somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফারজানা মোবিনের অনুবাদে প্যাট্রিক লিঞ্চিওনির বহুল আলোচিত বই "দ্যা ফাইভ ডিসফাংশনস অফ আ টিম, আ লিডারশিপ ফ্যাবল"

১১ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পাঠক, শিরোনামটা কি খটোমটো লাগছে? নিশ্চয়ই ভাবছেন প্রথাগত "কী করিলে কী হইবে" জাতীয় কর্পোরেট টেক্সটবুক , যার পাতায় পাতায় নানারকম তথ্য এবং তত্ত্ব সন্নিবেশিত, যেগুলোর মানে বুঝতেই গলদঘর্ম হতে হয়, আত্মস্থ করা তো দূরের কথা! কোম্পানির সিইও বা চেয়ারম্যান জাতীয় কর্মকর্তারা তাদের চৌকস এক্সিকিউটিভদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে গম্ভীর মুখে এই বইয়ের পাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করেন, যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই, এমনটাই ভাবা স্বাভাবিক। কারণ এমনটাই হয়ে আসছে, এমনটাই হওয়া দস্তুর! সুখের বিষয়, কেউ কেউ চেষ্টা করেন প্রথাসিদ্ধ নিয়ম ভাঙতে। গতানুগতিক এবং অনুমেয় শৃঙ্খলের নিগড় ভেঙে একই সাথে হয়ে ওঠেন সর্বজনীন এবং অনুসরণীয়। প্যাট্রিক লিঞ্চিওনি সেরকমই একজন লেখক এবং মানুষ। ভদ্রলোক বিখ্যাত কর্পোরেট কোম্পানি টেবল গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। এছাড়া কি নোট স্পিকার হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। বেশ কিছু বেস্টসেলার বই উপহার দিয়েছেন, যার সবগুলোই মূলত কর্পোরেট বিজনেস এবং টিম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে লেখা। তবে যদি বলা হয় শুধুমাত্র একটি পরিচয়ে তাকে বিশেষিত করতে, তাহলে আমরা তাকে আলোচ্য বইয়ের লেখক হিসেবেই সম্বোধন করবো।

কী আছে বইটিতে? কেন এটি বিশেষ কিছু? অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, বইটিতে কর্পোরেট টিমগুলোর পারফরম্যান্সের উন্নতিকল্পে, এড়িয়ে চলতে হবে এমন পাঁচটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পাঁচটি বিষয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং যেকোন একটির উপস্থিতি সায়ানাইডের মতই বিষাক্ত। ধ্বংস করে দিতে পারে পুরো টিমের মোটিভেশন এবং এফিসিয়েন্সিকে। আপনি যতই গুচ্ছের টাকা খরচ করে দেশের সেরা এবং দক্ষ এক্সিকিউটিভদের নিয়োগ দেন না কেন, দল হিসেবে কাজ করতে না পারলে আপনার প্রতিষ্ঠান মার খেতে থাকবে। বিলীন হয়ে যাবে। এই পাঁচটি ক্ষতিকারক অভ্যাস হলো,
১। বিশ্বাসের অভাব
২। দ্বন্দ্বের ভয়
৩। কমিটমেন্টের অভাব
৪। জবাবদিহিতার অভাব
এবং,
৫। লক্ষ্যভ্রষ্টতা
দল হিসেবে কাজ করতে গেলে এগুলোর মুখোমুখি হতেই হবে। এতে ভড়কে না গিয়ে কীভাবে এই বিচ্যুতিগুলোকে অপসারণ করে একটি দুর্দান্ত দল গঠন করা যায় তারই রোমাঞ্চকর এক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে বইটিতে।
তাহলে আমরা আলোচনায় চলে যাই...ওহ আচ্ছা আপনার কনফিউশনটা ঠাহর করতে পারছি। ভাবছেন "হাউ টু ডু" জাতীয় কর্পোরেট পুস্তকে রোমাঞ্চকর কাহিনী আসবে কোথা থেকে! এ কারণেই তো বইটি এত স্পেশাল! আপনাদের আর রহস্যের মধ্যে না রেখে বিষয়টি তাহলে খুলেই বলা যাক!

