somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : জননী

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরপর এক হালি মেয়ের জন্ম দেবার অতীত অন্ধকারময় ইতিহাস আছে আনোয়ারার। এবার আবারও যখন শুভসংবাদটা পেল, রাসু মিয়া তার বউ আনোয়ারাকে বলল, 'এইবারে মাইয়া হলি তোর বেটিরে বেইচা দিমু কইলাম। ঘরের মধ্য খালি খালি বসায় বসায় খাওনি মোর পোষায় না । পাইলে পুইষে বড় কইরলে পরের ঘরে যাবেনি। আকামাইম্যা গুলান।'

এরপরে আর মা হবার সুখ বড় একটা রইলো না আনোয়ারার মনে। চারটো মেয়ে সে আগেই বিইয়েছে, ওর সেই পনের বছর থেকে একে একে কিছু বোঝার আগেই পালা করে এসেছে ওরা দুনিয়ায় । তাই বুকে দুরু দুরু আশা নিয়ে অপেক্ষা করা ছিল নিরর্থক। এ নিছক এক জৈবিক প্রক্রিয়া বই তো নয়। তবে প্রতিবারই ভাবত এবার হয়তো ছেলে হবে, ভেবে একটু আনন্দ লাগতো মনে। এবার একেবারে বেচে ফেলার কথা শুনে আশা না, আশঙ্কাই মনে অনেক বেশী দানা বাঁধছে। এযে বড় চরম কথা। জননীদের স্বার্থপর হতে হয় না, তবু সে একটু নিজের কথা ভাবে,বেশ দুশ্চিন্তায় ভোগে। সংসারে মেয়ে এনে দিতে দিতে তার এখন জায়গা বড় সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে।
আবার একটা মেয়ের জন্ম দিলে মেয়েটার কি হবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন ওর আর ওর বাকি চার মেয়ের কি হবে? যদি ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে? এরকমন ঘটনা তো ওর পাশেই আছে। মজিরনকে মেয়ে জন্ম দেয়ায় তালাক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে আবার আরেকটা বিয়ে করেছে ওর রিকশাচালক স্বামী।ভাবতে শিউরে ওঠে সে।

প্রসব বেদনা উঠেছিল ঠিক রাতে। এমন বেতালা সময় যখন কোথাও নেওয়া মুসকিল , নেবেই বা কে? বাড়িতে ছিল একটিও পুরুষমানুষ মানে সাকুল্য যে একজনই এ বাড়িটার বাসিন্দা। রাসু মিয়া। সে তখন বাজারের বারবণিতা মিতালীর সাথে রঙ্গতামাশায় বড় ব্যস্ত ছিল। অতএব চারটি অনভিজ্ঞ বাচ্চা মেয়ে ছাড়া এ হেন সঙ্গিন অবস্থার হাল ধরতে পারে এমন একটি সক্ষম হাতও ছিল না আশেপাশে। বুদ্ধি করে বয়স্কা বিচক্ষণ সকিনা বুবুকে যদি নয় বছরের বড় মেয়ে আয়েশা না ডেকে নিয়ে আসতো বলা যায় না কি হতে পারতো। রাত ভর কষ্ট করে একটি মেয়েসন্তান জন্ম দিয়ে একেবারে নেতিয়ে পড়ায় মনে হয় ভালো হয়- সে সে এই দূর্ভাগ্যের কথা অন্তত অতটা নাজুক সময়ে জানতে পারে নি।

নবজাতিকাকে আয়শার জিম্মায় দিয়ে সকিনা বিদায় নিল। এরপরে ভোরবেলাতে আলো একটু গড়ালে সবাই শ্রান্ত ক্লান্ত ঘুমের ঘোরে। সবার শেষে চোরের মতন যখন রঙ্গমঞ্চে আগমণ রাসু মিয়া , তখন আর সবাই কঠিন তন্দ্রাচ্ছন্ন। সারারাত জেগেছে মেয়েরা, এমনকি সবচেয়ে ছোট দুইবছরের ময়নাও। কারণ চারপাশে কি হচ্ছে তার দুশ্চিন্তা নয়। সেসব বোঝার মত বয়স তার হয়নি। ব্যাথাতুরা জননীর বিকট কাতরানো আর তার চেয়েও বড় কারণ ক্ষুধা। ওকে কেউ খাবার দেয়নি-দেয়ার কথা কারো মনে ছিল না

