নিতান্তই একান্তই ব্যক্তিগত দর্শন বলা চলে। আজকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের নববর্ষ উপলক্ষ্যে ফাঁস করে দিলাম, যদি কারো কাজে লাগে তো উপকারের ভাগী হয়ে যাব। আলো যেমন প্রতিফলিত হতে থাকলে অনেক অনেক বেশি আলো মনে হয়, কল্যাণ তো ঠিক তেমনি।
বিশেষ করে, প্রতিটা বিশেষ দিনের শুরুতেই, ঘুম থেকে জাগার আগে আগে এই বিশেষ বিষয়টা মনে পড়ে।
এটা স্বাভাবিক যে, ব্যক্তিগত দর্শনে ব্যক্তিগত রুচির প্রভাব থাকবেই। যেমন, নাস্তায় প্রায় সব সময়েই পছন্দ করার ক্ষেত্রে কেউ চান টক তো কেউ ঝাল তো কেউ মিষ্টি- বিষয়টার পিছনে মনস্তত্ত্ব কী আছে জানি না, তবে কিনা নিতান্তই ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার।
জীবনদর্শন, যা নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দিই, দাঁড়িয়ে আছে তিনটা ভিত্তির উপর:
১. কর্ম। (সব এর আওতায়, ঘুমানো থেকে শুরু করে রকেটে করে চান্দের দেশে যাওয়া, সবই কর্ম।)
২. তৃপ্তি-সুখ।
৩. আত্মপরিচয়।
এই প্রতিটার ব্যাখ্যা, উৎস, কর্মপদ্ধতি এবং কার্যকারণ...
প্রথম দর্শন: কর্ম-
আমি আলহামদুলিল্লাহ, মুক্ত মানুষ। আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামির খত দেইনি, তিনি যাদের অনুসরণ করতে বলেছেন তাদের করি। যেহেতু মুক্ত, মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে যে কারো কাছে শিখতে বসে পড়ি, বেছে তার কাছ থেকে যেটা নেয়ার নিয়ে নেই।
প্রিয় 'অফলাইন' সমসাময়িক এবং গত একশ বছরের মধ্যে শিক্ষক যারা আছেন তারা হলেন- ১. আহমাদ রেজা খান রা. ২. শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ৩. ড. তাহির উল ক্বাদরী ৪. শাইখ হামজা ইউসূফ ৫. শহীদ আল বোখারী মহাজাতক ৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭. কাজী নজরুল ইসলাম ৮. হুমায়ূন আহমেদ ৯. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১০. পাওলো কোয়েলহো ১১. অবশ্যই আমার মা, কার্যকারণে, মাতৃত্বের কারণে নন ১২. কয়েকজন বিজ্ঞানী, যেমন মিচিও কাকু।
এর বাইরে দুজন আছেন যাঁদের নাম উচ্চারণ করি না।
কর্মদর্শনটা ঠিক হয়েছিল একেবারেই হঠাত করে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বান্দরবানের লামায় বিশাল বিরাট অঞ্চল নিয়ে রাজসিক কাজকর্ম করছে, যাকে সরলার্থে আশ্রম বলা যায়। এ ফাউন্ডেশনের এই একটা প্রজেক্টের পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়, সংক্ষেপে একবাক্যে বলতে গেলে, এটা সেই আশ্রম যেখানে সাতশোর উপর কর্মকর্তা কর্মচারী প্রতি বেলায় খাওয়াদাওয়া করেন, যে অঞ্চলের পুরোটাকে দুদিন হেঁটেও ঘের দেয়া সম্ভব নয়, একটা উঁচু পাহাড়ে ওঠার পর চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় এবং যা দেখা যায় তার সবই ফাউন্ডেশনের সম্পদ, বাংলাদেশের গণমানুষের উন্নয়ন এবং অখন্ডতার জন্য কার্যরত, অন্তত শ খানেক প্রজেক্ট যেখানে রয়েছে যার প্রতিটাই আলোচনার যোগ্য।
