somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দয়া করে বৃহস্পতিবারে মরুন

২৭ শে জুন, ২০১৪ ভোর ৪:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দৃষ্টি আকর্ষণ
এতদ্বারা সবার অবগতির জন্যে জানানো যাচ্ছে যে আপনার শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক বৈকল্য, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা, পুরোনো রোগের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, কিংবা অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু, যাই আসুক না কেন, বৃহস্পতিবারের আগে আপ্যায়ন করা যাবে না। এটা সকল হোস্টেল, বসতবাড়ি এবং মেসের জন্যে প্রযোজ্য হবে। আর আপনি যদি একান্তই অসমর্থ হোন সামলাতে, তাহলে এর দ্বারা উদ্ভুত অনাকাঙ্খিত অসহযোগিতার দরুণ সৃষ্ট দুর্বিপাকের জন্যে কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করা যাবে না। নিম্নে কিছু বিশেষ নিয়মাবলী বর্ণিত হলো, যা আপনাকে এ প্রজ্ঞাপনটি অনুসরণ করতে সাহায্য করবে।
১/ আত্মহত্যা করতে চাইলে শক্ত নাইলনের রশি দিয়ে ফাঁস নিন। এতে মৃত্যু তরান্বিত হবে, ঝুঁকিবিহীন একটি প্রক্রিয়া। বিষপান করবেন না। স্টোমাক ওয়াশের হ্যাপা রয়েছে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বেন না। আপনার আশেপাশের পরিবেশ সুন্দর রাখুন। বিষপান বা ঘুমের বড়ি সেবনে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে গ্রেপ্তার করা হবে।
২/ প্রেসার হাই হয়ে গেলে অহেতুক কাউকে ডাকাডাকি করবেন না। মাথায় জলপট্টি দিয়ে শুয়ে থাকুন। এমনিতেই কমে যাবে। তবে বৃহস্পতিবার হলে যদি প্রেসার ১৬০/১০০ এর মতো অনুভব করেন, তাহলে অন্যান্যদের ডাকতে পারেন। অন্য দিনগুলিতে স্ট্রোক করার আগ পর্যন্ত শুয়ে থাকুন।
৩/ হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে হার্টের রোগ ভেবে কাবু না হয়ে গ্যাসের ট্যাবলেট খান। ভালো হয় সিরাপ পান করলে। অনেকসময় গ্যাসের চাপ হার্টএ্যাটাকের মতো দেখায়। আর এতেও যদি সমাধান না হয় তবে বৃহস্পতিবারের জন্যে অপেক্ষা করুন।

অন্যান্য সব আচমকা প্রাণঘাতী রোগের ক্ষেত্রেও এমন পন্থা অবলম্বন করুন।

কেন এই বৃহস্পতিবার?
কারণ এর পরে দুটো ছুটির দিন আছে। ফলে আপনি অসুস্থ হলে বা মারা গেলে আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবার/রুমমেট শোকের ধকল কাটিয়ে নেবার সময় পাবেন, অথবা হাসপাতালে সারারাত ছোটাছুটি করতে হলে তারা পরের দুইদিন বিশ্রাম নিয়ে সতেজ হয়ে কর্মস্থলে যোগদান করতে পারবেন। এভাবে আপনার মৃত্যু বা অসুস্থতা বৃহস্পতিবারে সংঘটিত হবার ফলে রবিবার থেকে সবাই শোক এবং ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে কর্মস্থলে যোগ দিয়ে সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে বড় ধরণের কোন গড়মিল দেখা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হতে পারে।

