somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘ বালিকার দেশে -দার্জিলিং থেকে মিরিক //

১০ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দার্জিলিং বা কোলকাতা যেখানেই হোক না কেন ভারতের ভিসা পাওয়া এমনিতেই অনেক ঝক্কি।আজকালতো ই -টোকেন পাবার জন্য বেশ মোটা অংক গুনতে হয়।এই নিয়ে পত্র পত্রিকায় কম লেখা হয়নি। সে যাই হোক,আমার ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে।অনলাইনে ফর্ম ফিলআপ করার সময় চেংড়াবন্ধা র‍্যুট লিখে দিলাম, খুব একটা সময় লাগেনি ভিসা পেতে।ঢাকার উত্তরা থেকেই ছয় মাসের সীল লেগে গেল,কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতো লম্বা জার্নি আমি কি করে একা করি।ইন্ডিয়াতে দু’জন লেখক বন্ধু শিলিগুড়িতেই থাকেন,তারা না হয় চেংড়াবান্ধা থেকে আমাকে রিসিভ করবেন ।কিন্তু একা ঢাকা থেকে বুড়িমাড়ি কি করে যাই, রংপুর অব্দি যাওয়া কোন সমস্যা না।তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম, কোন ভাবেই কারো সাথেই র‍্যুট মেলে না।বেশির ভাগ বন্ধুদের প্রবেশদার কোলকাতা।এখানে বলে রাখা ভালো -ইন্ডিয়াতে যে পথে গমন সেই পথেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়।
আমার এই বিশাল সমস্যার সমাধান করে দিন ত্রিপুরায় থাকা প্রিয় বন্ধু মনীষা পাল।তার নিজেরই চ্যানেল আছে -ভূবেনশ্বরী স্যাটেলাইট চ্যানেল ।তাকেই অবশেষে অনুরোধ করলাম।অনুরোধে বেশ দ্রুত কাজ হয়ে গেল,আমার সাথে থাকা অন্য দুই বন্ধু ভিসা অফিসারের সাথে দেখা করতেই তাদের আরো এক খানা বাড়তি র‍্যুট দেওয়া হলো ।আর আমি বোনাস হিসেবে পেলাম কোলকাতা।ভাবলাম ফেরার সময় কোল কাতা দিয়েই ঢাকায় ফিরবো।কিন্তু সময়ের অভাবে তা আর হয় নি।
ঢাকা থেকে চেংড়াবন্ধা বর্ডারে প্রবেশ করার একটাই সহজ পথ তা হচ্ছে বুড়িমাড়ি ,বাসে যেতে হয় ।সময় মোটা মোটি ভালোই লাগে,কিন্তু খরচ কমই হয়।কল্যানপুর থেকে বাস ছাড়লো রাত ৯ টায় ।যমুনা সেতু পাড় হবার পর বাস ফুড ভিলেজে বিরতী দিল। এখানে খাবারের মান বেশ ভালো যদিও দামটা একটু চড়া।তবু রাতের খাবারটা সেড়ে নিলাম,কারন অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।বার বার চোখ লেগে আসছিল ,জার্নিতে কেন যে ঘুম পায় তা কে জানে।আমরা বুড়ি মাড়ি যখন পৌছলাম তখন ৬ টা ত্রিশ বাজে।এখানে সবার পাসপোর্ট ও সাথে ট্রাভেল ট্যাক্স হিসাবে ৩৬০ টাকা জমা নিয়ে নেওয়া হলো। বর্ডার যেহেতু সকাল ৯ টার আগে খোলে না তাই আমরা লালমনিরহাটে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করলাম এবং নাস্তাও সেড়ে নিলাম।সবার পাসপোর্টের সাথে মিলিয়ে দেখবার জন্য ছবি তোলা হলো,তারপর এন্ট্রি সিল দেওয়া হলো।আমার মনে হচ্ছিল নতুন করে বুঝি পাসপোর্ট বানাতে দিচ্ছি।বেশ মজাই লাগছিল।একজন কর্মকর্তাতো বলেই ফেললেন -আপনার ছবি দেখি পরিস্কার আসছে না।আমি হেসে উত্তর দিলাম-সারা রাত জেগে এসেছিতো ,সব মেকাপ উঠে গেছে।এই সকালেও এখানে লোড-শেডিং চলছে।আমি বললাম-ভাই,এত্তো বড় একটা ইমিগ্রেশন আর এখানে পাওয়ার নাই?তিনি কোন উত্তর দিলেন না,সম্ভবত এই প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না।
