বেলা সাড়ে একটা। অন্তত মামুনের তাই মনে হয়। সাড়ে বারোটা হতে পারলে সাড়ে একটা হওয়াটা কি বেস্বাভাবিক? কে যেনো একবার ধমক দিয়েছিলো সাড়ে একটা। রেগে মেগে মামুন বলেছে, আমার ইচ্ছে হলে সাড়ে দুটোও বলবো, সাড়ে তিনটা হলে সাড়ে দুটোও হবে। তাতে কার কি আসে যায়। কারোই কিছু আসে যায় না। কিন্তু আজ চিঠিটা না পাঠালে মামুনের অনেক কিছু আসে যায়।
পোস্ট অফিসের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটু রোমান্সিত। মাসের আজ পাঁচ দিন বয়স। পাঁচ তারিখের ভেতরেই নাটোরে চিঠিটা পাঠানোর কথা তার। প্রতি মাসেই পাঠায় পাঁচ তারিখের ভেতরে।
এ মাসে টাকা পয়সার বড্ড টানাটানি। টানাটানি ব্যাপারটা অবশ্য প্রতিমাস এবং প্রতিদিনের। এ মাসটা তাহলে টানা হ্যঁচড়ার। নাকি হ্যাঁচড়া হেঁচড়ির?
পকেট থেকে ন্যাতনেতে পচা ন্যাকড়ার মতো একটা দুই টাকার নোট বের করলো সে। কাউন্টারের ভিতর টাকা ধরা হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
পোস্ট মাস্টার টাকাটা হাতে নিলো খুব সাবধানে, যেনো কাঁচের কোনো জিনিশ, ভেঙে যাবে। খুব সাবধানে দু’হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো।
এই পোস্টমাস্টার আবার কারো মুখের দিকে তাকায় না। বড়ই বদমায়েশ। চাঁড়ারের মতো ব্যবহার। মামুন ভাবলো, নোটটা ছুঁড়েই না ফেলে দেয়। একদিন কলম চেয়েছিলো খামে ঠিকানা লেখার জন্য। বেজায় ধমক দিলো ব্যাটা। আঠা চেয়েতো একবার মহা মসিবতে পড়ে গেল। ব্যাটা সৃষ্টি রহস্যের দিকে চলে যাচ্ছিলো, আর একটু হলে বান্দর-টান্দর বলে সারতো।
পোস্ট মাস্টার টাকাটা ছুঁড়ে ফেললো না। মাথা নিচু অবস্থাতেই বিশ্রিভাবে তাকালো ওর দিকে। মামুন যতটা সম্ভব মুখটা করুণ করে রাখার চেষ্টা করলো। যাতে তার করুণ মুখের ভাবে ফুটে ওঠে ‘কাকা ওটাই একমাত্র সম্বল, ওটা আপনি না নিলে লিজার কাছে চিঠি লেখাই হবে না’।
লোকটার বোধহয় আজ সকালে নাস্তা ভালো হয়েছে, তাই মনটা ভালো। একটা খাম এগিয়ে দিলো।
মামুনের ধারনা, পোস্ট মাস্টার ভদ্রলোকের প্রতিদিন সকালের নাস্তা আগের রাতের পানি দেয়া ভাত। তা না হলে লোকের সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে কেন।
মামুন সুন্দর করে হলুদ খামের বুকে অন্ধকারের রঙে ঠিকানাটা লিখলো। সিলো কলমটা লিজার গিফ্ট্। এটা ওর বড় ভালোবাসার জিনিশ। লেখা শেষে একটা চুমু খেয়ে বুক পকেটে রাখলো সে ওটা। কলমটার গায়ে লিজার স্পর্শ লেগে আছে। চুমুটা কলমকে নয় স্পর্শে।
ঠিকানাটায় আরেকবার চোখ বোলালো সে, ‘ববি, কেয়ার অব- মহিদুল হক, থানাপাড়া, মল্লিকহাটি, নাটোর’। হ্যাঁ ঠিক আছে।
ববি হচ্ছে লিজার বন্ধু। সরাসরি লিজার বাসার ঠিকানায় চিঠি লেখা যায় না। ওর মা’র হাতে পড়লে খবর আছে। তার চে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা ভালো। ওর মা ডেঞ্জারাস মহিলা। লিজার কাছে শুনেছে তেনারাও নাকি ইয়ে করে বিয়ে করেছেন। আর মেয়েকে ইয়েটাও করতে দিচ্ছেন না। ছোটবেলার এই প্যাকেজ প্রেমটা সবাই করে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলা ছোট বলে কোনো জিনিশকে অবহেলা করতে শেখেননি। ধরতে পারলে ঠ্যাং ছিড়ে ফেলবে। এই হুমকি অনেকবার অনেককে দিয়েছেন তিনি। মুখ দেখে বোঝার কায়দা নাই এতো দজ্জাল মহিলা।
ববি ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মামুনের মনটা ভরে গেল। এই ছেলেটা যদি না থাকতো, ওর এতো বড় উপকার কে করতো। এই ববি বেচারা যদি ধরা খেয়ে যায় লিজার মায়ের হাতে, তবে বেচারার কি দশা হবে কে জানে।
মামুন পকেট থেকে মোটা সোটা চিঠিটা বের করে খামের পেটে ভরলো। মামুন কত মোটা-মোটা বড়-বড় চিঠি লেখে। আর মেয়েটা! ছোট্ট ছোট্ট চিঠি দেয়। লিজার লেখা প্রথম চিঠিটা বোধহয় কোনো প্রেমিককে লেখা কোনো প্রেমিকার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম চিঠি; মাত্র দুটো লাইন। মেয়ে মানুষ! বড় নিষ্ঠুর জাত, কষ্ট দিয়ে মজা পায়। একটু বড় চিঠি দিলে কী হয়!
