেহারার পরীবিবি আর কোথায় কালো মহিষের মত দেখতে নসিমন। নিজের ভাগ্যকেও দুষতে পারেনা সে।
বস্তির ঘরে ফিরে বাচ্চা দুটোকে কিছু মুড়ি আর গতরাতের বাঁচানো কিছু পানিভাত দিয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে সে। পাশের বাড়ীর ছবি ভাবীকে ঘরের চাবি আর এক গ্লাস দুধ বুঝিয়ে দিয়ে কাজে বের হয়ে যায়।
পথে যেতে যেতে ভাবে, বিবিসাহেবের কাছে আগামী মাসের কিছু টাকা আগাম চাইবে সে। পরীবিবি যত সুন্দরী হোক তার মত কি রাঁধতে জানে? না জানি কত কষ্ট হয় তার স্বামীটার। একদিন ভালো মন্দ কিছু রান্না করে খেতে ডাকবে সে স্বামীকে। হাজার হোক তার বাচ্চাদের বাপ, না এসে কি আর পারবে?
কিন্তু কোনো রকম কাঁকুতি মিনতিতেই কোরবান আলীর মন গলেনা।বড় ছেলেটাকে দিয়ে ডাকতে পাঠানো কোরবান আলী বরাবরের মত দুটো ৫০ টাকার নোট ছুড়ে দিয়ে তার চোখের সামনে দিয়ে পরীবিবিকে নিয়ে ট্যাক্সী সমিতির বনভোজনে চলে যায়।
এভাবেই দিন কাঁটে নসিমনের। কদিন পর পর সেই মুখ যত গালমন্দ করুক তাকে না দেখে সে থাকতে পারেনা। ঘর মুছতে গিয়ে হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যায় নসিমন। বিবিসাহেবই তাকে সরকারী মেডিকেলে নিয়ে আসে।ড্রাইভার দিয়ে খবর পাঠায় বস্তিতে।নসিমন জানেনা কি হয়েছে তার। ছবি ভাবী আসে হাসপাতালে তাকে দেখতে।বাচ্চা দুইটা তার কাছেই আছে। বলে চিন্তা করিসনা। ঠিক হইয়া যাইবো সব। তাকে দয়াকারীনি এই মহিলাটি আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে। নসিমন চুপি চুপি বলে ভাবীগো , একটাবার তারে খবর দিতে পারবা?শুধু একটাবার তারে দেখতে মন চায়।
ছবি ভাবী কথা দেয়, স্বামীকে দিয়ে খবর পাঠায় । বরাবরের মত কোরবান আলী বিরক্ত হয়। তবে ছবি ভাবীর স্বামীকে এবার সে ১০০ টাকার দুখানা নোট ধরিয়ে দেয়, তবে তা কার জন্য বাচ্চাদের জন্য না নসিমনের জন্য জানতে চায়না ছবিভাবীর স্বামী,দয়ালু এই ব্যাক্তিটির চোখেও ঘেন্না ফুটে ওঠে এই পাষন্ডের কান্ড দেখে বুঝি।তবুও যতদূর সম্ভব নরম করে বলে,
-সেতো টাকা চায়না।
কোরবান আলী বিরক্ত হয়, বলে
-তাইলে কি চায়??
- সে তোমারে দেখতে চায়। শেষবারের মত।
কোনবান আলী হঠাৎ থমকে তাকায়। তার কি মনে পড়ে দিনরাত তার খেদমতে খেঁটে যাওয়া, তাকেই সূখী করতে প্রানান্তকারিণী হাড় হাভাতে, চিরদুঃখী নসিমনের সতৃষ্ণ চেহারাটা?
দোনোমনো করে কথা দেয়, সে দেখতে যাবে নসিমনকে এক সম সময় করে।
পরদিন বিকালে নসিমনের অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকে।বুকটা ফেঁটে যায় তৃষ্ণায় যেন। নার্স দৌড়ে আসে। পানি ঢেলে দেয় মুখে।হাঁপাতে হাঁপাতে এদিকে ওদিকে কি যেন খুঁজে নসিমন। নার্স জানতে চায়
-কারে খুঁজো বোন?
নসিমন মাথা নাড়ে- কাউরে না
কাউরে খবর দিতে চাও?
নসিমন এক পলক তাকায় নার্সের মুখের দিকে। কিছু ভাবে সে একটুক্ষণ।বলে -হ্
-আমার লাশটা কেউ নিতে আইলেন কইয়েন, আমার স্বামী যেন আমার লাশের কাছে না আসে।
খুব অস্ফুটে বিড়বিড় করে বললেও স্তব্ধ হয়ে যায় নার্স ওর কথা শুনে। আর তার কোলে মাথা রেখে চিরকালের জন্য নিস্তব্ধ্ হয়ে যায় নসিমনের আজন্ম দুঃখী শরীরটি।
( নসিমন কোনো মিথ্যে গল্পের চরিত্র নয়। মাস ছয়েক আগে আমার দেখা একটি সত্যি গল্পের এক দুখিনীর নাম। কিছুদিন আগে অনেকটাই ঠিক তেমন মিলে যাওয়া আরেক নসিমনের গল্প পড়লাম। তখনও নসিমনকে নিয়ে কিছু লিখবো ভাবিনি। নসিমনদের দুঃখ নিয়ে কিছু লেখার সাহস ও কখনও আমার হতোনা হয়তো। শুধু মনজুরুল হক ভাইয়ার অনুপ্রেরণায়, আমার দেখা সত্যি ঘটনা ও গল্পের সেই নসিমন এক হয়ে মিলে মিশে গেলো আজ সকালে।তাই কিছু কল্পনা ও কিছু সত্যি মিশিয়েই একটা কিছু লিখে ফেললাম।মনজুরুল হক ভাইএর খেঁটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে লেখাগুলোয় কমেন্ট করবার পর্যন্ত সাহস হয়না আমার।আমি নিশচিৎ নসিমনদের কথাও তার অজানা নয়। তবুও লিখলাম...)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৪:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