ডিসিশনটেক নামক কোনো কোম্পানির নাম শুনেছেন? ঐ যে সানফ্রান্সিকোর সেই হাই প্রোফাইল কোম্পানিটা, যারা বছর দুয়েক আগে পয়সায়-প্রতিপত্তিতে ছিলো সবার চেয়ে ওপরে, উচ্চমানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমাগমে সেরা হবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো সিলিকন ভ্যালির আত্মাটা বুকে ধারণ করে...মনে পড়ছে না? আচ্ছা, আপনাকে আরেকটু হিন্টস দেই, জেফ শ্যানলি যার সিইও ছিলো বছর দুয়েক আগে...স্যরি আমারই ভুল হচ্ছে। এদের কথা তো আপনার জানার কোন কারণই নেই। কারণ তাদের বাস্তব কোন অস্তিত্বই নেই! ডিসিশনটেক, জেফ শ্যানলি এবং তার দলের সদস্যরা, সবাই কল্পিত চরিত্র। আসলে কী করবো বলুন, বইটিতে এত প্রাঞ্জল, বিশদ, এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে ডুবতে থাকা একটি প্রতিষ্ঠান এবং তার কর্মীদের আচরণ, দ্বন্দ্ব, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে, যে পাঠকমাত্রই প্রভাবিত হবেন, পড়তে গিয়ে তাদের খুঁজে বের করতে গুগলিং করবেন। হ্যাঁ, ফিকশন এবং নন-ফিকশনের এমন অভিনব ফিউশন আপনি হয়তো বা খুব কমই পড়েছেন। তাই যে ইউনিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাবেন সেটা আপনাকে আবিষ্ট করে রাখবে বলাই বাহুল্য। তো যা বলছিলাম...

ডিসিশনটেক এর আবির্ভাব ঘটেছিলো অতি উচ্চাভিলাষী এক লক্ষ্য নিয়ে। তারা চেয়েছিলো সবার সেরা হতে। এজন্যে গ্রাউন্ডওয়ার্ক যা করার করেছিলো। বিস্তর টাকা ঢেলেছিলো। নিয়োগ দিয়েছিলো বাঘা বাঘা সব এক্সিকিউটিভদের। সুতরাং, তাদের সাফল্য ছিলো অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আদতে তা হয় নি। দুই বছরের মাথায় তাদের শেয়ার এর দাম কমতে লাগলো, টেন্ডারগুলো হাতছাড়া হতে শুরু করলো, কোম্পানির ভালো পদগুলো খালি হতে লাগলো, এমন কী ইনভেস্টররাও মুখ ফিরিয়ে নিলো। কেন এমন হলো? কী এর রহস্য? অনেক মিটিং করেও কোন কূলকিনারা করা গেলো না। তাই অপ্রিয় কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। বরখাস্ত করা হলো সিইও জেফ শ্যানলিকে। তাকে বিজনেস ডেভেলপমেন্টের হেডের দায়িত্ব দেয়া হলো। সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো সাতান্ন বছর বয়েসী ক্যাথরিনকে। ক্যাথেরিন এত এত ভারী নামের ভীড়ে খানিকটা ম্রিয়মাণই ছিলো বলা যায়। সে একসময় শিক্ষকতা করতো, পরে গাড়ি কোম্পানিতে কাজ করেছে। আইটি বিষয়ে তার তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না। সে কীভাবে সামাল দেবে এতসব দুর্দান্ত এক্সিকিউটিভদের সমন্বয়ে গড়া টিমকে? আসুন প্রথমে আমরা তাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিই,