-আদেশক্রমে নগর কর্তৃপক্ষ।

সারা শহর ছেয়ে গেছে এই নির্দেশিকায়। শহরের মানুষজন এই অদ্ভুত দীর্ঘ পোস্টার দেখে চমকে গেলেও কর্মজীবী মানুষেরা ধাতস্থ হয়ে ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে এতে নগর কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞাই দেখতে পান। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দৈন্যের কথা চিন্তা করলে এটি চমৎকার একটা সুপারিশ। আর নগরায়নের সাথে সাথে সাম্পর্কিক বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকার ফলে পরস্পরের প্রতি যে সামাজিক অনাস্থা তৈরি হয়েছে তার উপশমের জন্যে বৃহস্পতিবারকে মরণ বা অসুস্থতা দিবস হিসেবে পালন করলে সামাজিক দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠা থাকবে না, উপরন্তু পারস্পরিক সম্পর্কটা ঝালাই করে নেবার একটা ভালো উপলক্ষ্য হতে পারে সেটা। অবশ্য বেকার এবং অকর্মণ্য মানুষেরা, মূলত বৃদ্ধেরা এই বিজ্ঞপ্তি দেখে ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করলেন। তারা এক ঝটিকা মিছিল করে মৃতবন্ত শ্লোগান দিয়ে এক সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে তাদের উদ্যোক্তা বলেন,
"কেন শুধু বৃহস্পতিবারকে প্রাধান্য দেয়া হবে? আমরা অথর্ব বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষ। পরকালের ডাক শুনতে পাচ্ছি। আমরা বুড়ো বয়সে প্রচুর এবাদত করে পর্যাপ্ত পরিমাণ সোয়াব কামিয়েছি, এখন সুবিধেমত ওপারে গিয়ে অপ্সরা আর সুরার হিসেব বুঝে নিলেই হয়। তো আমরা যেকোন দিন অসুস্থ বা মৃত হতে পারি, এতে কর্মঘন্টায় কি রদবদল হলো বা কে বিশ্রাম পেলো না, কে শোকাভিভূত হলো, এসব ভেবে দেখার সময় আমাদের নেই। সারাজীবন তো কষ্ট করেছি, মৃত্যুটাও কি পছন্দমত দিনে হবে না?"
বক্তৃতার এ পর্যায়ে তিনি থেমে গিয়ে যথাযথ আবেগ প্রকাশ করলে সবার প্রবল হাততালি উপহার পান। তার বক্তব্য শেষে মঞ্চে অধিষ্টিত হন বেকার সমাজের একজন প্রতিনিধি। বৃদ্ধের করুণ থরোথরো ভাষণের পর তার তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ শুনে সবাই নড়েচড়ে বসে।
"আমরা আপনাদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে এখানে এসেছি। আমরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ নই, তবে হতাশার পেষণে ক্লান্ত। আমাদের তেমন কোন অসুখ বিসুখ নেই, তবে আত্মহত্যাপ্রবনতা আছে। উল্লেখিত প্রজ্ঞাপনে ঝঞ্ঝাট কমানোর জন্যে নাইলনের রশি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকেরই এই পন্থাটা পছন্দ নয়। আমাদের বিশাল একটি অংশ হতাশা ভুলবার জন্যে ঘুমের বড়ি সেবন করে। এতে নেশা এবং ঘুম দুই'ই হয়। আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে আমরা এটাকেই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে মেনে নিয়েছি। এটা ব্যথাহীন এবং নরম মৃত্যুর নিশ্চয়তা দেয়। অনেকসময় ব্যর্থ হতেই পারি আমরা, কিন্তু সেক্ষেত্রে স্টোমাক ওয়াশকে ঝামেলা এবং কর্মঘন্টা থেকে বিয়োজন ধরে নিয়ে জরিমানা করাটা কোনমতেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা এর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।"

প্রবল করতালি শেষে তারা যখন সমাজের দন্ডমুন্ডের নির্বাহী আদেশের প্রতিবাদে বড় একটা জমায়েত করার সন্তুষ্টিতে কিছুটা জিরিয়ে নেবে ভাবছে, ঠিক তখনই বেরসিক, নিষ্ঠুর পুলিসের দল এসে তাদের ঠেঙিয়ে উচ্ছেদ করে ফেললো।

নগরবাসী, যারা এতক্ষণ দ্বিধার মধ্যে ছিলো, তারাও প্রশাসনের এই কঠোর অবস্থান দেখে নিশ্চিত হয়ে গেলো যে বৃহস্পতিবারের ব্যাপারটা কোন কৌতুক নয়।

ব্যাপারটা কৌতুক তো নয়ই, এটা সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনাবলী এবং প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে সবচেয়ে উচ্চস্থানে থাকবে সেটা ঠাহর করা গেলো কিছু ঘটনা ঘটার পর।

