somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহানবীর (সাঃ) মহাজীবনের স্বরূপ সন্ধানে অন্তহীন যাত্রা… (১ম পর্ব)।

১৯ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাম উচ্চারিত হলে দরুদ পড়া মুসলমানদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। অন্যান্য নবিদের বেলায় একই নির্দেশ প্রযোজ্য। এই লেখাতে (সাঃ) থাক বা না-থাক, পাঠকগণ এ বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।

“বালাগাল উলা বিকামালিহি
কাশাফাদ দুযা বিজামালিহি
হাসুনাত জামিউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি”

ভাবানুবাদঃ

সুখ্যাতির ঐ শীর্ষশিরে উঠেছিলেন মোদের নবি
মানবগুণের পূর্ণতায় তিনি ধরার ধ্যানের ছবি।
চরিত্রের মাধুরিমায় জুড়ি তাঁর নাইকো কোথাও
তাঁর নুরের রৌশনীতে জমাট আঁধার হলো উধাও।
আসুন সেই নবির ‘পরে আমরা সবাই দরুদ পড়ি
তাঁর জীবনের আলোকেতে আমরা মোদের জীবন গড়ি।

উপরের পংক্তিগুলি মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)এর শানে রচিত একটি সুবিখ্যাত ও সুপরিচিত নাত যার রচয়িতা পারস্যের অমর কবি মোসলেহউদ্দিন শেখ সাদী (রহঃ)।চার লাইনের এ নাতটির প্রথম তিন লাইন লিখে শেখ সাদী (রহঃ) আর শেষ লাইনটি লিখতে পারছিলেন না| স্বয়ং রসুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে শেষ লাইনের শব্দগুলো শেখ সাদীর মনে গেঁথে দিয়েছিলেন বলে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে গেছেন| এই নাতের মূল পংক্তিগুলি সৌন্দর্যে ভাষান্তরের অতীত। আমরা যে মহাপুরুষের নাতীদীর্ঘ জীবন-কথা ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াসী হয়েছি তাঁর স্বভাবের কোমলতা ও চরিত্রের মাহাত্ব্য এই পংক্তিগুলিতে বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জিত হয়নি।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এটি নিছক একটি নাম নয়। এটি একটি বিশ্বাসের নাম। একটি মহান ধর্মবিশ্বাস তথা ইসলামের মহান প্রচারকের নাম। সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের নাম। আল্লাহর প্রিয় হাবিবের নাম। শেষ বিচারের সেই সুকঠিন সময়ে হতভাগ্য উম্মতের মুক্তির জন্য একমাত্র শাফায়াতকারীর নাম। তিনি আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসুল, হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র বিশ্বের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহুতা'য়ালা ও তাঁর ফেরেশতাকুল নবীর (সাঃ) প্রতি দুরুদ ও সালাম পেশ করে থাকেন। কালেমা-ই তাইয়্যেবায় উচ্চারিত হয় আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ও তাহার প্রিয় হাবিবের নাম।

বিশ্বাসীদের কাছে মহানবী (সাঃ) এর জীবন সম্মন্ধে জানা এবং তাঁর দেখানো পথে জীবন পরিচালনা করা একান্ত অপরিহার্য। এমনকি অবিশ্বাসীদের কাছেও মহানবীর (সাঃ) জীবনালোচনা সত্যিকারের মুক্তির একমাত্র পথ। দুনিয়ার সকল প্রান্তে, সকল সমাজে, প্রধান প্রধান সকল ভাষায় তাঁর অসংখ্য জীবন কাহিনী রচিত হয়েছে। কেননা তিনি মানবেতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ও সফলতম ব্যক্তিত্বও বটে।
ইসলাম ধর্মের একজন একনিষ্ঠ বিশ্বাসী হিসেবে, মহানবী (সাঃ) এর একজন অতি নগণ্য উম্মত হিসেবে তাঁর মহাজীবনের নানা ঘটনা জানার ও বোঝার গভীর আগ্রহ আমার আজন্ম। তাই মহানবীর (সাঃ) মহাজীবনের স্বরুপ সন্ধানে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। আমি মূলতঃ আমার সেই অন্তহীন যাত্রার কথাই আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। আসলে মহানবীর (সাঃ) এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে হলে সবচেয়ে উত্তম সমাধান হলো পবিত্র কোরআন শরিফকে আত্বস্থ করা। কেননা গোটা কোরআনের বাস্তব প্রতিফলন মহানবীর (সাঃ) জীবন। কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই আমার প্রথম লক্ষ্য স্থির করি প্রাণপ্রিয় নবীজী (সাঃ) এর জীবনী পড়া। সেই অনু্যায়ী আমি যেগুলো এখন অবধি পড়েছি তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী আপনাদের সমীপে পেশ করলাম।