রাসু মিয়া এসে ঢুকলো , মেয়েকে দেখলো তারপরে চুপি চুপি বাচ্চা নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে যুগপৎ কন্যাশিশুর ধরাপ্রান্তে আগমণ ও রাসুর মেয়ে নিয়ে প্রস্থান যুগপৎ দুই কাহিনীর ধাক্কাই তাকে একসাথে নিতে হলো। রাসু মিয়া খাঁটি পুরুষ বটে। যেমন কথা তেমনি কাজ। আনোয়ারাও- দেখা গেল বাঘিনীমাতার চেয়ে কোন অংশে কম যায় না। মেয়ে বিয়ানোর অপরাধ সে বেমালুম ভুলে গেল ।তার বদলে স্বামীস্ত্রীতে যে কলহ শুরু হলো তার ভাষা বর্ননাতীত ও ভদ্রসমাজের লেখার অক্ষরে পরিবেশনের অযোগ্য। কলহের ভাষা ডালপালা ছাড়িয়ে উভয়েের পিতৃমাতৃকুলের দূর শাখাপ্রশাখায় ব্যাপ্তি লাভ করে যখন শান্ত হলো, আনোয়ার শাসাল, তার মেয়েকে ফেরত না পেলে সে রাসুকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বে।

এরপরে -সে অনেক কথা। আনোয়ারা ছুটা কাজ করে ''সুবাসিত'' নামক ঝকঝকে মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং-এর ছ'তলায়। তিনতলায় সাদিক আর খালেদার বাড়িতে বিয়ের পর পনেরো বছর যাচ্ছে কোন কচিমুখের দেখা নেই।

প্রখর বিজ্ঞানমনা হলেও দূর্বল হয়ে পড়লে একসময় মানুষ মানে না হেন জিনিস কমই আছে। শুরুতে ডাক্তার, কবিরাজ,দিল্লী হিল্লী বহুদূর করে করে পানিপড়া , তাবিজ কবচ, পীরের দোয়া আজমীর শরীফে সুতা তাগা বাঁধা বাঁধি এককথায় মানুষের পক্ষে সাধ্য অসাধ্য সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। শেষে তাদের জীবনে আলো হয়ে এসেছে রাসুর মেয়ে, সামান্থা। এই রকম সাহেবী নাম পেয়েছে মেয়ে , জন্মদাতা পিতা পেয়েছে নগদ দশ হাজার টাকা আর নিঃসন্তান দম্পতি পেয়েছে শিশু। শুধু একমাত্র লুজার হলো আনোয়ারা । তাই কি? আনোয়ারা মেয়ের খবর ঠিকই পেয়েছে, কিভাবে সে লম্বা কাহিনী। তবে এসব কথা কি আর চাপা থাকে? বিশেষত একই কলোনী যখন ওবাড়ির খালম্মার কাহিনী এবাড়ির ভাবীতে জানবে তারপরে বুয়াদের কাঁধে চড়ে কিভাবে লম্বা সফর পাড়ি দেয় কথা তা কারো অজানা নয়। সবচেয়ে বড় অনুঘটক রাসু নিজেই । এক ছাদের নিচে বসবাস করে দুটি মানুষ অনির্দিষ্টকাল যুদ্ধংদেহী থাকতে পারেনা। মাঝে মাঝে আছে সাদা নিশানের ক্ষণিকের যুদ্ধবিরতি। জেরায় চোখের পানিতে হুমকিতে অনুনয়ে ঠিক কোন একটা দাওয়া কাজে দিয়েছিল। কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে সে বলে ফেলেছিল ।

