২০০৬ সালের শেষদিকে। আমার ছোটভাই পরীক্ষায় খারাপ করেছে। ভালরকম খারাপ। যদিও ছোট ক্লাসে সবারই একটু-আধটু ফেল করার অভ্যাস থাকে, তবুও আম্মুর রাগ দেখে কে! ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বলে কথা, যে ছেলে লাস্ট ফাইনালে সিক্সথ হয়, সে ছেলে কিভাবে এবারের হাফ ইয়ার্লিতে ফেল করে?
আম্মু শুরু করল কারণ উদ্ঘাটন। টানা ২০ মিনিট ওর স্কুলের ব্যাগ আর রুমে চিরুনী তল্লাশীর পর পাওয়া গেল আসল রহস্য! হ্যারি পটার নামক গাঁজাখুরি গল্পের তিন-তিনটা বই! একটা ওর তোষকের নিচে, একটা আমার তোষকের নিচে, আরেকটা ওর টেক্সটবইয়ের চিপায়।
যদিও আমি নিজে ভয়াবহ বইয়ের পোকা, তবুও ‘বাচ্চাদের জাদু শেখানোর বই’ ধারণা নিয়ে হ্যারি পটারের প্রতি তখন যথাযথ বিরক্তি ছিল, তাই কোনটাই পড়া হয়নি; প্রথম পার্ট সিনেমা একটু দেখেছিলাম, ঝাড়ুর উড়াউড়ি পর্যন্ত দেখে নাক কুঁচকে বন্ধ করে দিয়েছি।
‘সৌভাগ্যবশত’, বিভিন্ন গার্ডিয়ানের কাছ থেকে আম্মুর ততোদিনে কানে এসেছে, হ্যারি পটার নামে তিন গোয়েন্দার মতো আরেক নেশা বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আম্মু আসলে বই খুব বেশি কিনে না দিলেও মোটামুটি ভালই দিত, তবে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, হ্যারি পটার, হুমায়ুন আহমেদ ইত্যাদি ‘নেশা’তে ঘোর আপত্তি ছিল। তাই ফিলসফারস স্টোন, চেম্বার অফ সিক্রেটস আর প্রিজনার অফ আজকাবান মোটামুটি দু টুকরো করে আম্মু আমাকে ফেলে দিতে বলে বলল, ‘তোকেও যেন আর এইসব বই ধরতে না দেখি!’
শত হলেও বই বলে কথা, ফেলে দিই কিভাবে! তাই শেলফেরই নিচের দিকে ঢুকিয়ে রাখলাম বইগুলো। ফিলসফারস স্টোন বইটা কিছুটা অক্ষত আছে দেখলাম, কি মনে করে ভাবলাম একটু চোখ বুলাই।
তখন ছিল সন্ধ্যা। সেদিন সারারাত, পরের দুদিন স্কুল ও বাসায় লুকিয়ে লুকিয়ে টানা পড়ে শেষ করলাম ফিলসফারস স্টোন। সাথে সাথে দ্বিতীয় বইটা তুলে নিতেই দেখি আম্মুর হাতের নিপুণ কারুকার্যে সেটার অনেক অংশই উধাও! শেষে এক বন্ধুর কাছ থেকে পরের দুটো নিয়ে আসলাম, যাকে আমি মাঝে মাঝেই পটারভক্ত হওয়ার কারণে ঠাট্টা করতাম!
পরের কয়টা দিন কেমন ঘোরের মধ্যে কাটল। কিসের পড়াশোনা কিসের কি... হোগার্টসের আনাচে-কানাচে ঘুরেই কুল পাইনা! তিন নম্বরটা শেষ করেই ছটফট করতে লাগলাম চার নম্বরের জন্যে, কিন্তু ওই বন্ধুর কাছে সেটা ছিল না। শেষে নিজের জমানো টাকা দিয়ে গবলেট অফ ফায়ার আর অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স কিনে আনলাম।
আমি হলফ করে বলে পারি, আমার কৈশোরের অন্যতম সেরা কিছু সময় ছিল পরের দু মাস। পরীক্ষার জন্যে ধীরে ধীরে পড়েছি, কিন্তু হ্যারি পটার বলে কথা! তাই ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল না করলেও রীতিমতো টিটিপি অবস্থা। আম্মুর চোখরাঙানি-টাঙানি খেয়ে সুন্দরমতো রুমে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে টর্চ জ্বেলে দিয়ে অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স পড়ছি। ঠিক এমনই সময় ঘটল আমার জীবনের অন্যতম দুঃখের ও আফসোসের ঘটনা!
