somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অঙ্গবিহীন, তবু স্বপ্ন সীমাহীন! নিক ভুইচিকের গল্প

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


“নিক, নিক! কী করছো তুমি? সর্বনাশ! কতক্ষণ ধরে পানিতে ডুব দিয়ে আছো সোনাটা! তুমি চলে গেলে আমরা কী নিয়ে থাকবো!”
চিৎকার করে কাঁদছিলেন নিক ভুইচিকের মা দুশকা ভুইচিক। নিক তাদের বড় ছেলে। তার বয়স মাত্র দশ। এরই মাঝে এত অভিমান জমা হয়ে গেছে তার বুকে! এরই মাঝে তার জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধতা এসে গেলো! এত তাড়াতাড়ি! তবে কি মা হিসেবে তিনি ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ? তার মনে পড়ে গেলো ১৯৮২ সালের এক দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয় শীতের সময়ের কথা। তারিখ সেদিন ৪ই ডিসেম্বার-

৪ই ডিসেম্বর ১৯৮২তে নিক পৃথিবীতে এলো। দুশকা ছিলেন একজন ধাত্রী। প্রসূতি বিদ্যার যাবতীয় জ্ঞান ছিলো তার নখদর্পণে। কে জানে কেন, নিক যখন পেটে তখন থেকেই একটা অমঙ্গল আশঙ্কা পেয়ে বসেছিলো তাকে। তার মনে হত আগত সন্তানটির মধ্যে বড় কোন ত্রুটি রয়েছে। নিকের বাবা বরিস তাকে বোঝাতেন সাধ্যমত, কিন্তু মায়ের মন কেন যেন কিছুতেই মানতো না। অবশেষে এলো সে দিন! নিক এলো। বিরলতম জেনেটিক দোষে আক্রান্ত। হাত-পা বিহীন ছোট্ট দেবশিশুটিকে দেখে, দুশকা ঠিক থাকতে পারেন নি। অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “নিয়ে যাও! ওকে নিয়ে যাও আমার সামনে থেকে!”। পরবর্তী জীবনে নিককে কম অবহেলা এবং হেনস্তার শিকার হতে হয় নি, কিন্তু জন্মদাত্রীর কাছ থেকে এই বঞ্চনার সমতুল্য হয়তো কোনটিই নয়। সেখানেই নিকের জীবনের আখ্যান করুণতম ট্রাজেডিতে বিলীন হয়ে যেতে পারতো। ভালোবাসাহীন অতি নিম্নস্তরের জীবন কাটাতে হতো হয়তো বা। কিন্তু সে মুহূর্তে হয়তো বা ঈশ্বর তার এই অবিচারের জন্যে অনুশোচনা বোধ করে নিকের বাবার মাঝে নিজেকে প্রকাশিত করেছিলেন। তিনি সস্নেহে নিককে কোলে তুলে নিলেন। তার মাকে দেখিয়ে বললেন “এমন করো না সোনা। দেখ ওকে, কত সুন্দর হয়েছে আমাদের ছেলেটা!”। চিকিৎসক এবং নার্সদের অবশ্য কোন ভাবান্তর হয় নি। নির্বিকার মুখে তারা বলে দিলেন “এ ছেলে দিয়ে কী করবেন! ও তো একটা ভেজিটেবল হয়ে বেঁচে থাকবে সারা জীবন”। নিকের বাবা এতে দমে যান নি। তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন অপত্য স্নেহে। কিন্তু নিকের মা তখন ভুগছিলেন প্রসব পরবর্তী মানসিক ধকল “ব্লু বেবি”তে। তাকে মেনে নিতে তার প্রায় তিন চার মাস সময় লেগেছিলো। এই মেনে নেয়া থেকে এক সময় জন্ম নিলো বাৎসল্যের। পরবর্তীতে নিকের জীবনে আর মায়ের ভালোবাসার অভাব হয় নি।

...তবুও, নিক যখন পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলো, দুশকার মনে সেই অপরাধবোধ আবারও ফিরে এলো। সে নিজের ছেলেকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলো। নিজের ছেলে! নাড়ী ছেঁড়া ধন! কীভাবে পেরেছিলো সে! সেই অভিশাপ কি আবার ফিরে আসছে? ঈশ্বরের অনুগ্রহে সেদিন খারাপ কিছু ঘটে নি। আর এখান থেকেই নিক পেয়ে গেলো জীবনে সফলকাম হবার দারুণ এক দীক্ষা। আর সেটা হলো, “নিজের সীমাবদ্ধতাকে সম্পদে পরিণত করা”। নিক নিজেকে ডুবোতে চেয়েও ডুবোতে পারে নি। কারণ তার এই হাত-পা বিহীন শরীরটায় একটা দারুণ আশীর্বাদ গ্রন্থিত ছিলো। তা হলো, “ভারসাম্য এবং ভাসমানতা”। পরবর্তী জীবনে নিক এসব নিয়ে দিব্যি রসিকতা করে বেরিয়েছে অনেক!