'চিন্তা কি তর। মাইয়া আলিশান বাড়িত আছে, ভালা থাকবো। আর এই যে কত ট্যাকা দিছে সেই ট্যাকাটয় তর বাকি মাইয়্যাও ভালা খাওন পরন পাইবো। 'খরখরে গলায় তখনও কাঁচা জখম কিন্তু টনটনে জ্ঞানে আনোয়ারা কিছু অতীব তিতা কথা রাসুকে শুনিয়ে দিয়েছে। ফের পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করেছে, 'কত ট্যাকায় বেচলেন ? ট্যাকা কই? বাচ্চার লিগ্যা কামে কয়দিন যাই নাই বইল্যা আমার কাম চইল্যা গেছে। ট্যাকা দেন। '

কথাটা সত্য নয়। ওর কাজ যায়নি। আজ যখন রাসু বাড়িতে ছিল না তখন সে বাড়ির গিন্নির সাথে দেখা করেও এসেছে। সদ্য প্রসূতিকে এমন একটা কারণে বিশেষত যখন সে কামকাজে দক্ষ- কেউ বিদায় করে না। যারা ছুটা মহিলা দিয়ে কাজ চালায় তার জানে সে কারণে অকারণে মাজে সাঝে অনুপস্থিত থাকবেই। কিছু করার নেই। আর এ তো জেনুইন কারণ, মানুষের দিলে তো রহম বলে কিছু একটা এখনও আছে।

তো , এইভাবে বেগম সাহেবের সাথে দেখা করে আনোয়ারা বিনিকাজেই শতিনেকটাকা , কয়েকটা কাপড় আর দিন দুয়েকের ছুটি বাড়িয়ে এনেছে। আনোয়ারার খালাম্মা জানেন না, যে বাচ্চা চুরি হয়ে হাতবদল হয়েছে। আনোয়ারা শোকে আকুল হয়েছে , তার মায়ের প্রাণ কিন্তু অভাব বড় নির্মম। যখন হৃদয় একদিকে ক্ষতবিক্ষত তখনও সে সেই হারানো বাচ্চার খবর না জানিয়ে তার নাম করেই সে আরো কিছু সাহায্য তাই বাগিয়ে নিতে পেরেছে। এটা তার অন্য বাচ্চাদের জন্য লাগবে , অন্তত। যে গেছে তার কথা ভেবে কেউ বাঁচাতো বন্ধ করে না!

এই তো গেল একটা দিক । আনোয়ারা ঠিক করেছে, সে আর এখনকার ''সুবাসিত'' নামের সু্উচ্চ বিল্ডিঙের ছয় নম্বর ফ্ল্যাটে কাজ করতে যাবে না। সে যাবে তার পরাণের ধনের কাছে, নয় নম্বর ফ্লাটে। সাদিক আর খালেদার বাড়িতে কাজ করা আছিয়াকে ভাড়িয়ে নিতে তার অসুবিধা হয় না। তারপরে কোন এক সুন্দর সকালে সে হাজির হয় দম্পতির বাসায়। সামান্থা সারাদিন শুয়ে থাকে। ঘর ঝাড়ু দেয় , দিতে দিতে আনোয়ারা ওকে দেখে । কেউ না থাকলে হাত পা একটু নাড়ে, কোলে নেয় সাবধানে। লাগোয়া বাথরুমটাতে কাপড় কাঁচতে কাঁচতে কেউ আশেপাশে না থাকলে গোলাপী কটে শায়িত সামান্থাকে একটু চুমো দিতে চায়। তখন খেয়াল হয় হাত ভেজা, ছোট বাচ্চা , এত আদরে আছে, ঠান্ডা লাগে যদি? সে জানে বড়লোকের আহ্লাদি ছাওয়ালপাওয়াল একটুতেই নেতিয়ে পড়ে। এ ওরই নাড়ি ছেঁড়া সন্তান হলেও , অনেক আরামে অভ্যাস, যদি কিছু হয়? থমকে দাঁড়িয়ে আলগোছে হাতটা মুছে নেয় পরনের কাপড়ে। নুড়ে একটু আদরের ছোঁয়া দিতে গিয়ে ওর এত বুক ঢিপ ঢিপ করে যে মনে হয় ঢোল বাজছে , এক্ষণি কেউ শুনতে পাবে, ছুটে আসবে, পাকড়ে ওকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে কোন এক অজানা মহাপাপ করছে যেন।

