আমাদের মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি বছর আগে আর পৃথিবী সহ আমাদের সৌরজগতের উদ্ভব হয়েছিল প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে। পরবর্তী ১০০ কোটি বছরে আমাদের গ্রহটি প্রাণের উৎপত্তির মত অবস্থায় এসেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া স্যা প্রমাণ অনুযায়ী প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। তারপর কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক কোষী আদিম প্রাণ থেকে উদ্ভব হয়েছে বর্তমানের মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী। ৪০-৮০ লাখ বছর আগে এক ধরণের বানর প্রজাতি দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেও তার থেকে আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ বছর আগে। মানুষ নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবতে পছন্দ করে। এই সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এক সময় নিজেকে প্রশ্ন করে বসে ’কে আমি ? কোথা থেকে এলাম? আর কেনই বা এলাম?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রচিত হয়েছে নানা ধরণের কল্প কাহিনী। প্রাচীন সব সভ্যতা গুলো তাদের তদানিন্তন সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের স্তর অনুযায়ী বিভিন্ন কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী মহাপ্রলয়ের শেষে এই জগৎ যখন অন্ধকারময় ছিল, তখন বিরাট মহাপুরুষ পরম ব্রক্ষ্ম নিজের তেজে সেই অন্ধকার দূর করে জলের সৃষ্টি করেন, সেই জলে সৃষ্টির বীজ নিপ্তি হয়। তখন ওই বীজ সুবর্ণময় অন্ডে পরিনত হয়। অন্ডের মধ্যে ওই বিরাট মহাপুরুষ স্বয়ং ব্রক্ষ্মা হয়ে অবস্থান নিতে থাকেন। তারপর ওটিকে বিভক্ত করে আকাশ ও ভূ-মন্ডল এবং পরবর্তীতে প্রাণ সৃষ্টি করেন। বাইবেল এবং কোরান বলছে যে সৃষ্টি কর্তা ছয় দিনে এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড তৈরী করেছিলেন। বাইবেল অনুযায়ী প্রথম দিনেই ঈশ্বর পৃথিবী এবং ’দিবস ও রজনী’ সৃষ্টি করেন। তৃতীয় দিনে সৃষ্টি করেন সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি আর এ সব কিছু তিনি সৃষ্টি করেছিলেন মাত্র ছয় হাজার বছর আগে। আবার চীন দেশের কাহিনী থেকে জানা যায় যে বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড শুরুতে একটা কালো ডিমের মত ছিল। ’প্যান গু’ নামের একজন দেবতা তার কুড়ালের কোপে ডিমটিকে দ্বিখন্ডিত করেন এবং মহাবিশ্বকে প্রসারিত হবার সুযোগ করে দেন।’প্যান গু’ এর শরীরের মাছি এবং উকুন থেকে পরে মানব সভ্যতার জন্ম হয়েছে ....... মানুষের উৎপত্তি নিয়ে এরকম হাজারো গল্প পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় এবং ধর্মগ্রন্থে।
বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের মনে এই ধারণাগুলো প্রথিত হয়ে আছে। এর সমর্থনে ধর্মগ্রন্থগুলোর পাশাপাশি কয়েকজন দার্শনিক তাদের মতবাদ দিয়ে এইসব ধারণাগুলোকে সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং যারা একটু স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতেন তাদের কে নানা ভাবে দমন পীড়ন করে গেছেন। বাইবেল অনুযায়ী মাত্র ছয় হাজার বছর আগে এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে আর তারপর থেকে সব গ্রহ নত্র ইত্যাদির পাশপাশি প্রকৃতিতে বিরাজমান সব কিছু ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে যে ভাবে ইশ্বর সৃষ্টি করেছেন। বদলায়নি একটুও, এবং থেকে যাবে অপরিবর্তিত ভাবে অনন্ত কাল। এই স্থির মহাবিশ্ব