ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাস নিয়ে ইদানিং খুব আগ্রহ জেগেছে। বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে এক জায়গায় লেখা দেখলাম , আগেকার বাংলা নাকি খুব সমৃদ্ধ এলাকা ছিল। এই ব্যাপারটা আগে খুব একটা দেখি নি।আজন্ম আমাদের এই বাংলায় খালি অনুন্নত বা আরেকটু ভদ্রভাবে বললে উন্নয়নশীলের ট্যাগ লাগানো। কেমন ছিল আগেকার সম্পদশালী বঙ্গদেশ? এখনকার এই অবনতির কারণই বা কি?ব্যাক্তিগত কৌতুহলে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি।
বাংলা বা বেঙ্গল বলতে এখন মূলত বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ বোঝায়- আগে অবিভক্ত বঙ্গদেশ বলে পরিচিত ছিল। যতটা না আমরা জানি তার চাই্তেও অনেক অনেক আগেকার পুরানো এখানের সভ্যতা- ২০ হাজার বছরের অতীত পর্যন্ত ট্রেস মিলবে। প্রায় চার মিলেনিয়াম বছরেও এখানে মানুষ বসতির অস্তিত্ব ছিল-জেনে অবাক লাগলো খুব।এখন পর্যন্ত যা নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে সুস্পষ্ট জীবনপ্রণালী, স্থাপত্য, নাগরিক ও প্রশাসনিক কাঠমোর ইঙ্গিত মেলে অনেক প্রাচীন কাল থেকেই। খুব পুরানো বলে যারা পরিচিত, যাদের সভ্যতা প্রাচীনত্ব ও উন্নতির দিক দিয়ে মানব সভ্যতায় অবদান রাখার জন্য বিশ্বখ্যাত যেমন মিসর , ইরাক , গ্রীস, রোম , চীন , পেরু এসবের কোনটিই এখনকার দুনিয়ার ধনে মানে কি জীবনযাত্রার স্ট্যান্ডার্ডে আর পৃথিবীর নেতৃত্ব দিচ্ছে না। পুরানো এককালীন গৌরবই এদের একমাত্র অহংকার। আর আমাদের তো নিজস্ব ইতিহাসের অবশিষ্টই খুব একটা নেই, এমনকি আমাদের স্মৃতিতেও । কেন?
''বাংলা''র উদ্ভব ১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব দ্রাবিরিয়ান শব্দ থেকে বলে একটা সূত্রে প্রকাশ। কিন্তু এর সীমানা বার বার পরিমার্জিত হয়েছে, বিবর্ধিত হয়েছে বঙ্গ( দক্ষিণ বাংলা) পুন্ড্র( উত্তরবঙ্গ), সুহমা'য়( পশ্চিমবঙ্গ)। মহাস্থানগড়ে পাওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনটা ৭০০ খ্রি: পূ: সময়ের , পুন্ড্র রাজত্বের রাজধানী ছিল।যারা গিয়েছেন বা ছবিতে দেখেছেন , তারা গোটাটা ধ্বংসস্তুপের উপরেও একটি সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা দেখতে পাবেন। অতটা আমাদের এই হিজিবিজি বর্তমান অতিআধুনিক নগরকাঠামোতেও পাওয়া যাবেনা। এখনকার নাগরিক কি গ্রামীন , পুরোটাই বিশৃঙ্খল অবকাঠামোর নড়বড়ে জঙ্গল হয়ে উঠেছে। শহরগুলো যেন কংক্রিটের এলোমেলো কালেকশন।
ঐতিহাসিকভাবেও সংঘাতপ্রবণ বাংলা খুব কম সময়ই একই নেতৃত্বের অধীন ছিল । তাও এর ধন , শক্তি , গর্ব কিন্তু কম ছিলো না।প্রাচীন ভারতের বিশেষত বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী সমুদ্রসীমার বাইরে দক্ষ নৌনির্ভর লেনদেনে রাজ্যের বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল জাভা, সুমাত্রা, শামদেশ( এখন থাইল্যান্ড) এর সাথে।
