ঘটনা ১:
যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর থেকে মোটামুটি কাহিনীর শুরু। এই বিচারের প্রতিবাদে উদ্বিগ্ন বোধ করে পাকিস্তান। বিনিময়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ। এর বিনিময়ে পাকিস্তান আবার বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে এবং স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে- পাকিস্তান কোনকালে বাংলাদেশে কোনরকম গণহত্যা চালায় নি!
ঘটনা ২:
জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পাকিস্তানের হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদকে সরিয়ে নিতে বলা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। পাকিস্তান ফারিনা আরশাদকে সরিয়ে ইসলামাবাদে নিয়ে যায়। পাল্টা জবাব হিসেবে অল্পকিছুদিনের মাথায় স্পষ্ট কোন কারন ছাড়াই পাকিস্তান ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সেলর মৌসুমি রহমানকে ফিরিয়ে নিতে বলে। মৌসুমী রহমানকে বদলি করে পর্তুগালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ঘটনা ৩:
সন্দেহজনক গতিবিধির কারনে গুলশান-২ থেকে গোয়েন্দারা পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের কর্মী আবরারকে আটক করেন। এদিকে আবরারকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। আবরারকে ছেড়ে দেয়া হলে ইসলামাবাদে সাদাপোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস শাখার কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করে। কয়েক ঘন্টা পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঘটনা ৪:
পিএসএল- এ রমিজ রাজার জোকারসুলভ আচরণে সবাই ক্ষুদ্ধ হলেও আমি নই। কারন রমিজ রাজার চরিত্রটি আমি আজ থেকে বহুবছর আগেই ধরতে পেরেছি এবং তার থেকে আমি এর থেকে ভালো কিছু আশা করি না। পুরস্কার নেবার সময় সাকিবকে না ডেকে ভুলবশত লেন্ডল সিমন্সকে ডেকে ফেলা কিংবা প্রায় এক দশক ধরে ক্রিকেট খেলা তামিম ইংরেজী ভাষা জানেন কি না তা নিয়ে ভঙ্গি করা- এগুলো তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনারই অংশ। বাংলাদেশের পরাজয়ে যে লোকটি সবথেকে বেশি আনন্দিত হয়, তার নামও রমিজ রাজা।
ঘটনার তালিকা করতে গেলে সে তালিকা শেষ হওয়া দুষ্কর। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আদর্শসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব দিনদিন বাড়ছে। মাঝখানে এদেশীয় অংশবিশেষের পাকপ্রীতির কারনে যদিও এই দ্বন্দ্ব মাথা তোলার অবকাশ পায়নি। কিন্তু যতবারই মূলধারার বাঙ্গালী চেতনা কথা বলেছে, ততবারই উদ্বিগ্ন হয়েছে পাকিস্তান। নিজেদের দুষ্টাচারের গোমর ফাঁস হবার ভয়ে শঙ্কাকূল পাকিস্তান তাই যখনই সুযোগ পায় নিজেদেরকে নির্দোষ দাবী করে, সুযোগ পেলেই অপমান করে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশীকে।
নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ১৮০ডিগ্রি বদলে দিয়ে তারা নিজেদেরকে বসিয়েছে ত্রাতার আসনে, আর বাঙ্গালীদের বানিয়েছে বিশ্বাসঘাতক, দুরাত্মাদের চর। আধুনিক পাকিস্তানীদের কাছে নিজেদের পাপাচার ঢাকার জন্য হলেও তো ৭১ ও গণগত্যাকে অস্বীকার করা প্রয়োজন!
২
শুরুতেই তুলে ধরা ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, পাকিস্তান এক চুলও ছাড় দিচ্ছে না কোন ক্ষেত্রে, যেন- ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী’ অথবা ‘চোরের মায়ের বড় গলা’! প্রশ্ন হল, বাংলাদেশ কি পারত আজ পাকিস্তান যা পারছে। অর্থাৎ, শুরুতে যদি পাকিস্তান বাংলাদেশের কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে বলত; বাংলাদেশ কি পারতে বিনিময়ে পাকিস্তানের কোন কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে বলার কথা? অনেক কঠিন হত বাংলাদেশের জন্য। অনেকেরই মনে হত, থাক্, কি দরকার। ওরা সরিয়ে নিতে বলেছে, সরিয়ে নিয়েছি। আর ঝামেলা বাড়িয়ে কি হবে?
পাকিস্তান কিন্তু সেরকমটা ভাবে নি। পাকিস্তান কিন্তু ঝামেলা বাড়ানোর ভয়ে ভীত নয়। বরং ইটের বদলে পাটকেল ছুড়তে তারা দ্বিতীয়বার ভাবে না। বাংলাদেশে জঙ্গীঅর্থায়নের পেছনে পাকিস্তানী পৃষ্ঠপোষকতার কথা অবিদিত নয় কারও। পত্র-পত্রিকা পড়ে জানলাম, ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাদের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্যই ছিল। কিন্তু মৌসুমী রহমানের দোষ কি ছিল, পাকিস্তান কিন্তু তা বলার সৎসাহস দেখায় নি। একই ঘটনা আবরারের ক্ষেত্রেও। গোয়েন্দারা ধরলে আবরার নিজের কোন পরিচয়ই দেখাতে পারে নি। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে কি অপরাধে ধরা হয়েছিল? শুধু কি সন্দেহের বশে জাহাঙ্গীরকে ধরা, নাকি প্রত্যুত্তরের অন্তর্জ্বালা মেটানোর পথ- উত্তরটা আমাদের কাছে অনুমেয়।
৩
অনেকেই এমন দাবী করছেন যে- পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সবরকম বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবসান ঘটা উচিত। যুক্তরাষ্টীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটে একবার ওবামার প্রতিপক্ষ গভর্নর রমনিকে এমন একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন- এটা পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার সময় নয়, কারন পাকিস্তান একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ! আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও তেমনটাই মনে করেন। তিনি বলেছেন- ‘কোনো দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চললে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় না। যুদ্ধের সময়ও সম্পর্ক বজায় থাকে।’ কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরমধ্যেই পাকিস্তানের সাথে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এপথে হাঁটতেই পারে। যদি তাই হয় তাহলে কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে এমন কথা বলা বেশ শক্ত হয়ে যাবে।
যদি বাস্তবটাকে মেনে নেই, তাহলে বলতেই হয় যে, সম্পর্ক ছিন্ন করা কোন সমাধান হয়ত নয়। কিন্তু চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনৈতিকতার ইতিহাস নতজানুতায় ভরা। এই সংশয় থেকে উঠে আসতে হবে। পাকিস্তান যদি দৃঢ় কণ্ঠে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখায়, তবে আমাদেরকেও সেই সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরার মানসিকতা গড়তে হবে। আসন্ন সার্ক সম্মেলনেই এ নিয়ে কথা হতে পারে। যদি কোন রকম সম্পর্ক ছিন্ন না করে নিজেদের সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে সাহসী হওয়া ছাড়া আর উপায় কোথায়? অপর পিঠে যদি ছাড় দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়, তবে অচিরেই পিঠ দেয়ালে ঠেকবে। আর দেয়ালে ঠেকা খুব কম পিঠই উঠে আসার ক্ষমতা রাখে। আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের উচিত হবে না পরাজিত অপশক্তিকে উত্থানের সুযোগ দেয়া। বাঙ্গালীর স্বাধীনতাচেতনাকে ধোঁয়াশাপূর্ণ করে রাখতে না চাইলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গৌরব তুলে ধরার বিকল্প কোথায়?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৩