ফিরে যাওয়া যাক নিকের শৈশবে,

বাবা-মা’র অফুরান ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণায় নিক গড়ে ওঠে বিপুল প্রাণশক্তিতে বলীয়ান এক হার না মানা যোদ্ধা হিসেবে। বাবা-মা তাকে বোঝাতেন, “তুমি আলাদা কেউ নও, তুমিও অন্যদের মতই। অন্যেরা যা পারে তোমাকেও তা পারতে হবে”। মাত্র ১৮ মাস বয়সেই তাকে পানিতে নামিয়ে দেন তারা। সাহসী নিক খুব সহজেই সাঁতার আয়ত্ত করে ফেলে। নিজের সীমাবদ্ধতা থেকেই আশ্চর্য সব উপায়ে সে অসম্ভবকে সম্ভব করার পদ্ধতি শিখে ফেলে। তার সম্বল হিসেবে ছিলো বাম কোমড়ের নিচে ক্ষুদ্র একটি পা সদৃশ বস্তু, পুরোপুরি পা’ও নয়। যাতে আবার দুটো আঙুলও ছিলো। ব্যাস! আর কী চাই! এত সামান্য সম্বলকে অর্জন করে সে কত কিছু করতে শিখলো! কলম ধরতে ফুটবলে কিক করা শিখলো। শিখে নিলো ভারসাম্য অর্জন করার উপায়। শিখলো সাঁতার, সার্ফিং। ছোটবেলায় তাকে কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করা শিখাতে চেয়েছিলেন তার বাবা মা। কিন্তু ওসব তার মোটেই ভালো লাগে নি। ওসবের সাহায্য ছাড়াই তো সে কত কিছু করতে পারে! তাই কী দরকার ওসব “উটকো ঝামেলা” বয়ে বেরানোর! ওগুলো নাকি তাকে আরো স্লথ করে দেয়।


“সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে। স্রষ্টা নিশ্চয়ই খামোখা আমাকে এভাবে সৃষ্টি করেন নি!”

নিক এমনই। কোন কিছুর জন্যেই তার অনুযোগ নেই। রয়েছে স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস। কর্মের মধ্যেই নিহিত ছিলো তার ধর্ম। নিকের জীবন দর্শন ছিলো সিম্পল। খুব ছোট্ট কিন্তু গভীর দুটি শব্দ। “হাল ছেড়ো না”।
“আমার হাত নেই, পা নেই, তাতে হয়েছে টা কী! আমি আরো ভারসাম্যপূর্ণ হয়েছি এর ফলে”।

তার বাম উরুর পা সদৃশ বস্তুটির ওপরেই ন্যস্ত ছিলো যাবতীয় কর্মব্যস্ততা! তিনি এটার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রপেলার’। আর যে দুটো আঙ্গুল ছিলো, কৌতুক করে তার নাম দিয়েছিলেন “চিকেন ড্রামস্টিক”। তার মতে,পানিতে সে বাড়তি সুবিধে পেতো এগুলোর কারণে। তার শরীরের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ফুসফুস, এটাকে সে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিলো।
২০০৮ সালে হাওয়াই ভ্রমণে প্রথম যখন তিনি সার্ফিং শেখেন, ৩৬০ ডিগ্রি স্পিন করিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সার্ফিং পত্রিকায় তার নাম বড় করে ছাপা হয়। পরবর্তীতে তিনি গলফ খেলাতেও পারদর্শীতা অর্জন করেন। কখনও হাল ছেড়ে না দেয়ার, মহতী জীবনের ব্রতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে?


দেখুন, নিক সার্ফিং করছে!

অনেকেই বলে থাকেন যে, নিকের এই নেই, সেই নেই, তারপরেও কত্ত কিছু করছে! হাত-পা থাকলে না জানি আর কী করতো!

