somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অভ্যাগত সরিসৃপেরা

০২ রা মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চলতি মাসের বেতন পাওয়ার পর খলিল একটা দুঃসাহসী কাজ করে ফেললো। ব্যাপারটাকে আদতে দুঃসাহসী বলা যায় না হয়তো, তবে খলিলের সাহস বরাবরই কম, সে অর্থে দুঃসাহসী বলা যেতেই পারে। কাজটা করার পর প্রথমদিকে একটু ইতস্তত বোধ করলেও পরবর্তীতে ট্যাবু ভাঙার আনন্দে তার ভীতি এবং সংকোচ উবে যায়। কাগজে মোড়ানো লালচে পানীয়ের বোতলটা ব্যাগে রাখার পর সে পানশালায় জমায়েত মানুষদের দিকে সসংকোচে তাকিয়েছিলো। এই বুঝি মুরুব্বীগোছের কেউ তার কাঁধে হাত রেখে কানটা মুচড়ে দিয়ে তিরস্কার করে! মদ খেলে নাকি চল্লিশ দিনের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। ইবাদত-বন্দেগীতে অবশ্য তার খুব একটা মন নেই। তারপরেও শৈশবের শৃঙ্খল আর শাসন ভাঙা খলিলের মতো ফ্যাকাশে চামড়ার, আত্মবিশ্বাসের অভাবে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটা যুবকের জন্যে একটু বেশিই ছিলো। তার সাথে থাকা বন্ধুটি, যে নাকি চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুকেই বলে দিতে পারে কোনটা কোন ব্র‌্যান্ডের মদ, সে মদ্যপান পরবর্তী সুখময় অবস্থার কথা, জাগতিক যন্ত্রণা আর বেদনা থেকে অব্যাহতি লাভের কথা রসিয়ে রসিয়ে বললে খলিলের সংকোচ অনেকটাই কেটে যায়। অবশ্য ব্যাপারটা এমন না যে খলিল খুব যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছে। যে চাকুরিটা করে তা দিয়ে তার মোটামুটি ভালোই চলে যায়। দেশে টাকা পাঠাতে হয় না। বাবা-মা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেঁচে আছেন এখনও বহাল তবিয়তে। একমাত্র বড় বোনটারও ভালো বিয়ে হয়েছে। প্রেমিকা সংক্রান্ত কোন দহন বা আক্ষেপ নেই। তারপরেও বন্ধুর কথায় প্ররোচিত হয়ে সে সপ্তাহান্তের জন্যে এক রাতের বিলাসিতা করেই ফেলবে ঠিক করলো। আধা বোতল ব্র্যান্ডি, কী বা হবে এতে! আধা বোতল মানে ৩৭৫ মিলিলিটার। তবে জসিমের মতে, এটা হেসেই উড়িয়ে দেবার মতো ব্যাপার। সে নাকি এক লিটার হান্ড্রেড পাইপারস নিমিষেই গিলতে পারে। এ কথার পর খলিলের আরো কোন দ্বিধা রইলো না। মদ্যপানের ইচ্ছার চেয়ে সেও যে একজন শক্ত পুরুষ মানুষ সেটা প্রমাণের জন্যেই সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। যাবার সময় জসিমের হাত ধরে শক্ত একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার শক্তি কার্যক্রমের উদ্বোধন করলো।

রাত এগারোটার সময় ৩৭৫ মিলিলিটারের বোতলটাকে কোমল পানীয় দিয়ে ৫০০ মিলিতে পরিণত করলো সে। জসিমের পরামর্শ অনুযায়ী, কোন কিছু না মিশিয়ে খেলে লিভারেরও ক্ষতি, বমি করে ভাসিয়ে নেশারও দূর্গতি হবার সম্ভাবনা। আধা বোতল খাওয়ার পর তার একটু মাথা ঝিমঝিম করলো বটে, তবে সে যেমনটা শুনেছে জসিমের কাছে তেমন কিছুই হলো না। কোথায় সে আনন্দরথ? কোথায় পলকা শরীরে আকাশ উড্ডয়ন? নিজেকে প্রবল পুরুষ ভাবতে ভাবতে সে চুমুকের পর চুমুক দিতে লাগলো দ্রুতগতিতে। নেশা হয়নি তাতে কী হয়েছে, আধা বোতল ব্র‌্যান্ডিতে যে তার কিছুই হয় না এটাকেই বড় অর্জন ভেবে নিয়ে সে শেষ চুমুক দিয়ে ঘুমুতে গেলো।