১. বিশ্বনবীঃ
লেখকঃ কবি গোলাম মোস্তফা, প্রকাশকঃ আহমদ পাবলিশিং; প্রথম প্রকাশকালঃ ১৯৪২; সাতচল্লিশতম মুদ্রণঃ ২০১১; বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪৭২; দামঃ ২০০ টাকার বেশী না।

মহানবীর (সাঃ) জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা আমার প্রথম পড়া বই কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’। এটি কবি গোলাম মোস্তফার অমর সৃষ্টি। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমার আব্বা আমাকে প্রথম এই বইটি পড়তে দেন। সে থেকে বইটি এতবার পড়েছি যে, বলা যায় এর প্রতিটি অধ্যায় আমার প্রায় মুখস্ত ছিল। আমার মন যখন খুব ভারাক্রান্ত থাকত তখন এই বইটি পড়তাম আর আমার মন ভাল হয়ে যেত। আর মন যখন খুব প্রসন্ন থাকত তখনও এই বইটি পড়ে মনকে আরো প্রশান্ত করে তুলতাম। যাহোক, এই বইটি ছিল আশ্চার্যরুপ সফল গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে হৃদয়ের আবেগ ও বিশ্বাস যেভাবে সমর্পিত হয়েছে, আন্তরিক অনুভূতি বর্ণনায় যেভাবে উচ্চকিত হয়েছে এবং চিত্তের উপলব্দিজনিত আনন্দ ভাষার আবহে যেভাবে জাগ্রত হয়েছে তার তুলনা আমাদের গদ্য সাহিত্যে সত্যিই বিরল। বাংলা সিরাত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বিশ্বনবী’ যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, অন্য কোনটির ভাগ্যে তা হয়নি। এর ভাব যেমন উচ্চস্তরের, ভাষাও তেমনি প্রাঞ্জল, গতিশীল ও ওজস্বিনী।

প্রথম খন্ডে মোট ৫৮টি পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের আলোচনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, হৃদয়গ্রাহী ও প্রাঞ্জল। ‘বিশ্বনবী’ নিঃসন্দেহে একটি গবেষণাগ্রন্থ, সর্বসাধারণের বোধগম্যও। আমার বিশ্বাস এ বিশাল গদ্য কাব্যটি আরও সুদীর্ঘকাল বাঙালি পাঠককে বিমুগ্ধ করে রাখবে। দ্বিতীয় খন্ড মূলত ব্যাখ্যামূলক। বিশেষ বিশেষ কিছু বিষয়াদি সবিস্তার আলোচিত হয়েছে।

এই বইটি পড়ে আমি আমাদের প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি। বিশেষ করে তাঁর ‘আলা-আমিন’ হয়ে ওঠার গল্প, নবুয়তী জীবন, ইসলাম প্রচারের সেই সুকঠিন সময়গুলোর কথা, তাঁর রাজনৈতিক জীবন, মক্কী ও মাদানী জীবন, বহু যুদ্ধের বিবরণ এবং সমাজ সংস্কারে নেয়া তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ, শেষ অবধি ইসলামের জয়জয়কার ইত্যাদি বিষয়াদি এখানে লিপিবদ্ধ আছে।

