আচ্ছা মর্মর ধ্বনি কি একেই বলে? ওই যে শুকনো পাতার ওপরে হেঁটে গেলে যে ম্যাড়ম্যাড়ে আওয়াজটা হয়!! পাঁচ নম্বর ঘুষিটার সময় মাথার মধ্যে তেমন একটা শব্দ হলো; আর এখন ছয় নম্বরটার সময়ও। অদিতির হঠাতই হাসি পেল। সে কি করছে!!! ঘুষির সংখ্যা গুনছে...হা হা হা!!! আহসানের বাম হাত ওর গলা চেপে আছে আর ডান হাতি ঘুষিগুলো পড়ছে ওর বাম চোখে। অদিতিকে বিছানায় ফেলে বক্সিং প্রাক্টিস হচ্ছে; ও অবশ্য ওঠার চেষ্টা করছে না; জোর করে উঠতে গেলে গলায় আঙ্গুলের দাগ বসে যাবে গতবারের মতো। ও আর এখন ব্যথা পাচ্ছে না, শুধু মারটা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করছে।
অদিতির ভাবনা শেষ হতে না হতেই আহসান ঘুষি বন্ধ করলো। ও উঠে বসলেও প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না; খালি অন্ধকার। “মা ও মাগো ...কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না যে...” অদিতির মা সেই কবেই মারা গেছেন অথচ কেন যে ও মাকে ডাকলো কে জানে। আহসানের গলায় বিদ্রুপ “ঢং করো নাতো...চোখে দেখবে না কেন??? তোমার ডান চোখেতো মারিনি...” বলতে না বলতেই অদিতি দেখতে পেল; মাথাটা ঘুরছে। মারের সময় চিন্তা হচ্ছিল; আটমাসের মেয়েটা বিছানায় ঘুমাচ্ছিলো। তাকাতেই দেখলো বাবুটার ঘুম ভেঙ্গেছে; দাঁত উঠবে; মুখে আঙ্গুল দিয়ে হাত লালায় মাখামাখি। মা তাকাতেই সে বিশাল একটা হাসি দিলো। অদিতি হাসি দেবার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো চোখে তীব্র ব্যথা হচ্ছে; চোখের চারপাশের চামড়া তেলেভাজা লুচির মতো ফুলে উঠছে।
অদিতি জানে কি করতে হবে। সে এক দৌড়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে চোখের ওপরে চেপে ধরলো। বরফের তা দিতে দিতেই ও বাথরুমে আয়নায় চোখের অবস্থা দেখতে গেলো। ইশশ রে...কি যে অবস্থা...যাকে বলে black eye…এইটাতো ঠিক হতে কম করে হলেও তিন থেকে ছয় মাস লাগবে। কালো দাগ আস্তে আস্তে নীল হবে, তারপরে গাঢ় হলুদ, তারপরে গাঢ় থেকে হালকা হলুদ মিলাবে ত্বকের বাদামীতে। আজ শনিবার; সোমবারে অফিসে যাবার আগে ঠিক হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। এর মধ্যেই অদিতির মনে হলো “আচ্ছা black eye এর বাংলা কি হবে? কালো চোখতো অবশ্যই না...তাহলে নীলকালো চোখ...ব্যথিত কালো চোখ...” তক্ষুনি মাথার মধ্যে অরণীর রাগী রাগী কন্ঠ বলে উঠলো “তুমি না বড্ড ফালতু কথা ভাবো...আগে ভাবো আজ রাতের দাওয়াতের কি হবে? তারপরে ভাবো অফিসে কি বলবে?” অরনীটা না খুব টেনশন করায়। আয়নায় তাকিয়ে অদিতি ফিসফিসিয়ে বললো “ছোট বাচ্চা থাকার অনেক সুবিধা...আজ আমি দাওয়াতে যাবো না...আহসানকে পাঠিয়ে দেব...বললেই হবে যে বাবুর জ্বর এসেছে...এই ভাবী যা গসিপ করেন...দেখা হলে খবর চারিদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাবে...কিছুদিন সামাজিকতা এড়িয়ে চলতে হবে...”