আনোয়ারা এখানে এসেছিল , কেন? ওর কি মনে হয়েছিল , এতদিন পার হেয়ছে, এখন কোন হইচই লাগিয়ে বাচ্চা ফেরত পাওয়া যাবে? যদি বা মনে হয়েই থাকে , মুখে আনতে সাহস হয়নি। প্রমাণ কি যে এ ওর সন্তান? মকদ্দমা কোর্ট কাচারি ? সে সোয়ামীকে ফাঁকা হম্বিতম্বি কররার দুঃসাহস সে খুব উত্তেজনার মুখেই আনতে পেরেছিল, বাস্তবে এটা করা তার মত গরীরের পক্ষে কি সম্ভব?

যদি রাসুকে সত্যি জেলে দেয়? সে ভাবতেই পারেনা সেটা। তার কি হবে ? তার পরিবারের কি হবে? তাছাড়াও হোক হাজার খারাপ, সে তো তার ভাতার, তার বাচ্চাকাচ্চার বাপ? কোন নারী কি পারে এমন করতে?

এছাড়াও এতো বড়লোকের সাথে থানা পুলিশ করলে সর্বস্বঃহারাই হতে হবে হয়ত। তার দেওরেরা আর স্বামী যেমন শশুড়ের মারা যাবার পরে সম্পত্তি নিয়ে কামড়া কামড়ি করে শেষ হয়ে গেছে তেমনি। নইলে ঢাকায় একটা বস্তিমতো জায়গায় না থাকা লাগতো , আর না আজ এই দিন দেখা লাগতো। সে আজ গৃহস্ত ঘরের বউ হয়ে পরের ঘরে কামলা খাটে, তার একদা পর্দানশীন বনেদি ঘরের এ কি অধঃপতনই না হয়েছে।

আর কত ? মেয়েটাকে পেতে গিয়ে যা আছে তাও যদি যায়? এতোগেল এক কথা। চুরি করে যদি নিয়ে যায় কোন এক শুনশান দুপুর বেলায়! কেউ জানবে না কেউ দেখবে না। পা টিপে টিপে কোন একদিন , যখন খালুসাব থাকবে অফিসে, খালাম্মা থাকবে দিবানিদ্রামগন। তখন যদি সে....! কোন এক নিঝুম দুপুরে সত্যি সে চেষ্টা নেয় ভাবনামতো। ফুলের মত ঘুমিয়ে থাকা, ফুল তোলা জামা পড়া নিস্পাপ শিশুকে চুপিসারে কোলে নেয়। বাতাস জানালা দিয়ে কাঁপিয়ে দেয় পর্দা। একটা তুলার পুতুল মেঝেতে পড়ে যায় সেি দাপটে। কোন শব্দ না হলেও চমকে ওঠে আনোয়ারা। বাচ্চাকে বুঝি সে কোল থেকে ফেলেই দেবে। তারপরে ঘোর কেটে গেলে সে আবার সামান্থা বেবীকে রেখে দেয় খাঁচাঘেরা কটে। সুরক্ষিত খাঁজকাটা কাঠের শিকে ঘেরা বিছানাতে শুয়ে শিশু কোন গোপন রহস্যভেদে হেসে ওঠে। মশারিটা টেনে ওকে ঘিরে দেয় আনোয়ারা। বড় মশা , কিভাবে যে এরা এই উপরে ওঠে আল্লাহ্‌ মালুম ।