সকালে উঠে বাথরুমে যাবার সময় সে খেয়াল করলো, শরীরে তেমন বল পাচ্ছে না। ব্যথায় মাথাটা ছিড়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। আচ্ছা, এটাকেই তাহলে হ্যাংওভার বলে। ও কিছু না, আরো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে কড়া করে এক কাপ চা খেয়ে নিলেই হবে। তবে প্রস্রাবের বেগ চেপেছে প্রচন্ড। বাথরুমে একবার না গেলেই না! এ কী! বাথরুমের ছিটকিনিটা ভাঙা কেন? গতরাতে সে এমন কিছু করেছে বলে মনে করতে পারে না। অবশ্য বাইরের ছিটকিনি থাকা বা না থাকা একই কথা। দরজাটা চাপিয়ে রাখলে বেশ এঁটে যায়। জলত্যাগ করে এসে ঘুমুতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো, লেপ-তোষক কেমন যেন ভেজা ভেজা। তাতে প্রস্রাবের কটূ গন্ধ। গতকাল রাতে বোতল শেষ করবার পর অনেকক্ষণ ধরে উবু হয়ে বসেছিলো বিছানার ওপরে এটুকু তার মনে আছে। তার মানে কী...ধ্যাৎ! কোথা থেকে কী হলো! আধা বোতল ব্র‌্যান্ডি খেয়েই সে দরজা ভেঙেছে, বিছানায় মুত্রত্যাগ করেছে, শেষতক আর শক্ত পুরুষ থাকা হলো না তার। সে সরোষে মেঝেতে তোবড়ানো বোতলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। বোতলটার ওপর এমন নির্যাতন চালালো কখন! ব্যাপার বিশেষ সুবিধার ঠেকছে না। নির্ঘাৎ ব্ল্যাকআউট হয়েছিলো তার। তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে কললিস্ট চেক করতে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। নাহ, গতকাল রাতে সে কাউকে ফোন করে নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারো ঘুমুতে যায় খলিল মুত্রগন্ধময় লেপ জড়িয়ে নিয়ে।

দুপুরে ঘুম থেকে উঠে কিছুটা ধাতস্থ হলো খলিল। নিজের দূর্বলতাকে মেনে নিয়ে কঠিন প্রতিজ্ঞা করলো, আর জীবনে মদ স্পর্শ করবে না। ব্র‌্যান্ডির বোতলটা ফেলে দিয়ে আসলো ময়লার স্তূপে। এখন মিস্ত্রী ডেকে বাথরুমের দরজাটা ঠিক করাতে হবে। লেপের কভার পাল্টিয়ে রোদে শুকোতে দিতে হবে নিজেকেই। শীতকাল এখনও বাকি আছে অনেকখানি। মুত্রগন্ধময় লেপ আর তোষক শীতের ওমশোষক হিসেবে কাজ করবে। বিরক্তির সাথে কভারটা খুলে লেপটা ছাদে শুকোতে দিয়ে আসলো সে।

বিকেলের দিকে পাড়ার চায়ের দোকানে দেখা হয়ে গেলো জসিমের সাথে। জসিম গতকাল রাতে এক লিটার ভদকা পান করেছে। তাকে দেখে অবশ্য বুঝবার জো নেই। দিব্যি খোশমেজাজে ভোঁসভোঁস করে সিগারেট টেনে গতকাল রাতের অভিজ্ঞতা বয়ান করছে। খলিলকে দেখে তার জোশ বেড়ে গেলো।
-আরে কী খবর খলিইল্যা! কালকে রাতে কেমন টানলি। চেহারা দেইখাতো মনে হইতাছে তুই মদ খাস নাই, মদই তোরে খাইছে হাহাহা!
খুনসুটিপ্রিয় বন্ধুবর্গ সোৎসাহে যোগ দিল এই হাস্যকর্মে। তখন সাঁঝ ঘনিয়ে আসছে। লেপটা ছাদ থেকে তুলে নিয়ে আসতে হবে। তাই খলিলের সেখানে বেশি সময় ব্যয় করার অবকাশ ছিলো না। সে পাংশু মুখ করে এক কাপ চা খেয়ে চলে এলো সেখান থেকে।
-আরে যাস কই! মদ তোরে কেমনে খাইলো কইয়া যা! কোনদিক দিয়া খাইলো? হালায় ফুটতাসে! কইলাম মদ খাইস না, সবাইরে দিয়া সবকিছু হয় না। আবালটা কথা শুনলে তো!

