আমার বয়স যখন ৫/৬ বছর,আমাদের বাসার বারান্দার একটা কোনা ছিলো আমার একটা ছোট্ট জগৎ।আমার রাজ্য। কোনাটায় মাটি জড়ো করে ইট দিয়ে ঘিরে আমি তাতে লাগিয়েছিলাম একটা ছোট্ট তারা ফুল গাছ।তার পাশেই ছিলো আমার পুতুলের বাড়ীঘর। সকাল সন্ধ্যা পানি দিয়ে পুতুলবাগানে ফুলফোটানোতেই ছিলো আমার সবচাইতে মজার খেলা। সে কাজে আমার সঙ্গী ছিলো আমাদের এক বুয়া, সবার অগোচরে যার স্নেহধন্য ছিলাম আমি। এই বুয়াটাকে আমি আপু ডাকতাম। যদিও আমি যখন ৫/৬ তখন সে বড়জোর ১৭/১৮ ছিলো।
এই আপুটা গ্রামে ফেলে এসেছিলো তার ৩/৪ বছরের মেয়েকে। মাঝে মাঝে সেই মেয়েটার কথা ভেবে মেঝেতে শুয়েশুয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতো সে। আমার খুব কষ্ট হত আমি স্বপ্ন দেখতাম মেয়েটাকে এনে দেবার, ওর মায়ের কাছে। নিজের সাথে কি এক অদ্ভুত মিল পেতাম আমি তার।
যেকোনো মায়াবতী রমনীর চেহারায় আমি তার মুখের আদল খুঁজে পাই আজো। কাপড়ের পুতুলের বাক্সের পুতুলবেবিটার জন্য ছোট্ট প্লাস্টিক ক্লথ কুড়িয়ে পাওয়া, ছোট মেডিসিনের বাক্স দিয়ে আমার পুতুলদের জন্য রেফ্রিজারেটর বানিয়ে দেওয়া, বা কাঁচের লম্বা চিকন টুকরোয় দাগকাঁটা কাগজ সেটে থার্মোমিটার বানানোর খুশীগুলো শেয়ার করার সাথী, আমার সেই মায়াবতী আপুটাকে আমি আজো মিস করি । আমার সে আপুটা আজ কোথায় কেমন আছে আমি তা আর জানিনা এখন। কালের স্রোতে হারিয়ে ফেলেছি তাকে।
শিশুশ্রেনীতে পড়বার সময় স্কুলের এক টিচার আপু যাকে আমি ডাকতাম বুলি আপা বলে সেই আপুটার মধ্যেও স্নেহ মায়ামমতার এক বিশাল প্রান্তরের হদিস পেয়েছিলাম আমি।এমনিতে কঠোরমুখের এই আপুটাকে সবাই একটু সমীহ করে চললেও আমি জেনেছিলাম তার মনের অপরপ্রান্তের এক মায়াপুরীর গল্প! জানিনা কোন অজানা কারণে উনি সব সময় তার ভালোবাসার আঁচলে ঢেকে রেখেছিলেন আমাকে।
আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি শুনেছিলাম তিনি আত্নহত্যা করেছিলেন। বুলি আপার ভেতরে যে কষ্ট টা ছিলো তার আভাস আমি সেই ছোট্টবেলায় ঠিকি জানতে পেয়েছিলাম। কতদিন কত ক্ষনে হঠাৎ হঠাৎ তাকে আমার মনে পড়ে যায়!!!!
জীবনে নেই নেই করেও ভালোবাসার ঝুলিতে কম মানুষের ভালোবাসা জমা পড়লোনা। এমন স্বার্থহীন বা নিস্বার্থ ভালোবাসাগুলোর জন্যই হয়তোবা আজো পৃথিবী জেগে রয়।
এবার আসি আমার ভার্চুয়াল জগৎটিতে।
এই ব্লগ পরিবারটির কথা আগেও বলেছি তবুও বারবার বলতে ইচ্ছে করে,আসলেও এটি আমার জীবনের এক বিশাল পাওয়া। ছোট্ট সেই বারান্দার খেলার প্রিয় কোণটির মতই এক ছোট্ট প্রিয় রাজ্য।সকল কর্মক্লান্তি হেলায় হারাই আমি যখন এখানটিতে উঁকি দিয়ে যাই।
কেউ কেউ হয়তোবা এই কথাগুলিকে তৈলাক্ততার উদাহরণ হিসেবে দেখাবে। তাতে আমার কিছু বলার নেই। বিশেষ করে আমার খুব প্রিয় কিছু মানুষের কথা আমার কখনও ভোলা হবেনা। এজীবনে যেখানেই থাকি যেভাবেই থাকি তারা আমার স্মৃতিতে থাকবে সমুজ্জল।এখানে আপুনি আর ভাইয়ামনি করে করে আমি এই দুটি শব্দকে বিরক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছি সে বেশ বুঝতে পারি।
তবে এই বিরক্তিটাতে আমি কিন্তু খুবি মজাও পাই।
আমার খুব এমনি একজন প্রিয় মানুষ সুরভীছায়া। যখন ব্লগে আসি খুব প্রথমদিকে সুরভীছায়াকে দেখেছি। তাকে দেখেছি সবার লেখা পড়তে। কাঁকনমনি আর সুরভীছায়ার মত এত লেখা পড়তে আমি আর কাউকে দেখিনি। সুরভীছায়া একজন অতি আবেগী মানুষ হয়তোবা। তার হৃদয়টাকে আমার মনে হয়েছিলো কুসুম কোমল পত্রপল্লবে ছাওয়া। আমার সাথে তার মেইলে কিছু যোগাযোগ হয়েছিলো। তার মত মায়াবতী রমনী আমি সত্যি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। সুরভীছায়া আমার হৃদয়েও সুরভী ছড়িয়ে যাবে সারাটাজীবন তার ভালোবাসা দিয়ে। যদিও সুরভীছায়াকে আর এখন সামু ব্লগের জানালায় দেখা যায়না, তবে