এরকম এক বার না , বারে বার চেষ্টা করেছে আনোয়ারা। ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবার , পারেনি। মন বলে ধরা পড়ে যাবে, তারপরে কি হবে? -এও না, এত গুছিয়ে চিন্তা করার মতো সামর্থ্য ওর নেই। আসল কারণটা কি? একলা ঘরে ফিরে যখন সে রাতে যুগপৎ একসাথে দুটা হাতের সাথে আরো ডজনখানেক অদৃশ্যহাতে চারকন্যাকে সামলায় তখন বুঝি একটু একটু বুঝতে পারে ব্যাপারটা। খুব কষ্ট লাগে, তাও ভাবে, গবীরের ঘরে ওকে পালবে কিভাবে? আর তার অন্তত একটা মেয়ে তো আয়েশী জীবন পেল। যে জীবন মানুষের, তার মত কুত্তা বিলাইয়ের না। রান্নাঘরে একটা বিড়াল মুখ বাড়িয়ে ছিল, সদ্য গোটাপাঁচেক বাচ্চা জন্ম দিয়ে, রাজ্যের রাক্ষুসে খিদে পেটে ঘোরে, পায়ে পায়ে তার ছানাপোনা। কার সাধ্য আছে ক্ষুধিত মায়ের ক্রদ্ধ দৃষ্টির সামনে থেকে ওদের সরায়! হ্যাট হ্যাট করে তাড়াতে গিয়েও তাড়ায় না আনোয়ারা। অল্প ভাত আছে হাড়িতে। আজ হয়ত রাসু আসবে না। সে নিজেও খায়নি, থাক তাতে কি? ছানাপোনা সমেত বিড়ালমাতাকে চেটেপুটে খেতে দেখে কেন খিদেতে অবশ দেহে একধরণের তৃপ্তিবোধ হয় ওর? রাসুর কথা ভাবতে আঁতকে উঠে মনে হয়, বিড়াল বাবাও সময়ে সময়ে নিজেরই বাচ্চাকে খেয়ে ফেলে ...।


একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে ভাবে , সামান্থা তার আদরেরে জাদুমণি, থাকুক ভালো, থাকুক দূরে এ জানোয়ার সংসার থেকে।
সে ঐ বাড়িতে কাজ করতে যায় প্রতিদিন।দেখতে পায় , সুযোগ পায় ছোঁয়ার - এই কত!

মাসকয়েক ভালোই কেটেছিল, ভাবছিল আনোয়ারা, জীবনে তার তাল ফিরে এসেছে। যেভাবে দিন যাচ্ছে , মন্দ কি? এই বাড়িতে আসার পরে তার কাজ বেড়েছে, আগে দুইকাজের জন্য ঠিকা ছিল, ঘর ঝাড়পোছ আর কাঁচাকাঁচি। এখন বাটনাকুটনা, হাড়িপাতিল পরিষ্কারের ব্যাপারেও সে আস্থা অর্জন করেছে। এখানে যে করেই হোক সে কর্মঠ প্রতিপন্ন হয়ে টিকে থাকবে এই তাড়নাই তার পেছনের কারণ। মন দিয়ে সে কাজ করেছে, অন্যবাড়ির মত আনাজটা , তরকারিটা চুরি করে নেয় নি। কাপড়গুলো ভালো করে ধুয়েছে, না হলে ওর বাচ্চারইও তো গায়ে ময়লা লেগে থাকবে। অপরিষ্কার থাকলে মেঝে থেকে ঐ যে দিনমান চালু টিভিতে বলা হতে থাকে , কি সব জীবাণু থেকে নাকি অসুখ বিসুখ হয়, তা কি সে হতে দিতে পারে?ছোটাবাচ্চা থাকলে গৃহিনীর কাজ বাড়ে, তাই আরও বেশী কাজ, আরও বেশী সময়টা মেয়েটার কাছে থাকা যায় । কি সুন্দর তুর তুর করে হাঁটতে শিখেছে মাইয়াটা তার! আবার এক দুটা অস্ফুট শব্দ করে। খালেদা দিনরাত ভাঙা ক্যাসেটের মত বাজাতে থাকে, 'বল মাম, মাম্মি , আম্মুউ। বল মা।'