তবে আমার মনে হয় এই এই বই পড়ে পরিপূর্ণ মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে না। কেননা মোটা দাগে এই বইতে তাঁর নবুয়তী জীবন ও কর্মই প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে মহানবীর (সাঃ) পারিবারিক, সামাজিক জীবনের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আলোচনা নেই। জীবনী রচনা বিধায় বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় হয়ত সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা তো সুন্নাত ওয়াল জামাতের অধীন। তাই আমাদের মহানবীর (সাঃ) জীবনের সকল বিষয় সম্মন্ধে জানা অত্যাবশ্যক। তাই আরো পড়ার কাজ জরুরী বলে মনে হলো।

২. মোস্তফা চরিত:
লেখকঃ মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ; বর্তমান প্রকাশকঃ কাকলী প্রকাশনী; প্রথম প্রকাশক ও প্রকাশকালঃ মুহম্মদী বুক এজেন্সী, কলকাতা থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫৭২; দামঃ ২৮০ টাকার মতো।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ রচিত সুবিখ্যাত একটি জীবনীগ্রন্থ ‘মোস্তফা চরিত’। ব্যাপক গবেষণাধর্মী ও হৃদয়গ্রাহী একটি বই। লেখক বই সম্বন্ধে নিজেই লিখেছেন- ‘এই অসাধ্য সাধন করিতে আমাকে মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া অবিরাম নিভৃত সাধনায় সমাহিত থাকিতে হইয়াছে। আমার এ সাধনা কতটুকু সিদ্ধি লাভ করিয়াছে, বিজ্ঞ পাঠক তাহার বিচার করিবেন। এই ব্যাপারে আমাকে ইতিহাস, জীবনী, তাফসীর, হাদীস ও তাহার ভাষা প্রভৃতি হযরতের জীবনী সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য অধিকাংশ গ্রন্থ অধ্যয়ন ও আলোচনা করিতে হইয়াছে।’
পন্ডিত আকরাম খাঁ তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) এর চরিত্রকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। গ্রন্থটি সম্বন্ধে শাহাবুদ্দীন আহমদ লিখেছেন-
‘বাস্তবিকই ‘মোস্তফা চরিত’-এর প্রায় তিনভাগের একভাগ নবী করীম (সা.) এর জীবনী সম্পর্কিত আলোচনায় বিতর্কিক। ২২৩ পৃষ্ঠা জুড়ে তিনি যে রসূল চরিত্রের মহিমা প্রদর্শনের পটভূমি রচনা করে তাঁর সমীক্ষাধর্মী মনীষার পরিচয় দিয়েছেন, জীবনী রচনায় তা তুলনারহিত। এতে শুধু হাদীসের সত্যাসত্য নিরূপণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সমগ্র ইসলামের আবির্ভাবের কারণের মধ্যে এই সমীক্ষা নিপুণ শিল্পীর সৃষ্ট পোট্রেটের বা ল্যান্ড স্কেপের সৌন্দর্যে বিকশিত হয়েছে। এই বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনায় আকরম খাঁ যে মেধা, পরিশ্রম ও মনীষার পরিচয় দিয়েছেন তা অক্লান্ত সাধনার অধ্যবসায়ের ফল।’’

