আজ এই অফিসটাকে ঠিক অফিস অফিস লাগছেনা।একটা মাত্র পিয়ন কিছুক্ষন পর পর চেয়ারম্যানের রুমে পানির বোতল , গ্লাস আর চানাচুড় বিস্কিট নিয়ে যাচ্ছে-আসছে।শিউলীর খুব ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ভেতরে কয়জন আছে,গ্লাস গুনে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।শিউলী প্রথম যে দিন এখানে আসে তখন এমন মনে হয়নি, প্রতিটা ডেস্কেই লোক ছিল ।সবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে,সে কেবল কোম্পানীর ই ডির কাছে নিজের সি ভি দিয়ে চলে গিয়েছিল।ই ডি আশ্বস্ত করেছিলেন ভেকান্সী খালি হলে অবশ্যই ফোন দিবেন।পরবর্তীতে প্রায় এক মাস পর ই ডি ফোন না দিলেও ফোন দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান, বায়োডাটা নিয়ে দেখা করতে বললেন।
শিউলী ঢাকায় এসেছে তা প্রায় দু’মাস।তার গ্রামের বাড়ী নাটরে,ওখানকার কলেজ থেকেই ডিগ্রী দিয়েছে অনেকটা বাবার সাথে যুদ্ধ করেই।কিন্তু কোন ভাবেই বাবা আর পড়াবেন না,শিউলীর ইচ্ছে ঢাকায় এসে সে চাকরী করে মাস্টার্স্টা আগে কমপ্লিট করবে।তাই মায়ের দূর সম্পর্কের ভাইয়ের ঠিকানা নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দিল।
মামী যে তাকে সাদরে থাকতে দিয়েছিল ,তা না।হোস্টেলে থাকার জন্য সে খুবই জোর করতে লাগলো।মামীর বয়স তার কাছাকাছি ,দু’জনে বান্ধবীর মতোন গল্প করতো সারা রাত।এক রাতেতো শিউলী বলেই ফেললো-আচ্ছা মামী,তুমি যে সারা রাত আমার কাছে থাকো,মামা তোমাকে বকে না।
-বকে,কিন্তু কি করবো।জেগে জেগে তোকে পাহাড়া দেই।
-কি আশ্চর্য ,আমাকে পাহাড়া দিবে কেন?আমি কি চোর?
-না,তুই মেয়ে মানুষ।
-মানে কি মামী?
-শোন,আমি যদি এই ঘরে না ঘুমাই তাহলে আমাকে বাহিরে থেকে আটকিয়ে তোর মামা তোর কাছে শুবে?তুই কি তাই চাস?
এরপর আর কোন উত্তর দিতে পারেনি শিউলী।আকাশে সূর্য ওঠার আগেই সেও বাড়ি ছেড়েছে ,হাতে ছিল নিবেদিকা লেডিস হোস্টেলের ঠিকানা।তারপর ফার্মগেট চোষে সে সেই হোস্টেল বের করেছে।এক সাথে চারজন থাকার ব্যবস্থা,সাথে তিনবেলা খাবার।মা হাতে যা দিয়েছিল তা দিয়ে টেনে টুনে আর বড় জোর এক মাস চালানো যাবে।চাকরীটা তার খুব দরকার।যে টুকটাক কম্পিউটারে কাজ শিখেছে তা দিয়ে মাসে অন্তত আট হাজার টাকার মাইনের একটা চাকরী কপালে জুটে যেতে পারে।
শিউলী ঘড়ি দেখে ,বিকেল চারটা।এক ঘন্টা ধরে সে বসে আছে।আর কিছুক্ষন পর সন্ধ্যা নেমে যাবে।শীতের দিন ধরে রাখা খুব কঠিন।এর মধ্যে বেল বাজলো,পিয়ন ছেলেটা দৌড়ে ভেতরে গেল।কিছুক্ষন পর বের হয়ে শিউলীকে উদ্দেশ্য করে বললো-বস,আপনাকে ভেতরে যেতে বলসে।
ভেতরে পা রেখে মোটা মোটি হক-চকিয়েই গেল শিউলী।এই শীতের মধ্যে রুম ঠান্ডা করে যিনি বসে আছেন তার সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি।তার পাশে আরো দু’জন মোটা মতো লোক বড় বড় চোখ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।বস তাকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললো-বসেন,আনোয়ার সাহেব চলে আসবে।
যতো দূর মনে পড়লো ই ডি যখন তার হাতে কার্ড দিয়েছিল ওতে আনোয়ার নাম তা ছিল।হোস্টের একজন অল্প পরিচিত মেয়ে তাকে এই অফিসের ঠিকানা দিয়েছিল ,কিন্তু সবার নাম সে বলতে পারেনি।আর শিউলী কা্রো নাম জানতে চায়নি,তার দরকার একটা কাজ।
প্রথম প্রশ্নটা বসই করলো-কয় দিন হয় ঢাকায় এসেছেন?
