বাংলা রূপ: ঋতো আহমেদ
ইংরেজী ভাষার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি এলিয়টের এই সাক্ষাৎকার টি নিয়েছিলেন ডোনাল্ড হল। ১৯৫৯ এ এটি প্রকাশিত হয়। এলিয়ট দম্পতির বন্ধু লুইস হেনরি কন এর নিউইয়র্কের এপার্টমেন্টে চমৎকার সব বইয়ের থাক সম্বলিত লিভিং রুমে বসেছিলেন সবাই। দেয়ালে এলিয়টের একটি প্রতিকৃতি টাঙানো ছিল যেটি এঁকেছিলেন তাঁর শ্যালিকা মিসেস হেনরি ওয়্যার এলিয়ট। টেবিলে এলিয়টের বিয়ের ছবি দাঁড় করানো ছিল। ঘরের এক কোণে মিসেস কন আর মিসেস এলিয়ট সোফায় বসে ছিলেন। আর ডোনাল্ড হল আর এলিয়ট মাঝখানে সামনাসামনি। তাদের মাঝখানে টেপরেকর্ডার আর মাইক্রোফোন রাখা ছিল।
ডোনাল্ড হল
আমার মনে হয় একদম প্রথম থেকে শুরু করতে পারি আমরা। আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে আপনি যখন সেন্ট লুইস-এ থাকতেন, কিশোর ছিলেন, তখন আসলে কোন পরিস্থিতিতে কেমন করে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন?
টি এস এলিয়ট
মনে আছে আমার বয়স তখন চৌদ্দ, ফিজগেরাল্ডের অনুবাদে ওমর খৈয়াম পড়ে উৎসাহিত হয়েছিলাম এবং বিষণ্ন, নান্দনিক ও নিরাশা মূলক কিছু চার লাইনের কবিতা লিখি যেগুলো পরে ধ্বংস করে ফেলি—মানে ওগুলোর অস্তিত্ব আর নেই। কাউকে ওগুলো দেখাইনি কখনো। সে হিসেবে আমার প্রথম কবিতাটি স্মিথ একাডেমি রেকর্ডে ও পরে হার্ভার্ড এডভোকেট-এ প্রকাশিত হয়। বেন জনসন-কে অনুসরণ করে লিখেছিলাম আমার ইংরেজি শিক্ষকের জন্য অনুশীলন হিসেবে। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল ১৫/১৬ বছরের ছেলে হিসেবে লিখাটা খুব ভালো হয়েছে। এরপর হার্ভার্ড এডভোকেট-এ সম্পাদনা পর্ষদের নির্বাচনে অংশ নিতে কিছু লিখা পাঠাই যা খুব উপভোগ্য ছিল আমার জন্য। তখন থেকেই পরবর্তী কয়েক বছরে বলা চলে আমার লিখালিখির উন্মেষ ঘটে। বদলেয়ার আর জুলেস লাফোর্গের প্রভাবে আমি আরো উর্বর হয়ে উঠি। এঁরা ছিলেন হার্ভার্ডের আমার প্রথম কয়েক বছরের আবিস্কার।
হল
নির্দিষ্টভাবে কেউ কি আছেন যে আপনাকে ফরাসি কবিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন? ইরভিং বেব্বিত্ নন মনে হয়।
এলিয়ট
না, বেব্বিত্ হতে পারেন শেষ ব্যাক্তি ! গ্রে'স এলিজি কবিতাটি বেব্বিত্ সবসময় আওড়াতো। নিঃসন্দেহে দারুণ একটি কবিতা, কিন্তু আমি মনে করি এই ব্যাপারটি এক ধরনের দূর্বলতা প্রকাশ করতো, ঈশ্বর তাঁর সহায় হউন। আমার পরিচিত পরিমন্ডলে খুঁজেছি; ওটা ছিল আর্থার সাইমনের একটি ফরাসি কবিতার বই। হার্ভার্ড ইউনিয়নেই ওটা পেয়েছিলাম। তখনকার দিনে হার্ভার্ড ইউনিয়ন মানে একটা সভাস্থান যেখানে এর সাথে সম্পৃক্ত স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতো। তাদের খুব সুন্দর ছোট একটা পাঠাগার ছিল। যেমনটি এখন