----------------------
একদিন ঐ 'ছত্রিশ নম্বর' লোকাল বাসটার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতেও ধরতে পারি নি । হঠাৎ ওই বাসটার কথাই কেন বললাম? আচ্ছা খুলেই বলি।
টিউশনির খাতিরে ছত্রিশ নম্বর বাসে চড়ে মিরপুরে যাওয়া হয়। বরাবরের মত যাচ্ছিলাম। বাংলামোটর সিগন্যালে 'তুমি' দাঁড়িয়ে ছিলে বাসের অপেক্ষায়। এই বাসটা পৌঁছা মাত্রই উঠে গেলে তুমি। বসেছিলে একদম সামনের দিকে। আমি যাবার বাকি পথটা হা করে তাকিয়ে ছিলাম তোমার দিকে। তোমার বেশ কয়েকবার চোখ পড়েছিল। আমি বিন্দুমাত্র দেরি না করে চোখ সরিয়ে ফেলছিলাম।তুমি আগারগাও নেমে গেলে। আমি জানালা দিয়ে সেই পথে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।
ব্যাপারটা খুবই কাকতালীয় যে পরের তিনদিন একই বাসে আমাদের আবার দেখা হয়। তুমি হয়ত কিছুটা অবাক হয়েছিলে। অবাক হওয়ার লক্ষণ একদম স্পষ্ট ছিলো। বোকা আমি তোমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। তোমার ঘামে ভেজা ওই মুখটা কেন জানি খুব আপন লাগতো আমার।
সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। তুমি কাকভেজা হয়ে বাসে উঠলে। কোথাও সিট না পেয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালে। তুমি দাঁড়িয়ে কষ্ট করছো আর আমি বসে থাকি কিভাবে বল? সারাটা পথ সেদিন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি হয়ত টেরই পাও নি।
তোমার নামটা জানা হয় নি আমার। আমি ডেইলি ১ কিলো হেঁটে বাংলামোটরে তুমি যেই বাসে উঠতে আমিও সেখানেই উঠতাম তোমার সাথে। আড়চোখে তোমায় দেখে নিতাম। এই ছত্রিশ নম্বর বাসই ছিলো তোমাকে আড়চোখে দেখে নেয়ার মাধ্যম।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমি খুব ভাল ভাবেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। একদিন তোমাকে বাসস্টপেজে না দেখলে অস্থির লাগতো আমার। এভাবে মাসের পর মাস আমি শুধু একবেলা একনজর তোমাকে দেখে নিতাম।
একদিন অনেক সাহস নিয়ে বলেই ফেললাম কিছু কথা।
- "আচ্ছা আপনি তো ছত্রিশ নম্বর বাসেই যাবেন। তাই না?"
-জ্বী। আপনিও যাবেন। তাই না?
-এই যে দেখুন আজ একটাও বাস নেই। শুনেছি বাস ধর্মঘট নাকি।
-বলেন কি !
-শুনলাম তো সে রকমই। আচ্ছা, আমি আশিক। ডিইউ তে পড়ছি, এপ্লাইড ফিজিক্সে।
-শুনে ভাল লাগলো।
-আপনার পরিচয়টা প্লিজ। যদি আপনি কিছু মনে না করেন। একই পথে আসা যাওয়া হয় তো তাই আর কি।
-আমি মৃত্তিকা।
তুমি এটুকু বলেই থেমে গিয়েছিলে সেদিন। আমিও আর কথা বাড়াই নি পাছে তুমি আমাকে আর দশটা ছেলের মত ভেবে বসো। শত কাজের ভীড়েও প্রতিদিন ঠিক সময়ে এক কিলো হেঁটে তোমার মুখটা যখনই দেখতাম আমার সব ক্লান্তি চলে যেত।
একদিন অনেক জ্বর নিয়েও ভার্সিটি এসেছিলাম শুধু ফেরার পথে তোমাকে দেখবো বলে। আমি জ্বর নিয়ে ক্লাস শেষে এতটা পথ হেঁটে সেদিন তোমাকে পাই নি। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন।
তারপরের তিনদিন তোমাকে পাই নি বাস স্টেপেজের ওই জায়গাটায়। তিনদিন থেকে সময় বাড়তে লাগলো। না তোমাকে আরর পেলাম না। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে দাঁড়িয়ে থাকি তোমার অপেক্ষায়।
প্রায় ১ মাস পর একদিন তোমাকে দেখেছিলাম হঠাৎ। আমি দৌড়ে সেদিন বাসটা ধরতে পারি নি। ওইদিনই ছিলো আমাদের লাস্ট দেখা। আমি আর কোনদিনই তোমার দেখা পাই নি।
কোথায় হারিয়ে ফেললাম তোমায়? হয়ত তুমি চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছো,হয়ত তোমার টিউশনি টা শেষ হয়ে গেছে কিংবা হতে পারে বাবা মা তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি জানি না তোমার পরিচয়,কই থাকো । কিচ্ছু না । আমি মৃত্তিকা নামটা ধরে কত খুঁজেছি তোমায়। কোথাও পেলাম না। একটা মানুষ বাতাসের সাথে যেন মিশে গেল। কোথাও যেন তার আর অস্তিত্ব নেই।
মৃত্তিকার জন্য একটা খোলা চিঠি অনেকদিন বুক পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। আজ এত বছর পরে বুকের ভিতরটা আবার কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো ! ভালবাসা কিনা জানি না কিন্তু মৃত্তিকাই ছিলো আমার প্রথম ভালো লাগা। যার ঘামে ভেজা মুখটা দেখে আমি শিখেছিলাম মুগ্ধতার সংজ্ঞা। যার জিজ্ঞাসু চাহনিতে আমি ডুবে মরতাম বারবার।
কোথায় গেল আমার সেই নিখোঁজ মৃত্তিকা? এত মানুষের ভীড়ে কোথায় আমি হারিয়ে ফেললাম তোমাকে? মোটা ফ্রেমের কাঁচের চশমাটায় বাষ্প জমে আমার। সেই বাষ্প শুধু খোঁজে ফেরে সেই "ছত্রিশ নম্বর" বাসের মায়াময় তোমাকে.........
এমন হাজারো মৃত্তিকা হয়ত হারিয়ে যায় খুব গোপনে । কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বুকের বাম পাশটায় একটুখানি মোচড়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়..
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০