যদিও জসিমের পীড়িাপীড়িতেই সে মদ্যপান করেছে, তারপরেও তার এহেন উপদেশমূলক মিথ্যাচারে সে বাগড়া না দিয়েই ছুটলো। এবং সবাইকে আরো একবার বিপুল আমোদিত করে হড়হড়িয়ে বমি করলো।


লেপের কভার খোলা সহজ, তবে সেটায় আবার লেপটাকে সাঁটানো বেজায় কঠিন কাজ। এই কোণা ঠিক থাকে তো ওই কোণায় একগুচ্ছ তুলো জমে থাকে, সেই কোণা ঠিক থাকলো তো অন্য কোণায় লেপজট। মহা বিতিকিচ্ছিরি এক ব্যাপার। বাহির থেকে ঠাসাঠাসি করে এ কার্য সমাধা করা দুরূহ, তাই খলিল লেপের কভার উঁচু করে তার ভেতরে মাথা গলিয়ে লেপের প্রান্তগুলো ঠিক করার চেষ্টা শুরু করলো। এটাও কম ঝঞ্ঝার না! লেপের কভারের ভেতর মাথা প্রবিষ্ট করে তার এক ভৌতিক অনুভূতি হলো। মনে হতে লাগলো যে এটা একটা বিশাল অজগরের হা, এবং সে ক্রমশই সেখানে ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ানক এক অনুভূতি। একলা থাকার এই এক জ্বালা, যখন তখন অদ্ভুতুরে ভয় ঘিরে ধরে। তবে আজকে যেমনটা হচ্ছে তা অন্যদিনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রভাববিস্তারী। সাপ ভারী ভয় পায় খলিল। সত্যি সত্যি যদি একটা অজগর সাপ তাকে গিলতে চেষ্টা করে এভাবে! বেদম ভয়ে লেপের কভার থেকে মাথা এবং হাত বের করলো সে। নাহ, কিচ্ছু হয় নি। নিজেকে বোঝালো। হ্যাঁ, হতে পারে তার ঘরটা এলোমেলো এবং নোংরা, এতে বড়জোর এডিস মশা বা বড় কেঁচো বাসা বাঁধতে পারে। অজগর সাপের তো প্রশ্নই ওঠে না। ওসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে অবশেষে সে লেপটা ঠিকঠাক মতো কভারের ভেতর ঢোকাতে পারলো। বেশ পরিশ্রম গেছে তার। শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। হাতে ব্যথা। তবে আজকে ঘুমটা হবে জম্পেশ। এখনই হাই উঠছে।

রাতে খেয়ে বিছানায় যাবার সাথে সাথেই তার চোখে ঘুমের পিপীলিকাদের আনাগোনা করার কথা। কিন্তু একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে তার ঘুম আসছে না কোনভাবেই। ঘুমের পিঁপড়াদের কুড়মুড় করে খেয়ে নিচ্ছে পিঁপড়াখাদক প্রাণী। কোলবালিশটাকে মনে হচ্ছে জীবন্ত। নড়ছে ওটা। বেডসুইচটা অন করার সাহস হচ্ছে না। কী না কী দেখে! কোলবালিশটা ক্রমশ তার গা ঘেঁসে আসছে। শীতল স্পর্শে শিউরে উঠলো খলিল। লুকোনোর জায়গা দরকার। লুকোনোর জায়গা দরকার একটা! কিন্তু কোথায় লুকোবে সে? ভয়ে তার স্বাভাবিক চিন্তাচেতনা লোপ পেলো। সে লেপের কভারটা খুলে সেখানেই সেঁধোনোর চেষ্টা করলো। যদিও সে ছোটখাট, পলকা অবয়বের মানুষ, কিন্তু তাই বলে তার পুরো শরীরটাই লেপের কভারের ভেতর ঢুকে যাবে তা তো হয় না! সেই অসম্ভব ব্যাপারটাই ঘটলো। লেপের কভারের ভেতর প্রস্রাবের বিকট দুর্গন্ধ। সেই সাথে একটা ভেজা ভেজা স্পর্শ। লেপটা কি ঠিকমতো রোদে দেয়া হয় নি? লোভাতুর চেরা জিভ দিয়ে কে যেন তার শরীর চেটে দেয়। খলিল চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে, এসব কিছুই হচ্ছে না, এসবই এ্যালকোহলের প্রভাব অথবা তার শারিরীক দূর্বলতা। তাতে বিশেষ লাভ হয় না কিছু। হঠাৎ করে লেপ অথবা অজগর সাপটা তাকে উগড়ে দেয় ঘরের সুইচবোর্ডের কাছে। কে যেন হিসহিসিয়ে বলছে, জ্বালো আলো জ্বালো! খলিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাইটের সুইচে হাত দিলো, এবং দেখলো লেপটার কভারের নকশা পাল্টে গেছে। তাতে অগজর সাপের পৃষ্ঠদেশের কারুকাজ। লেপের জমিন ধরে একটা শীতল প্রাণ এধার থেকে ওধার ছুটছে যেন। খুব আস্তে ওটা নড়ছে, সম্মোহনী চোখে তাকাচ্ছে খলিলের দিকে। লেপসর্পের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই খলিলের সমস্ত ভয় কেটে গেলো। হঠাৎ করেই তার অজগরটাকে বড় দুঃখী এবং তার মতই একাকী মনে হলো। বেচারা অজগরটা! আর কোথাও জায়গা না পেয়ে তার লেপের কভারের ভেতর জায়গা করে নিয়ে সেটাকে আত্মীকরণ করে ফেলেছে! এখন ঐ বস্তুটাকে লেপ নাকি অজগর কোনটা বলবে তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেলো খলিল। লেপসর্প নামটা বেশ! লেপসর্প তাকে আহবান করছে কাছে আসার জন্যে। এখানকার পরিবেশের সাথে সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে এতক্ষণে। এখন আর অস্বস্তিকর শীতল ভেজা ভাবটা নেই। উপরন্তু তার থেকে ওম বিকিরিত হচ্ছে। খলিলের ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। সে লেপসর্পের ভেতর ঢুকে পড়লো।