হার্ভাডের প্রায় অনেক বাড়িতেই আছে। আর্থারের উদ্ধৃতি গুলো আমার ভালো লাগতো এবং আমি একবার বোস্টনের এক বিদেশী বইয়ের দোকানেও গিয়েছিলাম (নাম ভুলে গেছি আর জানি না এখনো ওটা আছে কি না) যা ফরাসি, জার্মান এবং অন্যান্য ভাষার বইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেখানে লাফোর্গ আর অন্য কবিদের বই পেয়েছিলাম। এখনও ভাবলে অবাক হই ছোট ওই দোকানে কেনইবা ওরা লাফোর্গের মতো অল্প কিছু লেখকের বই সংগ্রহে রাখতো। ভালো কথা যে, না জানি কতোদিন বইগুলো সংগ্রহে ছিল কিংবা হয়তো অন্য কোনো চাহিদা ছিল ওদের।
হল
আপনি যখন অনার্সে ছিলেন তখন কি কোনো আগ্রজ কবির প্রভাব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? এখন যেমন তরুণ কবিরা লিখতে গিয়ে এলিয়ট, পাউন্ড আর স্টিফেনসের প্রভাব অনুভব করেন। আপনার তখনকার চিন্তা চেতনা কেমন ছিল মনে করতে পারেন? অবাক হবো যদি আপনার অবস্থা অতিমাত্রায় আলাদা না হয়ে থাকে।
এলিয়ট
আমার মনে হয় তখন ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় সেরকম কোনো জীবিত কবির উপস্থিতি না থাকাটা আমাদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছিল যার উপর কেউ আলাদা কোনো আগ্রহ দেখাতে পারতো। আমি জানিনা ব্যপারটা কেমন হবে কিন্তু আমি মনে করি এতোজন কবির প্রভাব, যেমনটি আপনি বললেন, তাহলে তো বিরক্তিকর ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। সৌভাগ্য যে আমরা একে অপরকে বিব্রত করিনি।
হল
হার্ডি কিংবা রবিনসন এর মতো লেখকের ব্যপারে কি একটুও সচেতন ছিলেন?
এলিয়ট
রবিনসন সম্পর্কে সামান্য সচেতন ছিলাম। কারন আটলান্টিক মান্থলি-তে তাঁর বিষয়ে একটা গদ্য পড়েছিলাম। সেখানে তাঁর কিছু কবিতার উদ্ধৃতি ছিল। ওগুলো মোটেই আমার ধাঁচের ছিল না। আর হার্ডি কে কবি হিসেবে খুব কম মানুষই চিনতো তখন। শুধু একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। কিন্তু তার কবিতা আসলে অনেক পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর ছিলেন ইয়েটস। তিনিও তখন তরুণ। অতি রোমান্টিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন মনে হয়েছে আমার তাকে। ৯০ দশকের কয়েকজন ছাড়া আসলে তেমন কেউই ছিলেন না। এঁরাও অবশ্য মদ খেয়ে কিংবা আত্মহত্যা করে অথবা অন্য কোনো ভাবে মারা গিয়েছিলেন।
হল
যখন এডভোকেট-এ সহ-সম্পাদক ছিলেন আপনি আর কোনরাড এইকেন তখন কি কবিতা বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করতেন?
এলিয়ট
আমরা বন্ধু ছিলাম। কিন্তু আমি মনে করি না এ বিষয়ে একে অপরকে প্রভাবিত করেছিলাম। কোনো বিদেশী লেখকের ব্যপারে ওঁর আগ্রহ ছিল স্পেনিশ আর ইতালিও-র দিকে আর আমার ছিল ফরাসি।
হল
অন্য কোনো বন্ধু বা কেউ ছিল সেখানে যে আপনাকে সাহায্য করেছেন?