নিকের সামনে গিয়ে যদি এসব কথা বলেন, তাহলে সম্মুখীন হবেন তার আশ্চর্য সুন্দর নীল দুটো চোখের শীতল ভর্ৎসনার। এমন তুলনা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। তার ভাষ্যে, “সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকলে দেখা যেতো সে ভবঘুরে অকর্মার ঢেকি হয়ে পড়ে পড়ে পড়ে ঘুমোতাম, কে বলতে পারে!”
তাই নিজের শরীর এবং দক্ষতার ব্যাপারে সে একশ ভাগ খুশী। নিক যেমন, তেমন ভাবেই তাকে গ্রহণ করুন, নইলে তফাৎ যান। এসব ব্যাপারে রূঢ় হতেও বাধ সাধে না তার।

আবারও তার বাবা-মার প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। তারা জানতেন তাদের সন্তানের জন্যে পৃথিবীটা মোটেও ফুলশয্যা হবে না। বিছানো থাকবে অজস্র কন্টক এবং পার হতে হবে হাজারো ব্যারিয়ার। কিন্তু তারা হাল ছাড়েন নি। নিকের মধ্যে এই বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছিলেন যে সে অন্যদের থেকে আলাদা নয়। অন্যেরা যা পারবে সেও তা পারবে। আর তাই তাকে কোন বিশেষ স্কুলে না দিয়ে মূল ধারার স্কুলে ভর্তি করেন হাজারো বাধা-বিপত্তি-বঞ্চনা সয়ে নিয়ে। তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান স্কুলগুলোর মধ্যে নিক’ই ছিলো একমাত্র শিক্ষার্থী, যে এমনতর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা স্বত্ত্বেও মেইনস্ট্রিম স্কুলে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
এ পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে, “আহা, কী চমৎকার ভাবেই না কাটছিলো নিকের জীবন! এত সীমাবদ্ধতা পেরিয়েও কী সুন্দর করে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো সে! বাহ বাহ! তালিয়া বাজাও হে সমাজ”। বাস্তব মোটেও অতটা অনুকূলে ছিলো না। সে যতই ইস্পাতদৃঢ় মনের অধিকারী হোক না কেন, তার বাবা মা যতটাই কেয়ারিং হোক না কেন, পুরো পৃথিবীর সবাই তো আর তার মিত্র নয়! স্কুলে সে ভয়াবহ রকম উৎপীড়ন আর অপমানের শিকার হলো। তাকে দেখে ছেলেপুলেরা হাসতো, মশকরা করতো, খেলা থেকে বাদ দিয়ে দিতো। কত আর সহ্য করা যায়! সে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগলো। হতাশায় আচ্ছন্ন হলো। তার মনে হতে লাগলো, এভাবে আর চলে না। শেষ পর্যন্ত তার আর কোথাও পৌঁছুনো হবে না। বাবা-মার বোঝা হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তার কখনো পরিবার, সন্তান কিছু হবে না। হতাশা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো, দশ বছর বয়সে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করলো, যার বর্ণনা আগেই দেয়া হয়েছে।

শুধু সাঁতার কেটে আর খেলাধুলা করে জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন জীবনের যে মহিমান্বিত আলো তাকে ছুঁয়েছে, তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। পৃথিবী জুড়ে এত হতাশ মানুষ, না পাওয়ার এত কষ্ট, সীমাবদ্ধতার অভিশাপ, এসব তিরোহিত করার সংকল্প করেন তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে। সারা অস্ট্রেলিয়ায় মোটিভেশনাল স্পিচ দেয়া শুরু করলেন। সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে বরণ করে নিলো এই অসাধারণ মানুষটির মহতী উদ্যোগটিকে। আশ্চর্য সুন্দর করে বলেন তিনি। জন্ম দিলেন অনেক বিখ্যাত উক্তির। অসহায় এবং নিপীড়িত মানুষেরা তার ভাষণ শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতো। পরবর্তী পাঁচ বছরে তিনি পাড়ি দিলেন আটান্নটি দেশ! তিন মিলিয়ন মাইল! কথা বললেন শীর্ষ নেতৃত্বদের সাথে। ঘরহারা এবং এতিমদের সাথে। তারুণ্যের উৎসাহে শাণিত করলেন নিজেকে, আলোকিত করলেন হাজারো বঞ্চিত মানুষকে। তার মতে, “নিরাশ্রয় এবং কর্মহীন থাকার চেয়ে হাত-পা না থাকা হাজার গুণ ভালো”। তরুণেরা উদ্দীপ্ত হতে লাগলো তার প্রেরণাময় ভাষণে।
পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে লাগলেন সেই সাথে। ২৫ বছর বয়সে সে ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং এবং একাউন্টিং এর ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করলেন। জীবন হলো আরো আত্মবিশ্বাসী, স্বপ্নময়।

