হাফিজি মাদ্রাসায় দেয়ার কথা কখনো ভাবিইনি। উদারতা নষ্ট হয়ে যাবে, একটু গোঁড়ামি চলে আসবে। মনোদৃষ্টি ক্ষীণ হবে। বড়জোর এগুলো পরবর্তীতে অর্জন করবে।
শিক্ষক রেখে পড়ানোর কথাও ভাবিনি। শিক্ষক পড়াবেন কনভেনশনাল পদ্ধতিতে। তার সাথে শাস্তির বিষয়টা থাকে। সবচে বড় কথা, আর্থিক সামর্থ্যও নেই।
শুভকামনা প্রত্যাশায় এই লেখা। পদ্ধতির আদান প্রদানের আশায়। আরো ঋদ্ধ কীভাবে করা যায় সেই ভাবনায়।
নিজেই শুরু করলাম ওকে পড়ানো। সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যাটাটাকে। গত দেড় বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। রোসেটা স্টোন ইন্সটল করে আরবি শিখলাম কিছুটা। দুইজনেই প্র্যাক্টিস করি। একটা পিডিএফ ডাউনলোড করে নিয়েছি, যেটায় কুরআনের ৮০% শব্দ আছে। চাইলে একদিনে শিখে ফেলা যায়। শব্দগুলো শিখাচ্ছি ও শিখছি মাঝে মাঝে। ইংরেজি আর বাংলা প্রতিশব্দ সহ। কুরআনের লার্নিং তেলাওয়াত ডাউন করেছিলাম বছর পাঁচেক আগেই। সেটা থেকে শুদ্ধ (খানিকটা বোরিঙও) উচ্চারণ নিজে শিখছি, শেখাচ্ছি। একটা আইওএস অ্যাপ ইন্সটল করে নিলাম। মেমোরাইজ কুরআন। একেকটা আয়াত আলাদা আলাদাভাবে পড়ে শোনায়, আবার সিলেক্ট করলে একাধিক বা পুরো সূরা।
যা সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে বিশ্বাসী আগে থেকেই। আমি নিজেই জানি না আরবি গ্রামার, সেটা জানার জন্য ষাট ঘন্টার ভিডিও কোর্স নামালাম। অবশ্য কোর্সটা বাংলা না।
কিন্তু ওকে গ্রামার ধরে কিছুই শিখাবো না। মাত্র আলিফ বা সবগুলো মুখস্ত পারে। ব্যস। যের যবর পেশ কিছুটা ধরতে পারে। এর বেশি এখন শিখাবো না। শুধু শব্দ আর শব্দের অর্থ (যদি জানা থাকে)।
শিখানোর টেকনিকটা খুবই সিম্পল। শেষ পারার তিরানব্বই নাম্বার সূরা থেকে ধরেছি। দ্বোহা। প্রথমে একটা করে শব্দ বলি। সেই শব্দটা ও শুদ্ধভাবে বলা শুরু করার আগ পর্যন্ত রিপিট করি। তারপর তাকে বলতে দিই। একটা করে আঙুল দেখাই। এভাবে শুদ্ধভাবে দশবার বলাই। এরপর পরের শব্দে চলে যাই। এভাবে পুরো সূরা।
এই প্রক্রিয়া চলাকালে সাহেব কখনো চক দিয়ে ডাবগাছের ছবি আঁকেন তো কখনো মাঝে মঝ্যে আমাকে শিশিমারু মোটু পাতলু নিনজা কা ছুপনে কা টেকনিক শেখান। কখনো সোফার কুশন দিয়ে ঘর বানান। সবই করা যাবে, খেলা যাবে, শুধু উচ্চারণটা ঠিকমত রিপিট করতে থাকতে হবে। তার সয়ে গেছে। সে টের পায় না, কিন্তু শুদ্ধভাবে বলেই ফেলে। মোটামুটি।
যখনি উচ্চারণ ভুল হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, ডেকে সামনে এনে বসাই, তারপর বলি, ঠিকমত বলতে না পারলে এখানে বসে বসে পড়তে হবে। কোন্ শিশু আর বসে বসে পড়তে চায়? উচ্চারণ ঠিক হয়ে যায়।
ডাউনলোড করলাম অ্যারাবিয়ান সিনবাদ কার্টুন এত কষ্ট করে! শেষে দেখি কিনা সেটা জাপানিদের বানানো, পোশাকবিহীন জলপরী আছে অনেক পর্বেই। এখন আবার ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার নামিয়ে ওই ফ্রেমগুলো কেটে এডিট করে তাকে দেখতে দেয়ার হ্যাপা আছে সামনে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা পেইড কার্টুন অ্যারাবিয়ান লার্নিং সিনবাদ নামানোর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কোথাও পেলাম না। মাত্র পঞ্চাশ মিনিট পেয়েছি। ওটাই দেখে মাঝে মাঝে।