রবিবার। সকাল আটটা। কাজে যেতে হবে। আগের রাতে ঘুমটা ভীষণ ভালো হয়েছে তার। লেপসর্পের সাথে ঘুমে-স্বপ্নে-তন্দ্রায় কথা হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। এটাকে অবশ্য ঠিক কথোপকথন বলা যায় না। সাপ তো আর কথা বলতে পারে না! তার মৃদু হিসহিস আর খলিলের নাক ডাকার ঐকতানে রচিত হয়েছে তাদের নতুন সম্পর্কের প্রথম অধ্যায়। তারা জানে, একে অপরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা জেনে গেছে, ভয়াল সরিসৃপ আর ছাপোষা মানুষের সামঞ্জস্য। তারা এখন একে অপরের আশ্রয়।

অন্যদিনের চেয়ে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো খলিল। বেচারা লেপসর্প একা একা কীভাবে আছে না আছে, কে জানে! জসিম অবশ্য অন্যদিনের মতোই তাকে আড্ডার আহবান জানিয়েছিলো। সে কোনমতে কাটিয়ে চলে এসেছে।

"তারপর লেপসর্প! কী খবর তোমার? কোথা থেকে উদয় হয়েছো, কেন আমার এখানেই আশ্রয় গড়েছো এসব জিজ্ঞেস করে তোমাকে বিব্রত করবো না। তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিলো ভীষণ। এই যে একা থাকা, এই যে একঘেয়ে চাকুরি, এই যে পলকা দেহ, এই যে খিস্তিবাজ স্বাস্থ্যবান বন্ধুরা, এদের ভীড়ে নিজেকে অনাহুত মনে হয়। সেদিন জসিমের কথামতো মদ কিনে ভালোই হয়েছে। মদ খেয়ে ব্ল্যাকআউট হয়ে বিছানা ভেজালাম, তারপর লেপের কাভার পাল্টাতে গিয়ে সেই অজগরনুভূতি। প্রথমদিকে খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো! পাওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তারপর রাতে শোবার সময়...উফ আর মনে করতে চাই না। খুব চমকে দিয়েছিলে সেবার। তবে লেপের ওপর নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে দারুণ একটা কাজ করেছো বটে! কী সুন্দর নকশাদার তোমার চামড়া! শীতঘুমের মৌসুমটা এখানেই কাটিয়ে দাও। খাবার দাবার যথেষ্ট আছে তো পেটে! ব্যাস!"