তো, এই লামার কোয়ান্টামম এর সেবাকার্যের জন্য পাঁচদিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ পড়ে গিয়ে মাইক নিয়ে যাবার বিষয়টা আদায় করলাম। এবং গিয়ে পেলাম সেই কর্মদর্শন।
কোয়ান্টামের গুরুজী অনেক কিছুই কোর্সে শিখান। তাদের বহু বহু কোর্স। অথচ এই বিষয়টা শিখলাম তাঁর কাছ থেকেই, শিখলাম কোর্সের বাইরে।
তিনি আশ্রম ঘোরার ফাঁকে উঁইয়ের ঢিবি দেখলেন। জানলেন এবং সন্ধ্যায় আমাদের জানালেন। উঁই পোকার ঢিবিতে যতই উঁই মারা হোক, যাই করা হোক, কোন লাভ নেই। উঁই বাড়তে থাকবে। বেরোতে থাকবে। এই পোকাগুলোর একটা মাত্র রাণী থাকে। সে-ই ডিম পাড়ে। সকল উঁই জন্মায় কর্মকার হয়ে।
এই ঢিবির সব পোকা মেরেও কোন লাভ নেই। কিন্তু শুধু রাণীটাকে মেরে ফেলতে পারলে কেল্লা ফতে। রাণী সব সময় থাকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠের সবচে সুরক্ষিত অংশে। তার আকৃতি সবচে বড় এবং আঘাতে মারা না যাবার সম্ভাবনা সবচে বেশি।
তিনি বললেন, আমরা প্রতিনিয়ত ঠিক করি, ভাল কাজ করব, সময়ানুবর্তী হব। জীবনটাকে এমন একটা কর্মপথে নিয়ে যাব, যা শুভ ও সুন্দর। যার কারণে আমরা এসেছি।
কিন্তু বাস্তবে হয় না। একটা সমস্যা, একটা বাঁধাকে টপকাই, আরেকটা চলে আসে, সেটাকে টপকাই, আগের বাঁধা পুনর্জন্ম নেয়।
আগামী কাল সকাল দশটা পর্যন্ত আমরা নিশ্চুপ থাকব। এবং সমস্ত ভাবনার পিছনে শুধু একটা বিষয়কে নিয়ে আসব, আর তা হল, আমার মনের এই রাণী উঁই পোকাটা কে?
নিরবতা করেছিলাম, এবং জবাব পেয়েছি।
আমি যা ঠিক করি, তা করি না। এছাড়া আর কোন সমস্যা নেই। দর্শনে নেই, বিদ্যায় নেই, সংস্কারে নেই, যা ঠিক করি, সেই ঠিক করা বিষয়টাতেও নেই।
কর্মবিষয়ে আজীবনের জন্য দর্শন ঠিক করে নিলাম: (অনেক ভেবেচিন্তে, বুঝে, শুভ জেনে...) যা ঠিক করব, ঠিক তাই করব।
শুধু একটাই ভরসা, রাসূল দ. বলেছেন, সেই ব্যক্তিই উৎকৃষ্ট যার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সৎকর্ম বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয় দর্শন: তৃপ্তি-সুখ-
অনেক বেছে যা উপলব্ধিতে এল, সম্পদ, সম্মান, স্বাস্থ্য, প্রজ্ঞা, সমাজ- এই কোনটাই সুখ দিতে পারে না এবং সুখের কারণে পরিণত হতে পারে না।
মানুষ অত্যন্ত অতৃপ্ত হয়ে সেইন্ট মার্টিন বিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখেছি এবং সেটা কোন প্র্যাক্টিক্যাল কারণ ছাড়াই। ভিক্ষুকের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখেছি। রিকশাচালকের মুখে।
সুখটাই সব। তৃপ্তি এবং সুখের জন্যই খাওয়া, আয় করা, পড়া, সেবা করা। বেঁচে থাকা। যেকোন অবস্থাতেই সুখে থাকা যায় এবং যে কোন অবস্থাতেই অসুখে থাকা যায়। সুখের পিছনে যে দর্শন আছে, সেই দর্শনটা ধারণ করতে পারলেই সুখ ও দু:খ আপন করায়ত্ত্ব।
পৃথিবীতে চাওয়ার কিছু নেই। পাওয়ার কিছু নেই। না পাবারও কিছু নেই। পৃথিবীর আয়ুর ক্ষেত্রে বা মহাবিশ্বের আয়ুর ক্ষেত্রে একজন মানুষ ধূলিকণাও নয়। একটা ধূলিকণা এক ফুট উপর থেকে পড়তে থাকলে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত সেটা যেমন অনুল্লেখ্য, প্রায় অদৃশ্য, ভরহীন, মূল্যহীন এবং সংক্ষিপ্ত সময় পরিভ্রমণকারী- আমরা প্রতিটা মানুষই প্রকৃপক্ষে তাই।
এই অনুল্লেখ্য জীবনকে কী পরিমাণ বিতৃষ্ণা, অসুখ, কষ্ট দিয়ে ভরিয়ে দিই আমরা শুধু আমাদের পেটভরা অবিদ্যা দিয়ে! খাইতে পাইনাই এবেলায়, তাই অসুখ। পেট ভরে খেতে পাইনাই, তাই অসুখ। আবার বেশি খেয়ে ফেলেছি, তাও অসুখ। অসুখের অতৃপ্তির শেষ নাই।
চাওয়া এবং চাওয়ার কারণ, পাওয়া এবং পাওয়ার কারণ, নিজের পাওয়া এবং বর্তমান পৃথিবীতে বাকি সাতশো কোটির পাওয়া, বিগত পৃথিবীতে একুশ হাজার কোটির পাওয়ার সাথে যখন তুলনা দিব, তখনি আর যাই থাক, অসুখ থাকবে না।
সুখের অভাবই অসুখ। আর অসুখ থেকে অসুস্থতা, শারীরিক বা মানসিক বা সামাজিক। অসুখ থেকেই অপ্রয়োজনীয় ক্ষুধার জন্ম। প্রয়োজনের সীমানা বাড়িয়ে যাওয়া। সম্মানের ক্ষুধা, ক্ষমতার ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষুধা।
হায়, যে সুখের জন্য এই ক্ষুধা, সেই স্বয়ং সুখটাকে কেউ চায় না। চাওয়া শুধু উপকরণকে। জিগ্যেস করুন, এই উপকরণ কেন চাও? সুখের জন্য। একটু শান্তি, একটু তৃপ্তির জন্য।
তাহলে উপকরণ না চেয়ে, বরং সুখটাকেই চাও। জগতে শুধু এই একটা জিনিস অক্সিজেনের পাশাপাশি ফ্রি আছে। আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে বেহেস্ত সরিয়ে নিয়েছেন, শুধু দিয়ে দিয়েছেন বেহেস্তের সুখটা। ঠিক বেহেস্তের মতই যত খুশি, যখন খুশি নেয়া যায় এ সুখ।
তাই দ্বিতীয় দর্শন, প্রতি মুহূর্ত আনন্দের করব।
তৃতীয় দর্শন: আত্মপরিচয়-
জগতে যাকেই দাস করা হয়েছে, তারই আত্মপরিচয় প্রথমে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। জগতে যারই আত্মপরিচয় মনে ছিল, সেই সফল এবং বিজয়ী।
বাঘ জন্মে বাঘ হয়ে। তাও সে বাঘ হতে পারে না, যদি মায়ের সাথে শিকারে অভ্যস্ত না হয়। তার বাঘজন্ম বৃথা।
আমরা মানব হয়ে জন্মেছি, কিন্তু মানবের অনন্ত কল্যাণের সম্ভাবনার কিয়দংশও আমরা অনুভব করিনি। আমরা শুরু থেকে যা জেনেছি তা হল, আমি পারি না। আমার মাথায় গোবর ঠাসা। চাইলেই যে কোন কিছু মুখস্ত করা সম্ভব নয়। আইনস্টাইন ব্রেইনি। বিল গেটস ব্রেইনি। উসাইন বোল্ট পরিশ্রমী। আর আমি লাউয়া।
অথচ আমরা এমনধারা বিজয়ী যে, আমাদের অর্ধাংশই জন্মের আগেই পঞ্চাশ কোটির সাথে রেস করে জিতেছে। বাকি অর্ধাংশ সেই বিজয়কে এত প্রাধান্য দিতে পেরেছে যে, এই একাংশকে নিয়ে বাকি পঞ্চাশ কোটির আঘাত সয়েও নিজেকে রিজার্ভ করে নিয়েছে। এই হল শুক্রাণু এবং ডিম্বানুর ঘটনা। বিজয়ের জন্য সামনে এগুতে হবে এবং বিজয়ের জন্য নিজেরটুকুকে ঠিকমত চিনে সংরক্ষণ করতে হবে। জন্মের আগের সেই শিক্ষা আমাদের ভিতরে নেই।
আমরা এমনধারা সম্পদশালী যে, কোন মানুষ যদি একশ একরের মালিক হয়, এবং আড়াই একর চাষ করে, তাকে গরিব বলা যায় না। বড়জোর মূর্খ বলা যায়। এই হল আমাদের ব্রেইন।
আমরা যা দেখি, যা শুনি, যা পড়ি, যা জানি, যা উপলব্ধি করি জীবনে একবার, মায়ের গর্ভে থাকতেও, তার সবই আমাদের ব্রেনে আছে। তারপরও বোকা গাধার মত ঘানিচক্রে ঘুরে বেড়ালে দোষ কার?
দোষ আমার। আমি আত্মপরিচয় জানি না। আমি সামান্য। কথা সত্যি। আমি একশ কেজি মাংস-রক্ত-হাড় আর বাতাসের সমন্বয়। কথা সত্যি। পচনশীল দ্রব্য থেকে জন্মেছি, পচনশীল দ্রব্যে মিশে যাব। কথা সত্যি।
কিন্তু আমার ভিতরে যিঁনি নিজ থেকে ফুঁকে দিয়েছেন, তিনি অনন্ত। তাই আমার চালিকাশক্তি অনন্ত। আমার ক্ষমতা অনন্ত। আমার আদেশ অনন্ত। সম্ভাবনা অনন্ত।
আমরা আক্ষরিক অর্থেই যা চাই তা করতে পারি, শুধু আমি কে, এই বিশ্বাসটা থাকতে হবে। এই আত্মপরিচয় সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মূলভূমি হল নিজ মন। যে নিজ মনে জানে, সে কে, তার আর বিজয়ের কিছু বাকি নেই।
হিমালয় এমন কোন মহার্ঘ্যবস্তু নয়, যে তা বিজয় করা যাবে না।
তাই তৃতীয় দর্শন, আর কোথাও প্রয়োজন নেই, নিজমনে সর্বক্ষণ আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করব। নিজের জমি বাদ দিয়ে পরের জমি যে চাষ করে, সে তো বর্গাচাষী। আর নিজের জমি যে চাষ করে, তাকে চাষী বলে না, বলে বাগন করছে।
অন্যের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। বরং যদি তাকে তার কাছে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া যায়, সেটাই কাজ।
এইতো, এই তিনটা বাক্য নিজেকে মনে করিয়ে দিই,
যা ঠিক করব, ঠিক তাই করব।
প্রতি মুহূর্ত আনন্দের করব।
আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করব।
আজকে দিনটাও এ ভাবনা দিয়ে শুরু করলাম। শুভ নববর্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:২০