নিকের বিখ্যাত কিছু উক্তি-
“মিরাকলের জন্যে অপেক্ষায় বৃথা সময় নষ্ট না করে নিজেই মিরাকলে পরিণত হন”
“আমরা পথ খুঁজে না পেয়ে বেদিশা হয়ে যাই, কিন্তু তার মানে এই না যে, পথ নেই। পথে নামার সাহসটাই মূল ব্যাপার”
“প্রতিটি সীমাবদ্ধতাই সীমাহীন বিকল্পের জন্মদাতা”
“ঈশ্বর আপনাকে ভালোবাসেন বলেই তিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।“
“আপনার কি নেই তা ভেবে ঈশ্বরের প্রতি রাগান্বিত না হয়ে কী আছে তা ভেবে কৃতজ্ঞ হন”
“সংগ্রাম যত কষ্টকর, তার ফল তত মধুর”


এ পর্যায়ে নিকের জীবনে আরেকটি বাঁক এলো। ক্যালিফোর্নিয়ায় তার কিছু আত্মীয় থাকতো। তারা তাকে আহবান জানালো সেখানে চলে আসতে। “আরে এখানে চলে আয় ব্যাটা! দুনিয়াকে দেখিয়ে দে তুই কত কিছু পারিস!”। নতুন জায়গা, নতুন মানুষজন, স্বজন, নতুন চ্যালেঞ্জ-এই তো নিকের প্রত্যাশিত জীবন! সেখানে গিয়ে ধাবিত হলেন নতুন স্বপ্নে। তার মত মানুষদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করবেন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অবশেষে ২০০৫ সালে তার স্বপ্ন সফল হলো। প্রতিষ্ঠিত হলো “লাইফ উইথআউট লিম্বস” নামক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মানুষে মানুষে সকল বাধা, বিভেদ, বিপত্তি দূর করে জন্ম, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক সামিয়ানার নীচে নিয়ে আসা এবং ঈশ্বরের কাছে জীবন সম্পর্কে কৃতজ্ঞতা জানানোর দীক্ষা দেয়া। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না যে নিক এমন ভয়াবহ প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও নিজের জীবন নিয়ে তৃপ্ত, আনন্দিত। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুঃখী মানুষেরা নিকের কাছে এসে যখন তার হাসি-খুশি এবং আত্মবিশ্বাসী অবয়বটা অবলোকন করে, তখন তারা সাহস ফিরে পায়। নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পালটে ফেলে। কিছুদিন আগে এই প্রতিষ্ঠানের দশ বছর পূর্তি হলো। ২০০৭ সালে নিক প্রতিষ্ঠা করেন মোটিভেশনাল স্পিচের সংস্থা এ্যাটিচুড ইজ এ্যালটিচুড"।

নিকের বাবা তাকে বলতেন, “তুমি ঈশ্বরের এক অমূল্য উপহার, শুধু একটু ভিন্নভাবে বানানো”। কী দারুণ সত্য এক অমিয় বাণী ছিলো সেটা!


“আমার তখন বড্ড দুঃসময়। কয়েক জায়গায় টাকা খাটাতে গিয়ে বিফল হয়েছি। খুব কাছের একজন স্রেফ মেরে দিয়েছে কিছু টাকা। হতবিহবল অবস্থা আমার। শেষতক বাবা-মায়ের কাছেই হাত পাততে হলো। ঘিরে ধরলো সেই পুরোনো ভয়, আমি কিছুই পারি না। অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন কাটাতে হবে আমাকে! “
হঠাৎ করেই ভীষণ দুঃসময় গেড়ে বসলো তার জীবনে। হতাশায় ভেঙে পড়ে কাঁদতেন নিক। সেই দুঃসময়ে তাকে সাহস যোগালেন কানাইয়ি মায়িহারা নাম্নী এক জাপানিজ-আমেরিকান তরুণী। যার সাথে তার টেক্সাসে দেখা হয়েছিলো একটি বক্তৃতা দেবার অনুষ্ঠানে। বেল টাওয়ারের উচ্চতম তলায় তাদের দেখা ,যা ছিলো একদম সিনেমাটিক কেতার “প্রথম দর্শনে ভালোবাসা”। এবং সেই হাই অল্টিচুডে তারাও বোধ করছিলেন “প্রেটি হাই!” ধীরে ধীরে তারা ঘনিষ্ঠ হলেন, একে অপরকে জানতে এবং বুঝতে শিখলেন। কিছুটা ধীর ছিলো ব্যাপারটা। কারণ দুজনের কেউই মুখ ফুটে ভালোবাসার কথাটা একে অপরকে বলেন নি। পরবর্তীতে নিক তার বই “আনস্টপেবল” এ উদ্ধৃত করেন, তারা দুজনেই একে অপরকে পাওয়ার প্রত্যাশায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। অথচ তারা কেউ এটা জানতোই না!

