*
কোলাহল। উচ্ছাস। আনন্দ। উৎসব। এই রাতে, এই বাড়িতে বেড়েই চলেছে সমানুপাতিক গতিতে। তরুণদের দল কেউ কেউ দল বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ আড়চোখে মেয়ে চাখছে। মেয়েরাও আজ যথেষ্ঠ উদার। রক্ষণশীল পরিবার থেকে আসা জবুথবু মেয়েটিও সস্তা রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
রসনাবিলাস। তৃপ্তির ঢেকুড়। অম্লনিরোধক ট্যাবলেট। ঝাঁঝালো পানীয়। যে যেমন পারছে খাচ্ছে। যেন কতদিন অভুক্ত ছিলো তারা! আমার তেমন ক্ষিধে পায় না। আমি সিগারেট নিয়ে কিছুক্ষণ তরুণদের দলে ধূম্র উদযাপন করি। কিন্তু জমলোনা তেমন। যদিও তারা আমার সমবয়সী, যদিও আমি ধোঁয়া ভালোবাসি, কিন্তু এ জায়গাটা তাদের গরমাগরম আলোচনা আর জ্বলন্ত সিগারেটের উত্তাপে চিমনীর মত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
উপহারের প্যাকেট। উৎসবের সামাজিক সনদ। হিসাব নিকাশ। প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধেরা এসব মিলিয়ে আভিজাত্যের জটিল বর্গমূল নির্ণয়ে ব্যস্ত। আমার হাতেও একটা উপহারের মোড়ক ছিলো। ওটা কে যেন ছো মেরে কেড়ে নিলো চিলের দক্ষতায়। চারিদিকে উন্মত্ত চিল চিৎকার শুনতে পেলাম।
আমি শিশুদের কাছে গেলাম তারা অবশ্য অন্যদের মত দল বেঁধে নেই। এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। খুব দুষ্টুমী করছে সবাই সুযোগ পেয়ে। কেউ হয়তো অসাবধানতাবশত মূল্যবান কাঁচের সামগ্রী ভেঙে ফেলে অভিভাবকদের বকুনি খেয়ে কাঁদছে। তা দেখে অন্যেরা ভীষণ আমোদ পাচ্ছে। আমার খারাপ লাগলো এরকম একজন ক্রন্দনরত শিশুকে দেখে। বছর সাতেক হবে বয়েস। আমার মায়া হল তাকে দেখে। এই উৎসবের বাড়িতে, এই উৎসবের রাত্তিরে সমবেত হওয়া সমস্ত পরিচিত অপরিচিত মানুষের কাউকেই চিনতে পারছিলামনা। কারণটা বোধ হয় আমার নিঃসঙ্গবিলাসী স্বত্বাটা অন্যদের প্রগলভতা, উন্মত্ততার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। আমার হিসেবে কাঁচা মস্তিষ্ক অন্যদের জটিল হিসেব নিকেশ বুঝতে পারেনি। তাই সবাই আমার কাছে ছিলো অপরিচিত এবং অস্বস্তিকর।
কিন্তু এই শিশুটির কান্নার রঙ থেকে কে যেন রঙতুলি দিয়ে আমার মনের ক্যানভাসে কিছু আঁকিবুকি করে দিলো। আমি তাকে চিনতে পারলাম।
"সামিন! তুমি কাঁদছ কেন?"
আমি ভেবেছিলাম সে প্রত্তুত্তরে কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করবে, কিন্তু সে এক অভাবনীয় বিপরীত আচরণ করল।
"মামা..."
বলে সে দৌড়ে এসে আমার কোল দখল করতে চাইলো।
"কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম!" মুখভরা হাসি তার।
"কাঁদছিলে কেন তুমি? দুষ্টুমি করেছিলে নিশ্চয়ই? আমি কপট শাসন করি তাকে।
"না, মামা। আমি কিচ্ছু করিনি। একটা দুষ্টুছেলে আমাকে মেরেছে"
আবারও তার চোখ ছলছল হয়ে ওঠে।
অপরিচিত হয়ে যাওয়া চেনা মানুষ আর পরিচিত চেনা মুখ ও মুখোশের ভীড়ে এই দেবশিশুর নিখাঁদ আবেগ আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি তার মন ভালো করার জন্যে কি করা যায় ভাবতে থাকি।
আমার পকেটে কোন চকলেট নেই।
আমার মানিব্যাগে কোন সুপারহিরোর স্টিকার নেই। তবে? হুম! সুপারহিরোর স্টিকার থাকতে হবে কেন? ওকেই আমি সুপারহিরো বানিয়ে দিই!