ছেলেটি একা থাকে। তার মা সমুদ্রসমান ভালোবাসা নিয়ে পড়ে আছে দূরের সবুজ এক গ্রামে। সবুজ গ্রাম। কোমল মাটি। উড়োংধনু ফড়িং। মিঠে মেঠোপথ। সেখানে কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই। সাতদিন কাজ করার বালাইও নেই। তারা এখনও শহরের দিন মেপে একে অপরকে সহযোগিতা করার বা মরার নতুন প্রকল্প সম্বন্ধে জানে না। সেই মেঠোভুলোটিয়ে গ্রাম থেকে ছেলেটা কর্ম সংস্থানের জন্যে শহরে চলে এলো। কংক্রিট অরণ্যে রোপিত হলো আরো একটি শেকড়। অনেক গভীরে। শেকড় প্রতিস্থাপনের এই জটিল প্রক্রিয়ায় মানিয়ে নিতে না পেরে সে মানসিক বৈকল্য এবং শারীরিক অসুস্থতার সম্মুখীন হলো। শহরে নতুন হওয়ায় সে সাম্প্রতিক আলোচিত প্রজ্ঞাপনটি ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। তাই সপ্তাহের মধ্যিখানে যখন তার পেট নেমে গেলো, বার পনেরো বাথরুমে গিয়ে সে নেতিয়ে পড়লো, তখন তার ভয় হলো ভীষণ। সে কাতরস্বরে তার রুমমেটকে অনুরোধ করতে লাগলো তাকে হাসপাতালে নেবার জন্যে। রুমমেট ঝানু শহরবাজ। সে গ্রাম্য বালকটিকে এক পলক নিরীখ করে কড়া স্বরে সুধোলো,
-আজকে কী বার?
-জ্বী মঙ্গলবার।
-তাহলে আজকে তুমি কি মনে করে অসুস্থ হলে? আর হলেই যদি, তবে সেটা প্রকাশ করে সাহায্য চাইলে কেন? দিনকাল খুব খারাপ ভাইডি, চারিদিকে চর। কেউ যদি এখন পুলিসে খবর দিয়ে বলে যে, এই মেসের একজন পেট খারাপ হবার কারণে সপ্তাহের মাঝামাঝিতে রাত দশটার সময় হাসপাতালে যাবার জন্যে পীড়াপিড়ী করছে, তাহলে জরিমানাটা কি আমি দেবো?
অবুঝ গ্রাম্য বালক পেটের মোচড় ভুলে গিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকলো। পরমুহূর্তেই বমি করে ঘর ভাসানোর পর সে আবারও তার অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে তার কক্ষ প্রতিবেশী বাধ্য হয়ে পুলিসে খবর দেয় এই গর্হিত আইনবিরোধী কাজটি করার জন্যে। তাকে দুইশত টাকা জরিমানা করা হয়, আর একরাত জেলযাপন। তার কক্ষ প্রতিবেশী সুচারূভাবে নাগরিক দায়িত্ব পালন করে আরামের একটা ঘুম দিয়ে পরদিন ঝরঝরে শরীরে অফিসে যায়।

এভাবেই গ্রাম্য বালক, আত্মহত্যাপ্রবণ কিশোরী, এবং শয্যাশায়ী বৃদ্ধেরা জেল জরিমানার সম্মুখীন হলে পরে তাদের আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে। এই প্রকল্পটি সাফল্যের পথে এগিয়ে যায় এবং বৃহস্পতিবারে মৃত্যু এবং অসুস্থতার হার বাড়তে থাকে।

এই চক্রের মধ্যে পড়ে আমি পুষে রাখি পৈটিক গোলযোগ, আর কাশি এবং গ্যাসের সমস্যা। আমি তেত্রিশ বছর বয়সের তাগড়া জোয়ান। আমার তেমন অসুখবিসুখ নেই। সারা সপ্তাহ কাজ করি আর সাপ্তাহিক ছুটির দুইদিন ঘুমাই। তাই বৃহস্পতিবারের বায়নাক্কা নিয়ে আমাকে আপাতত চিন্তিত না হলেও চলবে। আর থাকিও পরিবারের সাথে। স্ত্রী, বাবা, মা, ভাই। তাই কোন গোলযোগ হলে "বিশ্বস্ত সূত্রের ভিত্তিতে" আমাকে ধরে নিয়ে যাবে এমন সম্ভাবনাও নেই। সেই আমার একদিন বৃহস্পতিবার রাতে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করলো সম্ভবত হাই ব্লাড প্রেসার। দরদর করে ঘামতে লাগলাম, আর মাথাটা মনে হচ্ছিলো কেউ একজন চেপে ধরে বসে আছে। চোখ বন্ধ করলেই মাথায় একটা চক্কড় লাগে। বাসায় প্রেসার মাপার যন্ত্র আছে। মেপে দেখা গেলো ১৪০/৯০। কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর কমবে কী, আরো বেড়ে দাঁড়ালো ১৫০/৯৫! হাসপাতালে মনে হয় যেতেই হচ্ছে! অসুস্থ হবার জন্যে চমৎকার একটি দিন। বৃহস্পতিবার। আমার স্ত্রী এবং বাবার অফিস নেই কাল। হাসপাতালে নেবার দরকার হলে ছুটোছুটি করতে কোনই দ্বিধা হবে না তাদের। আবার প্রেসার মাপলাম, ১৫০/১০০। বাসার সবাই বলতে লাগলো হাসপাতালে নেয়া দরকার। আমি এই শারীরিক বিপর্যয়ের মধ্যেও একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম। মেসবাড়ি বা হোস্টেলে যেখানে ১৬০/১০০ প্রেসার না ওঠা পর্যন্ত অন্যদের ডাকা নিষেধ, আর আমি এবং আমার পরিবার ১৫০/১০০ রক্তচাপ নিয়েই হাসপাতালে যাবার বিলাসী চিন্তা করতে পারছি। পরিবারের সাথে থাকার সুবিধেটাই আসলে অন্যরকম। আর তাছাড়া আমার নিজেরও অনেক কাজ জমে ছিলো অফিসে। বুধবার বা মঙ্গলবার হলে বিপাকে পড়ে যেতাম। বাসার কাউকে না বলে হয়তো বা চুপ করে শুয়ে ঘামতাম। এই, প্রেসারটা মাপো তো আরেকবার,
১৪০/৯০
এইতো কমে আসছে। তবে বাড়লেও ক্ষতি ছিলো না। আজ বৃহস্পতিবার। হাসপাতাল বা কবরে যাবার জন্যে উৎকৃষ্ট একটা দিন।