কতোক্ষণ ধরে পড়ছি মনে নেই। ‘দ্য আই অফ দ্য স্নেক’ চ্যাপ্টার। ক্রিসমাসের ছুটির আগে শেষ DA মিটিং-এর পর চো চ্যাং আর হ্যারি একা ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চো ছাদে ঝোলানো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘Mistletoe’। আমার অবস্থাও হ্যারির মতোই। সারা গা অবশ, হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেছে (মনে হচ্ছিল চো যেন আমাকেই বলছিল!)... চো কান্নাভেজা স্বরে বলল, ‘I really like you, Harry’। :#> :#> :#> তারপর ধীরে ধীরে হ্যারির দিকে আগাতে লাগল, এই সময়...
‘হৃদয়!!!’ :-& :-&
হৃৎপিন্ড যেন ধড়াস করে গলায় চলে এল, দু হাত লাফিয়ে উঠে কম্বলসুদ্ধু দুদ্দাড় মাটিতে ধপাস! আমার সামনে চোখ দিয়ে আগুন বের করে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস উইসলি, যাকে ওই মুহূর্তে আম্মুর মতো দেখাচ্ছিল! :-&:-&
হতচকিত অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরে এসে টের পেলাম ওটা আম্মুই, ওরফে সাক্ষাৎ মিসেস উইসলি! এবং মসজিদ থেকে ফজরের আজান দিচ্ছে!
বিশ্বাস করুন, আম্মুকে বিন্দুমাত্র ভয় লাগছিল না, কিন্তু আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল তারপর কি হল জানার জন্যে! কিন্তু সে সৌভাগ্য কি আর হয়?
আমার অসীম দক্ষতায় বইটা টুকরো টুকরো হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারল না আমার শেলফ, ওটায় তালা মারা হল। তাতে কি! অনেকদিন ধরে অনেক কষ্টে বাথরুমে, বাসার ছাদে গিয়ে পড়ে তবে শেষ করলাম অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স।
সেই অবধি ওটা বেস্ট ছিল। হাফ-ব্লাড প্রিন্সের জন্যে ছটফট করছিলাম, কিন্তু তার আগে সিনেমাগুলো দেখব ঠিক করলাম। কিন্তু প্রথম চারটা সিনেমা দেখে যারপরনাই হতাশ। মূল বইয়ের একশ’ ভাগের একভাগ স্বাদও সিনেমায় পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র দুর্দান্ত অভিনয় আর দারুণ ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবু চার নম্বর সিনেমাটা কিছুটা ভাল লেগেছিল।
তারপর আর কি। প্রায় এক বছর পর হাফ-ব্লাড প্রিন্স পড়লাম। ডাম্বলডোরের মৃত্যুতে বিহবল হয়ে থাকলাম। কিছুদিন পর ডেথলি হ্যালোজ বের হল, নাওয়া-খাওয়া-ঘুম বন্ধ রেখে সেটাও এক টানে শেষ করলাম। সত্যি বলতে কি, সপ্তাহখানেক আমার মন খুব খারাপ ছিল... মেনে নিতে পারছিলাম না যে হ্যারি পটার শেষ হয়ে গেল!
আচ্ছা... ঠিক কি আছে হ্যারি পটারে? যা অন্য দশটা বইয়ে নেই?
আমি এককথায় বলব, Complexity full of Simplicity। এতো ব্যতিক্রম, এতো জটিল প্লট যে এতোটা সহজভাবে লেখা যেতে পারে, রাওলিং কে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আপনি যদি এখনো হ্যারি পটার না পড়ে থাকেন, তাহলে বাজি ধরে বলতে পারি, এতোটা ব্যতিক্রম কিছু আপনি কখনো পড়েননি!
