দিনের সবচেয়ে রহস্যময় সময় দুপুর। দুপুর এলেই মনে হয় সমস্ত পাড়া দুয়ার এঁটে ঘুমের আয়োজন করছে। কোথাও একটু লুকোচুরি…গোপনীয়তা!! নিরালা দুপুরগুলোর কোথাও নিষিদ্ধ সুবাস থাকে। দুপুরগুলো বড্ড নিজস্ব; নবীন কিশোর তার প্রথম প্রেমকে চিরকুট লেখে; নব্য বিবাহিতার কপোল গতরাত্রির সোহাগের কথা ভেবে গোলাপী হয়। কোন এক দুপুরেই শেখরের চোখে ললিতার সর্বনাশ ছিলো; চারুলতার অমলের সাথে খুনসুটির সময় সেই দুপুরবেলাই। সত্যজিতের চলচ্চিত্রে দুপুরগুলোতেই বিবাহিতার শোবার ঘরে সবার চোখ এড়িয়ে প্রেমিকের আনাগোনা।
ছোটবেলায় দুপুরটা বড় কাঙ্ক্ষিত ছিল; স্কুল শেষ। রোদ ঝমঝম দুপুরগুলোতে রিক্সা চেপে বাড়ি ফেরা; সেন্ট্রাল রোডে আদর্শ কলেজ পেরোতেই দুপাশের দেয়াল চেপে আসতো। ক্রমশ সরু গলি আর এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় রিক্সার বাড়তি ঝাঁকুনি। গলির শেষ মাথায় কারুকাজময় মস্ত শাদা গেটের বনেদী বাড়ি; ডান পাশে মোড় নিতেই কিছু দূরে বিষন্ন ছায়া ছায়া অন্ধকার একতলা বাসা। রহস্যময় সেই বাসার পাশে একটু জঙ্গলা জায়গা পেরোতেই আমাদের ভাড়াবাড়ি। খোলামেলা আলো ঝলমলে তিনতলা সাদা দালান; সামনে মাত্র তিন চার ফুটের বাসন্তীরঙ্গা ইটের দেয়াল; বামপাশে হুড়কো দেয়া ছোট্ট লোহার গেট। গেট খুলতেই সবুজ ঘাসের ওপরে লালচে বাদামী ইটের পথ ডেকে নিয়ে যায় সিড়িঘরে। দেয়াল ঘেঁষে রাজকীয় গোলাপ আর শাদা গোলাপী নয়নতারা; মাঝামাঝি একটা মস্ত নারিকেল গাছ অতন্দ্র প্রহরীর মতো গুরুগম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।
সুযোগ পেলেই দুপাশে হাত মেলে দেয়ালের ওপরে সরলরেখায় পা ফেলে হাওয়ার সাথে বাজি রেখে হাঁটা; আর নীচু দেয়াল টপকে ভেতরের সীমানায়। সহজ এই আসা যাওয়ার পথে সমস্যা হচ্ছে নীচতলার বারন্দায় ইজিচেয়ারে আসীন বাড়িওয়ালা দাদু। শাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়া সফেদ শ্মশ্রুমন্ডিত মানুষটার ভয়েই আমার ভদ্রভাবে গেট খুলে ঢোকা। গেটের লোহার রডে পা রেখে বেশ এদিক ওদিক দোলও খাওয়া যায়। পাল্লারা অবশ্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে আপত্তি জানাতো একটু; সে আপত্তি কানে না নিলেও দাদুর বকা আমলে নিতেই হতো।
বাসায় আসতে আসতে প্রায় দুটো। স্কুলব্যাগ নামিয়েই গোসল। শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুমের চাইতে বাইরের বারোয়ারী বাথরুমই আমার পছন্দ ছিলো। ওই বাথরুমের জানালা দিয়ে দুপুরের রোদ উঁকি দিতো; বালতির জলে আঙ্গুলের টোকায় অদ্ভুত সুন্দর আলোর কাঁপন। জলের সাথে আলোর এই খেলা চিরন্তন। ভালোবাসলে মানুষ জল হয়ে যায়, জীবন নদীর মতো....আর ভালোবাসা তার ওম ওম রোদে সেই জলে অবিরাম ছবি আঁকে।