সেই গ্রাম্য ছেলেটি, যে পেটের দুর্দিনে পেটের দুর্বিপাকে পড়ে জরিমানা গুনেছিলো, সেও ইদানিং শহরের হালচাল শিখে গেছে খুব। পেটব্যথা হলে এখন আর সে কাউকে ডাকে না। চুপিসারে মায়ের কথা মনে করে এক গেলাস স্যালাইন খেয়ে নেয়। সে শিখে গেছে শহরের বিচ্ছিন্ন এবং হঠাৎ জেগে ওঠা সামাজিকতা। যে ছেলেটি গ্রামে থাকতে তার পোষা বাছুরের অসুস্থতার জন্যে পশু চিকিৎসকের বাড়িতে যেতো দুবেলা, সে তার আশেপাশের মানুষের অসুস্থতা দেখলে ভ্রু কুঁচকে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দিন দেখে নেয়। হ্যাঁ, ছেলেটা এখন শহুরে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছে, শরীরটা পোক্ত হয়েছে বেশ, আর চাকুরীও পেয়ে গেছে একটা কর্পোরেট হাউজে। সে এখন আর সবুজ ঘাসের মালা গলায় হাওয়ার মুকুট মাথায় বেঁধে আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে মুরুব্বীদের শরীরের হাল হকিকত জানতে চায় না। এই শহর যাকে একবার নেয়, তার খোলনলচে পাল্টে দেয় পুরোপুরি।

...তারপরেও কেউ কেউ থাকে না, যাবতীয় নিয়ম আর শেকলের বিরুদ্ধতাবাদী, শহরবিমুখ, সবুজআকুল মেঠোমনের মিঠে মানুষ? ঐ যে, ফুটপাতের আবর্জনার সাথে বাস করা ক্ষুধার্ত শিশুটিকে অম্লানবদনে কোলে তুলে নিয়ে খাবার গুঁজে দেয় হাতে? তারা এসব মানতে চায় না। না চাইলে হবে কী, তাদেরও তো রোগবালাই আছে, এবং শহরের নিয়মানুযায়ী বৃহস্পতিবারের আগে অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুবরণ করা যাবে না, শরীর না মানলে তারা কি স্পর্ধার সাথে রোববার রাতে মেসের মানুষজনকে ডেকে অনুকম্পা চায় জেল জরিমানার ভয় না করেই?