শীত বেড়ে চলেছে ক্রমশ। এত শীত এই নগরে আর কোনদিন পড়ে নি। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে দু প্রস্থ জামা কাপড় শরীরে চাপিয়েও যখন শীত কমলো না, খলিল সিদ্ধান্ত নিলো লেপসর্পকে গায়ে দিয়েই অফিসে যাবে। হঠাৎ করে দেখে ভারী সুন্দর কাজ করা একটা চাদর মনে হতে পারে। বেশ তো! ফ্যাশনও রক্ষা হবে, আবার শীত থেকেও নিষ্কৃতি মিলবে। তবে লেপসর্পের এই প্রস্তাব মোটেও মনঃপুত হলো না। সে শরীর কিলবিলিয়ে, হিসহিসিয়ে, বিকটা হা করে প্রতিবাদ জানাতে লাগলো।

"বলি তোমার সমস্যাটা কী! মানুষ ভয় পাও? আরে ওখানে কে বসে আছে তোমাকে কাটার জন্যে! মানুষেরই বরং তোমাকে ভয় পাওয়া উচিত। কী বললে? ব্যাপারটা ভয়ঘটিত না? একা থাকতে চাও? তাও না? তাহলে কী! লজ্জা লাগে? রাখো তোমার লজ্জা!" গজগজ করতে করতে খলিল লেপসর্পটিকে শরীরে চাপিয়ে রওনা হয়।

এরকম অদ্ভুত এবং ভয়ানক পোষাক পরে অফিসে যাত্রা করার পেছনে শুধুমাত্র শীত নিবারণই তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো না। সে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায়, অজগর সাপকে স্কন্ধে নিয়ে পুরুষোত্তম হতে পেরেছে। জসিমকে আজ দেখিয়ে দেবে কার কত শ্যাটার জোর! এহ! এক লিটার মদ খেতে পারে বলে খুব অহমিকা দেখায় ছোকড়াটা। আজকে আমিও দেখাবো তোমায় বাছাধন! আমার লেপসর্প তোমাকে, তোমাদেরকে, যাবতীয় টিপ্পনিকে এক গ্রাসে খেয়ে ফেলবে। তখন দেখা যাবে কে কেমন পুরুষ।

অফিসে ঢোকার মুখে যথারীতি তাকে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। এর জন্যে অবশ্য সে প্রস্তুতই ছিলো। তবে তার ভাবনার সাথে উদ্ভূত পরিস্থিতির বেজায় ফাড়াক। সে ভেবেছিলো সবাই শশব্যস্ত হয়ে তার পথ ছেড়ে দেবে, আতঙ্কে ছুটোছুটি করবে তেমন কিছুই হলো না। বরং সবাই তাকে দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। যথারীতি ফাজলামো করে বসলো জসিম,
"কি দোস্ত, জামদানী শাড়ি কিনা দিছে কেডা? তোমার বয়ফ্রেন্ড নাকি? যাই কউ, জিনিসটা ভালা হইছে। তোমারে মানাইছে হেব্বি"।
ব্যাপারটা যে ফাজলামোর পর্যায়ে যাবে খলিল ভাবতেও পারে নি। পারবেই বা কী করে, বাহিরে আসার সাথে সাথে লেপসর্প কুঁকড়ে মুকড়ে সংকুচিত হয়ে, মাথা এবং জিহবা ভেতরে লুকিয়ে রেখে কখন যে একটা বাহারী চাদরের আকৃতি ধারণ করেছে, তা সে বুঝতেই পারে নি। সুতরাং খলিলের সারাদিনটা কাটলো সহকর্মীদের টিটকারি, মিচকে হাসি আর কথার ছুরিতে আহত হয়ে বাসায় গিয়ে লেপসর্পকে খুব এক হাত দেখে নেবার পরিকল্পনা করতে করতে। বাসায় ফেরার পথে জসিম তার পথ আটকালো।
-জামদানি দোস্ত, হবে নাকি আইজকা?
-কী হবে?
-আরে আজকে সপ্তাহের শেষদিন। একটু মৌজমাস্তি না করলে কি চলে! চলো এক বোতল ব্র‌্যান্ডি নিয়া বসি।
-নাহ, টাকা নাই হাতে।
-আরে টাকা নিবা আমার কাছ থিকা। ধারও না, গিফ্ট দিমু তোমারে যাও। সেইদিন আসলে ব্র‌্যান্ডি খায়া তোমার যুৎ হয় নাই। ব্র‌্যান্ড চেঞ্জ করা লাগবো। হুইস্কি খাও আইজকা।
যদিও মদ্যপানের জন্যে কোনরকম তাড়না সে অনুভব করছিলো না, তারপরেও সে এক বোতল হুইস্কি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে সে মাতাল হয়ে লেপসর্পের আজকের আচরণের জন্যে শাস্তি দিতে পারে। কোন কথা না বলে সে গটগট করে পানশালার উদ্দেশ্যে রওনা হলো, এবং পুরো এক বোতল হুইস্কি নিয়ে ঘরে ফিরলো।


