কাঁদো নদী কাঁদো নাটকের মঞ্চে সেলিম আল দীন। আলোকচিত্র: বারীণ ঘোষ
কথা পরম্পরা
শিল্পে নিয়ত নতুনত্বের সন্ধানী আচার্য সেলিম আল দীন। একই নদীতে যেমন দুবার স্নান সম্ভব নয়, শিল্পসৃষ্টির পথে ঠিক তেমনি দ্বিতীয়বার হাঁটেননি তিনি। তাঁর প্রতিটি কাজে প্রখর প্রজ্ঞা আর নান্দনিকতার সাম্য আমাদের নজরে পড়ে। মূলত লেখক সেলিম আল দীন নাট্যকার অভিধায় সুপরিচিত। নাটকে তাঁর নিরীক্ষা প্রবণতার কথা এখন আর কারো অজানা নয়। বাংলা নাটককে তিনি ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে বিশ্বধারায় সম্পৃক্ত করেছেন। গবেষক, লেখক, শিক্ষক ইত্যাদি নানা পরিচয়ের পাশে তাঁর আরো একটি পরিচয় নিভৃত। তিনি একজন সফল নির্দেশকও বটে। মহুয়া, দেওয়ানা মদিনা, একটি মারমা রূপকথা, মেঘনাদবধ ও কাঁদো নদী কাঁদো ইত্যাদি তাঁর নির্দেশনাকর্মের অত্যুজ্জ্বল অভিজ্ঞান। হাতের মুঠো খুলে কয়েন লুপ্ত করে দেওয়ার মতো বিস্ময় ছড়িয়ে থাকে এসব প্রযোজনার প্রতিটি দৃশ্যে।
'উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ' অভিধায় এমনতরো এক বিস্ময় নিয়ে তিনি ধরা দেন শিল্পপিপাসু দর্শকের সন্নিকটে। এ ক্ষেত্রে তিনি বেছে নেন অমর কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো'। আমাদের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের কোনো স্মৃতি ইতিপূর্বে ছিল না। কেমন সেই ভ্রমণ? তা-ও আবার মঞ্চে! কেননা মঞ্চে নাটক, কাব্যনাটক, মহাকাব্য, গল্পের নাট্যরূপ, উপন্যাসের নাট্যরূপ, কবিতার নাট্যরূপ আমরা জানি এবং সেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতারই অন্তর্গত। কিন্তু মঞ্চভ্রমণ! মানতেই হবে, একেবারেই নতুন এক ভাবনা।
সচরাচর নাটকেরই চিত্ররূপ মঞ্চে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। মহাকাব্যের মঞ্চায়ন আমাদের অজানা নয়। অজানা নয় কোনো গল্পকে নাটকে রূপ দিয়ে তাকে মঞ্চোপযোগী করে তোলা কিংবা উপন্যাসের কাঠামো বিলুপ্ত করে দিয়ে তাকে নাটকের পাণ্ডুলিপিতে সাজিয়ে নেওয়া। এসব কিছুই আমাদের মঞ্চে নতুন কিছু নয়। বহুবার এমনতরো সৃজন আমরা লক্ষ করেছি, করছি এবং হয়তো আরো বহুকাল করব। কিন্তু আস্ত একটা উপন্যাস মঞ্চে উপস্থাপিত হয়ে, হেঁটে-চড়ে-ঘুরেফিরে চলে গেল অথচ উপন্যাসটির কোনোরূপ বিকৃতি ঘটল না! পাশাপাশি দৃশ্যকাব্য রচনাতেও কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করল না! এটি কিভাবে সম্ভব?
সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন সেলিম আল দীন। উপন্যাসটি তার স্বাভাবিক প্রণোদনায়, নিজের ছাঁচটিকে অবিকৃত রেখে কিছু কলাকুশলীর মাধ্যমে মঞ্চভ্রমণ করে যাবে, অথচ তাতে থিয়েটারের মূল সুরে যেমন কোনো ছন্দপতন হবে না, তেমনিভাবে উপন্যাসটিও তার কৌমার্য অক্ষত রাখতে সক্ষম হবে। নতুনতরো এই ভাবনার উদ্ভাবক সেলিম আল দীন বলেন- 'সচরাচর শতবর্ষের বাংলা থিয়েটার উপন্যাসকে যখন মঞ্চে এনেছে তখনই উপন্যাসের ছাঁচটা পাশ্চাত্য প্রভাবিত অঙ্কদৃশ্য বিভাজিত নাট্য আঙ্গিকেই আত্মবিলোপ করেছে দেখতে পাই। কিন্তু উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণে আমরা ওই প্রথাগত রীতিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছি। আমরা যা চেয়েছি তা উপন্যাসের ভাষা ও গল্পের বাঁকসমূহকে হুবহু মঞ্চে তুলে আনতে।'
'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসটিকে মঞ্চে তুলে আনতে নির্দেশক সেলিম আল দীন বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যরীতির আশ্রয় নিয়েছেন। বোধ করি এ ছাড়া আর কোনো পথ তাঁর সামনে খোলা ছিল না। কেননা অন্য যেকোনো নাট্যরীতির আশ্রয়ে উপন্যাস তার স্বীয় কাঠামো হারিয়ে শেষ পর্যন্ত নাট্য পাণ্ডুলিপিতে রূপান্তরিত হতো। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির আশ্রয় কথা কিংবা বর্ণনা ও দর্শকের শিল্পমনস্ক চিত্ত। নির্দেশক বলেছেন- 'আমি এ নাটকে সংগীত ও নৃত্য সর্বাংশে পরিহার করেছি। কারণ কাঁদো নদী কাঁদোর ভাষারীতির সঙ্গে তা যাচ্ছিল না। উপরন্তু এটাই যেন বিধি নির্দিষ্ট হয়েছে গিয়েছে যে বর্ণনাত্মক নাটকে ওসব থাকবে।'
কিন্তু মূল প্রযোজনায় দেখা যায়, নাট্যের শুরুতেই অন্ধ ভিখারির হারমোনিয়াম সহযোগে গান গেয়ে ভিক্ষা করা কিংবা শেষদৃশ্যে 'কাঁদো নদী কাঁদো হো হো, কাঁদো নদী কাঁদো' বাক্যটিতে সুরারোপ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা প্রযোজনার স্বার্থে। অন্ধ ভিখারির গান উপন্যাসের বিষয়বস্তু নয়। নির্দেশক স্টিমারের আবহ তৈরির নিমিত্তে নিজ ভাবনার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন মাত্র। এ ছাড়া চার্চের ঘণ্টাধ্বনি কিংবা বাঁশের চটির সাহায্যে তাল উৎপাদনের চেষ্টা, মোটা দাগে সংগীতেরই ব্যবহার বলে বিবেচনা করি। অবশ্য এ কথা সত্য, এ দুটো গান কিংবা ঘণ্টাধ্বনি, চটির ব্যবহার ইত্যাকার বিষয়গুলো প্রযোজনা থেকে বাদ দিয়ে দিলেও কোনো ছন্দপতন অথবা রস সৃষ্টিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। আকাশ থেকে ধেয়ে আসা কয়েক ফোঁটা জল যেমন বৃষ্টির নামান্তর নয়, তেমনি কয়েক সেকেন্ডব্যাপী সুর আর কয়েকটি ছন্দ-তালধ্বনিও সংগীতরূপে গৃহীত হতে পারে না।
কাঁদো নদী কাঁদো নাটকে নির্দেশক সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমরা
মঞ্চে কলাকুশলীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক পোশাক নিয়েই মঞ্চে অভিনয় করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট বৃত্তে পোশাকের সহজ স্বাভাবিকতা সম্ভবত নির্দেশক নষ্ট করতে চাননি। ফলে ব্যক্তি চরিত্রগুলোর সঙ্গে দর্শকরা নিজেদের একাত্মতা বোধ করেছেন সহজেই। কিন্তু ফর্মাল সেটের উঁচু-নিচু ধাপে অভিনয় ক্রিয়ার সঞ্চালনে সেই একাত্মবোধের ঘোরও স্থায়ী হয় না। সেট পরিকল্পনায় তিনটি প্ল্যাটফর্মকে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধাপ পদ্ধতিতে তা নিচে নেমে এসেছে। মঞ্চের পেছনে চটি আর কাগজের সমন্বয়ে দুটো বিশাল চোখ তৈরি করা হয়েছে। মূল সেটের চারদিকেই উঁচু-নিচু বাঁশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ২০-২৫টি হারিকেন। হারিকেনগুলো নাটকের শুরুতেই পাত্রপাত্রীরা মঞ্চে বহন করে নিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে দেন। উপন্যাসের কাহিনীর প্রয়োজনে, দৃশ্য রচনায় হারিকেনগুলো কখনো কখনো প্রপস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ঝড় কিংবা কষ্ট কিংবা রাতের আবহ সৃষ্টিতে কখনো শুধু বিমূর্ত কোনো কিছুকে ইঙ্গিত করতে হারিকেনগুলোর ব্যবহার হয়েছে। কখনো কখনো মনে হয়েছে পুরো সেট-মঞ্চ-হারিকেন এসব কিছু মিলে যেন অন্য কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে উঠেছে, যেন ভিন্ন কোনো কিছু বোঝাতে চেয়েছে, যেন বা একটি জনপদের প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার শোকে কম্পমান নগরী কিংবা শুকিয়ে যেতে যেতে মরে যাওয়া নদী, মানুষের আশা-হতাশার প্রতীকরূপে কখনো কখনো প্রতিভাত হয়েছে। নির্দেশক সেলিম আল দীনের মুনশিয়ানা ঠিক এখানেই। পুরো প্রযোজনাটিকে তিনি অখণ্ড এক সুরে বেঁধেছিলেন, যাতে করে কোনো কিছুকেই বাহুল্য বলে মনে হয়নি। তাঁর চিন্তার নির্যাসের বাস্তবায়নে জড়বস্তুগুলোও মঞ্চে চরিত্রে রূপ নিয়েছিল। এ নাট্যের নির্দেশনার সাবটেক্সট প্রসঙ্গে সেলিম আল দীন বলেন- 'তিনটি সংযুক্ত প্ল্যাটফর্ম, ধাপ পদ্ধতিতে নিচে নেমে আসে। ফাঁকগুলো ফোকর বেড়া। মঞ্চের উত্থানস্থলে দুটি বিশাল চোখ। চোখের মণিতে হারিকেন। শুরুতে জ্বলে শেষে অন্ধ করে দেওয়া হয়। ভাবা যায়, অশ্রুমতি দুটি চোখ নদীর দুপাশে দুটি চোখের মাঝখান দিয়ে স্রোতধারার মতো নদী! সেটি আবার স্টিমার, সেটি কুমুরডাঙা শহর ও গ্রামের নানা মানুষের ঘরবাড়ি, মোহাম্মদ মোস্তফার শহরের বাড়ি। মঞ্চে প্রায় পনেরো-কুড়িটি হারিকেন-লণ্ঠন ব্যবহৃত হয়। তা আশার আলো, নানা কম্পোজিশনের মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে বিভাগ উদ্ভাবিত চরিত্র প্রকাশের মাধ্যমরূপে নানা বর্ণের উড়নির ব্যবহার।'
উপন্যাসটিতে কালুমিয়া, কালুমিয়ার জামাই, মোহাম্মদ মোস্তফা, খোদেজা, মোস্তফার মা আমেনা খাতুন, ক্ষীণ যৌবনা সকিনা, উকিল কফিল উদ্দিন, ডাক্তার বোরহান উদ্দিন, তবারক ভূঞা, লস্কর সর্দার, সলিম মিয়া ইত্যাকার অজস্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। বর্ণনাত্মক রীতির আশ্রয়ে একজন অভিনেতা-অভিনেত্রী অনেক চরিত্র রূপায়ণ করেছেন। আবার একটি চরিত্রই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পাত্রপাত্রী দ্বারা রূপায়িত হয়েছে। প্রযোজনাটিতে খোদেজার আত্মহত্যার একটি দৃশ্য পাঁচবার দৃশ্যায়িত হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, কেন? নির্দেশকের উত্তর এ রকম- 'কাঁদো নদী কাঁদোতে পুরো ঘটনা স্টিমারেই বিবৃত হয়, কাজেই এ নাটকের সবটাই বর্তমান বলে ঘুরে ঘুরে আত্মহত্যার ঘটনাটা ফিরে ফিরে আসে।'