বর্ডারের এই প্রান্ত থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ওয়েল কাম ইন্ডিয়া ।আমরা হেঁটে হেঁটে বর্ডার ক্রস করলাম,সেই সাথে আমাদের ল্যাগেজ গুলো কোন চেকিং ছাড়াই ঢুকে গেল ভারতে।ওই পাড়ে গিয়েই ঘন্টা খানেক সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকলাম।কোথায় যাবন,কি করি -এই সব প্রশ্ন করতে থাকলেন অফিসার ,আমরা সোজা উত্তর দিলাম-দার্জিলিং।অফিসার আর তেমন কোন প্রশ্ন করেননি,একজন কেবল জানতে চেয়েছিল সাথে ডলার আছে কিনা।আমি হাসলাম-লেখকের কাছে বই থাকে ভাই,ডলার থাকে কোটি পতির ল্যাগেজে । এরপর শ্যামলীর লোকেরাই একটি দোকানে নিয়ে গেলো যেখান থেকে আমরা বাংলাদেশী টাকা ভাঙ্গিয়ে ইন্ডিয়ান রুপি করে নিলাম।এবার যেতে হবে শিলিগুড়ি,বাসের জন্য আর অপেক্ষা করলাম না।খুব ক্লান্ত ,তাই ভারতীয় বন্ধুদের রিজার্ভ করে আনা টেক্সিতেই উঠে পড়লাম ১২০০ টাকায় । চেংরাবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি মাত্র দেড় ঘন্টার পথ,কিন্তু আমি লাগিয়ে দিলাম পাক্কা দুই ঘন্টা।কারন এই পথে ভারত প্রবেশ জীবনে এই প্রথম।যা দেখি তাই যেন নতুন লাগে,কিছুক্ষন পর পর টেক্সি থামাই আর ছবি তুলি।চৌরাস্তার মোড় যখন পাড় হচ্ছিলাম তখন জাকিয়ে বৃষ্টি নামলো ,ওদিকে ড্রাইভারের গাড়ির কাঁচ মোছার জন্য নেই কোন ওয়েফার ।কোথায় ভয়ে সিটিয়ে যাব তা না,পীচ ঢালা পথ মাড়িয়ে যেন সাদা কোন দ্বীপে ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগলাম ।
পাশ থেকে একজন বলে উঠলো-এমন বৃষ্টি ,আজ আর দার্জিলিং পৌঁছতে পারবো না।অল রেডি দুটো বাজে।
ওখান থেকে নিম্নে চার ঘন্টার রাস্তা।তাই ঠিক করলাম শিলিগুড়িতেই রাত কাটাবো।আমার কিন্তু খুব চার্মিং লাগছিল,এতোকাল বইতে পড়েছি এই শহরের নাম ,আর আজ তার বুকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি।আমরা মহানন্দা ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছতেই বৃষ্টি ধরে এলো।এখানে একদম লোকে লোকারণ্য ,সিজন চলছে ।দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা চলে এসেছে,নেমে দেখি কোথাও রুম খালি নেই।যাও বা আছে,দুটো রুমের ভাড়া চায় চারটের সমান।তখন ট্যাক্সিচালকই পরামর্শ দিল এয়ার ভিউতে থেকে যেতে ।আমিতো হোটেলের রুম দেখতে গিয়ে মহা বোকা হলাম,ওদের ওয়াশ রুমে কোন টয়লেট পেপার নেই এবং কোন স্যান্ডেল নেই।।ম্যানেজারকে এই প্রশ্ন আমি বহুবার করেছি ,কিন্তু উত্তর একটাই -এইগুলো আমরা দেইনা দিদি।