হ্যাঁ,

-ভাই, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। ছোটবেলা থেকে আমার হার্টের সমস্যা, কিছু একটা করেন!
সে অনুরোধ জানায় মেসবাসীকে। সবাই তার সাহস দেখে অবাক হয়ে যায়! সপ্তাহের সূচনাদিনে এমন করে কেউ বলতে পারে? মানুষের কি কাজকাম নেই? ঘুম নেই? বিশ্রাম নেই? ছেলেটির যে হার্টের ব্যারাম আছে তা কমবেশি সবাই জানে। একদম মরমর অবস্থা হলে অন্য কথা, কিন্তু সামান্য বুকব্যথার জন্যে কে এত ছুটোছুটি করতে যাবে? অসুস্থ হবার জন্যে বড় খারাপ একটা দিন। এখন যদি কেউ পুলিসে খবর দেয়, তাহলেই হয়েছে! মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হবে। সাথে হাজতবাস তো রয়েছেই! ছেলেটি আবারও অনুনয় করে, এবার বেশ তেজের সাথে
-ভাই, এসব বৃহস্পতিবারের অমানবিক নিয়মকানুন আপনারা কেনো মানছেন? এই আইনটা কি আপনাদের সভ্যতা পরিপন্থী মনে হয় না? আমরা মানুষ, কেউ স্বার্থপর, কেউ উদার, কেউ সুস্থ, কেউ অসুস্থ, এই ভিন্নতাই তো আমাদের সৌন্দর্য। এভাবেই তো আমরা পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবো, মানবতাকে ঋদ্ধ করবো। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, আমি সয়ে যেতে পারবো, বৃহস্পতিবারের জন্যে অপেক্ষা করতে পারবো। কিন্তু এ আমার প্রতিবাদ, অমানবিক আইনের বিরুদ্ধে। আসুন আপনারা, আমাকে হাসপাতালে নিন, সারারাত আমার পেছনে ব্যয় করুন, একটা দিন না হয় রাতে ঘুমুলেন না, কী এমন ক্ষতি হবে তাতে?
দেশের আইনের প্রতি এরকম খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। পুলিস ডাকার কথাও ভুলে গেছে সবাই। তবে গোলমাল শুনতে পেয়ে পুলিস উপযাচক হয়ে এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো।

আইনভঙ্গ, নৈরাজ্যসৃষ্টি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার কারণে তার এক মাসের জেল হয়ে গেলো। সাথে দুই হাজার টাকা জরিমানা। অনাদায়ে আরো পনেরো দিনের জেল।

মা,
আমি ওদের এসব নিয়মকানুন মানতে চাইনি। মানুষের এই যে একে অপরের প্রতি সহানুভূতির অভাব, স্বার্থাণ্বেষণে অবিরত ছুটে চলা, মেপে মেপে কথা বলা, কড়া গুনে আবেগ প্রকাশ, এমন তো তুমি আমাকে শিখাও নি। তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে পাখিপ্রকরণ, মেঘনামচা, আকাশচুরি। তুমি না আমাকে শিখিয়েছিলে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ? মনে আছে তোমার? সেই যে আপা যখন মেডিক্যাল ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো, আমি রাস্তা থেকে একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। রক্ত দরকার ছিলো তার। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হবার মতো সামর্থ্য তার ছিলো না। আমরা তার জন্যে ক্যানুলা, সিরিঞ্জ এসব কিনে ঘরেই রক্ত দিলাম। সেটা কী অপরাধ ছিলো মা? বলো! ধুর, তুমি তো কোনো কথাই বলতে পারো না। কেন তুমি হারিয়ে গেলে কথা না বলার দেশে? এখন এখানে আমাদের নিয়ম করে বাঁচতে হয়, দিন মেপে অসুস্থ হতে হয়, অসময়ে মৃত্যুও এখানে অসম্মানের ব্যাপার। আমি আর এসব নিতে পারছি না মা। আমিও তোমার কাছে যাবো। জেলখানার ত্রিশ দিনে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। ওরা আমার সাথে কেমন আচরণ করেছে তা বলে তোমার মন খারাপ করিয়ে দিতে চাই না। আমি চলে যাচ্ছি। ১২০টা ডরমিকাম ট্যাবলেট কিনেছি। আমার ফাঁসি নেবার সাহস নেই। আজ বৃহস্পতিবার। ওদেরই জয় হোক। আমার খুব আপন কিছু মানুষজন এখানেও আছে। লাশ সৎকার এবং শোকযাপনের জন্যে দুটো দিন তো ওরা পাচ্ছেই! তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।

এটুকু লিখে কী মনে করে যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো ছেলেটা। ট্যাবলেটগুলো ফেলে দিলো জানালা দিয়ে। চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলো প্রাচীন সবুজের দিকে। যেখানে তার নাড়ী পোঁতা। মৃত্যুর জন্যে ভালো দিন বাছাই করার ঔদ্ধত্য সে দেখাতে চায় না। সে যাবে সেই পাখিদের নিবাসে, যেখানে বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিটা দিনই ভালো। যাবার পথে দেয়াল থেকে একটা সেই দিবসীয় পোস্টার ছিড়ে নিলো। এটা দিয়ে কাগজের নৌকো বানিয়ে ঝিলের জলে ভাসানো যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৪ রাত ১০:৪১
৬৮টি মন্তব্য ৬৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×