দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিলো আমার। কিন্তু হঠাৎ করেই মরে গেলাম। মরে যাওয়াটা একদম আকস্মিক। ভাবতেও পারি নি সুস্থ দেহের তরতাজা মনের এই আমি এত তাড়াতাড়ি মৃত্যুবরণ করবো। ঘটনার প্রথম ধাক্কাতে আমি খুব ভেঙে পড়ি। কারো সান্ত্বনাতেই কোন কাজ হয় না। এক দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণকাল আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। মরে যাবার দুঃখটা ভুলতে আমি শিবরামের হাসির বই এবং জিম ক্যারির কিছু কমেডি সিনেমা কিনে নিয়ে আসলাম। কিন্তু বন্ধুবান্ধব আর স্বজনদের ক্রমাগত শোকবার্তামূলক ফোন আর ই মেইল পেতে পেতে বই আর সিনেমা দেখে মৃত্যুজনিত বিহবলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা বিফলেই গেলো। যেমন এই মুহূর্তে ফোন করেছে আমার ঘনিষ্টতম বন্ধু আসিফ। নাহ, ফোনটা বন্ধ করেই রাখতে হবে দেখছি। মানুষের কোন কমনসেন্স নেই! বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলেও কথাবার্তায় তা প্রকাশ হতে দেই না।
-হ্যালো!
-হ্যালো শিহাব, তুই নাকি মারা গেছিস?
-হ্যা দোস্ত। হঠাৎ করেই মরে গেলাম।
-কীভাবে মরলি?
-সেটা এখনো নিশ্চিত না। অনেক কারণেই হতে পারে। ভাবছি। ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না।
-ভেরি স্যাড। তুই আমার সাথে দেখা করতে পারবি আজকে?
-কেন?
-এই যে মরে গেলি হঠাৎ করে, তার কারণ অনুসন্ধান করবো দুজনে মিলে।
আমি ওর নির্দয়তায় মর্মাহত হলাম। একজন মৃত মানুষকে নিয়ে এত কিসের টানা হেঁচড়া! আমি ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে ভাবতে বসি। কিজন্যে মারা গেছি তার জন্যে আসিফের সাথে বসে গবেষণা করার কোন মানে হয় না। শরীরটা ভীষণ অবসন্ন। কেন মারা গেলাম? কোন অপরাধে? সেই মফস্বলী মেয়েটা, যার সাথে দুই বছর প্রেমের অভিনয় করে সপ্তাহখানেক আগে ব্রেক-আপ করে ফেলেছি তার অভিশাপে? নাকি সেই রিকশাওলাটার, যে দুইটাকা বেশি চেয়েছিলো বলে তাকে থাপ্পড় মেরেছিলাম তার অভিযোগে? এই দুটো কি খুব বড় অন্যায়, যার জন্যে মৃত্যু অবধারিত?
যেদিন মারা গেলাম সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি। ভালো মানুষ, অফিসে কাজ করছিলাম। একটা বিশাল ট্রান্সলেশনের কাজ গছিয়ে দেয়া হয়েছিলো আমাকে। দ্রুতহাতে টাইপ করতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম আমার হাত কাজ করছে না। একদম থেমে আছে। জলের গেলাশটা ঠিকই ধরতে পারছি, ঢকঢক করে পানিও খেলাম সেখান থেকে, কিন্তু অফিসের কোন কাজ করতে গেলেই স্থবির হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। গলা শুকিয়ে শিরীষ কাগজ, হাত দুটোয় যেন একশ কেজি ওজন ভর করেছে। একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে এ্যাপ্লাই করার জন্যে সিভি প্রস্তুত করেছিলাম। সেটি আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে হেসে জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেলো। আর তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে এটাই মৃত্যু। মুখ ম্লান করে বসের কাছে গেলাম। খবরটা শুনে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেই ভয় করছে। মৃত্যু ব্যাপারটা সবসময়ই ব্যথাতুর, কিন্তু তিনি কি আর সেসব বুঝবেন? তার দরকার হলো কাজ। এই বিশাল সওদাগরী অফিসে থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু। কাঁচুমাচু মুখ করে তার রুমে ঢুকলাম।
-স্যার, আমি মারা গেছি।
এনে সুধালেন,
-দুঃখজনক ব্যাপার। কখন মারা গেলেন?