-বেশি দিন হয় নি,প্রায় দু’মাস।
-কোথায় উঠেছেন?
-হোস্টেলে ,ফার্মগেট।
-ওহ,তাহলেতো আপনাকে তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে,ওরা তো আবার আটটার পর ঢুকতে দেয় না।
শিউলী হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লো।বস তার হাত থেকে বায়োডাটা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছে-সমস্যা নেই,আমাদের এখানে অনেক কাজ আছে।এন জি ও সেক্টরে মেয়েরাতো খুব শ্রম দিচ্ছে।বাই দ্যা ওয়ে আপনি ফিল্ডে কাজ করতে পারবেন তো?
-জ্বী পারবো।
-কিছু মনে করবেন না,মফস্বল থেকে যে সব সুন্দরী মেয়েরা ঢাকায় আসে তারা প্রথম প্রথম কাজে নামার আগে বলে -পারবো।আর যখন ফিল্ডে পাঠানো হয় তখন বলে-রোদে কালো হয়ে যাচ্ছি।হা হা হা ...
দুই মটু বসের হাসিতে হাসি মেলালো।এরা কি কোম্পানীর ডিরেক্টর নাকি এই বসের বন্ধু তা জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না শিউলী ।সে খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে-এই লোক কি তাকে অকর্মন্য ভাবে নাকি?রীতিমতোন কাজের মেয়ের মতোন খেটে তাকে ডিগ্রী পাশ করতে হয়েছে বাপের বাড়িতে আর এখন তো তাকে কাজ করতেই হবে।
শিউলী খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলো-আনোয়ার স্যার কখোন আসবেন?
তার দিকে কোকের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বস বললো-এতো টেনশন করছেন কেন,চলে আসবে।আপনি কোক খান।দেখবেন গল্প করতে করতে চলে আসবে।
-আমি কি গল্প করবো স্যার,আমার কাছে কোন গল্প নেই।
-এই আপনার কলেজ জীবনের কথা বলুন,স্কুলের কথা বলুন।শুনেছি গ্রামের মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।
-জানিনা স্যার।তবে আমাদের খুব যুদ্ধ করে লেখা পড়া করতে হয়।ক্লাশ সিক্সে উঠলেই বাবা মা বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
-আপনিতো অপূর্ব সুন্দরী,আপনাকে কয় জন বিয়ে করতে চেয়েছে?
শিউলী বুঝতে পারছেনা ,তার কাজের সাথে এই জাতীয় প্রশ্নের কোন সমন্বয় আছে কিনা।কেবল চোখের সামনে ধোঁয়াশা লাগছে,কোক খেলে এমন কখনো লাগেনি আগে। এটা কোন দেশের কোক প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরতে থাকে।সে কিছুই বলতে পারে না ,কেবল হাসির শব্দ শোনা যায়।নানা রঙের হাসি।অট্ট-হাসি,মুচকী হাসি ,বুক হীম করা হাসি – সে হাসির মধ্যে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে শিউলী।নিজেকে এতো ভার লাগে,এতো ভার যেন কোন দিন লাগেনি।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ।।
শিউলী যখন চোখ মেললো তখন তার গায়ে কেবল কামিজ ছাড়া আর কিছুই নেই,তাও পুরো জামাটা ভেজা।বহু চেষ্টা করেও সে উঠে দাঁড়াতে পারলোনা,অন্ধকারের মধ্যেই বুঝতে পারলো এই ঘরে আর একজন আছে।কিন্তু সেটা কি সেই বস ,নাকি বাকী দুই জন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।সে গোঙ্গাতে লাগলো, চিৎকার দেবার মতো তার শরীরে শক্তি নেই।অবশ্য এই রুম থেকে হাজার চিৎকার দিলেও লাভ হবে না,শব্দ বাইরে যাবে না।তার মুখের কাছে মোবাইলের আলো জ্বলে উঠলো।সেই আলোতে সে আনোয়ার স্যারের মুখ দেখতে পেল।প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে সে প্রশ্ন করলো-আপনাকে আমি বলেছি,আমি ডাকবো।আপনি আমার সাথে কথা না বলেই অফিসে এলেন কেন?