আমরা চলচ্চিত্রে বা টেলিফিল্মে ফ্ল্যাশব্যাকে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করেছি। কিন্তু মঞ্চে? বোধকরি প্রথমবারের মতোই নির্দেশক সেলিম আল দীন এ ধরনের একটি কাজ করেছেন। আমাদের কারো মনে কোনো ঘটনা স্থায়ী আসন গেড়ে নিলে তা দৈনন্দিন জীবনে বারবার ফিরে আসে। এমনি একটা বিষয় সেলিম আল দীনের হাত ধরে আমাদের মঞ্চে প্রবেশ করল। অত্যন্ত দুরূহ কিন্তু তাৎপর্যমণ্ডিত এ দৃশ্যের রূপায়ণ। মানুষের অন্তর্গত সত্যকেই যেন মঞ্চে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
'উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ' নতুন এই মঞ্চ নিরীক্ষার প্রসার হোক। নির্দেশক সেলিম আল দীনের ভাষায়- 'এর বিস্তৃতি চাই। অন্যভাবে অন্য কারো দ্বারা।'
কাঁদো নদী কাঁদো নাটকের একটি দৃশ্য
কথামর্ম
সেলিম আল দীন উপন্যাসের কাঠামো বিলোপ না করে মঞ্চে উপস্থাপনের মাধ্যমে মূলত শিল্পে তাঁর দ্বৈতাদ্বৈতবাদী অবস্থানকেই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দেখা যাচ্ছে, মঞ্চের জন্য আলাদা করে আর নাটক রচনার প্রয়োজন পড়ছে না। অর্থাৎ তিনি নির্দেশক হিসেবে লেখ্যমাধ্যমের সব জেনারকে অবিকৃত পন্থায় মঞ্চে উপস্থাপন করে লেখক হিসেবে নিজেকে ননজেনরিকে রূপান্তর করেছেন। ফলে তাঁর রচনাগুলো শুধু নাটক অভিধার ঘেরাটোপে আবদ্ধ না থেকে লেখ্যমাধ্যমের অন্যান্য শাখাতেও সমাসীন হয়ে যায় অনায়াসে।
কাঁদো নদী কাঁদো নাটকের অন্তিমদৃশ্য
কথাপুচ্ছ
মূলত তৃতীয়বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা 'কাঁদো নদী কাঁদো' মঞ্চে উপস্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে একাডেমিক থিয়েটারের প্রযোজনা হিসেবে ২০০২ সালের ৫ এপ্রিল এটি সর্বসাধারণ্যে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। 'সমৃদ্ধ পূর্বপুরুষের খোঁজে' শীর্ষনামে, 'উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ' অভিধায় আচার্য সেলিম আল দীন এই প্রযোজনার নির্দেশনা দেন। তিনি এর ২৫তম মঞ্চায়ন পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলেন। আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টা, জেদ, গুরুবাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ২৩তম মঞ্চায়ন পর্যন্ত 'কাঁদো নদী কাঁদো'কে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মাত্র কয়েকজন দর্শকের অভিমুখেও আমরা আমাদের মঞ্চায়ন অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু দর্শক স্বল্পতার কারণে আচার্য সেলিম আল দীন ২৩তম প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি ঘোষণা দিয়ে আমাদের নিবৃত্ত করেন। সতত তাঁর আভাময় স্মৃতির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা আর নিঃশর্ত ভালোবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২০