somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহমুদ দারবিশ এবং তার কবিতা অনুবাদের কিছু কথা

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮) বিশেষত আরব কবিদের যারা স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও দেশকবিতার জন্য খ্যাত হয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা আরবজুড়েই তার সুখ্যাতি। তিনি ছিলেন আরবি কবিতার উন্নয়ন প্রতিভূ। আরবি কবিতার বন্ধ্যত্ব ঘুচাতে তার শ্রম, কৌশল ও সংগঠন ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তিনি কবিতা লিখেছন— স্বপ্ন দেখি পৃথিবীর হৃদয় তার মানচিত্রের চেয়েও বড়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের হৃদয় তো অত বড় নয়। তাই ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি সৈন্যদের ফিলিস্তিন দখলের সময় এক ভয়াবহ রাতে আক্রান্ত হয় দারবিশের এ ছোট্ট গ্রামটিও। অজস্র ফিলিস্তিনির মতো তিনিও হারিয়েছিলেন তার গৃহ, গ্রাম, শৈশব। হানাদার ইসরাইলি সৈন্যরা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তার স্বদেশ-মাতৃভূমি এবং পরিচয়। কিন্তু পরিচয় ও ভূমিহীন মাহমুদ দারবিশ দেখিয়েছেন একজন কবি, ভাষা-কবিতার মাঝে কিভাবে নির্মাণ করে নিতে পারে তার মাতৃভূমি-স্বদেশ পরিচয়, হারানো শৈশব ও মায়ের ভালোবাসা।

‘আমি দেশের জন্য গাই না’ একটি কবিতায় দারবিশ বলেছেন, আমি নিজেই একটি দেশ। অস্ত্রহীন ফিলিস্তিনি তরুণরা ইসরাইলি সৈন্যদের রাইফেলের গুলি ও ট্যাংকের গোলার মুখে ছুড়েছে নির্বাক পাথর। মাহমুদ দারবিশ দেখিয়েছেন নিরীহ ভাষা-কবিতা কিভাবে পরাজিত করে দিতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর পরাশক্তিকে। জীব ছেড়া ফিলিস্তিনিদের চিৎকার ও বিজয়ী ভাষার নাম মাহমুদ দারবিশ। ফিলিস্তিনহীন পৃথিবীর মানচিত্রে দারবিশের কবিতা লাল ফিলিস্তিন। তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মাঠে ছিলেন। তবে লড়েছেন ভাষা কবিতা দিয়ে। এ সময় দারবিশের কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটে। তিনি তার এর আগের কবিতায় যে কাব্যিক জটিলতা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি দেখতে পান তার এ ধরনের কবিতাগুলো সাধারণ মানুষ ও যোদ্ধারা বুঝতে পারে না।

মাহমুদ দারবিশ প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেন নতুন ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদযাপন অনুষ্ঠানে। দারবিশ তখন স্কুলের ছাত্র। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে দারবিশ স্বরচিত কবিতা পড়ছিলেন—তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছুই নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদযাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বল কেন আমরা একসাথে খেলতে পারি না? এ কবিতা শুনে পরদিন ইসরাইলি সামরিক সরকারের লোকরা তাকে ডেকে নিয়ে শাসায়। তাকে বলা হয় ভবিষ্যতে এ ধরনের কবিতা লিখলে তার বাবার চাকরি যাবে।

মাহমুদ দারবিশ বুঝে যায় তার কবিতার ভাষা কতটা ক্ষুরধার। তিনি অবিরাম লেখে যান। তিনি লিখেন— শেষ সীমান্ত পার হওয়ার পর আমরা কোথায় যাবো? শেষ আকাশের পর কোথায় উড়বে চড়ুইরা? শেষ বাতাস বয়ে যাওয়ার পর উদ্ভিদরা কোথায় ঘুমাবে? আবিরমেশানো ধোঁয়া দিয়ে লিখে দেব আমাদের নামগুলো, আমাদের গোশত দিয়ে আবার নির্মিত হবে—তাই কেটে নিয়ে যাবো সংগীতের বাহু।