যদিও ভোরে ওঠার অভ্যেস আমার নেই ।কিন্তু ,কি এক অদ্ভূত সকাল আমাকে চোখ মেলতে সাহায্য করে দিল।নতুন শহর ,আমরা ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম দার্জিলিং যাবার উদ্দেশ্যে ।নাস্তা করলাম একটি বিহারী রেঁস্তোরায়-চাপাতি ,ছোলার ডাল আর ডিম ভাজি।ছোট ছোট বাটি একটি স্টিলের থালায় সুন্দর করে সাজানো।এতো ছোট বাটি আমি এর আগে কোন দিন দেখিনি,মনে হচ্ছিল বাচ্চাদের খেলনা ভেঙ্গে আনা হয়েছে।কিন্তু,খাবার মুখে দিয়েই বুঝলাম -অনেক সুস্বাদু । এই শহরে খাবারের বিল এতো কম হয় আগে আমার জানা ছিল না।আমি আয়েশ করে এক কাপ দুধ চা খেলাম।মহানন্দার মোড়েই পেয়ে গেলাম জীপ-টাটা ।পাহাড়ি পথে সব ধরণের গাড়ি উঠতে পারে না,তাই বিশেষ জীপের বিশেষ ড্রাইভাররা খুব কনফিডেন্ট থাকেন। আমরা জীপের পিছনের চারটি সিটে ভাগাভাগি করে বসেছিলাম। মাঝের সিটে বাঙ্গালী আরো চারজন এবং সামনের সিটে ড্রাইভারসহ তিনজন। মোট এগারজন একটি জিপে। মালপত্র যা ছিল সব ছাদে বেঁধে দেয়া হলো।আরম্ভ হলো আমাদের দার্জিলিং ভ্রমণ ,আমি বুঝতে পারছিলাম কিছুক্ষন পর পর আমার কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।তাই বার বার পানি খেয়ে ঢোক গিললাম।মনে হয় এতে খুব কাজ হলোনা,এতো উঁচুতে জীবনে আমি কোন দিন উঠিনি।বোকার মতোন পাহাড়ের গাঁয়ে গড়ে ওঠা শহর দেখতে লাগলাম। খাঁদের কিনারা দিয়ে ড্রাইভার যেভাবে কনফিডেন্টলি গাড়ি চালাচ্ছিল, আমি আতংকে বিস্বয়ে হতভম্ব।কিন্তু আমার সঙ্গী সাথীদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল-ওরা এই পথে এতোটাই অভ্যস্থ যে এটা আর এমন কি ,এর চাইতে হিমালয়ে ওঠা অনেক সহজ !
চার চাকার সাদা টাটা যেন উড়ে চলেছে একদম খাড়া পথে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ।কেবল উঠছেইতো উঠছে,হঠাৎ ছিমছাম রেল-স্টেশন দেখে আমার চোখ আটকে গেল।নেপালী ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম গাড়িতে ব্রেক কষতে, কেবল আমি একাইযে মুগ্ধ হয়ে নেমে গেছি তা নয়, সাথে আমার সহযাত্রী আরো সাত জন।হুম,বলছিলাম “ঘুম” রেলস্টেশনের কথা।পাহাড়ের এত উপরেও যে রেলগাড়ি চলতে পারে তা কেবল সিনেমায় দেখেছি।এবার দু’চোখ ভরে দেখলাম কেমন হেলতে দুলতে ৭০০০ ফিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি।
ঘুমে কিছু ছবি তুলে নিলাম জেগে জেগেই।এবার আসল জায়গায় যাবার পালা।ঘড়ির কাটা তখন বেলা বারটা ছুঁয়ে গেছে ,জীপ এসে ঠেকলো এক জনবহুল লোকালয়ে। চারদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে।কারন আমরা দার্জিলিং-এর একদম সুউচ্চ চূড়ায় অর্থাৎ প্রায় ৭৫০০ ফুট উপরে পৌঁছে গেছি, জুন মাসে এখানে সিজন চলে।বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকে বলে অভিভাবকরা এই সময়টাতেই বাচ্চাদের বেরানোর জন্য নিয়ে আসে ।আর কোলকাতা বা দিল্লী যে কোন পথেই দার্জিলিং খুব কাছের একটি পর্যটন কেন্দ্র ।