সে খামের আঠা লাগা জায়গাটায় একবার চেটে দিলো, ভেজার জন্য। বেশি ভিজলে আঠা নষ্ট হয়ে যাবে। আটা চাইতে গেলে পোস্ট মাস্টার সৃষ্টি রহস্যের গালাগালি দেবে।
এামুন আশেপাশে দেখে নিলো লোক আছে কি না, যেনো এক্ষুনি একটা অবৈধ কাজ করে ফেলবে। খামের বুকে আয়েশ করে একটা চুমু খেলো সে। এই আদরটা চিঠি যাকে লেখা তার জন্য। চিঠি হাতে নেবার পর আদরটুকু তার হাতে লেগে যাবে। তবে অনেক কায়দা ফ্যাসাদ করে তারপর। এই খাম বাক্স থেকে বকেজন টেনে বের করবে, পোস্টমাস্টার হাত দিয়ে ধরে ধুপধাপ সিল্ মারবে, আলাদা করবে। তারপর আবারো বাক্স...গাড়ি। নাটোর পোস্ট অফিস সেগুলো ঘেঁটেঘুঁটে আলাদা করবে, ডাকপিয়ন দেবে শুভর হাতে; শুভ বইয়ের ভেতর করে দেবে লিজার হাতে। আদরটুকু বাসি হয়ে যাবে। যাই হোক, তবুতো যাবে। মাত্র দুই টাকায় এই আদর ভালোবাসা এত দূরে চলে যাচ্ছে, এটাই কতো! মামুনেরতো ইচ্ছে হচ্ছে পোস্ট বাক্স, ডাকগাড়ি, পোস্টমাস্টার সবকটাকে একটা করে চুমু খেতে। সে চিঠিটাকে বাক্সে ফেললো। দু’পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে বর করে বাক্সের ফুটো দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, চিঠিটা পড়েছে কি না। হ্যাঁ, পড়েছে। মামুনের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। এই চিঠি যদি না পৌঁছে! লিজা মাঝে দুটো চিঠি পায়নি। এই চিঠিতে অনেক জরুরি কথা লেখা আছে। লিজা চিঠি পায়নি শুনে সেবার ডাক বিভাগের উপর প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিলো তার। এই চিঠি যদি মিস্ হয়ে যায়!!!
বাসার দিকে হাটছে মামুন। সুন্দর রোদ। চৈত্র মাস, আকাশ ফাটাফাটি নীল। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে রিকশার নিচে পরার ভয় আছে। রাস্তাদিয়ে রিকশায় করে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা যাচ্ছে। স্কুলড্রেস পরা মেয়েগুলোকে দেখতে তার বেশ লাগে। কিন্তু একবারের বেশি দেখে না, লজ্জা করে।
পথের উপর একটা শিরীষ ফুল পড়ে আছে। মামুন সেটা তুলে নিলো। কি অদ্ভুত সুন্দর রঙ। লিজা কি কখনো শিরীষ ফুলের এই অদ্ভুত রঙ খেয়াল করেছে? ও বড় আনমনা। কিছু খেয়াল না করিয়ে দিলে খেয়াল করে না। অথবা করে হয়তো, নিজের ভেতরে রাখে, প্রকাশ করে না। করা উচিৎ। সৌন্দর্য ব্যাপারটা একা উপভোগ করার জিনিশ না। কোনো সৌন্দর্য দুজনে মিলে উপভোগ করলে পূর্ণতা পায়। ভাল লাগা কোনো কিছু ওর সাথে শেয়ার না করতে পারলে সৌন্দর্য জিনিশটায় কিসের যেনো একটা কমতি আছে মনে হয়; পুরা হয়না। এই ফুলটা আসার পথে পেলে খামে ভরে দেয়া যেতো। যাই হোক, ভাবলো মামুন, আগামী চিঠিতে অবশ্যই একটা শিরীষ ফুল মনে করে চিঠির ভেতর দিয়ে দিতে হবে। মনে থাকবে না হয়তো। এখনো একমাস, আবার আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। ক্যালেণ্ডারের আগামী মাসের পাঁচ তারিখের গায়ে শিরীষ ফুলের বিষয়টা লিখে রাখতে হবে।
আজ মামুন স্কুলে যাবে না। এখন স্কুলের সবচে’ সিনিয়র ক্লাসে পড়ে সে। এখন কি আর স্কুল করতে ভালো লাগে?