নিকের যখন দুঃসময়টা এলো, তখন তার হাতে হাত রেখে গভীর আবেগে মায়াবতী কানাশি বললেন,

“যত যাই হোক, তোমাকে ছেড়ে যাবো না আমি। তোমার কাজ নেই তো কী হয়েছে! আমি কাজ করবো। নার্সিংয়ের একটা কাজ দিব্যি জুটিয়ে নিতে পারবো।“
সেই মুহূর্তেই নিক বুঝতে পারলেন, কানাশি হতে যাচ্ছে তার অর্ধাঙ্গিনী।


ভালোবাসার শক্তিতে বলীয়ান হতে পারলে আর কী লাগে! যত দুর্যোগই আসুক না কেন, সাচ্ছন্দ্যে জীবনের পথ পাড়ি দেয়া যায়। নয় মাসের মাথায় নিক তাকে এনগেজমেন্ট রিং পরিয়ে দিলেন। তারা বিয়ে করলেন। বছর ঘুরতেই কোল জুড়ে এলো বিধাতার আশ্চর্য উপহার, এক পুত্রশিশু। তার নাম রাখা হলো কিয়োশি। ছেলেও বাবার মত খুব লায়েক হয়েছে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর! দিনে বেশ কয়েকবার তারা হাই ফাইভ করে। চুমু দেয়, আলিঙ্গন করে। নিকের জীবন অবশেষে পূর্ণতা পেলো।


নতুন উদ্যমে তারা আবার কাজ করা শুরু করলেন। নিকের ওপর এখন অনেক দায়িত্ব। কানাইয়িকে ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই নিককে বাড়তি কাজ করতে হলো। কাজকে কবেই বা ভয় পেয়েছে নিক? আর এখন তার ঘরে আছে অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস, তার সন্তান। সুতরাং আরো বেশি কাজ, আরো বেশি পরিশ্রমের চ্যালেঞ্জটা খুশি মনেই গ্রহণ করলো সে। এমনিতেই মোটিভেশনাল স্পিচ দিতে তাকে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। এছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধ এবং স্কুলের বুলিয়িং প্রতিরোধে সোচ্চার হয়েছেন তিনি এখন।

ইতিমধ্যে বেশ কটি বইও লিখে ফেলেছেন। অভিনয় করেছেন সিনেমায়। এবং যথারীতি, সেখানেও পেয়েছেন অভাবিত সাফল্য। তার প্রথম বই-“ Life Without Limits: Inspiration of a Ridiculously Good Life” বেস্ট সেলার হয়। অনুদিত হয় ত্রিশটি ভাষায়। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “দ্যা বাটারফ্লাই সার্কাস” এ অভিনয়ের সুবাদে পুরষ্কার বাগিয়ে নেন এই আশ্চর্য মানুষটি।

নিক কখনো হাল ছেড়ে দেন না। কখনও ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারান না। জীবনে অনেক কিছুই অন্যরকম হলে ভালো হতো, তবে যা আছে তা নিয়েই অগ্রসর হওয়াটাই হলো তার মূল মোটিভেশন। আমরা অনেক সময় মিরাকলের অপেক্ষায় থাকি। এভাবে মিরাকল আসে না। অন্যের জীবনকে উজ্জীবিত করে নতুন আশা যোগানো এটাই হলো সত্যিকারের মিরাকল। এই অসাধ্য কাজ করার চ্যালেঞ্জে সফল ভাবে এগিয়ে চলেছেন বিস্ময় মানব নিক ভুইচিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৭
৪১টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×