রাওলিং-এর লেখনী নিয়ে বলার কিছু নেই। কোন পর্যায়ের লেখনী হলে বাচ্চা থেকে বুড়ো লেখা গিলে ফেলতে পারে, তা বলা বাহুল্য। এমনকি বড়দের জন্যে হ্যারি পটারের অ্যাডাল্ট এডিশনও বের হয়েছে। অবশ্য সাধারণটা সাথে সেটার পার্থক্য শুধু মলাটে; চিন্তা করুন আপনার অফিসের বস আপনার বাসার এসে দেখল আপনি বাচ্চাদের রূপকথার মতো চঙবঙে কার্টুন প্রচ্ছদের কোন বই পড়ছেন, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? তাই বড়দের জন্যে একটু ভিন্ন মলাটের এডিশন।
অ্যাডাল্ট এডিশন
টুইস্ট আর ফান সম্ভবত হ্যারি পটারের নেশা জাগানীয়ার মূল কারণ। আপনি কোনভাবেই আন্দাজ করতে পারবেন না পরবর্তী পাতায় কি অপেক্ষা করছে, এবং এতো হিউমেরাস সব জায়গা পাবেন যা অনবরত কমিক রিলিফের কাজ করবে! বিশেষ করে শেষ তিনটা বইতে রাওলিং-এর সেন্স অফ হিউমার, বিভিন্ন চরিত্রের বুদ্ধিদীপ্ত ডায়লগ, সোজাসাপ্টা ফান সারাক্ষণই আমাকে মাতিয়ে রেখেছে। অনেক সিরিয়াস জায়গাতেও আপনি হেসে ফেলতে বাধ্য হবেন।
জে কে রাওলিং-এর সাথে ড্যান র্যাডক্লিফ, রুপার্ট গ্রিন্ট, এমা ওয়াটসন
আমার মত আরও অনেকেই বিশ্বাস করেন ডাম্বলডোর আর স্নেইপ বিশ্বের অন্যতম যুগান্তকারী দুটো চরিত্র। ডাম্বলডোরের যে প্রবল ব্যক্তিত্ব প্রবল আর মেধার ছাপ প্রতিটা বইতে ফুটে উঠেছে, তাতে ভেতর থেকেই ডাম্বলডোরের প্রতি একটা শ্রদ্ধা চলে আসে। এবং আমার মনে হয়েছে মনে হয়েছে সম্পূর্ণ হ্যারি পটার সিরিজে ডাম্বলডোরের মতো বুদ্ধিদীপ্ত, প্রত্যুতপন্নমতিতা সম্পন্ন ডায়লগ আর কেউ দেয়নি। পাঁচ নম্ব বইয়ের ‘The Hearing’ চ্যাপ্টার, হ্যারির সাথে ডাম্বলডোরের বিভিন্ন কথোপকথন যা প্রতিটি বইতেই রয়েছে, তার বড় প্রমাণ। তবে বলে রাখি, হ্যারি পটার সিনেমার প্রথম দুটি ছাড়া অন্য কোনটির ডাম্বলডোরকেই আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি। এতো ওজনদার, রহস্যময় ক্যারেক্টারটাকে রীতিমতো ফানি বানিয়ে ফেলেছে।
হ্যারি পটার সমালোচকরা বলে থাকেন এখানে নাকি ভাল আর খারাপের পার্থক্যটা খুব সুস্পষ্ট, তাই এতে ভাবনা-চিন্তার খোরাক নেই। কিন্তু স্নেইপের মধ্যে এর চমৎকার জবাব রয়েছে। এই একটা চরিত্র নিয়েই আপনি সারাক্ষণ দোদুল্যমান থাকবেন, ভাল নাকি খারাপ? সন্দেহ নেই, হ্যারির সাথে সাথে তার প্রতি আপনার মধ্যেও চরম একটা ঘৃণা তৈরী হবে, যদিও স্নেইপের সাথে হ্যারির তীব্র হিংসাপূর্ণ জায়গাগুলো নিঃসন্দেহে দারুণ উপভোগ্য। কিন্তু তার উপর ডাম্বলডোরের বিশ্বাসই সবকিছু উলটাপালটা করে দেয়; মাঝে মাঝে মনে হবে হ্যারিও কম বাড়াবাড়ি করছে না! এবং সাত নম্বরের অন্যতম অ্যান্টাগোনিস্ট স্নেইপ। বলে রাখি, আমার মনে হয়েছে সিনেমায় স্নেইপের চরিত্রে অভিনয় চমৎকারভাবে পারফেক্ট।