নবী করীম (সা.) এর জীবনী সম্পর্কিত আমি যে কয়েকটি বই পড়েছি এটির সেগুলো থেকে একদম ব্যতিক্রম। অন্যান্য লেখকেরা যেমন ঢালাওভাবে বিদেশী বিশেষ করে ইংরেজী বই থেকে কিছু বিতর্কিক ঘটনা হুবহু কপি করেছেন বা কোন ঘটনার সত্যাসত্য বিশ্লেষণের প্রয়াস চালাননি এই বইয়ের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। যেমনঃ নবী করীম (সাঃ) এর বক্ষ বিদারণের (সিনা চাক) ঘটনাটির কথা উল্লেখ করা যায়। বেশীরভাগ মুসলিম-অমুসলিম লেখক শুধু বক্ষ বিধারণের কথা স্বীকারই করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং এটাকে খুব সুণিপুণভাবে তাদের বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু মাওলানা আকরাম খাঁ এটি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ব্যাখ্যা আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। কেননা নবীজী (সাঃ) আমৃত্যু নিস্পাপ ছিলেন। যাইহোক, একটা জীবনী রচনা কতটা হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণবন্ত হতে পারে তার প্রমাণ এই বইটি। তবে একটা ব্যাপার হলো, লেখক সাহেব আহলে হাদীস মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন বিধায় নবী করীম (সা.) এর মিরাজ শরীফ তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেও এর বিস্তৃত বিবরণ তিনি দেননি। তিনি মনে করতেন মিরাজ সংক্রান্ত হাদিসগুলির স্থানকালাদি বৃত্তান্ত এবং প্রকৃত স্বরুপ সম্মন্ধে বেশ অসামঞ্জস্য আছে বিধায় এর আলোচনা বিস্তৃত করা সম্ভবপর হয়নি।

এটিও মূলত প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর নবুয়তী জীবন, ইসালাম প্রচারের সুকঠিন সংগ্রামমুখর সেই দিনগুলোর কথা, তাঁর রাজনৈতিক জীবন, সকল যুদ্ধের বিবরণ, বিভিন্ন লেখকেরদের অপ্রিয় যুক্তির খন্ডন এবং সমাজ সংস্কারে নেয়া তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ ইত্যাদি বিষয়াদি এখানে লিপিবদ্ধ আছে। প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর পরিপূর্ণ জীবনালোচনা এখানেও অনুপস্থিত বিধায় আমার অনন্ত যাত্রা অব্যহত থাকল।

৩. সীরাতে ইবন হিশামঃ
প্রথম সীরাতকার হিসেবে বর্তমান বিশ্বে যার নামটি সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবন ইসহাক (জ. ৮৫ হি.-মৃ-১৫১ হি.)। রাসূল (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৭৪ বছর পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী ইবন ইসহাকের রচিত ‘সীরাতু রাসূলুল্লাহ’ সীরাত বিষয়ক সর্বাধিক প্রাচীনতম এবং পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য গ্রন্থ। এটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, সর্বাধিক প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে উন্নতমানের গ্রন্থ। মূলত এই গ্রন্থটিই সকল সীরাত রচয়িতারদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

মূলতঃ প্রাথমিকভাবে ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থটি এত সুবিশাল ছিল যে তা সহজে বহনযোগ্য ছিল না। পরে তিনি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেন। এরপর ইবন হিশাম তাঁর পূর্বসূরী ইবন ইসহাক রচিত ‘সীরাতু রাসূলুল্লাহ’ নামক গ্রন্থটির সংশোধিত, পরিমার্জিত রূপ দিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে ‘সীরাতে নবুবিয়্যা’ নামে প্রকাশ করেন যা সীরাতে ইবন হিশাম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আজ পর্যন্ত এ গ্রন্থটি প্রামাণ্য সীরাত গ্রন্থ হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত। সীরাতে ইবনে ইসহাক লেখা হয়েছিল বুখারী শরীফেরও আগে। আর, সিরাতে ইবনে হিশামকে ইসলামী সাহিত্যের অন্যতম সহীহ তথা নির্ভুল গ্রন্থ হিসাবে ধরা হয়।

মূল রচনাটিকে বক্ষ্যমান সংক্ষেপিত গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, অধ্যয়নের ধারাবাহিকতা বিনস্ট না করার ব্যবস্থা সম্বলিত ও নবতর আঙ্গিকে শোভিত করে সিরাতের নির্যাসটুকু উপস্থাপন করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার’-র পরিচালক এ.কে.এম. নাজির আহমেদ। এই বইটিই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। আমি ডাউনলোড করে পড়েছি।