কোন শব্দই বের হচ্ছে না মুখ থেকে।শিউলীর হাতে এক গ্লাশ পানি ধরিয়ে দিল আনোয়ার।ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে তার পিঠে সোফার কুশন দিয়ে দিল।
এবার একটু বসতে পারছে শিউলী।কিন্তু এতোক্ষন তার সাথে কি হয়েছে তা বুঝতে কিছুটা সময় নিল ।নিজেকে সামলে উত্তর দিল-
-আমাকেতো বস বললো আপনি আসবেন।
-আর আপনি তাই বিশ্বাস করে ওয়াইন খেলেন আর তাদের সাথে গাল গল্প করলেন।
-স্যার কয়টা বাজে?আমি হোস্টেলে যাবো।
-আপনি কি জানেন আপনার সাথে কি হয়েছে?
শিউলীর সাথে কি হয়েছে তা এতোক্ষনে সে নিজেও তা পরিস্কার,কিন্তু এই শুভ কর্মে আনোয়ার তাদের সাথে শামিল ছিল কিনা সেই ব্যাপারে সে কনফিউজড।তার মস্তিষ্কে কেবল তিনটি কালো মুখ আর অট্টহাসি ছাড়া আর কিছুই নেই।
-শিউলী,রাত একটা বাজে।আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার সাথে কি ঘটে গেছে?
এবার খুব বিরক্ত হয়ে যায় শিউলী-কি হয়েছে ?বার বার এক কথা বলছেন।আমার সাথে কি আর হবে ।যা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।
-আশ্চর্য ,আপনি কি ইচ্ছে করেই ঘটনাটা ঘটতে দিলেন।আমার নম্বরতো আপনার কাছে ছিল।
-আমার কাছে নম্বর ছিল ,কিন্তু মোবাইল ছিল না।আর যখন আমি অলরেডি তাদের জিম্মায় তখন আপনাকে ফোন করার কোন অবস্থাই ছিল না।
-আপনি এখন কি করতে চান বলেন,বাবা মার কাছে যাবেন?আমি ব্যবস্থা করি।
-আপনার কি ধারণা আমি এখন কান্নাকাটি করে এলাকা গরম করব,আর মিডিয়া এসে আমাকে উদ্ধার করবে।আমি বাবা মার কোলে ফিরে যাবো,তা সম্ভব না।
-না,এমন কিছুই আমি ভাবছি না।আর ওরা আপনাকে আমার কাছে দিয়ে গেছে।এখন আপনি যদি এলাকা গরম করেন তাহলে ফাসবো আমি।এই অফিস আর চালাতে হবে না,বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হবে।
-থাক,আপনার বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হবে না।আমি সকাল হলে চলে যাবো।
-আচ্ছা,আপনার কি মনে হয় ওই লোক এরপর আপনাকে জব দেবে?ইনফ্যাক্ট কিছুই দেবে না।আর এখানে কোন ভ্যাকেন্সী নাই আগেও বলেছি।ও কেবল ফুর্তি করার জন্য আপনাকে ডেকেছে।
শিউলী বুঝতে পারছে না,তার কি এখন চিৎকার করে কাঁদা উচিৎ ।কিন্তু তার কান্না আসছে না,আসছে খুব ক্ষিদে ।দুপুরের পর থেকে একটা দানাও তো পেটে পড়েনি।সে আনোয়ারকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-আচ্ছা,আপনার অফিসে কি কিচ্ছু খাওয়ার নাই?পিয়নকে দেখলাম বিস্কিট চানাচুড় নিয়ে ছুটো ছুটি করতে।আনোয়ার খুব হক চকিয়ে গেল প্রথমটা ,পরে নিজেকে সামাল দিয়ে হাসলো-সত্যি ,ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
সে শিউলীকে সোজা করে বসালো,অন্ধকারের মধ্যেই মেয়েটার জামা খুলে চাদর পেঁচিয়ে দিল।একবারো শিউলী তা্তে অসম্মমতি করলো না,আনোয়ারের কাঁধে ভর দিয়েই বাথরুমে গেল এবং গায়ে পানি ঢাললো।রুমে ফিরে সেই স্বল্প আলোতেই দেখতে পেল প্লেট ভর্তি খাবার।
খুব আবাক হয়ে শিউলী প্রশ্ন করলো-এই ভাত কোথা থেকে এলো?