এছাড়া রন, হারমিওন তো আছেই। আমার প্রায়ই মনে হয় ঠিক এতোটা বড় ক্ষেত্র নিয়ে এর আগে কোন উপন্যাস সিরিজ লেখা হয়নি। এবং রাওলিং নতুন একটা ধারা তৈরী করেছেন, যার নাম ম্যাজিক ফিকশন। এরই মধ্যে এই ফিকশনের আরও অনেকধরনের বই বেরিয়ে গেছে, যা রাওলিং-এর লেখা না। নাগিব মাহফুজ একবার একটা মজার কথা বলেছিলেন- “যে বই কেউ পড়ে না সেটাই নোবেল পুরস্কার পায়; নাহলে নির্ঘাৎ হ্যারি পটারের অন্তত তিনটা বই সাহিত্যে নোবেল পেত”।
গতকাল ১৫ জুলাই; Harry Potter & The Deathly Hallows Part 2 মুক্তির মধ্যে দিয়ে শেষ হল দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলা হ্যারি পটার সাগা। রাওলিংকে রীতিমতো পথের ফকির থেকে করেছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে একজন।
সাতটা সিনেমার মধ্যে সত্যিকারভাবে উপভোগ্য হচ্ছে এ সর্বশেষ সিনেমাই। অন্যসব সিনেমায় যেমন বইয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাও বাদ দেয়া হয়েছে, এটা দুই পার্টে করায় তাই সে সমস্যা নেই। এবং IMDb-র বর্তমান রেটিং-এর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন সদ্য রিলিজ পাওয়া পার্ট ২ কতোটা ভাল সিনেমা- 8.7/10। উইকিপিডিয়া বলেছে, ৯৭% দর্শক একে পজেটিভ বলেছেন। ধারণা করা হচ্ছে Highest Grossing Films-এর মধ্যে অ্যাভাটার ও টাইটানিকের পরেই এটি স্থান করে নিবে।
শেষ করি হ্যারি পটার নিয়ে তিনটা ভুল ধারণার কথা বলে, যেটা আমাদের বাঙালীদের মধ্যে প্রবল। প্রথমত- কোনভাবেই বাংলা অনুবাদ কিনবেন না; দুই আর তিন টেনেটুনে চললেও বাকিগুলো ভয়াবহ রকমের অখাদ্য, রাওলিং দেখলে মনে হয় হার্টফেল করবে! দ্বিতীয়ত, সিনেমা দেখে কোনভাবেই বই জাজ করার চেষ্টা করবেন না, তিন নম্বরের পরিচালক নিজেই বলেছেন বর্তমানের দ্বিগুণ বাজেট, অন্তত চার ঘন্টার রানটাইম আর স্পিলবার্গের মতো ডিরেকশান ছাড়া হ্যারি পটারের দশভাগের এক ভাগ স্বাদও সিনেমায় দেয়া যাবেনা। এবং তৃতীয়ত, চট করে দেখেই বাচ্চাদের রূপকথা ভেবে ভুল করবেন না! মনে রাখবেন হ্যারি পটারের প্রথম বইটা, যেটা সত্যিকার অর্থেই ছোটদের, সেটা বিক্রি হয়েছে সবচেয়ে বেশি, ১০৭ মিলিয়ন কপি। এবং সাতটা সিরিজ মিলে মোট বিক্রি হয়েছে সারা বিশ্বে ৪৫০ মিলিয়ন কপি, অনুবাদ হয়েছে ৬৭+ ভাষায়। এবং যতোই সিরিজে আগাতে থাকবেন ততোই বুঝবেন প্লটের জটিলতা আর বড়দের উপাদান ক্রমশ বাড়ছে।
আর সবশেষে... হারমিওনের কথা না বললেই নয়! প্রিজনার অফ আজকাবানে ‘হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া’ হারমিওনের চরিত্রে এমা ওয়াটসনকে দেখে সেই যে প্রেমে পড়েছি, আর ছাড়াছাড়ি নেই! আমার মনে সিনেমাগুলো পুরোপুরি উপভোগ করতে পারিনা আর একটা কারণ এমা ওয়াটসন; ও যতোক্ষণ পর্দায় থাকে অন্য কোনদিকে তাকাতে পারিনা! :#> :!> :#> :!>
যারা এখনও এই অদ্ভুত জগতের সাথে পরিচিত হননি, তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এখানে। একেবারে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে যাচাই করে দেখাইতো ভাল!!