-এই তো কিছুক্ষণ আগে। ওভারিয়ান টিউমারের প্রবন্ধটা অনুবাদ করার সময়।
-তা কী কারণে মারা গেলেন বুঝতে পেরেছেন কিছু?
-হয়তো বা, তবে স্যার ব্যাপারটা পারসোনাল। আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম না।
-পার্সোনাল ব্যাপারের গুষ্টি মারি!
এবার স্বরুপে ফিরলেন তিনি। আমি এই ভয়ই করছিলাম!
-আপনারা অফিসের কাজ বাদ দিয়ে যা তা করে বেড়াবেন, আর কাজের মধ্যিখানে জরুরী অবস্থায় তেলতেলে মুখ করে এসে বলবেন যে “স্যার মারা গেছি” ফাইজলামি পেয়েছেন নাকি?
-যা হবার তা তো হয়েই গেছে। একটু যদি কনসিডার করতেন, হয়তো বা দ্রুতই অভিশাপ কেটে যাবে, আমি বেঁচে উঠবো। আমাকে পনের দিনের ছুটি দিন স্যার, এর মধ্যে দেখেন ঠিকই সামলে নেবো, স্যার!
-আপনাকে এক সপ্তাহের ছুটি দিলাম। এর মধ্যে অভিশাপ কাটিয়ে পুনর্জ্জীবিত হয়ে আসতে পারলে আসবেন নইলে ইউ আর স্যাকড। এখন যান তো... আপনার গা দিয়ে বোঁটকা গন্ধ বেরুচ্ছে, উহ হু!
ভগ্ন মনে অফিস থেকে বের হলাম আমি। বাসে উঠে আবার ঝামেলা লাগলো কন্ডাক্টরের সাথে। সে আমার কাছে পুরো ভাড়াই চাচ্ছে, কিন্তু আমি হাফ ভাড়ার বেশি দেবো না। মৃতদের জন্যে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু বাসমালিকেরা এখনো সেই পুরোনো নিয়মেই চলছে। এমন বিশৃঙ্খলা যেই দেশে, তার হবেটা কী! অগত্যা আমাকে পুরো ভাড়াই দিতে হলো। আমি গজগজ করতে করতে জানালার পাশের সিটে বসে আমার দ্বারা সংঘটিত সাম্প্রতিক পাপাচারের কথা ভাবতে লাগলাম। মফস্বলের মেয়েটা? নাকি বুড়ো রিকশাওলাটা?
মেয়েটা খুব কাঁদছিলো। আমাকে হৃদয়হীন বলে ভর্ৎসনা করছিলো। আমি এরকম আরো কত মেয়ের সর্বনাশ করেছি জানতে চাইছিলো। বড্ড সেকেলে তার কথাবার্তা। এই যুগে কেউ সতীত্ব বছরের পর বছর আগলে রেখে বাসর রাতে অপরিচিত কোন পুরুষকে বিলিয়ে দেয়ার মত অনগ্রসর চিন্তা করতে পারে? আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। কতজন এর চেয়ে ঢের বেশি সময় ধরে কত কত মেয়েকে প্রতারিত করছে, তাদের বেলায় কিছু হয় না, আর আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে গেল মৃত্যুর কারণ? অবশ্য মৃত্যু ব্যাপারটাই এরকম। বলে কয়ে আসে না। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। এইসব অতি সংবেদনশীল মানুষের সাথে মেলামেশা করাটা বিপদজনক। কখন কে হৃদয়ে আঘাত পেয়ে বসে, আর আমাদের মতো আধুনিক মননের এই যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সত্যিকারের মানুষেরা ঈশ্বরের দরবারে হৃদয়হীন বলে আখ্যায়িত হয়ে মৃত্যুবরণ করে!