জেফ(প্রাক্তন সিইও এবং বর্তমানের বিজনেস ডেভেলপমেন্টের হেড)- একজন সত্যিকারের অলরাউন্ডার! নেটওয়ার্কিংয়ে তার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তার এই বিশেষ গুনের কারণেই ডিসিশনটেকের এক্সিকিউটিভ টিমে এত প্রসিদ্ধ সব নাম যুক্ত হয়েছে। এছাড়া ইনভেসমেন্ট বাড়াতেও তার অবদান অসামান্য ছিলো। শুধু একটা গুণের অভাব ছিলো তার মাঝে; টিম ম্যানেজমেন্টে অদক্ষতা। আর এ কারণেই দু বছরের মধ্যে ডিসিশনটেক ধুঁকতে শুরু করলো, তাকে ডিমোশন দেয়া হলো।
মিকি(মার্কেটিং)- মার্কেটিংয়ের গুরু। সিলিকন ভ্যালিতে তার নামই হয়ে গেছে "ব্র্যান্ড মাস্টার"। তবে সেও সমস্যার ঊর্ধে না। ভদ্রতার বালাই করে না সে। মিটিংয়ে অপ্রোয়জনীয় বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্তি উৎপাদন করে। মার্কেটিং বিষয়ে কেউ তার ওপর কথা বলতে পারে এটা সে মেনে নিতে পারে না মোটেও। এমন অবস্থা হলে সে কুতকুতে চোখে আত্মম্ভরীতার সাথে এমনভাবে তাকায়, যেন বক্তা একটি তুচ্ছ কীট ছাড়া কিছু নয়। এসব কারণে অতি দক্ষ কর্মী হওয়া স্বত্ত্বেও কেউ তাকে পছন্দ করে না।
মার্টিন (চিফ টেকনোলোজিস্ট)- কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। জাতিতে বৃটিশ। আবিষ্কারক হিসেবে সিলিকন ভ্যালিতে তার অবস্থান কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে। সমস্যা হলো, সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজের কোন কিছু কারো সাথে শেয়ার করে না। অনেকের ধারণা সে পজিশন হারানোর ভয় পায় বলে এমন আচরণ করে। মিটিংয়ে কোন ভূমিকা রাখে না। মনোযোগ দেয় না। ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।
জেফ রাওলিন্স(সেলস)- অন্যদের তুলনায় কিছুটা বয়স্ক। হাসিখুশি মানুষ। কোন কিছুতেই না বলে না। দক্ষ কর্মী। জীবনে কোন রেভিনিউ টার্গেট মিস করে নি। কিন্তু ডিসিশনটেকে সে কেন যেন খুব একটু সুবিধে করতে পারছে না। কোন কাজ সময়মোতো শেষ করতে পারে নি।
কার্লোস(কাস্টমার সাপোর্ট)- স্বল্পবাক, মনোযোগী কর্মী। অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলে। যা বলে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়ে এসেছে সবসময়। আপন মনে কাজ করে। বিশ্বাসযোগ্য। এই একজনের ব্যাপারেই ক্যাথরিনের উদ্বেগ কম।
জ্যান (চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার)- সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে। একরোখা, জেদি এবং কিছুটা অহংকারীও বটে। সবাইকে চাপের মধ্যে রাখে। বোর্ড অফ ডিরেক্টরেরা তার ওপর বেশ আস্থাশীল।
নিক (চিফ অপারেটিং অফিসার)- এক্সিকিউটিভ টিমের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম। কোম্পানিটিকে বড় করার জন্যে, সারা বিশ্বে নতুন অফিস খুলতে তৎকালীন সিইও জেফ শ্যানলি তার ওপর সবচেয়ে ভরসা করতো। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে নি। কিন্তু তারপরেও তার ডাঁট কমে নি। সবাইকে তার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করার বাজে প্রবণতা ছিলো তার। সে ভাবতো কোম্পানির সিইও হবার যোগ্যতা একমাত্র তারই আছে।

এদের নিয়েই ক্যাথরিনকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ; ঝঞ্জাসংক্ষুদ্ধ পথ।