ফিলিস্তিনের ভাষা আরবি। আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটা সময় এবং এখনো আরব অঞ্চলের মানুষ ভাবে, ফিলিস্তিনের মানুষ তাদেরই মতো আরব। প্রকৃতপ্রস্তাবে ফিলিস্তিনের ভাষা আরবি হলেও তাদের মাঝে আধুনিক কবিতার যাত্রা হয়েছে তাদের ওপর নতুন করে নির্যাতন শুরু হবার পর থেকেই। নয়ত এর আগে ‘ফিলিস্তিন সাহিত্য’ বলে আরবি সাহিত্যের মাঝে আলাদা কোনো পার্টিশন ছিল না। ১৯৪৭ সালে যখন এ যুগে নতুন করে ফিলিস্তিনিরা ভূমি হারাতে বসে, তখনই তাদের ভেতর একটা নতুন পরিচয়ের বিকাশ ঘটতে থাকে একটু একটু করে। আরবি সাহিত্যের যেসব শিল্পী ও কবি ফিলিস্তিনের রক্ত ধারণ করেন, ফিলিস্তিনি হওয়ার অপরাধে তাদের অনেকে বন্দি হন, অনেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির সঙ্গে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন কিংবা উদ্বাস্তু হয়ে জীবন যাপন করেন পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে। এই অসহায়ত্বই তাদের ভিন্ন একটা পরিচয় দেয়—তারা ফিলিস্তিনি। তাই তাদের রচনায় ফিলিস্তিনের উপস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠে। এভাবে দীর্ঘসময়ের পরিক্রমায় একসময় ফিলিস্তিনি সাহিত্যের একটা আদল দাঁড়িয়ে যায়, হয়ত তাদেরও অজান্তে। তবে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ গাসসান কানাফানি এই সাহিত্যকে আরো একটু মাত্রা দিয়ে নাম দেন— ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’।

এ সাহিত্য বেড়ে ওঠে আরবির হাত ধরে। যখন তা বাংলায় রূপান্তর হয়ে আসে, তখন অনুবাদ ও মূলভাষার মধ্যে অন্য একটা ভাষার আড়াল পড়ে যায়। কারণ, বাংলা ভাষায় এর আগেও আরবি ভাষা কিংবা ফিলিস্তিনি সাহিত্যের অনুবাদ হয়েছে। কিছু কবিতা ও গল্প বাদ দিলে তার বেশিরভাগ হয়ে এসেছে ইংরেজি অনুবাদ থেকে। এতে যেমন অনুবাদক কাব্যের দায় নিতে রাজি থাকেন না, তেমনি কবি যদি খোদ এসে তার কাব্যরূপটা কোনোরকম দেখতে পান, তাহলে তিনিও সে কবিতাকে নিজের বলে মানতে রাজি হবেন না নিশ্চিত। কারণ, মূলভাষা ও অনুবাদের মাঝে যদি আরেকটা ভাষার আড়াল পড়ে যায় তখন তার মূলভাবটা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। আমিও এর আগে কিছু আরবি ভাষার গল্প ও অনুবাদ দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। কোথায় কবির কবিতা, আর কোথায় অনুবাদ। যেন আরব আর বাংলাদেশের মতোই দুস্তর মরুর বিস্তর ব্যবধান।

নিচে আমার করা সরাসরি মূলভাষা (আরবি) থেকে মাহমুদ দারবিশের একটি কবিতা অনূদিত হলো—

বাবা, আমি ইউসুফ

বাবা! আমি ‍ইউসুফ...
বাবা, আমার ভাইয়রো আমাকে ভালোবাসে না
ওরা চায় না, আমি ওদেরই একজন হয়ে থাকি,
ওরা আমাকে প্রহার করে, পাথর ছুঁড়ে মারে
আর অপমানে করে ক্ষত-বিক্ষত
বাবা, ওরা আমার মৃত্যুকামনা করে
যাতে সহজইে মেকি প্রশংসার প্রলাপ বকতে পারে।

ওরা আমার জন্য হারাম করেছে তোমার ঘরের দরজা,
জমি-জিরেত থেকেও করেছে পরিত্যাজ্য, বেশরিক—
বাবা, ওরা আমার আঙুর বাগানে বিষ ছিটিয়ে সবকিছুর
করে দিয়েছে খেলখতম।

প্রবাহিত মৃদুমন্দ হাওয়া যখন আমার
চুলে দোলা দিয়ে যায়
তখন ওরা র্ঈষায় কাতরায়—
ওদের ক্রুব্ধ আক্রোশে বিদ্ধ হই তুমি আর আমি
কী অপরাধ ছিল আমার, বাবা!
কোন্ ক্ষতির হেতু বনেছিলাম একদা?

প্রজাপতিরা এসে আমার কাঁধে বসে,
খানিকটা কুর্নিশ করে আমাকে গমের শীষ
পাখিরাও বেজায় উড়ে বেড়ায় আমার হাতের ’পর।
এতে আমার কী অপরাধ, বাবা!
তবে আমিই বা কেন?
তুমিই তো নাম রেখেছিলে আমার—ইউসুফ!

ওরাই তো আমাকে ফেলে দিয়েছে কুয়োতে
তারপর দোষ চাপিয়েছে নেকড়েদের।
বাবা, ওই যে নেকড়ে, সে-ও
আমার ভাইদের চেয়ে অনেক দয়ালু।

বাবা, আমি তো স্রেফ স্বপ্নের কথা বলেছি—
এতে কী অন্যায় আমার?
স্বপ্নে দেখেছি এগারো সেতারা, চাঁদ আর সূরুজ
মস্তকাবনত হয়ে রয়েছে ওরা আমারই সামনে।

(মূল আরবি প্রথম কমেন্টে)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৩
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×