"আরে বোকা ছেলে! কেউ মারলে তুমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলে সবাই কি ভাববে বলোতো? তোমার তো অনেক শক্তি আর বুদ্ধি। যাও, কে কে দুষ্টুমী করছে তাদের নামের লিস্ট বানিয়ে আমায় এনে দাও। মনে কর যে তুমি সুপারম্যান, তোমার সাথে কেউ পারবেনা। মনে কর যে তুমি ফেলুদা, বুদ্ধিতে তুমি সব্বার ওপরে!"
আমার কথা শুনতে শুনতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
"হ্যাঁ, এখনই যাচ্ছি আমি। আমি সুপারম্যান!" সবগুলো দুষ্টু ছেলেমেয়ের লিস্ট বানিয়ে আনছি। তুমি এক মিনিট দাঁড়াও, আমি যাব আর আসবো"।
সে উৎসাহের উদ্দীপনায় ভালবেসে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে অদ্ভুত ধরনের একরকম শিশুসুলভ আনন্দধ্বনি করতে করতে দৌড় দেয়।
সে চলে যায় ছোট্ট দুষ্টুদের তালিকা করতে।
আমি ভীড়ের মধ্যে হেঁটে বেড়াই। এতক্ষণের সংকোচ এবং ইতস্তত ভাব অনেকটাই কেটে গেছে। আমি ধীরে ধীরে মিশে যাই বাকমুখরতা, উপহারসামগ্রী, চিৎকার আর নানাবিধ ঠাট্টা মস্করায়।
**
আমাকে আমার মামা পাঠিয়েছে দুষ্টু ছেলেমেয়েদের লিস্ট করতে। ক্লাশে যেরকম টিচাররা করতে দেয় আমাকে মাঝেমধ্যে। আমি ক্লাশ ক্যাপ্টেন তো, তাই। এখন অবশ্য নিজেকে ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট মনে হচ্ছে! মামাটা আসলেই খুব মজার। দারুন একটা প্রজেক্ট দিয়েছে আমাকে। আবার বলেছে লিস্টটা করে নিয়ে আসলে নাকি একটা দারুণ উপহার দেবে। সরাসরি অবশ্য দেবেনা। পরীদের নাকি বলে দিয়েছে, যখন আমি ঘুমিয়ে থাকবো, তখন মেঘের রাজ্য থেকে একটা পরী নেমে এসে চুপি চুপি একটা জাদুর বাক্স রেখে যাবে আমার বিছানার পাশে। কি মজা! যে করেই হোক, লিস্টটা বানাতেই হবে ঠিকমত। নাহলে মামা আবার ভাববে আমি কিচ্ছু পারিনা। ঐ যে দেখতে পাচ্ছি কয়েকটা দুষ্টু ছেলে মেয়েকে। ওরা খামোখা চিৎকার করছে আর দৌড়ুচ্ছে, একজন আবার একটা বেলুন ফুলিয়ে ওটা ফাটানোর উপক্রম করছে, আরেকজন একটা মেয়ের বেনী ধরে টানছে। আমি ছুটে যাই ওদের কাছে।
নাহ! ওদের সাথে দৌড়ে পেরে উঠলামনা। ওরা বড্ড বেশি সেয়ানে। আমিই বরং বোকা। দৌড়ুতে দৌড়ুতে ভুল জায়গায় চলে এসেছি...