সেই বুড়ো রিকশাওলাটা, যাকে আমি চড় মেরেছিলাম, যার চোখ থেকে সবুজ অশ্রূ নির্গত হচ্ছিলো, সেই নোংরা লোকটার আর্জি কেন যে আমার মত ধোপদূরস্ত, ব্যস্ত, উন্নত প্রজাতির মানুষের সাময়িক রূঢ়তার সাথে জিতে গেলো, কিচ্ছু ভেবে পাই না। ঈশ্বর ইদানিং বড় বেশি খামখেয়ালী হয়ে গেছেন।
যাই হোক, এসব নিয়ে ভেবে আর কী হবে! সামনে অনেক কাজ। দাফন-কাফনের ব্যাপার আছে। একটা মিলাদ দিলে ভালো হয়। তারপর আবার চল্লিশার আয়োজন করা। আমি একলা মানুষ, সব আমাকেই করতে হবে। মিলাদে কোন আইটেমটা দিলে ভালো হয়? এই গরমে তেহারি বা কাচ্চি না দেয়াই ভালো। জিলিপি, খেজুড়, আর একটা করে আপেল-যথেষ্ট। পরিচিতজনদের খবর দিতে হবে।
-হ্যালো, মা? একটা খারাপ খবর আছে, মন শক্ত করো।
-কী হয়েছে বাবা?
ওপাশ থেকে মা’র উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
-আমি মারা গেছি।
-কী বলিস! কেমন করে? কবে? কীভাবে?
-এইতো আজ দুপুরেই, কাজ করতে করতে হঠাৎ মারা গেলাম। বাবাকে এখনই কিছু বলো না যেন! তিনি অসুস্থ মানুষ...আর শোন, কালকে বিকালে বাদ আছর একটা মিলাদের আয়োজন করেছি। চলে এসো তোমরা।
মা কোন কথার উত্তর দেন না। ওপাশ থেকে বিলাপ করে কাঁদেন। “আমার এত ভালো ছেলেটা! ও কারো সাথে অন্যায় করতেই পারে না। কে যে তাকে অভিশাপ দিলো! কোন সে নিষ্ঠুর লোক। তার ওপর গজব পড়ুক!”
এসব শুনতে শুনতে আমার মনও সিক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। যা হয়েছে তাকে মেনে নিতেই হবে। আমি ফোন রেখে দিয়ে অন্যান্যদের মিলাদে আসার আমন্ত্রন জানাতে থাকলাম। মাইকিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে। এরপর কুলখানি, চল্লিশা...মরে গিয়েও হাঁফ ছাড়ার জো নেই। মিলাদে বাবা-মা আসেন নি। আমার মৃত্যুসংবাদ শুনে তারা এতই কাতর হয়ে পড়েছেন যে ধাঁই ধাঁই করে প্রেসার বেড়ে গেছে দুজনের। এখন তাদের কোন ক্ষতি না হলেই হয়! মিলাদ শেষ হবার পরে সবাই এসে মলিন মুখে শোক প্রকাশ করতে লাগলো। শোক প্রকাশের মাঝে অবশ্য পেট পুরে মালঞ্চের সুস্বাদু খিচুড়ি খাবার তুষ্টি অনেকেই গোপন করতে পারছিলো না। অনেকেই অবশ্য মিছে আশা দিচ্ছিলো এই বলে, আধুনিক আধ্যাত্মবাদ অনেক উন্নত হয়েছে, ঠিকমতো ধ্যাণ এবং প্রার্থনা করতে পারলে আবার জীবিত হওয়া যাবে। শুনে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেই ভাগ্য খুব কম জনেরই হয়। একবার হৃদয়হীনতার দায়ে দোষী হয়ে অভিশাপের খপ্পরে পড়লে আত্মাশূচি করাটা বড্ড কঠিন। ঈশ্বরের এই নতুন হেঁয়ালী সাথে খাপ খাইয়ে চলাটা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। সরলা মফস্বঃলী কিশোরী, বুড়ো হাড় জিরজিরে রিক্সাচালক, ভীড়ের যেকোন একজন মানুষ, ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখি, পদতলে পিষ্ট হওয়া দোমড়ানো ঘাসফুল, কখন কার অভিযোগে মৃত্যুযোগ হয় কেউ বলতে পারে না। আর তাই সঠিক কারণটি ভেবে বুঝে বের করে আত্মশূদ্ধির চেষ্টায় রত হওয়াটা খুব কঠিন।
-কী এত ভাবছিস তখন থেকে?
আমার কাঁধে হাত রেখে আসিফ জিজ্ঞেস করলো।
-ভাবছি, কী অপরাধে এমন হলো।
-আরে বাদ দে ওসব ভাবাভাবি। কবর কোথায় হবে ঠিক করেছিস?