সিরাতে ইবনে হিশাম বইটি পড়ার সময় মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করেছিল। আমার মনে হয়েছিল আমি যেন রাসুল (সাঃ) এর আমলেই অবস্থান করছি। কেননা এর বেশীরভাগ বর্ণনা সম্মানিত সাহাবী (রাঃ)এর সরাসরি সাহায্য নেয়া হয়েছে। এখানে ঘটনার বিবরণগুলো এত জীবন্ত যে আপনার এই অনুভূতি আসতে বাধ্য যে আপনি নবীজীর (সাঃ) ছায়ায় আছেন। বইটির ভাষার মাধুর্য, ও লালিত্য এবং বিষয়বস্তুর মাহাত্ব্য খুবই আকর্ষণীয়।

এই বইতে নবীজীর সাঃ এর সামরিক ও সাধারণ জীবনেতিহাসসহ গোটা জীবনেতিহাসকে একত্রিত, সংকলিত ও সক্ষিপ্তাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এটা সক্ষিপ্তাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাই এখানেও দৈনন্দিন জীবন, সমাজ জীবনের চিত্র পুরোপুরি আসেনি। তাছাড়া রাসুল (সাঃ) এর নবুয়তী জীবনের মহান ২৩ বছরের অনন্যসাধারণ ভূমিকার প্রভাবে ওইসময়ের মানুষের জাহেলী জীবনকে কিভাবে চিরতরে পরিবর্তন করে দিয়ছিল তার কোন উল্লেখ এই বইতে নাই। কাজেই আমার যাত্রা অব্যাহত থাকল।

৪. আর রাহীকুল মাখতুমঃ
একটি অনন্য সাধারণ সীরাত গ্রন্থ। আলোচ্য গ্রন্থ ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ শাইখ আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী কর্তৃক রচিত। সৌদি আরবের সরকারী উদ্যোগে রাবেতা আলম আল ইসলামীর পক্ষ থেকে ১৩৯৬ হিজরী সনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন-চরিত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপি সীরাতুন্নবী (সাঃ) প্রতিযোগিতায় ১১৮২টি পান্ডুলিপির মধ্যে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী।

মহানবীর (সা.) বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত জীবনী গ্রন্থ ‘আর রাহীকুল মাখতুম’।আর রাহীকুল মাখতুম পবিত্র কোরআন মজিদে ব্যবহৃত একটি বাক্যাংশ যার মানে ‘ছিপি আঁটা উত্তম পানীয়’। সূরা ‘আল-মোতাফফেফীন’-এ আল্লাহতায়ালা তাঁর নেক বান্দাহদের পুরস্কার হিসেবে জান্নাতে এই পানীয় সরবরাহের ওয়াদা করেছেন। কোরআন মজীদ বর্ণিত ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ মুমিনদের জন্য সত্যিই এক শ্রেষ্ঠ পাওনা, যাদের জন্য এই মহা আয়োজন তাদের সর্দারের জীবনী গ্রন্থ ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী একটি ভিন্ন স্বাদের সীরাতগ্রন্থ। সারা দুনিয়ার নবী প্রেমিকেরা মনে হয় এমন একটি সীরাত গ্রন্থের জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেছিল-যাকে এই বিষয়ের ওপর রচিত অতীতের সব কয়টির নির্ভরযোগ্য উপাদানের সমন্বয়ে তৈরী করা হবে। অপর কথায় যা হবে সীরাত সংক্রান্ত বিশাল পাঠাগারের একটি নির্যাস।

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য সম্বলিত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী গ্রন্থ হিসেবে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ বিশ্বের বিখ্যাত উলামা ও গবেষকগণের যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এ বইটি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা সহ পৃথিবীর অগণিত জীবন্ত ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন খাদিজা আখতার রেজায়ী; পরিবেশনায়ঃ আল কোরআন একাডেমী লন্ডন। এটিও অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে পড়েছি।