প্রথমদিকে, স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহলের দৃষ্টিতে স্টাফ এবং এক্সিকিউটিভরা তাকে পরখ করছিলো। যখন তারা দেখলো যে ক্যাথরিন কিছুই করছে না, শুধু স্টাফদের সাথে গল্পগুজব করে এবং মিটিংয়ে চুপচাপ সবাইকে অবলোকন করে এবং নোট নিয়ে সময় কাটাচ্ছে, তখন তারা কিছুটা আশাহত হলো বৈকি। নাক সিঁটকিয়ে ভাবলো, একে দিয়ে কিছু হবে না। এর মধ্যে ক্যাথরিন একটা কাজ করে ফেললো। প্রতিমাসের দুটো দিন নাপা ভ্যালিতে এক্সিকিউটিভদের নিয়ে অফ সাইট মিটিংয়ের আয়োজন করলো। মিটিংয়ের কিছুদিন আগে মার্টিন তাকে ই-মেইল করে জানালো যে বন্ডস্টেইন কোম্পানির সাথে জে আরকে নিয়ে সে অমুক তারিখে মিটিং করতে যাচ্ছে প্রোডাক্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে।
সে সময়টায় আবার কোম্পানির অফ সাইট মিটিং ছিলো। কিন্তু মার্টিন নতুন সিইওকে তোয়াক্কা করলে তো! এমনভাবে সে ই-মেইলটি পাঠালো, যাতে মনে হলো অফ সাইট মিটিংয়ে না থাকাটা একান্তই তার স্বীয় ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল। তার এ চিন্তাতে নির্মম আঘাত হেনে ক্যাথরিন তাকে বুঝিয়ে দিলো যে আসলে যতটা নরম এবং সহজ ভেবেছিলো নতুন সিইওকে সে আদতে তা নয়। ক্যাথরিন তাকে বাধ্য করালো এ্যাপয়ন্টমেন্টটা পিছিয়ে দিয়ে অফ সাইট মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে। এভাবেই ক্যাথরিন আড়মোড়া ভেঙে কোম্পানিকে পুনর্গঠন করার কাজ শুরু করলো।

প্রথম অফ সাইট মিটিংয়ে যথারীতি কিছুটা অসহোযগের সম্মুখীন হতে হলো তাকে। বিরোধীতা এলো নানা তরফ থেকে। প্রশ্ন উঠলো সময় নষ্ট করে এমন মিটিংয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে। মার্টিন পুরোনো অভ্যাসমত তার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ক্যাথরিন চায় সবাই মিটিংয়ে থাকুক এবং মনোযোগ দিক। অংশগ্রহণ করুক, পক্ষে বিপক্ষে তর্ক চলুক। মিকি আপত্তি তুললো এত লম্বা তর্ক বিতর্কে অযথা সময় নষ্ট হবে বলে। ক্যাথরিনের প্রথম দায়িত্ব ছিলো সবাইকে মিটিংয়ের মাঝে সম্পৃক্ত করা। সে সেটা সাফল্যের সাথেই করতে পারলো। গৎবাঁধা মিটিংয়ের পদ্ধতি অনুসরণ না করে হালকা আড্ডার আয়োজন করে ফেললো। সবাইকে তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো। কার বাড়ি কোথায়, ছেলে মেয়ে কয়জন, প্রিয় কাজ, শখ ইত্যাদি। এটা ছিলো তাদের জন্যে এক অভাবনীয় বিষয়! গত বছর দুয়েক তারা প্রফেশনালিজমের নামে কতটা দূরে সরে গিয়েছিলো একে অপরের থেকে, তা অনুভব করে অবাক হলো। ক্যাথরিনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো এটাই। পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে কোনভাবেই মিলেমিশে কাজ করা যায় না। লক্ষ্য অর্জন তো অনেক দূরের কথা! সবাইকে আড্ডায় মেতে উঠতে, খুনসুটি করতে দেখে ক্যাথেরিন স্বস্তিবোধ করলো। তবে সে বহু ঘাটের জল খাওয়া দুঁদে কর্মী। জানে এই সহৃদয়তা ধরে রাখাটা বড় কঠিন। গত দুই বছরে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, ক্রমাগত চর্চা না করলে তা দূর করা অসম্ভব। কে জানে এই মিটিংয়েই কারো কোন রুক্ষ শব্দে অথবা বিরোধীতায় তা গায়েব হয়ে যায় কি না!
তার আশঙ্কা অমূলক ছিলো না। মোটামুটি সবাই ঠিক থাকলেও মিকির স্থুল অভদ্রতা এবং দেমাগী মনোভাবে সভার স্পিরিট অনেকাংশেই নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছিলো। তবে তা ফিরিয়ে আনাও গেছে বহু কসরৎ করে। ক্যাথরিন মূল যে বিষয়টা ফোকাস করতে চেয়েছিলো তা হলো, একটি প্রতিষ্ঠান সফল হয় তখনই, যখন প্রতিটা দলের মধ্যে শুভ সমন্বয় থাকে। ডিসিশনটেকের ক্ষেত্রে যা ছিলো একেবারেই শূন্যের কোঠায়। মিকি গর্ব করে তার মার্কেটিং প্রতিভা নিয়ে। মার্টিন ব্যস্ত তার টেকনিক্যাল টিম নিয়ে। এভাবেই সবাই যার যার তার তার আখের গোছানোর ধান্দায় মগ্ন। নিজের ডিপার্টমেন্টের বাইরে অন্য কোথায় কী হচ্ছে তা জানার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিলো না কারো মাঝে। ছিলো না গঠনমূলক সমালোচনা, নিজের ভুল স্বীকার করা, অন্যের ভুল ধরিয়ে দেয়ার চর্চা। ফলে এত দক্ষ সব কর্মী থাকা সত্ত্বেও সাফল্যের দেখা মিলছিলো না। এসব ব্যাপার নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হলো। মিটিংয়ের শেষ পর্যায়ে যখন ক্যাথরিন প্রায় ধরেই নিয়েছে যে মিটিংয়ের মূল কথাগুলো সে সবার মধ্যে প্রোথিত করে দিতে পেরেছে, তখনই অপ্রত্যাশিত আঘাত এলো সেলসের প্রধান জেফ রাওলিন্সের তরফ থেকে। তার মতে, মিটিং ফলপ্রসু হয়েছে, সামনে ডিল পাওয়ার জন্যে অনেক খাটতে হবে। সুতরাং এত দূরে এসে মিটিং করে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, প্রাক্তন সিইও জেফ শ্যানলি মনোযোগের সাথে ক্যাথরিনে কথা শুনেছিলো এবং আত্মস্থ করেছিলো। সে মতামত জানায়, দুই বছরের পুরোনো স্বভাব এত সহজে দূর হবে না। তাদেরকে আরো মিটিং করে ব্যাপারগুলো চর্চার মধ্যে রাখতে হবে। কার্লোস এবং জ্যান এতে সম্মতি জানায়। সবশেষে ক্যাথরিন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সবাইকে জানায় যে, এর পর থেকে কেউ যদি অভদ্রতা করে, কারো মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র অহংকার দেখা যায়, যদি টিম হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখা দেয়, তাহলে সে সবার সামনে তাকে অপদস্থ করবে। এটাই ছিলো প্রথম অফ সাইট মিটিংয়ের সমাপ্তিসূচক বাক্য।