-মীরপুর বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে গিয়ে কথা বলতে হবে।
-যা করার তাড়াতাড়ি কর ভাই! বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবুও না বলে পারছি না, তোর গা দিয়ে বিকট বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে।
-আচ্ছা চল দাফন কাফনের যোগাড়যন্ত্র করি।
মৃত্যু সংক্রান্ত ব্যবসায় নিয়োজিত বেশিরভাগ দোকানের নামই একরকম। শেষ বিদায় বা আলবিদা এরকম। আমরা শেষ বিদায় স্টোরে গিয়ে কাফনের কাপড় এবং খাঁটিয়া কিনলাম। সাথে কিছু আগড়বাতি আর গোলাপজল।
-মূর্দা কে? সঙ্গে আনছেন?
-জ্বী আমি।
-একদম ফার্স্টক্লাস খাঁটিয়া আর কাপড় সদাই করছেন। কবর খোড়ার লোকও চাইলে আমাদের এখান থিকা নিতে পারেন। মার্কেট প্রাইসের চেয়ে কম দামে রাখবো।
ঝানু ব্যবসাদার দোকানীর সাথে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। তবে দামাদামির সুযোগ পেলে আসিফ ছাড়ে না।
-আরে ভাই, বেচারা জীবনে প্রথমবারের মতো মারা গেলো, ওর মানসিক অবস্থাটা বিবেচনা করবেন না? আরো তো মরবে, আপনাদের সার্ভিস ভালো পাইলে এখানেই আসবো বারবার। একটু কনসিডার করেন না!
-নারে ভাই, ব্যবসা বানিজ্য ভালা না। আর আমাদের গোরখোদক স্পেশাল প্রশিক্ষণ পাওয়া। তারে এর চেয়ে কম দামে পাইবেন না।
বাদানুবাদ শেষ হলে পরে আমাকে খাঁটিয়ায় শুইয়ে দেয়া হয়। কাফনের কাপড়ের শুভ্রতায় যেন মেরু অঞ্চলের শীত হামলে পড়ছে। শোক সঙ্গীতের ধর্মীয় সংস্করণ এই শবযাত্রাকে আরো ভৌতিক আর গম্ভীর করে তুলেছে। মহাগ্রন্থ থেকে উৎসারিত মন্ত্রে জীবনতন্ত্রের বিদায়ী সুর।
আমি ভাবছি, ভেবেই চলেছি... কী অপরাধে এমন হলো? আমি চড়ুই ছানাদের আদর করি নি বলে? ঘাসফুল মাড়িয়ে গিয়েছিলাম বলে? আমি হৃদয় ভেঙেছি সরলা কিশোরীর, আমি পিতার বয়েসী রিকশাঅলাকে প্রহার করেছি, আমি গোপনে পাশের বাসার মেয়েটির স্নান দেখেছি, আমি সুন্দরবনের প্রাচীন বৃক্ষের গায়ে মূত্রত্যাগ করেছি, আমি...
মনে পড়েছে... বুঝতে পেরেছি... কেন এমন হলো আমি বুঝতে পেরেছি! এখন কিছুদিন ধরে অনুশোচনা আর প্রার্থনায় সময় কাটালেই আবার জীবিত হয়ে উঠবো। কিন্তু ওরা আমাকে কবরে শুইয়ে দিয়েছে। আমার শরীরে মাটি পড়ছে ঝুরঝুর করে। আমি ওদেরকে থামাতে চাই, কিন্তু পারি না। আমি ডুবে যাচ্ছি, গেঁথে যাচ্ছি আরো গভীরে, আমার চিন্তাশক্তি হ্রাস্ব পাচ্ছে, ঘোলাটে হয়ে আসছে সবকিছু। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, চিন্তা করতে পারছি না কিছু। একটু আগে যেন কী ভেবে প্রায়শ্চিত্তের বুনিয়াদ গড়তে গিয়েছিলাম? মনে পড়ছে না, কিছুতেই মনে পড়ছে না। থাক, আর মনে করে কাজ নেই। কালকে সকালে উঠে পরিস্কার হয়ে অফিসে যেতে হবে। হৃদয়ের ঈশ্বরের অনেক বায়নাক্কা দেখলাম ধৈর্য্য ধরে। সে বড়ই অভিমানী। তার অভিমান কাটতে সময় লাগবে অনেক। ততক্ষণ বরং সওদাগর ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করি নিজেকে, এটাই সুবিবেচনার কাজ হবে!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:২২