লিজার জন্য মাঝে মাঝে খুব কান্না পায়। ওকে খুব মিস্ করে সে। লিজাও কি ওকে ঠিক ওর মতো করে মিস্ করে? কখনো কি একলা বসে দরজা বন্ধ করে কাঁদে? কে জানে!
আজ মা বাসায় নেই। দরজার তালা খুলেই মামুন দেখলো মেঝেতে একটা হলুদ খাম পড়ে আছে। লিজার হাতের তারার মতো জ্বলজ্বলে হরফে লেখা ওর নাম। খুশিতে ওর চোখে পানি চলে আসলো। লিজা কথা রেখেছে। পাঁচ তারিখের ভেতর চিঠি লেখার কথা। ঠিক পাঁচ তারিখেই চিঠি দিয়েছে। মাঝে মাঝে যখন খুব আশা করে, আজ চিঠি আসবে; ভাবে দরজা খুললেই চিঠি পড়ে থাকতে দেখবে। কিন্তু আসেনা। চিঠি পড়ে থাকে না, খুব হতাশ হয়। এই হতাশ হওয়াটাও ভালো লাগে। আবার অপ্রত্যাশিতভাবে যখন চিঠি পায় তখনো ভালো লাগে, যেমন আজ। সে খামটা তুলে নিয়ে গালে ছোঁয়ালো। সে ভাবতে ভালোবাসে লিজাও বুঝি আদর দিয়ে খামটা ছেড়েছে। কিন্তু দেয়না আসলে। কারণ ওর এসব আবেগ কম। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না।
মামুনের তর সইলো না। খামটা খুলে ফেললো সে। যদিও লিজার বেশির ভাগ চিঠি সে মধ্যরাতে পড়ে। জুয়েলের গানটার মতো—“মধ্যরাতের চিঠি মধ্যরাতে, অনাবিল মমতায় প্রেয়সীর প্রীতি...”। সে চিঠিটা পড়া শুরু করলো। শাদা কাগজ জুড়ে কালো কালো তারার মেলা। শিরোনামহীন শুরু.....
কেমন আছো? আমি একটুও ভালো, আমার অবস্থা খুব খারাপ। আমি যে কিভাবে তোমাকে চিঠি লিখছি তা শুধু আমিই জানি। বিস্তারিত লেখা সম্ভব না। মামুন ভুলে যাও মামুন আমাকে। জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। তারপরেও বলছি ভুলে যাও। কি হবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে। তুমিতো আমাকে পাবে না। তুমি আমি চাইলেও আমার পরিবার পরিবার মানবেনা। আমি জানি সামনে তোমার পরীক্ষা। আমার অনুরোধ তুমি পরীক্ষাটা ভালো করে দাও। আর উল্টাপাল্টা কিছু করো না। আমি তোমার জীবনের চারটা বছর নষ্ট করেছি। এর জন্য দুঃখিত আসলে সত্যিই যারা ভালোবাসে তাদের কপালে বুঝি এমনই হয়। আমিও তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবো, জানিনা পারবো কি না। ধরে নাও, এটাই আমার শেষ চিঠি। আমি অনেক কষ্টে শুভকে রাজি করিয়েছি এই চিঠিটা যেনো অন্যেও হাতে না পড়ে ও সেটা দেখবে। মনে রেখো এই চিঠিটা হবে শেষ চিঠি। এর পরে চিঠি লিখলেই সরাসরি মায়ের হাতে পড়বে। যদি কোনো দিন সামনা সামনি কথা হয় সব ঘটনা বলবো।
ভালো থেকো।
ইতি............
কিছুক্ষণ আগের ভেজা চোখ দুটো মামুনের আবার ভিজে উঠলো। এই ফোঁটা কতক পানি কত না অর্থবহ।
কিছুক্ষণ আগের ভেজা চোখ আর এখনকার ভেজা চোখের কত না ব্যবধান।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