-আমি যখন রাতে অফিসে কাজ করি তখন আমার ওয়াইফ খাবার দিয়ে দেয়।
-ছি ছি স্যার,আমি এটা খেতে পারবোনা।আপনার খাবার আমি খাই কি করে ?
-তুমি খাও,তোমার উপর দিয়ে যা গেছে তাতে এই খাবার সামান্য।আমি সকাল হলে বাড়ি গিয়ে খাবো।আর শোন ,আজকের কথা একদম ভুলে যাবা।কাউকে কোন দিন বলবানা।
অনেকটা ধমক দিয়েই আনোয়ার বললো-কি ,বুঝতে পেরেছো?
অন্ধকারের মধ্যেই শিউলীর হাসি মাখা মুখ উজ্বল হয়ে গেল-আচ্ছা স্যার ,আপনিও কি তাদের মতোন করবেন আমার সাথে?এবার খুব রেগে গেল আনোয়ার-এতো বুঝো,আর ওরা যে তোমাকে মিথ্যে কথা বলে এখানে আনলো তা বুঝোনি।
শিউলী ভাত খেতে খেতে বললো-বুঝেছি,কিন্তু ততক্ষনে আমার আর কিছুই করার ছিল না।আমি যখন কোকের গ্লাস খালি করেছি,তখন বুঝতে পেরেছি আমার কোকে অন্য কিছু মেশানো ছিল।স্যার জীবনে আমি কোন দিন ঘুমের মেডিসিন খাইনি।তাহলে লাল পানি খেয়ে কি ভাবে ঠিক থাকবো তাই বলেন ।
-বুঝলাম,কিন্তু এখনতো ঠিক মতোন হোস্টেলে ফিরতে পারবা?নাকি আবার শালিস কেন্দ্রে যাবা?
-ওইটা আবার কি স্যার?
-থাক,অতো বোঝা লাগবে না।আর ওই খানে গেলে আমার অফিসের বারোটা বাজবে আগে।আর তোমার ভাবী আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।
আনোয়ারের হঠাত খেয়াল হলো সে অনবরত শিউলীকে তুমি তুমি করে যাচ্ছে।তাই খুব সংযত হয়েই প্রশ্নটা করলো-আমি যে আপনাকে তুমি তুমি করছি আপনি রাগ করছেন নাতো?
এবার খুব জোরে হেসে উঠলো শিউলী-আপনি যদি আমাকে তুই করেও বলেন তাও কিছু করার নেই স্যার।আপনি যে দয়া করে আমার উপরে না চড়ে আমাকে খেতে দিয়েছেন তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।
আনোয়ার খুব লজ্জা পেল,এ লজ্জা পুরুষ হয়ে জন্মানোর লজ্জা।মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যেই কেমন করে যেন বদলে যাচ্ছে।প্রথম দিন তাকে দেখেছিল সদ্য মফস্বল থেকে আসা লাজুক একটা মেয়ে।এখনকার শিউলীকে তার ভীষন অচেনা মনে হয়।এই মেয়েটি কি আর কোন দিন তার কাছে চাকরী খুঁজতে আসবে?নাকি এই শহরের কোন অন্ধকার গলিতে সে হারিয়ে যাবে।রাতের মক্ষিরানীরা লুফে নেবে রাতের শিউলী আর সারা রাত ধরে ছড়াবে তার সুগন্ধী , অবশেষে ভোরের আলোতে ঝরে পরবে ধুলোময় রাস্তায় আর তা মাড়িয়ে কর্ম-ব্যস্ত জীবন আবার চঞ্চল হয়ে উঠবে।সবার অন্তরালে ফুটে উঠবে আরো কোন শিউলী।
(লেখাটা মোটেও এখানে শেষ করার ইচ্ছে নেই,কিন্তু অদ্রী ল্যাপটপের জন্যে অস্থির করে ফেলছে।আগে ডিজিটাল বাচ্চা শামলাই,তারপর গল্পটা পুনরায় সাজাবো।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:২৭