আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
তোমাদের ঘরে ফিরতে হবে। এখন তোমাদের ঘরে ফিরতেই হবে। জানি তোমাদের খুব রাগ হচ্ছে আমার কথা শুনে। তোমাদের সহপাঠীদের আঘাত করা হয়েছে। তোমাদের ৯ দফা দাবীর বাস্তবায়নে কোন প্রতিশ্রূতি আসে নি। কিন্তু তারপরেও তোমাদের ঘরে ফিরতে হবে। কেন, জানো? তোমরা যে দাবীগুলো দিয়েছো, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করে দেখিয়েছো এই কদিনে। তোমাদের এই অসাধারণ কাজগুলি দাবীগুলিকে ছাপিয়ে গেছে। আজ আমি যখন বাসায় ফিরছিলাম হেঁটে, ফুটপাথ ধরে হেঁটেছি (যতটুকু পারা গেছে আর কী, ফুটপাথের অবস্থা তো জানোই)। পরে যখন রিকশায় উঠলাম, রিকশাটা একবার রাস্তার কিছুটা মাঝদিকে চলে গিয়েছিলো। তখন পাশ থেকে একটা মোটরসাইকেল যাবার সময় বললো, “কী ব্যাপার, বামে চাপাও”। রাতের বেলায় তোমরা যখন রাস্তায় থাকো না, তখনও গাড়িগুলো সারি বেঁধে চলে। এ রকম অসম্ভব ব্যাপার কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলো কখনও? আজ খবরে দেখলাম পুলিশের বড় কর্তা ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের বলেছেন, ভালোভাবে সব গাড়ি চেকিং করতে, তোমরা বুঝতে পারছো কোনখানে নাড়া দিয়েছো?
আমি জানি না সরকার তোমাদের সবগুলো দাবী পূরণ করবে কি না। হয়তো সবগুলিই পূরণ করবে, হয়তো আশ্বাস দেবে, হয়তো আশ্বাসও দেবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, এই দাবী মেনে নেয়া না নেয়া দিয়ে তেমন কিছুই এসে যায় না। কারণ এখন থেকে,
যে রিকশাওলাটি গতির নেশায় রাস্তার মাঝপথ দিয়ে ছুটছে, তাকে রিকশায় বসা মানুষটি যদি কড়া করে ধমকে দিয়ে লাইনে আনবে।
যে বাইকার ফুটপাথে বাইক উঠিয়ে দিতো সে এই কাজটি করার আগে আরেকবার ভাববে।
কেউ যদি ফুটপাথে বাইক উঠিয়ে দেয় তাকে অন্যরা বাধা দিবে।
যে বাস ড্রাইভারটি ওভারটেকের নেশায় রেস করছে তাকে আমরা সবাই মিলে প্রতিহত করবে।
আমরা এখন থেকে শর্টকাটে রাস্তা পার না হয়ে ওভারব্রিজ ব্যবহার করবো।
আমি ওপরের কথাগুলি পালন করে চলবো, প্রতিজ্ঞা করছি। আমি অন্যদের এগুলো মেনে চলতে বাধ্য করবো। আমার ছোট্ট বাচ্চা দুটি, যারা এখনও সিস্টেমের গলতি সম্পর্কে জানে না, তারা জানবে ওটাই সিস্টেম। আমি জানাবো। আমার স্ত্রী জানাবে। আমার ঘনিষ্ঠজনদের প্রত্যেককে এগুলো মেনে চলতে বাধ্য করবো। কথা দিচ্ছি। শুধু তাই না, তারা যেন অন্যদের এগুলি পালন করতে বাধ্য করে তা নিশ্চিত করবো।
দেখলে তো, একজনের সাথে কতজন কানেক্টেড হয়ে গেলো?