***
এমন উৎসবের রাত্তিরে সবাই মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে। বহুমুত্র রোগে জর্জরিত প্রৌঢ় শরবতে এক চামচ চিনি বেশি খেয়ে মুখের মিষ্টিভাব দূর করার জন্যে পান চিবুতে চিবুতে তার বর্ণাঢ্য অতীত আর সমৃদ্ধ বর্তমান নিয়ে আয়েশী আলাপ জুড়ে দেয় উচ্চরক্তচাপে ভোগা সমগোত্রীয়র সাথে যে কিনা একটু আগেই দৈনিক নির্ধারিত একটি সিগারেটের জায়গায় পরপর দুটি টেনে ফেলেছে।
****
ওদের কাউকে খুঁজে পেলামনা। ধ্যাৎ! আমি মনে হয় জাদুর বাক্সটা পাবোই না। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমি কেন এত্ত ছোট্ট? আমি মোটেই কোন সুপারহিরো নই। ফেলুদার মত বুদ্ধিও নেই। কিচ্ছু হবেনা আমাকে দিয়ে। এই অন্ধকার বারান্দায় বসে থাকতে ভয়ও করছে। আমি এত্ত ভীতু কেন? তাড়াতাড়ি চলে যাই এখান থেকে। খাতা আর পেন্সিল খামোখাই বয়ে বেড়াচ্ছি। ফেলে দিই এগুলো! ফেলে দিতে গিয়ে এক কান্ড ঘটলো। কোত্থেকে একটা ধবধবে সাদা হাত এসে আমাকে একটা খুব খুব সুন্দর আর ঝলমলে হালকা একটা বাক্স দিয়ে গেল। আমি অবশ্য মোটেও ভয় পাইনি এতে। পরীটা মনে হয় আমার ওপর মায়া করে জাদুর বাক্সটা দিয়েই গেল! পরীরা এত্ত ভালো হয়! আমার মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। যদিও এর ভেতরে কিচ্ছু নেই, কিন্তু দিয়েছে এই বেশি। আমি তো কিছুই করতে পারিনি যে বাক্সভরা উপহার দিয়ে যাবে। এই খালি বাক্সটাই আমি যত্ন করে সাজিয়ে রাখবো। আর বন্ধুদের দেখাবে। অনেক অবাক হবে ওরা।
থ্যাঙ্কিউ পরী!
#
সামিন যখন বারান্দা থেকে বেড়িয়ে মেদাক্রান্ত জৌলুসে বুড়োদের নিস্প্রাণবন্ত আলাপের মাঝে ঢুকলো, তখন তার নতুন উপহার পাওয়া বাক্সের আলোকছটায় আলাপে মশগুল মানুষগুলোর বয়ে বেড়ানো রোগ এবং যাপিত জীবনের যাবতীয় সম্ভোগগুলো ধাক্কা খেলো। বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিটির ভীষণ পেচ্ছাপের বেগ পেলো।
"এই ছেলে ও জিনিসটা এখানে নিয়ে আয় তো, আর সামলাতে পারছি না।
এই বলে সে তার কাছ থেকে খালি বাক্সটা কেড়ে নিয়ে পেচ্ছাপ করতে শুরু করল। একই সময়ে একজনের হাঁপানির টান উঠলো, আরেকজনের রক্তচাপ বেড়ে গেলো। হাঁপানি রোগীটির কাছে ইনহেলার ছিলোনা, সে মুত্রদূষিত বাক্সটা নাকের কাছে নিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে লাগলো। আর তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নবীন প্রৌঢ়টি, যে এতক্ষণ ধরে চাখতে থাকা বালিকাদের কথা ভেবে সুখকল্পনায় বিভোর ছিলো, শারিরীক অক্ষমতার কারণে উত্তেজনা নিবারণ করতে না পেরে সে বাক্সের ভেতরেই বীর্যপাত করে ফেললো। এসব কর্মকান্ডে বাক্সটির ঝলমলে স্বর্গীয় রঙটা বিবর্ণ হয়ে গেলেও ওখান থেকে রঙ শুষে নিলো ঘরটি। ফলে ভারসাম্য রক্ষা হল। তারা আবার জৌলুসী জ্ঞানী উৎসবমুখর প্রৌঢ় হয়ে উঠলো। আর সামিন তার বাক্সের এরকম ধারাবাহিকভাবে আক্রান্ত হওয়াতে কেঁদে কেটে একাকার!
ঘরে একটা দেয়ালঘড়ি আর একটা ক্যালেন্ডার ছিলো।
হঠাৎ করেই ঘড়ির কাটা দ্রুত ঘুরতে শুরু করল।
হঠাৎ করেই ক্যালেন্ডারের পাতা দ্রুত উল্টোতে থাকলো।
এই গতি সামিনের মধ্যেও সঞ্চারিত হল এবং গতিজড়তার প্রভাবে সে অনিচ্ছুক দৌড়ে ঘর থেকে ছিটকে পড়ল।
##
ইতিমধ্যে আমি বেশ জমিয়ে নিয়েছি সবার সাথে। যতসব 'তুতো ভাইবোনেরা। মুরুব্বিরা। অপরিচিত ছেলেমেয়ে। সবার সাথে পরিচয় এবং পুনঃপরিচয় শেষে উৎসবের আগ্রাসনে হারিয়ে যাই। আমিও মোহগ্রস্থ হয়ে উঠি। হঠাৎ মনে পড়ল সামিনের কথা. ওকে কি যেন একটা করতে বলেছিলাম! কি যেন বলেছিলাম! ভুলেই গেছি বেমালুম। সে যাকগে...