তা একদিন ভুল করে নাকি বুঝেই কে জানে সত্যি সামান্থা মা ডেকেই ফেলল। কি আশ্চর্য! আর কি খুশির লহর বয়ে গেল ঘরে। খালেদা ভুলে যায় আনোয়ারা এক কাজের লোক মাত্র । অনেক নিচু তার সামাজিক অবস্থান। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আনোয়ারাকে বসিয়ে সে বলে , সামান্থাকে বল দেখি , এই দেখো আমার বেবি কেমন মা বলতে শিখেছে। সামান্থা আবারও দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসি দেখায়, আলতো পায়ে টুকটুক এগিয়ে যায় আর বলে 'মা।'আনোয়ারার শরীর কেমন করে ওঠে ।নাকি মন? এরপরও কেমন করে সে ওখানে স্থির বসে ছিল তা সে জানে না, বাথরুমের দরজায় ছুটে ফিরে খিল দেয়। অঝোর বন্যা তার চোখে। সব ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার এত শক্তি তবু তো কোন জোর নেই।

চোখের সামনে নিজেরই আত্নজাকে পরেরে মাঝে আত্নীভূত হতে দেখা সুখকর না, তবুই তো দিন যায়। কিন্তু এক একটা সময় মনে হয় সব কিছু থমকে গেছে। তেমনই একটা মুহূর্তে সে জানলো, খালেদাই জানালো , ওরা সবাই তল্পি গুটিয়ে এখানের আবাস ছেড়ে চলে যাবে কানাডা। ঝলমলে মুখ আর বড় সুখ তার । ঐ দূর দেশে সাদিক অনেক ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ভালো হয়েছে, ওদের দুইকুলেই অনেক আত্নীয়বন্ধু আছে ওখানে। আছে সমৃদ্ধির হাতছানি, আছে সামান্থার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
একজনের খুশি অন্যজনের উপরে কেমন গ্রহণ ফেলে। আনোয়ারা খালেদার কথা বুঝেও ভালো করে বুঝে উঠতে পারে না। ওরা চলে যাবে! সাথে সামান্থাও? ওর আদরের দুলালী, ওর পরাণ সামান্থা চলে যাবে, আর কোনদিনও ওকে দেখতে পাবে না?


একলা ঝরঝর করে চোখে বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। সে মনস্থির করে যেভাবে পারে সে যাবে সামান্থার সাথে, যেখানেও ও যাবে এই গোলাকার পৃথিবীর বুকে। সে তার মেয়ের অধিকার হারিয়েছে কিন্তু তাকে দেখার অধিকারও হারিয়ে সে বাঁচতে পারবে না।


অসম্ভব এই চাওয়া শুনে খালেদা হাসবে না কাঁদবে ভাবে। পাগল নাকি? বলে কি মহিলা? মানছে যে আনোয়ারা কাজ করে খুব ভালো, কোন অভাব অভিযোগ নেই, দুদিন পরে পরে কাজ কাম কামাই দেবার বাহানা নেই। নিরুপদ্রব বিশ্বাসী এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ওকে নিয়ে সেই দূর দেশে যাওয়া , নিজেদেরই যেখানে কি হয়, ঠিকানা কিছুরই ঠিক নেই, আর সেখানে কাজের লোক কেইবা রাখে?আর ওর প্লেনের টিকেট? অবাস্তব আবদার।এ তো পুরোদস্তুর খ্যাপামি।আর কি জন্যেই বা যেতে চায় সে?কাজের ইনসিকিওরিটি ?

না, কাজের ভাবনা নেই। যাবার আগে খালেদা ওকে আরও বেতনে খুব ভালো কোন পরিচিত বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে। এত দিনের লোক, মায়াদয়া বিবেচনা আছে তার।

তাতেও কেন মানছে না বুয়া?