এই গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল: তৎকালীন আরবের ভৌগোলিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা, রবের ধর্ম-কর্ম ও ধর্মীয় মতবাদ, জাহিলিয়াতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে বংশ পরিচয়, বিবাহ, দাম্পত্য, সন্তান-সন্ততি, তাঁর আবির্ভাব এবং এর পর ঘটনা বহুল পবিত্র জীবনের চল্লিশটি বছর, নুবুওয়াত লাভের পূর্বকালীন সংক্ষিপ্ত চিত্র, নবুওয়তী জীবন এবং তার দাওয়াত, প্রথম পর্যায়ের মুসলিমগণের ধৈর্য ও দৃঢ়তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ, মক্কা ভূমির বাইরে ইসলামের দাওয়াত প্রদান, ইসরা ও মিরাজ, হিজরত, মাদানি জীবন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি-চুক্তি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

সীরাতবিষয়ে লিখিত প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকেও তিনি বহু মণিমাণিক্য উপস্থাপন করেছেন যা ত্রুটিরহিত সংক্ষিপ্ততায়, সুখপাঠ্য দীর্ঘ আলোচনায়, অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। সে হিসেবে, বইটি, বন্ধ্যাত্বের এই আধুনিক যুগে পূর্ণাঙ্গ ও পর্যাপ্ত তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে। বইটি নির্ভরযোগ্যতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড রক্ষা করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সীরাত উপস্থাপন করেছে, যা পাঠকের সামনে উজ্জ্বল করে দেয় সীরাতুল মুস্তাকীমের নিশানাসমগ্র, দেখিয়ে দেয় সীরাতুন্নাবী পাঠের সঠিক পদ্ধতি।

‘আর রাহীকুল মাখতূম’ বইটি পড়ার পর আর ইচ্ছে হলো না সীরাত বিষয়ক আর কোন গ্রন্থ পড়ি। তবে রাসুল (সাঃ) কে আরো গভীরভাবে জানার প্রবল আগ্রহ এতটুকু কমলো না। বরং আরো বেড়ে গেল। এরপর চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালালাম। তার আগে চলুন অন্য একটা বিষয় আলোচনা করি।

মোট ৩ পর্বের এই মেগা পোস্টের ২য় পর্ব দেয়া হবে আগামীকাল, ইনশাআল্লাহ।


উৎসর্গঃ
সদ্যপ্রয়াত আমার প্রাণাধিক প্রিয় ‘মা’ কে।

কৃতজ্ঞতায়ঃ
এটি মূলতঃ একটি সংকলনমূলক পোস্ট। লেখাটি তৈরী করতে সংশ্লিস্ট বইগুলো ছাড়াও উইকিপিডিয়া, অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটি লেখা, ‘কুরআনের আলো’ নামের একটি ওয়েবসাইট এর সাহায্য নিয়েছি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:০১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৌলবাদ: ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ প্রযুক্তি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫১




মজার বিষয়—

আজকের মৌলবাদীরা রোকেয়া বেগমকে মুরতাদ ঘোষণা করে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, অথচ নিজেদের অস্তিত্ব টিকেই আছে যাদের ঘৃণা করে— সেই “কাফেরদের” বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে। ইতিহাস পড়লে এদের বুকফুলা হাওয়া বের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতী এখন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩



শেরে বাংলার নিজস্ব দল ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টি; তিনি সেই দলের নেতা ছিলেন। একই সময়ে, তিনি পুরো বাংগালী জাতির নেতা ছিলেন, সব দলের মানুষ উনাকে সন্মান করতেন। মওলানাও জাতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট

লিখেছেন আরোগ্য, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬



ওসমান হাদী অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, স্পষ্টবাদী কণ্ঠ, প্রতিবাদী চেতনা লালনকারী, ঢাকা ৮ নং আসনের নির্বাচন প্রার্থী আজ জুমুআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×