বা অপরিবর্তনশীলতার দর্শনের নাটের গুরু হচ্ছেন আমাদের বিশ্ব জোড়া পরম পুজনীয় দার্শনিকদ্বয়, প্লেটো এবং এরিস্টোটল। প্লেটো এবং এরিস্টোটল দুজনেই স্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। তাদের মতে বিশ্বজগতের সবকিছুর পেছনে একটা উদ্দেশ্য ঠিক করা আছে এবং এই উদ্দেশ্যের মূলে রয়েছে অপরিবর্তনশীলতা। সবকিছুর ’বিদ্যমান স্বভাব ধর্ম ’ জানাটাই নাকি বিজ্ঞান। মানব সভ্যতা তার এই স্থবির জাগতিক দর্শনের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার বছর। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ’পাশ্বাত্য দর্শনের ইতিহাস’ বইতে এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এরিস্টোটলের এই মতবাদ বিজ্ঞান এবং দর্শনের জন্য পরবর্তীতে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। তারপরে যত বড় বড় বৌদ্ধিক এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটেছে তাদের প্রায় সবাইকেই কোন না কোন ভাবে এরিস্টোটলীয় মতবাদ কে উৎখাত করে এগুতে হয়েছে।
প্রাচীন কালের সাহিত্যেও এই কল্পনার ছড়াছড়ি। গ্রিস এবং তার আসে পাশের এলাকার প্রচীন লোক কাহিনীর চরিত্র গ্রিফিনের সাথে অদ্ভুত সাদৃস্য পাওয়া যায় প্রোটোসেরাটপ নামের প্রাচীন এক ডাইনোসরের ফসিলের। হোমারের গল্পেও এক চোখা দৈত্য সাইকোপের কথা লেখা আছে। ক্রিট দ্বীপের আশেপাশের এলাকায় অনেক বিশালাকৃতির আদিম প্রানীর ফসিল পাওয়া গেছে। তাই অনেক গবেষক মনে করেন এ অঞ্চলের মিথ গুলোর সঙ্গে এদের সম্পর্ক আছে। মুখ দিয়ে আগুন ঝরানো ড্রাগনের গল্প দিয়ে চীনা কাহিনী ভরপুর। পাশাপাশি রাখা ডাইনোসরের ফসিল এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্পিত ড্রাগনের মধ্যে মিল দেখে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে ডাইনোসর থেকেই ড্রাগনের কাহিনীর উৎপত্তি হয়েছে।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিন্তু ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ফসিলগুলো আসলে পৃথিবীর আদিম জীবদের নিদর্শন এবং পাহাড়ের গায়ে যে সামুদ্রিক প্রানীর ফসিল দেখা যাচ্ছে তার কারণ আর কিছুই নয়, একসময় আসলে এই পাহাড় গুলো সমুদ্রের নীচে ছিল। তাকেই প্রথম বলতে শুনি যে বিশ্বব্যাপী নুহের প্লাবনের কাহিনীটা একটা অসম্ভব ঘটনা। সমস্ত পৃথিবীই যদি পানির নীচে ডুবে যায় তাহলে এই বিপুল পরিমান পানি সরে গেল কোথায়। আর এই ফসিল গুলো কোনভাবেই বন্যায় ভেসে যাওয়া প্রাণীদের দেহাবশেষ হতে পারে না, কারণ সবকিছু বানের পানিতে ভেসে গেলে তাদের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা। তারা সুগঠিত ভাবে মাটির স্তরে স্তরে সাজানো থাকতে পারতো না। এখন আমরা আধুনিক ভূতাত্বিক গবেষনা থেকে জানতে পারছি যে বিভিন্ন সময়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে সমুদ্রের পানির লেভেল ওঠানামা করলেও এ ধরনের পৃথিবী ব্যাপী মহাপ্লাবন আসলে কখনোই ঘটে নি।
ফেরাউনের কবর খুড়ে বিচিত্র সব জিনিষ পাওয়া গেছে। নরবলি দেওয়া কঙ্কাল থেকে শুরু করে ৭০ ফুট লম্বা ১৪টি নৌকা পর্যন্ত! পরজন্মে রাজাদের দাসদাসী লাগবে তাই নরবলি, ধন দৌলত এবং আরও অনেক কিছু। এখনকার কাহিনীতে এ ধরণের কথা কেউ লেখে না কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর আনাচে কানাচে সব জাতি গোষ্ঠির মধ্যেই বহু রকমের সৃষ্টি তত্ত্ব , এই তত্ত্ব নির্ভর লোক কাহিনী এবং ধর্মীয় রীতি নীতির অস্তিত্ব দেখা যায়। দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত সামাজিক অভিজ্ঞতার সাথে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে আমরা তৈরী করেছি এই কাহিনীগুলো আর তদানীন্তন সামাজিক নিয়ম কানুনগুলো কে তার সাথে বেধে দিযে বলা হয়েছে য়ে এটাই নিয়ম, এটাই ধর্ম এবং একমাত্র জীবন বিধান। সমাজপতিরা তাদের শাসন কে বৈধতা দেবার জন্যও ভর করেছে ধর্মের উপর। একে পুঁজি করে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শোষণকে বৈধতা দিয়েছে। আর সত্যিকারের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা যেন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত না পৌছায় তার জন্য তৈরী করে রেখেছে বিভিন্ন নিয়ম।
আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে বিজ্ঞান তার সঠিক গতিতেই এগুতে শুরু করেছিল কিন্তু প্লেটো এবং বিশেষ করে এরিস্টোটল সেই সময়ের দাসপ্রথা ভিত্তিক নিবর্তন মূলক সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ যোগ্যতা দেয়ার জন্য শক্তিশালী একটা ভাববাদী দর্শনের জন্ম দিলেন যার মূলে ছিল অপরিবর্তনশীলতা এবং জীবের শাশ্বত স্থায়িত্বের তত্ত্ব। আর এই স্থবির ধারণার উপর ভর করেই রোমান সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠল খ্রিস্টীয় ধর্ম।
কালের প্রবাহে মানুষের সৃজন শক্তি, অজানা কে জানার কৌতুহল এবং বুদ্ধিমত্তা একদিকে যেমন তাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছে তেমনি আবার নতুন চিন্তা এবং আবিষ্কারের খোরাক ও যুগিয়েছে। দেড় হাজার বছর পরে ষোড়শ শতাব্দীতে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারনাটা হাজার বছর ধরে টিকে থাকা টলেমীর পৃথিবী কেন্দ্রিক জগতের ধারণা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় এবং সামাজিক স্থবিরতার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিল। চার্চ ব্র“নোকে পুড়িয়ে মারলেও সূর্যকেন্দ্রিক জগতের ধারনাকে মারতে পারলো না। বিজ্ঞান এগিয়ে গেল। ১৮৫৯ সালে ডারউইন এবং ওয়ালেস যখন বিবর্তনের তত্ত্বটি প্রস্তাব করলেন তখন চার্চের বিশপের স্ত্রীর মুখ থেকে যে আতঙ্ক বাণী বেড়িয়ে এসেছিল তা যেন আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি আর্তনাদ করে বলেছিলেন ’ বনমানুষ থেকে আমাদের বিবর্তন ঘটেছে! আশা করি যেন এটা সত্যি না হয়, আর যদি তা একান্তই সত্যি হয় তবে চলো আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি সাধারণ মানুষ যেন এটা কখনোই জানতে না পারে।’ আর ১৯০৫ সালে যখন আইনষ্টাইন তার সাধারণ আপেকি তত্ত্ব প্রকাশ করলেন তখন যেন মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশের চরম প্রকাশ ঘটলো। প্রাচীন দর্শন এবং ধর্ম তত্ত্বগুলোর উপড় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
যদিও পুরানো ধারণা সমুহের কোন ভিত্তি নেই তবুও আমরা আজও সেই পুরানো ধারণা ভিত্তিক সমাজেই বসবাস করছি, অনেক প্রাচীন সামাজিক প্রথাকেই জানছি, মানছি। আমরা এখনও বলি সূর্য উঠছে বা ডুবছে; পৃথিবী কেন্দ্রিকতার লেশ রয়ে গেছে সর্বত্র। ভাষায়, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, সামাজিক রীতি নীতিতে। সর্বোচ্চ ডিগ্রী ধারী ব্যক্তিটিও বিবর্তন কে মানেন না। সমাজের পরিবর্তনকে মানেন না বা মানতে চান না। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা বিজ্ঞান মনষ্ক হচ্ছিনা তবে বাস্তবতা হলো সমাজ পরিবর্তনশীল, কিছু কায়েমী স্বার্থবাদী লোকের প্রবল বিরোধীতা সত্বেও কালের প্রবাহে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে কেউ থামাতে পারে নি এবং পারবেও না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:০৪