###
ওই বুড়োগুলো আমার জাদুর বাক্স নষ্ট করেছে। এটাকে পরিস্কার করতে হবে।
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো এখনও সমানে সামনের দিকে উল্টোচ্ছে।
দেয়ালঘড়িটাও পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে।
আমিও ছুটছি। কোথায় যাচ্ছি জানিনা।
শালার কি সব বিতিকিচ্ছিরি কারবার! জীবনে প্রথমবারের মত মুখ খারাপ করলাম আমি। ভালোই তো লাগলো! আহ বেশ বেশ!
####
তরুণদের দলটাকে জমিয়ে রেখেছে এক মোটাসোটা দাপুটে চেহাড়ার যুবক। সে প্রাপ্তবয়স্কদের কৌতুক এবং মেয়েদের বিছানায় নিয়ে যাবার কৌশল বলে সবার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে অবশ্য রাজনৈতিক বিতন্ডাও হয়ে গেছে খুব এক চোট এক ফাঁকে। কেউ কেউ শিল্পের বিভিন্ন ধারা উপধারা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছিলো। তারা ছিলো নীরোগ এবং স্বাস্থ্যবান। সামিন যখন ছুটতে ছুটতে তাদের ঘরে ঢুকলো, যুবকেরা মুত্র এবং বীর্যের কটু গন্ধে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো।
"এ্যাই ছেলে, কি এনেছিস এটা হ্যাঁ? ঘরতো গন্ধ করে ফেললি!"
এতক্ষণের ছোট্ট, দুষ্টু ভীতু সামিন এখন বেশ একরোখা এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
"আমার সাথে তুই তুকারি করলে একদম লাথি দিয়ে বিচি ফাটিয়ে দিবো হারামজাদা! খুব উৎসব করে বেড়াচ্ছিস, না? আর আমি ছুটতে ছুটতে হয়রান ঐ বাঞ্চোত ক্যালেন্ডার আর দেয়ালঘড়ির দাবড়ানিতে। আমাকে উৎসব করতে শেখা। তোদের উৎসবের উপকরণগুলো সব এই বাক্সে রাখ!"
ভয় পেয়ে গেলো ওরা। একে একে জমা হতে থাকলো আমুদে প্লেবয় যুবকের পকেট থেকে পর্নো উপকরণ আর জন্ম নিরোধক। উদাস কবির হাত থেকে খসে পড়ল কলমের বদলে ভোঁতা ছুরি। সদ্য শিক্ষাজীবন শেষ করা ফিটফাট যুবকের জীবনবৃত্তান্ত। নব্য গান শেখা ছেলেটার শখের গিটার। বাক্সটা ভারি হয়ে ওঠে খুব। অবশ্য সামিন ওটা বইবার জন্যে যথেষ্ঠ শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে ইতঃমধ্যে।
#####
"শালারা উৎসব করছে খুব!" খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবে সামিন।
"আর আমি এক বোকাচোদা, কোন মামা না চাচা কে কি বলল না বলল তাতে পটে গিয়ে এখন মাদারচোৎ ক্যালেন্ডার আর দেয়ালঘড়ির দৌড়ানি খাচ্ছি! পিঠে বিশাল এক বোঝা। উফ! গুষ্টি মারি উৎসবের। গুল্লি মারি উপহারকে! রোগাক্রান্ত বৃদ্ধদের ফুর্তি আর উচ্চাকাঙ্খী, আধা শৈল্পিক, আধা গবেট তরুণদের আঁতলামো আমোদ আর কাঁহাতক সহ্য হয়!"
"আমি ভীষণ একা আর দলছুট হয়ে গেছি। কিন্তু এ দৌড় তো থামাতেই পারছিনা। শালার ক্যালেন্ডার আর দেয়ালঘড়ি!"
"খানকির ছেলে তোরা থামবি?"