আমার জানলার পাশে হাসনাহেনা ফুল যখন রাতে সুরভী ছড়ায় সত্যি তার কথাই আমার মনে পড়ে।
সহেলীমনি , তাকে আমার অতি কাছের , হৃদয়ের একদম কাছাকাছি থাকা একজন প্রিয় বন্ধু মনে হয়। আমার যে কোনো হাবিজাবি লেখাকেই উৎসাহ , উদ্দিপনা দেওয়ায় তার কোনো জুড়ি নেই। সহেলী , প্রিয় বন্ধুর প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে আমার হৃদয় কুঠুরে সারাটা জীবন ধরে।
আরেকজন আমার নির্ঝরিনী আপুনি। এই আপুটা আমার মাঝে খুঁজে পায় তার দেশে ফেলে যাওয়া ছোটবোনটিকে। আমিও তার মাঝেই পেয়েছি বড় বোনের মমতা। নির্ঝরিনী আপুর শিল্পীমন তার ভালোবাসায় দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
ফেরারী পাখী আপুটা যে হৃদয়ে এতখানি ভালোবাসা ধারন করেছিলো তা বুঝেছিলাম যেদিন, সেদিন চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। আমার নিজের আপন কোনো বোন নেই। সত্যি আমার যদি কোনো বড় বোন থাকতো সেকি এভাবেই ভালোবাসতো আমাকে? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
সাজি আপু। এই আপুটা যে কি রকম মায়াবতী সে মনে হয় এই ব্লগের সবাই জানে। তার কবিতা কথায় সব খানেই মায়া মায়া ছায়া। এমন একজন শুভাকাংখী, সবার জন্য এত মায়া, আর কি কোথাও পাওয়া যায়?
শ্রাবণসন্ধ্যা আপু তুমি নিজেই জানো তুমি আমার কত প্রিয়। আর আমি জানি কতখানি ভালোবাসা আর মায়ায় জড়িয়ে রেখেছো তুমি আমাকে। আমি কখনও একদম হারিয়ে যাই যদি তুমি সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাবে সে বেশ জানি আমি।
লীনা আপুনি আমার কবি আর স্পষ্টবাদী আপুনি। তাই আপু যেদিকেই যাক আমি আপুর দলে। কারণ আমি জানি কত ভালোবাসো তুমি আমাকে।
রুমমামনি আমার শিল্পী আপুনিটা আর বন্ধুও বটে। তার শিল্পপ্রতিভার গুণমুগ্ধ আমি। আর এটা তো খুবি বুঝতে পারি তার মায়া মমতা আর ভালোবাসাটা।
ভোর আপুটার মায়া মায়া মনটির দেখা যে কেউ পাবে তার বাচ্চা কাচ্চা পোস্ট পড়লেই। তার পেশা আর আমার পেশা একি হবার কারনেই নয় আমরা দুজন দু মেরুর হলেও মনে হয় তার ভালোবাসার পরশ থেকে আমি বন্চিত হতাম না।দুজন দুমেরুর বলছি কারণ আপুনিটা যেভাবে বাচ্চাদের সবরকম জ্বালাতন অকাতরে হাসিমুখে স হ্য করে আমি তা মোটেও পারিনা। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে নিজেই এমন চিৎকার জুড়ে দেই মহা দুষ্টু বাচ্চাগুলোও তাতে ভয় পেয়ে দুষ্টুমী থামিয়ে দেয়।
ভেভেবলি আপু । পিচকি এই আপুনিটার সাথে আমার মনের এতই মিল যে আমাদের একিরকম টুইন প্রফাইল পিক ছিলো।
বাবুনি সুপ্তি আমার ছোট্ট আপুনিটা। আমার কেবলি মনে হয় ওর কাছে আমার সাত খুন মাফ। আমি যাই করিনা কেনো তবু বাবুনিমনির ভালোবাসাই পেয়ে যাবো।
ত্রেয়া আপুনি তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন। তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন। এত ভালোমনের হয় কি করে মানুষ তোমাকে দেখলেই সেই প্রশ্ন জাগে মনে।
আমার মায়াবতী আপুনিরা , যেখানেই থাকো , ভালো থেকো আজীবন। আমার ছোট্ট বেলার বারান্দার প্রিয় কোনটির মত তোমাদেরকে খুঁজে পাওয়া এই প্রিয় কোনটিও চির অম্লান হয়ে রইবে আমার স্মৃতিতে আজীবন আর সাথে থাকবে তোমরা, তোমাদের মায়া মমতা ও ভালোবাসাটুকু।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