আমার প্রিয় অনুজেরা,
সিস্টেম একদিনে পরিবর্তন হয় না। জাপানের মানুষ আজ সারা বিশ্বে উদাহরণ। ভদ্রতার জন্যে, আন্তরিকতার জন্যে, নিয়ম শৃঙ্খলার জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কি ওরা এমন ছিলো? ছিলো না। ওরা পার্ল হারবারে হামলা করেছে, চাইনিজদের ওপর নির্যাতন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিলো ওদেরকে বদলে দেবার এক ক্রান্তিলগ্ন। আমরা আমাদের বহুল আকাঙ্খিত সেই ক্রান্তিলগ্ন খুঁজে পেয়েছি তোমাদের মাধ্যমে। তোমাদের প্রতি আর দশবছর পর বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ থাকবে, লিখে রাখো। তোমরা এই চার-পাঁচদিনে যা করেছো তা বাংলাদেশের জন্মের পর কেউ করতে পারে নি। করা যাবে বলে বিশ্বাসও করে নি। এখন এই বিশ্বাসটা এসেছে। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ না। দেশকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে, রাজনীতিবিদদের গালাগালি করে সময় কাটাই। এখন থেকে আমি অবসর সময়ে আমার বন্ধু, সতীর্থ, সহকর্মীদের সাথে তোমাদের রচিত গৌরবগাঁথার গল্পটাই করবো। এটা যে শুধু গল্পতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা তো আগেই উল্লেখ করেছি।
আমি যতদূর জানি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক কিছু সংস্কারের প্রস্তাব গেছে। আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন করার মানুষগুলো ঠিক আমলে নেয় না, আমরাও নিজেদের দিকটাই বেশি ভাবি। তারপরেও আমাদের আশা করার সাহস তোমরা দিয়েছো। এতদিনের জং ধরা সিস্টেম পরিবর্তন করার সোনার কাঠি তোমাদের কাছ থেকে পেয়েছি। ধরে রাখবো কথা দিচ্ছি।
এখন ফিরে যাই রাস্তায় থাকা না থাকার প্রসঙ্গে। কাল তোমরা মিরপুর ১৩তে মার খেয়েছো। আর আজ ধানমন্ডিতে তো প্রলয় ঘটে গেলো! গুজব ছড়িয়েছে যে ৪টি লাশ পড়েছে, রেপ হয়েছে, চোখ উপড়ে নেয়া হয়েছে, এগুলো পরে মিথ্যাও প্রমানিত হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। কাল কিন্তু আজকের গুজব সত্যিও হয়ে যেতে পারে। ছাত্রলীগ তোমাদের পিটিয়েছে, কিন্তু লাশ ফেলতে পারে নি, এতে অনেকেই খুব দুঃখ পেয়েছে। হ্যাঁ, আমি তাদের নাম নিবো। তারা বিএনপি, জামাত।
তোমরা কাল কেন রাস্তায় নামবে? গুণ্ডাদের সাথে লড়াই করার জন্যে? আজ লীগ মাঠে ছিলো, কাল দল থাকবে, শিবির থাকবে। তোমাদের একটা লাশ পড়লে তারা যে কী আনন্দিত হবে, বুঝতে পারছো? বিএনপির নেতা আমীর খসরুর ফাঁস হওয়া ফোনকথন শোনো নি? শুনে নিও।
তোমরা আজ প্রেস কনফারেন্সে বললে “জোহরের নামাজের পর একদল লোক এসে আমাদের জানায়, জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করছে। সে কথা শুনে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে যায়। তবে আমরা অবস্থান ছাড়িনি। বিচ্ছিন্নভাবে কে কারা হয়তো আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে গেছে এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে”।
তোমাদের এই ন্যুব্জ মুখ, আর দেখতে চাই না। পপুলারে, ল্যাব এইডে তোমাদের মধ্যে অনেকেই মারাত্মক আহত হয়ে ভর্তি হয়েছো। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় এত সিরিয়াস ইনজুরি হয়? কেবল এক পক্ষ আহত হয়?
তোমাদের প্রতি তো অনেক কমিটমেন্ট দিলাম, তোমরা এখন কমিটমেন্ট দাও, যখন বড় হবে, যৌবনে পদার্পণ করবে, তখন তোমাদের প্রতি আজ যা হলো, সেটা অন্যদের প্রতি করবে না। ডিল? দেখো তবে দশ বছর পর কী হয়!
যারা আমার লেখা পড়ছেন, যারা আমার মত অভিভাবক, তাদের লাইক কমেন্ট শেয়ার করে পাশে থাকার দরকার নাই। কমিটমেন্ট দেন। প্রতিজ্ঞা করেন,
১। ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হবেন না
২। রিকশাকে লাইনে রাখতে বাধ্য করবেন
৩। বাসচালককে ঠিকমত গাড়ি চালাতে বাধ্য করবেন
৪। সংরক্ষিত আসনে যাদের বসার কথা তাদেরকেই বসতে দিবেন
৫। ফুটপাথে বাইক ওঠাবেন না, আর কেউ ওঠালে তাকে নামায় দিবেন
৬। গতিসীমা বজায় রেখে গাড়ি চালাবেন
৭। ইউটার্ন নিবেন, ঘুরে যেতে হলেও। রং ওয়ে দিয়ে যাবেন না।
যদি প্রতিজ্ঞা করার হ্যাডম থাকে, তাহলে ভালো। নাহলে তাদেরকে বাড়িতে বসিয়ে খোপের মধ্যে বন্দী করে রেখে সোনালী যোগবোধক চিহ্ন প্রসব করতে সাহায্য করুন, আর কবর খুড়ুন ভবিষ্যতের।
ভালো থেকো প্রিয় অনুজেরা, ধন্যবাদা আমাদের পথ দেখানোর জন্যে।
ইতি
তোমাদের গুণমুগ্ধ
হাসান মাহবুব
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:২৩