গাঠিনিক দুর্বলতা প্রচ্ছন্ন হলে নিরবে মরে যায় দেশের গরীব সম্প্রদায়, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা হয় না। এই দুর্বলতা উদ্ভাসিত হলে প্রাণ হারাতে থাকে মধ্যবিত্ত, এতে কিছু মাথাব্যথা হয় ঠিকই, কিন্তু তার জন্য সিডাটিভ কিনতে হয় না।
আর এই দুর্বলতা যখন প্রকট হয়, তখন রাজা কিংবা প্রজা, বাদ যায় না কেউ।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে গতকালের দুর্ঘটনায় ভূমিমন্ত্রী তাঁর সন্তান হারিয়েছেন। দুঃখের বিষয়। পত্র-পত্রিকার জরিপ অনুযায়ী, গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৬৪২ জন প্রাণ হারিয়েছেন (তাঁদের মধ্যে একজন আমার বন্ধু), আহত বাইশ হাজার।
বছর শেষে পরিসংখ্যানটা যতই ভয়জাগানিয়া হোক, বছরের মাঝামাঝি সময়ে যখন মানুষগুলো মরে যায়, তখন আমরা এত ভয় পাই না। ভয় পাওয়ার মত যথেষ্ট চেতনা কেন যেন জাগে না।
একটি দেশের রাজধানী যেকোন সময় ধ্বংশ হবার জন্য প্রায় প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। ভূবিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা যদি সঠিক হয়, যদি সত্যিই হিমালয়ের কাছাকাছি ৮.২ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়, তাহলে কি হবে কিছুই বলা যায় না। সেই দেশেই আবার বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আট হাজারের বেশি মানুষ মরে যায়। তারপরও যখন ঢাকায় মেট্রোরেল বসানোর পরিকল্পনা করা হয়, তখন কেন যেন আমার কাছে পুরো বিষয়টি ঘোরতর রহস্যময় লাগে। বাংলাদেশের অনেক স্থানেই সাধারণ রেল সার্ভিস পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। রেলের বেহাল দশা। সরকার যদি সবার আগে দেশের রেলসার্ভিসকে উন্নত করার পরিকল্পনা নিত, এটুকু বলে দেয়া যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের সংখ্যাটা অনেক কমে আসত।
মাঝে মাঝেই পত্র-পত্রিকায় খবর আসে যে ঢাকার ‘অমুক’ এলাকার মানুষেরা তিনদিন ধরে পানি পায় না। গবেষকরা অনেক দিন ধরেই সতর্ক করছেন যে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। গতকালই ডেইলি স্টারের খবরে পড়লাম, মোহাম্মদপুরের চারতলা একটি ভবন নাকি হেলে পড়েছে। রাজধানীসর্বস্ব একটি দেশের সর্ববৃহৎ পরিকল্পনা হওয়া উচিত রাজধানীকে ঘিরে। এই পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন রাজধানী নির্মান নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ রাজধানী নির্মান। সবার আগে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নিরাপত্তা, আর আমরা সেটাকে বিবেচনায় আনি সবার শেষে।
অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে বড়সড় ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা নেই। তাই এত ভীত হবার কারন নেই। এটা সত্য কথা। কিন্তু এই সম্ভাবনার ডানায় ভর করে যথেচ্ছাচারের রাজধানী বানানো কতটা যৌক্তিক? সারাবছর মাথায় থাকেনা এসব কিছুই। বঙ্গবন্ধু সেতুর মত পূর্ণপরিকল্পিত একটি চমৎকার রাস্তায় যখন ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আহাজারি ভেসে ওঠে সবখানে, ছেলে হারানোর বেদনায় মন্ত্রী কেঁদে ওঠেন, কাঁদি আমরাও। বহুতল ভবন যখন রাতবিরেতে ডানে-বাঁয়ে কেঁপে ওঠে, এক হয়ে ঈশ্বরকে ডাকি সবাই, ধর্মশালা ভরিয়ে তুলি প্রভুবন্দনায়।
এতে কতটুকু লাভ? ক্ষতি কি আরেকটু বাড়ল? হিসেব কষতে কষতে পত্রিকার পাতাটা রিলোড করি, দেখি আরও একটি সড়ক দুর্ঘটনার খবর। রিপোর্টটি বেশ বড়। পড়তে পড়তে বিরক্ত লাগে। যাই হোক, হিসেবের খাতাটা আরেকবার খুলতে হবে, মৃতের সংখ্যাটা বাড়ল কি না…!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৬