বাংলা একসময় এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে দ্বিগবিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারও এখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন।এটা খ্রিষ্ট পূর্ব৩২৬ সালের ঘটনা। গ্রীক ও ল্যাটিন ঐতিহাসিকদের মতে , এই সিদ্ধান্তে তাকে প্ররোচিত করেন তারই সবচেয়ে দক্ষ ও বিশ্বস্ত জেনারেলদের একজন, Coenus । তাদের ভয় ছিল তৎকালীন বাংলার Gangaridai ও বাংলা, ভারত, নেপালের কিয়দাংশের অধিকারী নন্দ (Prasii)সামাজ্যের মিলিত পাল্টা আক্রমণের। ভয়টা বেশী ছিল Gangaridai রাজাদের ক্ষমতাকে নিয়েই , গ্রীক ইতিহাসবিদ Diodorus Siculus যাকে অখন্ড ভারতের সবচে শক্তিশালী রাজত্ব বলে অ্যাখায়িত করেছেন। এর রাজধানী কোথায় ছিল জানেন কি?এখনকার গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া! তখনও এই এলাকা এই অঞ্চলে বিদেশী বহিরাগতের থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করায় এক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। দলমতে পার্থক্য থাকলেও অধুনা স্বাধীনবাংলার জন্মের পেছনে একই জায়গার সন্তান শেখ মুজিবের প্রভাবশালী ভুমিকার কথাও কে না স্বীকার করবে।ইন্টারেস্টিং কাকতালীয় মিল বলতে হবে।পরের মানুষটার স্বাধীনতা যুদ্ধে এককভাবে কৃতিত্ব দেয়ানেয়া বাড়াবাড়ি , এমনকি কিছু পরিমাণে ব্যাক্তিপূজার পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু তাঁর নিজসময়ে নানা স্বার্থে নানা ভাগে বিভক্ত জনতাকে এক করায় তার ক্যারিশমার কথা কট্টর বিরোধী মানবে। ব্যাক্তি মুজিবের খুঁত বের করা যাবে, রাজনীতির স্বার্থ তাঁর হয়তো ছিল, হয়ত না। কিন্তু দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সময়ে তাঁর নেতৃত্বের মাধ্যমে একটা লিডার ফিগারের প্রভাব যা কিনা অবস্থার প্রক্ষিতে সময়ের দাবী ও দরকার হয়ে উঠেছিল তা সেটা যার কাছ থেকেই আসুক- বিবেচনা করলে মুজিবের কৃতিত্বটা ইতিহাসে দিতেই হবে। যাহোক,ফিরে যাই আরও সুদূর অতীতে। সম্রাট আলেকজান্ডার এই রাজ্যের সামরিক শক্তিতে এমনকি শুধু হস্তিবাহিনীর সামর্থ্যের ব্যাপকতায় চিন্তিত হয়ে ওঠেন। এই রাজ্যটি কতটা শক্তিশালী ছিল তার আন্দাজ , তার ২ লক্ষ পদাতিক, ২০ হাজার ঘোড়া, ২ হাজার শকট, ৪ হাজার হাতির যা কিনা শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীরই অন্তর্ভুক্ত হিসাব- এ থেকেও করা যায়।শেষমেশ তিনি এখানে দখল পাকাপোক্ত না করেই পিঠটান দেন ।এমনকি গ্রীক মিথেও এই অঞ্চলের মহিমাকীর্তন শোনা যাবে।ভার্জিলের রচনার উদ্ধৃতি হয়ে এই নামটা উঠে এসেছে,
"On the doors will I represent in gold and ivory the battle of the Gangaridae and the arms of our victorious Quirinius." –Virgil, "Georgics" (III, 27)
এখন আলেকজান্ডারের বীরত্ব ও শৌর্যের কাহিনী দুনিয়ার এমাথা ওমাথা সবাই জানে কিন্তু ঘরের কাছের বিনাযুদ্ধে এই বীরবাহাদুরকে হঠিয়ে দেবার রাজত্বের মধ্যে আমাদেরই পূর্বপুরুষের যে প্রাচীন তাগদ, ঐশ্বর্য ও মর্যাদার গরিমা অহংকার তা খোদ আমরাই জানিনা।
লেখাটা আমার মূল ব্লগার একাউন্টে প্রথম প্রকাশিত এই লিঙ্কে:
view this link
সূত্র:
https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Bengal
https://en.wikipedia.org/wiki/Gangaridai
https://en.wikipedia.org/wiki/Nanda_Empire
https://en.wikipedia.org/wiki/Coenus_(general)
https://en.wikipedia.org/?title=Diodorus_Siculus
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ রাত ১:৫১