দ্রুত ঘুর্নায়মান দেয়ালঘড়ি আর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে সামিন। ওর চিৎকারে হঠাৎ করে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খুনসুটি, ঠাট্টা, হিসেব নিকেশ, সব থেমে যায়।
*
সামিনের গলা শুনতে পেলাম বোধ হয়! সেই রক্ষণশীলা, অনাঘ্রাতা তরুণীর সাথে সুবাসিত আলাপচারিতায় মগ্ন ছিলাম আমি। চুমু দেয়ার জন্যে প্রায় পটিয়েও ফেলেছিলাম। সে সময় এ বিপত্তি! আমরা খুব বিব্রত হই। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
নীরবতার শূন্য পাতায় কে যেন কি লিখে চলে। আমার মনে পড়ে আমি সামিনকে একটি ছেলেমানুষি তালিকা করতে বলেছিলাম। তাকে একটা রঙচঙে প্যাড আর লাল পেন্সিল দিয়েছিলাম।
কিন্তু কোথায় সেসব! সামিন পেল্লায় একটা ছুরি দিয়ে দেয়ালে আঁচড় কেটে কেটে কি সব লিখছে। সেই তালিকা! কিন্তু এ কি! ও কাদের নাম লিখছে! ওর তো ছোট্ট দুষ্টুদের নাম লেখার কথা ছিলো। আর ও এত বড় হয়ে গেলো কখন? কিভাবে?
"কেউ থামাও ওকে!" আমি ও অন্য সবাই চিৎকার করে উঠি। সামিন আমার দিকে, হ্যাঁ বিশেষভাবে শুধু আমার দিকেই সরোষে তাকায়। ওর চোখে ঘৃনার আগুন।
"এই দ্যাখ শালা তোর তালিকা"
নামগুলো দেখে আমরা শিউরে উঠি। আমাদের পড়তেও ভয় হয়।
"কেউ আমাকে থামাতে পারবেনা।" ও তালিকাটি লিখে শেষ করে। তারপর প্রকান্ড বাক্সটা খুলে ছড়িয়ে দেয় যাবতীয় দ্রব্যাদি।
ডায়েবেটিস রোগীর পেচ্ছাপ।
লোলূপ, অক্ষম পুরুষের বীর্য।
ছড়িয়ে দেয় হাঁপানি রোগীর দূর্বল শ্বাসনালী থেকে উৎসারিত বাতাস।
আমাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
আরো যা যা সংগ্রহ করেছিলো সব ছুড়ে ফেলতে থাকে। সবকিছু ভেঙে চুড়ে যায়। সবকিছু ভেঙে পড়ে। আমাদের উৎসব শেষ হয়ে যায়। এখন সামিনকে বেশ শান্ত এবং ক্লান্ত দেখায়। সে তার প্রকান্ড হাত দিয়ে ক্যালেন্ডারের এগিয়ে যাওয়া পাতাগুলো উল্টে দেয় পেছনে, সাথে দেয়ালঘড়ির কাটাটাও।
ওকে বিদ্ধস্ত দেখায়। ওর প্রকান্ড দেহ ক্রমশঃ সংকুচিত হতে থাকে। ও আবার ভীত, মুখচোরা, ছলছলে চোখের এক দেবশিশু হয়ে যায়। ওর পাশে রাখা বাক্সটা আবার ফিরে পায় স্বর্গীয় উজ্জলতা।
**
আমরা সবাই ওর কাছে যাই। ফিসফিসিয়ে বলি, "সামিন, তালিকাটা মুছে দাও, দিই?"
কিন্তু ও ছিলো ক্লান্ত এবং ভীত। প্রবল ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়ে শেষতক।
আমাদের মধ্যে সুযোগসন্ধানী কেউ একজন ওর ঝলমলে বাক্সটা তুলে নিতে গেলে ওটা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। আমি তালিকাটার দিকে আবার তাকাই। ওখানে সবার আগে আমার নাম। তাতে কি! আমি ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে ঘুমন্ত সামিনকে কোলে তুলে নিই। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারিনা। আমার কাছ থেকে ওকে ছিনিয়ে নেয় তালিকার মধ্যে থাকা ওর মা।
"কোথায় ছিলি সোনা মানিক! জান আমার!" বুকের ভেতর জাপটে ধরে তাকে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। তালিকার অন্যতম ব্যক্তি ওর বাবাও হাত বুলিয়ে দেয় তার এলোমেলো চুলে। তার চোখও অশ্রূশিক্ত।
***
আমরা, কালো তালিকাভুক্তরা, এবং অন্যেরা ওকে আদর করি একে একে। জানি, সেও হয়তোবা একদিন কোনো ছোট্টো দুষ্টুর তৈরী করা কালো তালিকায় থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে ঘুমন্ত সামিনের কেঁপে কেঁপে ওঠা স্বপ্নালু চোখ এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য।
ঘড়ির কাটাটা থেমে থাকে। থামিয়ে দেয় কেউ একজন। থাকুক!
আমি ওর কপালে আরেকটা চুমু দিই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:৫৮