পাহাড়ের উপর একটা আস্ত জেলা ,চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা।কি নেই এখানে ?হাসপাতাল ,বড় বড় রেস্টুরেন্ট ,চিড়িয়াখানা ,বিশাল বিশাল মল,চা বাগান ,মন্দির ,চার্চ,পার্ক স্কুল,আর সব কিছুকে ছাড়িয়ে দেখা যায় টাইগার হিল।ছোট ছোট পুতুলের মতোন বাচ্চারা উঁচু উঁচু সিঁড়ি বেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় তারা কতোটা পরিশ্রমী জাতি।আমাদের গাড়িটি যখন প্রায় চূড়ায় পৌঁছে গেছে তখন বেশ কয়েকজন ট্রাফিক এসে রাস্তা আগলে দিল।ভাবা যায়,এতো উচ্চতায় এসেও জ্যামে পেয়েছে।বাকীটা পথ হেঁটেই উঠতে হবে।ঘাড়ের ব্যাগ নিয়ে আমরা তখন আকাশ মুখে টেনে চলেছি পা দু’খানা ,মাধ্যাকর্ষনের বিপরীতে এমন হাঁটা হয়নি কোন দিন।তাই ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেও ঘামতে লাগলাম,কিন্তু হেঁটে হেঁটে লাভ নেই।কারন, একদিকে হোটেলে যেমন রুম খালি নেই অন্য দিকে আরম্ভ হয়েছে বৃষ্টি।শীতের কথা আগেই জেনেছিলাম ,কিন্তু আচমকা এমন বৃষ্টি সত্যি অবাক করে দিল।দুপুর একটাকে মনে হচ্ছিল সন্ধ্যা সাতটা।চারপাশে কেবল পাহাড় আর সাদা সাদা মেঘ।দেখে মনেই হবে, তারা একে অন্যের সাথে লুকোচুরি খেলছে।আমরা রাতে থাকার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আর একটা জীপ নিয়ে সাইট দেখতে রওনা হলাম ।
দার্জিলিঙ্গের দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আগেই কিছুটা ধারণা নিয়েছিলাম।তারমধ্যে অবজারভেটরি হিল ,সেন্ট অ্যাণ্ড্রুজ চার্চ ,ওয়ার মেমোরিয়াল ,পিস প্যাগোডা , চৌরাস্তা অ্যান্ড দ্য মল ,হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেন ,পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্ক ,ধীরধাম মন্দির আছে।জিলাপীর মতোন ঘুরে ঘুরে এবার জীপ নীচের দিকে নামছে।হঠাত মনে হলো দশ মিনিট আমরা একে অন্যকে দেখতে পেলাম না,পরে বুঝলাম মেঘ এসে আমাদের সমস্ত শরীর ঢেকে দিয়ে গেছে,সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস।প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর জীপটি ডান দিকে ইউ টার্ন নিল।আমি লক্ষ্য করে দেখলাম জীপটি চলে যাচ্ছে মিরিক শহরের দিকে যেটা গিয়ে মিশেছে একদম নেপালের বর্ডারের সাথে।আমার ডান পাশে তখন বিরাটাকায় পাহাড় আর বাম পাশে পাইন গাছের লম্বা শারি ,মাঝ খানে পীচ ঢালা পথ।মনে হচ্ছিল কে যেন নীল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে আর তার উপর দিয়ে উড়তে উড়তে আমরা ঘন অরণ্যে তলিয়ে যাচ্ছি।নীচের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছিল পাহাড় খোদাই করা শহর ,হাজার লোকের বাস যেখানে।স্কুল থেকে ফিরতে থাকা বাচ্চাদের কোলাহল আর গীর্জার টুং টাং শব্দ কানে এসে এক অপরূপ ছন্দে মাতোয়ারা করে দিল নিমিষেই।আমরা নীচে নামতে নামতে মিরিকের একদম স্বচ্ছ হ্রদের কাছে চলে গেলাম।

এই হ্রদটির নামই সুমেন্দু হ্রদ। হ্রদের একদিকে বাগান, অন্য দিকে পাইন গাছের সারি। দুটি পাড়কে যুক্ত করেছে রামধনু সেতু। পুরো সাড়ে ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ হ্রদটিকে ঘিরে রেখেছে। হ্রদের পশ্চিম পাড়ে আছে সিংহ দেবী মন্দির। এখানে হাঁটতে হাঁটতে আর ছবি তুলতে তুলতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করে নিলাম।। পাহাড়ের ঠিক মাথার উপর তখন মেঘ খেলছে,এ কোন ভাবেই ক্যামেরায় বন্দী করার দৃশ্য নয়।চোখের লেন্সের মধ্যেই আজন্ম কারাবাস হয়ে থাকবে এমন মুগ্ধকর দৃশ্য ।অনেকে বোটে করে হ্রদে ঘুরে বেরাচ্ছে ,কেউবা ঘুরছে ঘোড়ায়।এখানে দাঁড়ালে নেপালের পাহাড়ের বেশ অনেকখানি অংশ এক নিমিষেই দেখে নেওয়া যায় ।