সন্ধ্যায় আহসান বের হতেই বাবুকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ও আয়নার সামনে। দেখা যাক মেকাপ দিয়ে ব্যথিত কালো চোখের ব্যথা কতোটা আড়াল করা যায়!!! চোখের আসলেই বীভৎস অবস্থা; ভুরুর নীচে একটু কেটেছেও; চোখটা ফুলে ছোট হয়ে গেছে। অদিতির আবারো হাসি পেলো; ওকে দেখাচ্ছে র্যাম্বোর মতো...Lady Rambo। সব মজার সময় গুলোতেই অরণী কথা বলে ওঠে “শোনো মেয়ে এইসব ফাজলামি কথা না ভেবে আগে ভাবো অফিসে কি বলবে? Domestic abuse সন্দেহ হলেইতো বস প্রথমে Human Resources কে ডাকবে আর জেরার পরে ধরা খেলে পুলিশ হাজির...” অদিতি দ্রুত ভাবতে থাকে “একটা বলা যায় যে বাবু চোখে খেলনা দিয়ে জোরে মেরেছে...কিন্তু বাচ্চা মানুষ এত্তো জোরে মেরেছে কেউ বিশ্বাস করবে না...হুউউ তাহলে মাইনর কার অ্যাক্সিডেন্ট...তাওতো আবার কার ড্যামেজ নেই...ইন্স্যুরেন্স পেপারস???” “তাহলে কিচেন ফ্লোর ক্লিনিংয়ের সময় পা পিছলে গেছে...চোখ গিয়ে লেগেছে কাউন্টারের ধারালো করনারে...হুউউ এটা হতেও পারে...” অফিসে গিয়ে অদিতি বলবে “পা পিছলে আলুর দম”; ওর আবারো হাসি পাচ্ছে।
আহসানের দাওয়াত থেকে আসতে বেশ রাত হবে; অদিতি বাবুকে আরেকবার খাইয়ে রাতের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিলো। একা একা টিভি দেখার সময় ও হঠাৎই আতঙ্কে জমে গেলো; আজ যদি ও অদিতিকে চায়। চাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী; আদর করতে করতে বলবে সে সরি...আর হবে না...কিন্তু অদিতি কেন ওকে রাগায়...এত্তো তর্ক করে!!! আগের সব বারেই তাই ঘটেছে। ও ফিসফিস করে বললো “শোনো অরণী ওই সময়টা আমার সাথে থেকোতো...একটু কথা বোলো...” রাতে বিছানায় আহসান কাছে টানতেই অদিতি শক্ত হয়ে গেলো; ভাগ্যিস অন্ধকার; নাহলে আহসান দেখতে পেতো যখন চুমু দিচ্ছে অদিতির বমি বমি লাগছে। অদিতির ইচ্ছে না করলেও মানা করার সাহস নেই; ও আহসানকে প্রচন্ড ভয় পায়।
অদিতির শরীরে সুখ খুঁজতে ব্যস্ত আহসান; ও নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো আহসান কি জানে যে শরীরে ভালোবাসাও থাকে? আদরের একসময়ে অদিতি সাহস করে বললো “শোনো এরপরে থেকে মারলে পিঠে বা শরীরে মেরো...হুউউ...মুখে মেরো না প্লিজ...” বলতেই মাথার ভেতরে অরণী বলে উঠল “তুমি মরবে মেয়ে...making a deal with the devil…বাইরে দেখো রুপালী জোছনার কাফন...ঠিক এমনই দুধ সাদা কাফনে মুড়বে তুমি...” অদিতি মনে মনে প্রচন্ড হেসে উঠলো “বোকা মেয়ে...তুই কি আসলেই জানিস না??? আমিতো সেই কবেই মরে গেছি...কবেই!!!”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪১