somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হন্তারক

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

মেয়েটি বুকে বিষণ্ণতার চরাচর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে জানতে দেয়না। সঙ্গোপনে তাকে জীবনের সারথী করে নিয়েছে এই কথাটি নিজের নিঃশ্বাসকেও জানাতে তার প্রবল কুন্ঠা। নিঃশ্বাসও তো মানুষেরই অব্যক্ত আবেগের গর্ভে জন্মায় মুহূর্মুহ। তাকেও বিশ্বাস করবে কেমন করে? বিশ্বাস, হাহ!!! শব্দটি তার অনুভূতির অভিধান থেকে বিদায় নিয়েছে সেই কবে। সেই সময়ে প্রতিটি সান্ধ্যকালীন আলোকে সোনালী মনে হতো। যেন হরদম তার মাঝে স্নাত হবার স্বাদ নেওয়ার মধ্যেই একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। একটি নশ্বর জীবন। অগণিত ভুলে ভরা একটি রক্তমাংসের জীবন্ত জীবন। প্রতিদিন তার গন্ধ নেওয়ার কি তীব্র আকুতি যে বুকের মাঝে পুষে রাখতো। এখন তার সবকিছুকেই বিগত কোন জীবনের অনুল্লিখিত অর্থহীন বাসনা বলে মনে হয়। সেসবের অস্তিত্বই যেন নিজের অনস্তিত্বকে সাড়ম্বরে প্রকাশ করার কোন ঘটনা মাত্র।

বাস থেকে সে ধীর পায়ে নেমে আসে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে ঘর থেকে বেরুলো। এর মধ্যেই রাস্তায় বিদ্যমান প্রতিটি মনুষ্যপ্রাণী থেকে শুরু করে প্রতিটি বস্তুকনাকেও তার অচেনা বলে মনে হচ্ছে। তার দিকে কুৎসিত চোঁখে তাকিয়ে থাকা লোকগুলোর লোলুপ দৃষ্টি থেকে শুরু করে ঘর থেকে নামতেই যেই চিরপরিচিত দোকান তার প্রতিটি কনাকেই চিরকালের অচেনা বলে মনে হয়। গীতিআপা একবার বলেছিলো “মেয়েদের জীবন হলো প্রতিমুহূর্তে চিরপরিচিত জিনিসকেও অপরিচিত হিসাবে আবিষ্কার করার জীবন।” আহা গীতি আপা, তুমি তো সেই কদাকার বলয় থেকে বের হবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলে। তুমিও কেন তাহলে জীবিত থেকেই নিরন্তর আত্মহত্যার দিকে নিজের প্রতিটি নিঃশ্বাসকে ঠেলে দিয়েছিলে? ড্রাগ এডিক্টেড, চিরকালের কান্ডজ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচারী স্বভাবের শিবু দাকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলে কোন মায়াবী ক্ষণের বিভ্রমে? সেই যে একবার তুমি নিজস্ব পরিসরের ব্যাপ্তি সংকীর্ণ করতে শুরু করলে তারপরে কোথায় হারিয়ে গেলো সব। নিজেকে তো পরিচিত সকল মহলেই অপরিচিত করে ফেললে। একবার এটাও ভেবে দেখলেনা তোমার এই নির্বাসনে তোমার নিকটেরই কেউ নিজেকে হারিয়ে প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরবার মর্মন্তুদ বাস্তবতায় নিজেকে ভেসে যেতে দেখতে পারে। বিস্মৃত হওয়ার অতীতের এসব কথা ভাবতে ভাবতে মেয়েটি অবনত মুখ উপরে তোলে। দেখতে পায় সে গন্তব্যের বেশ কাছে চলে এসেছে। তার পা স্বাভাবিকের চাইতেও ধীরগতির হয়ে আসে। কি হবে দ্রুত এগিয়ে? হৃদয়কে আন্দোলিত করতে পারে এমন কিছুর দেখা তো সেখানে মিলবেনা। সে নিশ্চিত জেনে গেছে।

২.

“আমি তোমাকে খুশী রাখতে পারিনা, না? এখনো তার কথা ভুলতে পারোনাই। একটু কিছু হইলেই তার কথা বলতে হবে। তার মধ্যে, সেই মেয়েমানুষের মতো চরিত্রের ছেলেটার মধ্যে আছে টা কি আমার মধ্যে যা নাই? দেখতে তো হিজড়ার মতোই, চালচলনেও আবালচোদা লাগতো। আমাদের ফ্রেন্ডসার্কেলেই তাকে নিয়ে কি হাসাহাসি হইতো তার কথা তো কিছুই জানোনা। জানলে তো......” তার প্রতি দয়াপরবশ হয়েই কিনা কে জানে রাসেল অবশেষে নিজের মুখকে বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো। এতো এতো গালাগালের প্রত্যুত্তরে সে কিছুই বললোনা। প্রত্যাশাই যেখানে আর কনামাত্র অবশিষ্ট নেই সেখানে কলহের আর অর্থবহতা কোথায়? এতো অনিবার্য যাতনার মাঝেও একটু হাসলো। এই যে এইমাত্র, অর্থহীন বর্তমানের কিছু গুরুত্বহীন মুহূর্তে পুরুষের দখল করবার চিরাচরিত সর্বগ্রাসী ঈর্ষাকে সরাসরি ভাস্বর হতে দেখলো এর মাঝে সেও কি একসময়ে ডুবে থাকতে প্রবলভাবে উন্মুখ হয়নি? গোলগাল চেহারার, চশমা পরা ভালোমানুষ ভালোমানুষ দেখতে একটি অপাপবিদ্ধ মুখকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে ভাবতে ভালোবাসতো। সিনেমাটিক। জেলো। আমাদের এ সকল যা কিছু অনুভূতিই আছে তার সবই নিখাদ মেলোড্রামায় সিক্ত। এতো বিচিত্র সব চশমায় দৃষ্টিকে বদ্ধ করে দেয় যে যখন চশমাগুলো খসে পড়ে নিজেকে অন্ধরুপে আবিষ্কার করা ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকেনা। রাসেলকে দোষ দেবে কি? নিজের কর্তৃত্ব তার উপরে পুরাদমে ফলাবার লাইসেন্স সেই তো দিয়ে দিয়েছে। চাইলেই এক লহমায় তাকে বন্ধ করে দিতে পারে। দেয়না কেন? কিসের আশায়? আশার নূন্যতম কোন ব্যাঞ্জনাও এখানে নেই এই সত্যের সাথে তো সে শুরু থেকেই পরিচিত। হঠাৎ করে শেলীর কোটেশন মনে পড়ে যায়। “First our pleasures die - and then our hopes, and then our fears - and when these are dead, the debt is due dust claims dust - and we die too.” ঈশ্বরে কোন সচেতন সময়েই আস্থা রাখেনি। নাইলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো, ইংরেজিতেই প্রশ্নটি করতো। “When you are going to take me to the hell?”

৩.

সারাদিনই বৃষ্টি হয়েছে অবিরাম। শৈশবে নানুরবাড়িতে গেলেই যখন বৃষ্টি হতো তখন বাড়ি থেকে একটু দূরের এক জনমানবহীন বাড়ি ছিলো। তার টিনের চালের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো। কাউকে না জানিয়েই। সেখানে একা একা যেতো। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার ছমছম শব্দ কানে আসলে কি যে ভালো লাগতো!! অনেক অনেক দিন হলো, কতো অর্থহীন ঘন্টা পেরিয়ে গেলো কিন্তু সমগ্র শরীরকে নাড়া দেওয়া কোন আওয়াজ পেলোনা। জনমানবহীন সেই ঘরের টিনের চালে একাকী দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টির শব্দ শোনা। কাউকে সাথে নিয়ে সেই আওয়াজ শোনার তীব্র সাধ সময়ের থেকেও দ্রুতগতিতে পল্লবিত হয়েছিলো। সেই আকাঙ্খার শাখাকে বাড়তে বাড়তে হঠাৎ একদিন সমূলে উৎপাটিত হতে দেখলো। কোন কিছুই কি একদিনে হয়? অনিবার্য সেই দিনটির বেশ আগে থেকেই চশমা পরা গোলগাল মুখটিতে লোভের পঙ্কিল ছায়া যাওয়া আসা করছে আন্দাজ করেছিলো। নিজের নিঃশ্বাসের গতিপ্রকৃতির থেকেও সেই মুখের প্রতিটি রেখার গতিপথকে সে বেশী ভালো করে পড়তে পারতো। একে আজীবন প্রাপ্তি হিসাবেই ভেবে নিতে চেয়েছিলো। পরিবর্তে তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডী হিসাবে গ্রহণ করে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

সে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ায়। বাইরে দেখার মতো কিছুই নেই। আকাশের উপরে এখনো মেঘমালা পুঞ্জীভূত। কখনো যাকে মন দিয়ে লক্ষই করেনি আজকে তার দিকে চোঁখ গেলো। বারান্দার গ্রিলে বৃষ্টির শেষ ফোঁটাটি যুক্ত হয়ে আছে। হাত দিয়ে নাড়িয়ে দিলেও নড়ছেনা। সে ফোঁটাটির কাছে তার মুখ বাড়িয়ে দিলো। জিভ দিয়ে স্পর্শ করতেই গ্রিলের থেকে বৃষ্টির ফোঁটাটি তার জিভের স্বাদ নিলো। আত্মসমর্পণ করে। অনিচ্ছায়।

মেয়েটি তখন অনুভব করলো সে ক্রমশই হন্তারক হয়ে উঠছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:১৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×