পাঠক, খুব অল্প কথায় শেষ করে দেয়া হলো, না? এই অধ্যায়টিতে বর্ণনা খুব কম ছিলো, প্রাধান্য পেয়েছে সংলাপ। লেখক হিসেবে প্যাট্রিক লিঞ্চিওনির প্রশংসা না করে পারা যায় না। তিনি প্রতিটা সংলাপ এত যত্ন নিয়ে নির্মাণ করেছেন, কর্পোরেট সাইকোলোজির জটিল সব মারপ্যাচ দেখিয়েছেন, এমন সব জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, এবং অমন পরিস্থিতিতে ক্যাথরিনের চরিত্রে স্থিতধী সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, যা রীতিমত থ্রিলিং এবং এক্সাইটিং। সাসপেন্সফুলও বটে। গ্রন্থ পর্যালোচনায় তার শতকরা এক ভাগও ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। আর অনুবাদক ফারজানা মোবিনও অসাধারণ কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। খুবই প্রাঞ্জল এবং সাবলীল তার অনুবাদ। নিজের মত করে শব্দ সাজিয়েছেন। সংলাপে কিছু আনঅর্থোডক্স শব্দ, যেমন (ফাটাফাটি, ব্যারাছ্যারা, আজব! এবং আরো অনেক কিছু) ব্যবহার করে ভাষাকে পাঠকের নিকটবর্তী করতে পেরেছেন। ব্যবহার করেছেন বাংলা গানের লাইন (যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, আয় তবে সহচরী)। এমন কী এক জায়গায় মিসির আলির বইয়েরও উল্লেখ করেছেন। এসব কিছু বইটিকে সুপাঠ্য করেছে নিঃসন্দেহে। তবে যেসব আধাস্ল্যাং ব্যবহার করেছেন, সেগুলো শুধু সংলাপে সীমাবদ্ধ রাখলেই ভালো হতো। বর্ণনায় এমন কিছু পড়তে গেলে কেমন যেন হোঁচট খেতে হয়।

দ্বিতীয় অফ সাইট মিটিংয়ের আগে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এক্সিকিউটিভদের একজন চাকুরি ছেড়ে দেন। লেখক এ ব্যাপারটি বেশ রহস্যময়তায় ঢেকে রেখেছিলেন। পাঠককে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছেন বেশ কয়েক পাতায়, উদ্দিষ্ট ব্যক্তির নাম অনুমান করতে। অনেকটা গোয়েন্দা গল্পের মতো। দারুণ একটা কৌশল ছিলো সেটা। বেশ কিছু জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একটি কোম্পানিকে এ্যাকুইজিশন করার প্রস্তাব নিয়ে আসে নিক। তা কি অনুমোদিত হবে? দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে জনবল বাড়ানো-কমানোর ব্যাপারে। ক্যাথরিন এবং তার দল কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তির ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব কে নেবে? প্রথম মিটিংয়ের পর যে চনমনে ভাব সৃষ্টি হয়েছিলো তা যেন অনেকটাই উবে যেতে থাকে। ক্যাথরিন কি পারবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে? দ্বীতীয় অফ সাইট মিটিংয়ে আছে আরো চমক এবং টুইস্ট। সেসব বলে দিয়ে স্পয়লার সৃষ্টির দায়ে দোষী হবার কোনই মানে হয় না! আর পরিশেষে ডিসিশনটেকের অবস্থা কী হলো? জানতে খুব ইচ্ছে করছে? তো পড়ে ফেলুন বইটি!

বইয়ের ফিকশন অধ্যায় এখানেই শেষ। বাকি চল্লিশ পৃষ্ঠা নন ফিকশন। এই অংশে লেখক টিমের জন্যে ভয়ংকর ক্ষতিকর পাঁচটি বিচ্যুতি বা ডিসফাংশন নিয়ে আলোচনা করেছেন। কীভাবে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, একটির ওপর আরেকটি কীভাবে নির্ভরশীল, কীভাবে এই বিচ্যুতিগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়, কাটিয়ে উঠতে না পারলে কী ক্ষতি হয় তার বিশদ আলোচনা রয়েছে সেখানে, যা শুধু হোমড়াচোমড়া কর্মকর্তাদের জন্যে না, কোম্পানির অতি অধস্থন কর্মীরও জানা খুব দরকার।


আর শুধু কোম্পানি কেন, এগুলোর চর্চা ঠিকভাবে করলে বাস্তব জীবনেও চমৎকার ফল পাওয়া সম্ভব। লেখক এখানে উদাহরণ হিসেবে ৯/১১'র সেই বিভৎস ঘটনায় কীভাবে পুলিশ, চিকিৎসাকর্মী, অগ্নি নির্বাপনকর্মী এবং সাধারণ মানুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন, টিম হিসেবে কাজ করেছেন তার উল্লেখ করেছেন।
তো পাঠক, আপনি যদি কোন কোম্পানির অতি উচ্চপদে আসীন হন, বইটি আপনার অবশ্যই পড়া উচিত। আগেও বলা হয়েছে, আবারও বলি, নিম্নপদস্থ চাকুরেদের জন্যেও বইটি প্রয়োজনীয়। এসবের কোনটাই যদি না হন, তাহলেও জেনে রাখার জন্যে পড়া উচিত, বলা তো যায় না কখন কোন পরিস্থিতিতে আপনার দরকার হয়ে পড়ে তা! আর যদি শেখার কোন অভিপ্রায় না থাকে, তাহলেও জাস্ট একটা উপভোগ্য মনস্তাত্ত্বিক, সাসপেন্সফুল উপন্যাস হিসেবেও পড়তে পারেন। কখন যে শেষ হয়ে যাবে টেরই পাবেন না!

বইটি প্রকাশিত হয়েছে অন্যরকম প্রকাশনী থেকে। ঘরে বসে পেতে চাইলে রকমারি
থেকে অর্ডার করতে পারেন।

শুভপাঠ!


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:৪৩
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×