হুইস্কি জিনিসটা ভালোই। ব্র‌্যান্ডির চেয়ে হালকা। খেলে পরে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, সবাইকে ক্ষমা করে দিতে মন চায়। তবে তাই বলে লেপসর্পটাকে সে আজকের আচরণের জন্যে ক্ষমা করতে পারবে না। ভীতু হারামীটার জন্যে তাকে আজ সারাদিন "জামদানী দোস্ত" শুনতে হয়েছে। নামটা মনে হয় পার্মানেন্ট হয়ে যাবে!

"কী হে সর্প! সেদিন আমার মাতলামির সুযোগে হুট করে এসে গিয়েছিলে, ভয় দেখিয়েছিলে, আবার নির্ভরতার আশ্বাসও দিয়েছিলে। কিন্তু শেষমেষ হলো কী! আমি একটা লাফিং স্টক হলাম সবার কাছে। এখন তো খুব তড়পাচ্ছো, তখন সবাইকে একটু ভয় দেখিয়ে দিলে কী হতো! সবাই আমাকে কতো তোয়াজ করতো! সেদিন আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে লেপ-তোষকের ওপর প্রস্রাব করেছিলাম, আজ সেটা সানন্দে, নিজ ইচ্ছাতেই করবো। "

রেগেমেগে প্যান্টের জিপার খুলে সে দেখে সেখানে তার শিশ্নের বদলে একটা অজগরের বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। লেপসর্প তার বাচ্চাকে কাছে নেয়ার জন্যে লেপ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে তেড়ে আসছে। খলিল হুইস্কির বোতলটার দিকে তাকালো। অর্ধেকের অর্ধেকও শেষ হয় নি, সুতরাং নেশার ঘোরে এসবকিছু দেখার প্রশ্নই ওঠে না। শিশ্নের জায়গায় অজগর! খারাপ না জিনিসটা। অজগরটা তাকে একটা ভালো জিনিস উপহার দিয়েছে! খলিল অজগরটাকে মাফ করে দিলো। কিন্তু অজগরটা আজ ক্ষেপে আছে কোন কারণে। তার চোখে চোখ রেখে খলিল পড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো সর্পকথা,

"ভয়, প্রয়োজনীয়। ভয় পেতে থাকো। ভয় পাও আমাকে। কিন্তু কাউকে সে ভয়ের কথা বলো না। সবারই আছে নিজের ব্যক্তিগত ভয়। তাকে শ্রদ্ধা করো। আমাকে শ্রদ্ধা করো। মানুষ ভয়শীল। মানুষ ভঙ্গুর। মানুষ বিকৃত। বেঁচে থাকতে হলে আমাকে পাশবালিস না ভেবে যকৃৎ ভাবো। পোষা ভয়ঙ্কর প্রাণী ভেবে গর্বিত না হয়ে আতঙ্কিত হও। মানুষ, বিশেষ করে একা মানুষ ধ্বংসবাদী। ধ্বংসের পথে যতো তুমি অগ্রসর হবে তত পাশে পাবে হিংস্র সহচর, আমার মতো। তাকে তুমি ভয় পাবে, সে তোমার দুঃস্বপ্নের দোসর হবে, একসাথে মরণপাত্রে চুমুক দিবে, তোমাকে শক্তিশালী ভাবাবে, কিন্তু জাগতিক কোন কাজে তোমার সহায় হবে না। অন্যের কাছে হাসির পাত্র হয়েই থাকবে। যার যার ভয়াস্ত্র তার তার আঁধারসহায়।"


সকালে ঘুম থেকে উঠে খলিল খেয়াল করে, সে আবারও বিছানা ভিজিয়েছে মদ খেয়ে। লেপটা নেড়ে দিতে হবে রোদ্দুরে। প্যান্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তার অজগরশিশ্নটা চেপে ধরে সে দেখে তা কুঁচকে মুচকে এক লজ্জাজনক খর্বাকৃতি ধারণ করে আছে। অজগর সাপে কোন বিষ নেই, সে ভাবে। তার দরকার কোবরা, কিং কোবরা! যা ফণা তুলবে, ছোবল দেবে।

পরের সপ্তাহে বেতনের প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করে সে দুই বোতল বিদেশী মদ কেনে।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:২৯
৭২টি মন্তব্য ৭২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×