'বাবুর লাগি বড় মন পুড়ব গো খালাম্মা।'

তাতে কি? জীবনে কি সবাইকে নিয়েই সবটুকু পথ পাড়ি দেয়া যায়? খালেদা জানে সামান্থাকে আনোয়ারা বড় ভালোবাসা তাও বিমূঢ় হয় , এযেন বাড়াবাড়ি।

'তোমার নিজের মেয়ে ফেলে যাবে কি? ওদেরকে দেখবে কে? বাপও তো নেই এখন।'

আনোয়ারা চোখ মুছে । আবার অবাধ্য পানি গড়িয়ে পড়ে। একসময় যে রাসুর জন্য সে মুখ বন্ধ রেখেছিল , সন্তান আর স্বামীর মধ্যে বেছে নিয়েছিল স্বামীকে, সে তার সেই মমতার কোন তোয়াক্কা না করেই এক পৌষের হিমঘন সকালে ক্ষণস্থায়ী কুয়াশার কুহকের মত মিলিয়ে গেছে তার জীবন থকে। আর দশটা মানুষ যেমন যায়, ব্যস নিরুদ্দেশ। কেউ বলে আরেকটা বিয়ে করেছে। কেউ বলে মারা গেছে। যত খোঁজখবর সব করা হয়েছে, তারপরে একদম নিশ্চিত হয়েছে আনোয়ারা, সে একেবারেই গেছে।কারণ বাড়িতে থাকা সর্বস্ব সঞ্চয়টিুকুও যে নিতে ভোলেনি যে!কোন নটী বেটির কাছে মরছে নিশ্চয়ই !এটাই আনোয়ারা বিশ্বাস। স্বামীর গুণপণা তো তার কাছে অজানা না।

তো এখন, এই পরিস্থিতিতে সে কি আসলেই যেতে পারে? এক মেয়ের পিছে পিছে দুনিয়ার শেষ প্রান্তে , বাকি মেয়েগুলোকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে?


তবু মন শক্ত করে আনোয়ার বলে,' ওরা থাইকপো ওদের নানীর কাছত, ডাগর ডোগর হ্যছে, এখন বড়ডি ছোটগুলানরে সামলাইবো ।

কি আজব মেয়েমানুষ ? কি পাষাণ জননী! কি লোভে কি আকর্ষণে সব ফেলে ছুঁড়ে এই নারী তাদের সাথে যেতে চাইতে পারে? শুধুই মায়া মমতা পরের মেয়ের জন্য ? তাও নিজের পেটের গুলোর চেয়েও বেশী? যতই ভাবে ততই ধন্দ্ব লাগে খালেদার।


এখন আনোয়ারা কিভাবে বোঝায় তার আসলে বেঁধেছে কোনখানে?' না , আমি যামুই খালাম্মা 'এই আর্তি তার আর্তনাদ। একবার কোলের শিশুকে হারিয়ে ফেললে এ জীবনে আর তো দেখা পাবেনা সে। কোন ভাবেই ওকে বোঝাতে না পেরে , এবং নিজেও কিছু বুঝতে না পেরে খালেদা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেয়। আপাতত থাকুক। পরে আনোয়ারা বুয়ার মাথা ঠান্ডা হলে সে আবার বোঝাবে। নিয়ে যাবার প্রশ্ন উঠতেই পারে না। এ কি এখান থাকে?ঢাকা আর চিটাগাং? এ হলো পৃথিবীর উল্টাপারের প্রবাস।' আচ্ছা , বুয়া আমি সামান্থার বাবার সাথে কথা বলে দেখি। দেখি তোমার ব্যাপারে কি করা যায়? 'বলে আপাতত উদ্বাসী ক্রন্তনরতা আনোয়ারাকে ফেলে সে নিষ্ক্রান্ত হয়। আর আরো অনেক কাজ আছে। সবাইকে জানানো আছে। শপিং আছে। গোছগাছ আছে। খেয়ালী কাজের মহিলার কথা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবলে তার চলে না।আনোয়ারা দরজার পাশে পাশে থাকে , আড়ালে কান পাতে।স্বামীকে ফোন করছে কি খালেদা? হ্যাঁ, ডায়াল ঘোরাচ্ছে বটে।কাকে সে জানে না, নিশ্চয়ই খালুকেই হবে। বলে যে গেল! এটুকুই এত দূর থেকে চোখে পড়ে, কিন্তু কিছু শোনা যায় না। ।তার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হবে? রাজি হবে কি? অবুঝ আনোয়ারা চোখ মুছতে মুছতে তার নিয়তির অপেক্ষা করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৪৮
৫৩টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×