তো শব্দের পর শব্দ শেখানোর পর বাক্য (আয়াত) টা শেখাই। তাও চাপ দিয়ে না। আমি বারবার বলি, সেও বলে। এরপর পুরো সূরাটা আমি বলতে থাকি, সে সাথে সাথে বলতে থাকে। অবশেষে আইফোন ফাইভ হাতে তুলে দিই। পুরো সূরা প্রথমে স্লো মোশনে ছাড়ি। ইন্টারভাল থাকে প্রতি আয়াতে। ওই ইন্টারভালে সেও উচ্চারণ করে। এরপর একটু একটু করে স্পিড বাড়াই (কুরআন মেমোরাইজ অ্যাপ)। তারও স্পিড বাড়ে। কোন আয়াতে একবার উচ্চারণ ভুল করলে ওটা রিপিট প্লে মেরে দেই। ব্যস। ঠিক। সবশেষে সর্ব্বোচ্চ স্পিডে সাথে সাথে পড়তে পারলেই পুরস্কার। টেম্পল রান টু। ফ্রুট নিনজা। স্পাইডারম্যান গেইম খেলা।
প্রতি সূরা শেষ করতে পারলে আরো বড় পুরস্কার। পনির। টম অ্যান্ড জেরি দেখতে দেখতে তার পনির প্রিয় হয়ে গেছে। তারপর আছে তাকে নিয়ে গল্প বলা। যে প্রাণী দেখতে চায় ওটাকে গুগল ইমেজ সার্চ করে দেখানো। বর্ণনা দেয়া। বিজয় বাংলা শিশুশিক্ষার সফটগুলো ইন্সটল করে দিয়েছি। নিজে নিজেই অনেকটা বাংলা ইংরেজি আর সংখ্যা অঙ্ক শিখছে। পাশে শুধু বসে থাকতে হয়।
আশার কথা হল, কুরআন মেমোরাইজ করার সবচে বড় যে পুরস্কারের আশায় সে বসে আছে, সেটা একটা গেইম। বলেছি, পুরোটা মুখস্ত করো, একমাস রাইজ অভ নেশন খেলতে দিব। আহা, আমার সবচে প্রিয় গেইম এখন তারও সবচে প্রিয়।
এর বাইরে ধর্মীয় ইন্সপায়ার তো আছেই। সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সে কি চায় তার প্রিয় নবীজি তাকে আরো ভালবাসুক? আল্লাহ তাকে প্রিয় করে নিক? সে কি চায় ওয়ালিউল্লাহ্ হতে? হ্যা। খুবই বেশি পরিমাণে চায়। নবী দ. কীভাবে কথা বলতেন, যে সূরাটা পড়ছি সেটার সময় নবী দ.'র কী অবস্থা ছিল, এইসব গল্প তাকে প্রচন্ড উৎসাহিত করে। কুরআনে যে অসাধারণ সব গল্প আছে সেটা আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না। সেই্সব গল্প খুজে বের করি, তাকে জানাই।
এর বাইরে গোণা গুণতিতে সওয়াব বাড়ার হিসাব তো আছেই। যে কুরআন শেখে ও শেখায় সেই শ্রেষ্ঠ- এইসব কথা তো আছেই। তুমি নিজে বেহেস্তে যেতে পারবে এবং দশজনকে নিতে পারবে, সে বন্ধুদের লিস্ট করে, কাকে কাকে নিয়ে যাবে।
এবং সবশেষে আসল টেকনিক, প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার পর প্রথমে তার পাশে শুয়ে শুয়ে আচ্ছামত তার প্রশংসা করি। আমার বাবাটা কত্ত ভাল, এই, সেই। সবশেষে ছেড়ে দেই এদিন যে আয়াতটুকু পড়েছে, সেই আয়াতটুকু। রিপিট দিয়ে। ঘন্টা দুয়েক চলে। পরদিন আরো শার্প।
ইচ্ছা আছে, ওকে এভাবে পুরো কুরআনের সাথে প্রথমে তীব্র অভ্যস্ত করব। তারপর প্রতি রাতে পুরো কুরআন খতম হবে আমাদের ঘুমের ভিতরে। মনের অবচেতন স্তরে গেঁথে যাবে সবটুকু।
কুরআনে অভ্যস্ত করতে মাস তিন থেকে চারেক সময় নিব। অভ্যস্ত বলতে অনেকটা নজরানা পাঠের মত। এরপর দুইজনে খতম দিতে থাকব।
হয়ত বছর দেড়েক পর দেখা যাবে কুরআন আত্মস্থ হয়ে গেছে আমাদের দুজনেরই। বিশেষ করে ছেলেটার জন্য সবার দোয়া ও শুভকামনা প্রত্যাশা করছি।