এলিয়ট
হ্যা, একজন ছিলেন। টমাস এইচ টমাস, আমার ভাইয়ের বন্ধু। তিনি কেমব্রিজে থাকতেন। আমার কিছু কবিতা হার্ভার্ড এডভোকেট-এ পড়েছিলেন। তারপর একটি দারুন অনুপ্রেরণা মূলক চিঠি লেখেন আমাকে যেটা পড়ে খুব উৎফুল্ল হই। আর আমি মনে মনে চইতাম তিনি এরকম আমাকে আরো লিখুন। ওই উৎসাহটি দেয়ার জন্য আমি উনার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলাম।
হল
আমি মনে করি কনোড়াড এইকেন-ই আপনাকে আর আপনার কাজকে পাউন্ড-এর কাছে তুলে ধরেন।
এলিয়ট
হ্যা, ঠিক বলেছেন। এইকেন একজন উদার মনের বন্ধু ছিলেন। তিনি আমার কিছু কবিতা লন্ডনে কয়েকটি স্থানে দিতে চেয়েছিলেন। কোনো এক গ্রীষ্মে হ্যারল্ড মনরো এবং আরো কয়েক জায়গায়। কিন্তু কেউই ওগুলো ছাপতে আগ্রহ দেখায়নি। পরে ওগুলো ফেরত এনেছিলেন আমার কাছে। তারপর ১৯১৪ সালে হবে হয়তো, আমরা দুজনে তখন লন্ডনে। তিনি বললেন, “তুমি পাউন্ড-এর কাছে যাও। তোমার কবিতা তাঁকে দেখাও।” ভেবেছিলেন পাউন্ড ওগুলো পছন্দ করবেন। এইকেন পছন্দ করেছিলেন, যদিও ওগুলো তাঁর ধারার চেয়ে আলাদা ছিল।
হল
পাউন্ড-এর সাথে আপনার প্রথম সাক্ষাত কেমন ছিল?
এলিয়ট
প্রথমে ফোনে যোগাযোগ করে দেখা করতে যাই। কেনসিংটনের ছোট তিন কোনা বসার ঘরে ভালো ছাপ ফেলতে পেরেছিলাম। তিনি বললেন, “তোমার কবিতা পাঠিও আমাকে।” তারপর উত্তরে লেখেন, “আমার দেখা মতে এগুলো খুবই ভালো হয়েছে। এসো একদিন কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলবো।” তারপর তিনি ওগুলো হ্যারিয়েট মনরো তে পাঠিয়ে দেন। কিছু দিন পর ছাপা হয়।
হল
আপনার এডভোকেট এর দিন গুলো নিয়ে এইকেন একটি গদ্যে লিখেছেন, যেটি বই হিসেবে আপনার ৬০তম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন, এইকেন সেখানে লিখেছেন প্রথম দিককার ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো এক চিঠিতে পাউন্ডের কবিতা সম্পর্কে আপনি লিখেছিলেন “অস্পৃশ্য অখাদ্য”। আমি অবাক হয়েছি যখন আপনি আপনার মতামত বদলালেন।
এলিয়ট
হাহ্! ব্যপারটা খুব বাজে, তাই নয় কি? হার্ভার্ড এডভোকেট-এর একজন সম্পাদক প্রথম পাউন্ড-এর কবিতা দেখান আমাকে। ডব্লিউ জি তিন্কম-ফারনান্দেজ আমার এবং কনোড়াড এইকেনের এবং সিনেটের অন্য কবিদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেন, “এই কবিতা গুলো তোমার ধারার, তোমার উচিৎ এগুলো পছন্দ করা।” আসলে আমার তেমন ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল অলঙ্কারে ভারাক্রান্ত, পুরোনো ধাঁচের, রোমান্টিক কবিতা। তেমন খুশি করতে পারে নি আমাকে। এমনকি যখন আমি পাউন্ডের সাথে দেখা করতে যাই, তখন তাঁর লিখার ভক্ত ছিলাম না আমি। যদিও আমি মনে করি তখন যা ভেবেছিলাম তা ঠিক ছিল, তবে তাঁর পরবর্তী লিখাতেই মহৎ কাজ গুলো পেয়েছি আমরা।
হল
আপনি প্রকাশিত কোনো লিখায় বলেছেন পাউন্ড আপনার অপেক্ষাকৃত লম্বা ওয়েস্ট ল্যান্ড কে কেটে বর্তমানের মতো ছোট করেছিলেন। এরকম কাটাকাটি তে আপনি কি উপকৃত হয়েছিলেন? তিনি কি আর কোনো কবিতা কাটছাঁট করেছেন?
এলিয়ট
হ্যা, সেই সময় করেছিলেন। তিনি একজন অসাধারণ সমালোচক। কারন তিনি চাননি কেউ তাঁর নকল হয়ে উঠুক। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন আপনি কী করতে চাইছেন।
হল
কখনো কি আপনি কারও কবিতা পূনর্লিখনে সহায়তা করেছেন? এই ধরুন এজরা পাউন্ড?
এলিয়ট
...
(চলবে..)
সূত্র : প্যারিস রিভিউ
কৃতজ্ঞতা : এমদাদ রহমান (এ-সময়ের অন্যতম গদ্যকার, বন্ধু)