৪৯০৫ ফুট উচ্চতার মিরিকে যেতে দার্জিলিং থেকে প্রায় ৪৯ কিমি পথ অতিক্রম করতে হয়েছে ।আর যদি শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি কেউ আসেন তাহলে ৫২ কিমি পথ যেতে হবে।বলার অপেক্ষা রাখেনা,এখানে কিন্তু আর বৃষ্টির ছিটে ফোটাও ছিল না ।কেবল মেঘ আর ঘন অরন্য,মনেই হচ্ছিল একে অন্যকে আলিঙ্গন করে পাহাড়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।আর পাহাড়টাও কেমন নির্বিকার আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে আছে আকাশের গায় ।
দার্জিলিং-মিরিক পথটি কিছুটা নেপাল সীমান্ত ছুঁয়ে গেছে। এই সুযোগে আমরাও জীপে চেপে নেপালের ভিতর ঢুকে ৩-৪ কিমি গিয়ে দেখে এসেছি সস্তার বাজার পশুপতি মার্কেট। মিরিক শব্দটি এসেছে লেপচা শব্দ ‘মির-ইয়ক’ থেকে। এর অর্থ ‘আগুনে পুড়ে যাওয়া স্থান’। এখানকার জলবায়ু সারাবছরই মনোরম থাকে । গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০° সেলসিয়াস এবং শীতে সর্বোনিম্ন ১° সেলসিয়াস ।তাই জুন মাসে খুব একটা গরম কাপড় পড়তে হয়না এই অঞ্চলে ।
এখানে খাবার জন্য বেশ কয়েকটি ভালো হোটেলও আছে,একটা রেস্টুরেন্টতো একদম পাহাড়ের উপর ঝুলে আছেও দেখলাম। টি প্লাস খুব ভালো ফাস্ট ফুডের দোকান । এছাড়াও অন্য রেস্তোঁরাগুলি হলো গীতাঞ্জলি নেপালী হোটেল ও হিলস্‌ রেস্তোঁরা । সরকারি সংস্থা ডিজিএইচসি পরিচালিত একটি মোটেল এবং লেকের কাছে একটি টুরিস্ট লজ আছে । এছাড়াও অনেকগুলি ভালো হোটেল আছে কৃষ্ণনগরে যেমন জগজিৎ, সদভাবনা, রত্নাগিরি, মেহলুং, দ্য পার্ক হোটেল, ভিরাস, পারিজাত এবং ব্লু লেগুন । মিরিক বাজারে আছে বৌদির হোটেল ও হোটেল পায়েল । নিঘা, আশীর্বাদ ও বুদ্ধ - এর মত লজ ও প্রাইভেট গেস্ট হাউসও আছে এখানে । মিরিকে একটি সুন্দর বনবাংলো আছে যেটি কার্সিয়াং জেলা বনদপ্তর থেকে বুক করতে হয় । লেকের কাছে একটি পাবলিক ওয়র্কস ডিপার্টমেন্ট ইন্সপেক্সন বাংলো আছে যেটি বুক করতে হয় শিলিগুড়ি পি ডব্লু ডি অফিস থেকে ।
ভারতের ২০০১ সালের আদম শুমারি অনুসারে মিরিক শহরের জনসংখ্যা হল ৯১৭৯ জন ।এখানে সাক্ষরতার হার ৭৪%, । পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮২%, এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৬৫%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার তখন ৫৯.৫%, তার চাইতে মিরিক এর সাক্ষরতার হার বেশি।এখানে একটি সরকারী হাসপাতালাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
মিরিকের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর বাগডোগরার দূরত্ব ৫২ কিমি এবং শিলিগুড়ি দিয়ে গেলে নিউ জলপাইগুড়ি- সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন ।মিরিক থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত শেয়ার টাক্সি এবং বাস চালু আছে । ব্যক্তিগতভাবে টাক্সি ভাড়া করা যায় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে । দার্জিলিং মোটর স্টান্ড থেকে মিরিকের কৃষ্ণনগর পর্যন্ত শেয়ার টাক্সি চালু আছে যা মিরিক ট্যুর ও ট্রাভেলস দ্বারা পরিচালিত । মিরিকের মধ্যেও ভ্রমণ করার জন্য শেয়ার টাক্সি চালু আছে মিরিক লেক থেকে মিরিক বাজার পর্যন্ত ।
মিরিক ছেড়ে যখন ক্যান্টনমেন্টের পথ ধরে নামছিলাম তখন গাড়ির স্পীড আরো দ্রুত করে দিল ড্রাইভার।সন্ধ্যার সময় এই পথে ফেরা খুব নিরাপদ নয়।সূর্যের শেষ আলো এসে পড়ছিল অরণ্য ঘেরা পাহাড়ের গায় । সবুজ অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসছিল রাসি রাসি ধোঁয়া। তার মধ্য দিয়ে পাইনে জড়িয়ে থাকা মেঘের দল মাঝে মাঝেই টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছিল।মনে হচ্ছিল কোন এক শিল্পী তার অনাবিল তুলির স্পর্শে আকাশের বুকে এঁকে দিয়েছে সাদা সাদা মেঘবতীদের মুখচ্ছবি।মেঘের দৌরাত্বে যেন পথ ভুলে আমরা চলে যাচ্ছিলাম কোন এক অজানা দেশে যেখানে পাহাড় আর মেঘ সারাদিন লুটোপুটি খেয়ে চলে এক সাথে।
ভাবলাম সময় যখন খুব বেশি নেই তাহলে একটা দিন না হয় জলপাইগুড়ি বেরিয়ে যাই ,কোল কাতা এবার আর যাওয়া হলো না।।আমাদের ফিরতি টিকেট কাটার কোন তাড়া ছিল না,বুড়িমাড়ি থেকে রংপুর পর্যন্ত গাড়ি রিজার্ভ ছিল আর যারা ঢাকা থেকে এসেছি তারাতো ঢাকার বাসের টিকিট আগেই বুকিং দিয়েছিলাম।তাই ক্যামেরা হাতে সারাদিন ঘুরে বেরালাম প্রাচীন একটি শহর জলপাইগুড়ি।রেক্ল স্টেশন থেকে তিস্তার পাশে গড়ে ওঠা জুব্লি পার্ক সবটাই মনে রাখার মোতন।একটি অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম চেংড়াবান্ধা।সেই আগের মতোন ছবি তোলার সিরিয়াল,তারপর একজিট সীল পাওয়া।অবশেষে যখন ভারতের সীমার বাইরে পা রাখতে যাচ্ছে তখনি পেছন থেকে একজন বলে উঠলো-দিদি,তোমার ব্যাগটা চেক করা হয়নি।একটু দেখিয়ে যাও।আমি খুব মিষ্টি করে উত্তর দিলাম-আমার ব্যাগ চেক করে কেবল ক’খানা শাড়ি কাপড় ছাড়া আর কিছুই পাবে না।বরং আমার ডি এস এল আর চেক করে নাও ,যা অভূতপূর্ব জিনিস এটাতে নিয়ে যাচ্ছি তার মূল্য তোমার রুপিতে কুলোবেনা।
লোকটা কি বুঝলো কে জানে,আমার পথ থেকে সড়ে দাঁড়ালো।তারা বাংলা বলে কিন্তু অন্য রকম ভাবে ।তবু তারা বুঝতে পারে মানুষ কেন এতো কষ্ট করে এতো উঁচুতে ওঠে ।কেন এতো কষ্ট করে ভিসার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়ায় ।কেনইবা এতো পয়সা খরচ করে ওই সবুজ পাহাড়ের মায়ায় ছুটে যায়। উত্তরতো একটাই-মানুষ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ভালোবাসে ।
(সিরিয়াল মতো ছবি লোড করতে পারলাম ন।।)

[img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/Rodela77/Rodela77-1468141253-8ae98db_xlarge.jpg







সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৩:৪১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×