কাপড় ধোয়ার জেট পাউডারও বাইরের বাথরুমে থাকতো; নীল রঙের বাক্সে হাসিমুখের সেই বিদেশী রমনী!! মেঘ শাদা তুলতুলে ফেনা নিয়ে খেলা; মাঝে সাঝে নীল সবুজ শাদা টুথপেষ্টের মিশেল। বেশীর ভাগ দিনই বাইরে থেকে আয়া মায়ের হাঁকডাক শুনে তাড়াহুড়া করে খেলা শেষে কাক গোসল; কোন কোন দিন অবশ্য পিঠে মায়ের কিল পড়তো জেট পাউডার নষ্ট করার জন্য।
মা বাবার অফিস সেরে বাসায় আসতে আসতে বেলা গড়িয়ে চারটে বাজতো। নিয়ম ছিলো হয় দুপুরে ঘুমাবো নাহয় পাটিগণিত; কোনটাই আমার পছন্দের না। বিছানায় আয়া মার পাশে শুয়ে ঘুমের ভান; কখনো আয়া মাই ঘুমিয়ে যেতেন বা আমি ঘুমিয়েছি ভেবে উঠে যেতেন। সাথে সাথে বালিশের নীচে রাখা গল্পের বইয়ে চোখ; বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে রোমাঞ্চ, অস্থিরতা, কষ্ট, আনন্দ, আর চোখের জলে মাখামাখির সময়। রুদ্ধশ্বাসে লালকমল নীলকমলের সাথে দীঘির জলে ডুব দিয়ে রাক্ষসের প্রাণভোমরা খোঁজা। সুনশান দুপুরে একাকী দুর্গের জানালায় চুলের বন্যা; কেশবতী কন্যা তার রাজকুমারের অপেক্ষায়। বড় হতে হতে জেনে গেছি রুপকথার মতো বাস্তবের দুয়োরানীদের চোখেও সারাদিনের কাজের ফাঁকে এই দুপুরেই জল নামে।
কোন কোন দিন বই পড়তে ভাল লাগতো না; রেজীর মা বুয়ার কাছে রান্নাঘরে গুটিসুটি হয়ে বসতাম ভুতের গল্প শোনার জন্য। গল্পে শাকচুন্নী ঠিক দুক্কুর বেলা শ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসতেই ভয়ে বুয়ার কোলে চেপে বসতাম। কখনো কখনো মস্ত টানা বারন্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগতো। রক্তের মতো কালচে মোজাইক করা বারান্দার মেঝে দুপুর রোদেও শীত শীত; কংক্রিটের নিরেট ভারী রেলিঙয়ে দুহাতে মাথা রেখে রোদের দিকে তাকিয়ে মন কেমন করতো। একটু ফাঁকা, একটু হাহাকার; কোথাও কি যেন নেই!!!
বাসার পাশের সরু রাস্তার ওপাশে সাদাটে পুরনো উঁচু দেয়ালে; কাটাঁতারের ওপাশে সায়েন্স ল্যাবোরেটরীর কর্মচারীদের সরকারী কোয়ার্টার। বাসাগুলোতে হোটেলের মতো টানা বারান্দা; একপাশে খোলা সিঁড়ি। দুপুরের বাউল বাতাস সেই বারান্দাতে শুকোতে দেয়া রং বেরঙের কাপড়ের ঢেউ তুলতো; মাঝে মাঝে নির্জনতা ভেঙ্গে উঁচু গলায় ঝগড়া শোনা যেত। চুপচাপ কল্পনার ঘোড়া ছোটাতাম; খুব ইচ্ছে করতো ওই দেয়ালের ওপারে যাই!! কেমন ওই মানুষগুলো? তাদের জীবন? দেয়ালের ওপারের জীবন আজও জানা হলো না; একটাই জীবন...যদি টুকরো টুকরো করে এখানে ওখানে ছড়াতে পারতাম!!!
পরীক্ষা এগিয়ে এলে বা স্কুলের বাড়ীরকাজ থাকলে অবশ্য মায়ের ভয়ে পড়তে বসতেই হতো। এমন উদাসী সুন্দর দুপুরগুলো কঠিন অঙ্কের জালে জড়ানো; পানির ট্যাঙ্কিতে ফুটো হয়ে জল পড়ে যাচ্ছে বা তেলমাখা বাঁশ বেয়ে বাঁদর উঠানামা করছে। বছর আটেকের ফাঁকিবাজ আমি অঙ্ক বাদ দিয়ে ভাবতাম, আজও ভাবি, একই রেললাইন বরাবর দুটো ট্রেন কেন মুখোমুখি যাত্রা শুরু করবে?
পড়ার টেবিলের পাশের দরজা পেরোলেই বারান্দা। মাঝে মাঝেই ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যেত; “নিবেএএ...এএএ...ন” শুনলেই দৌড়ে যেতাম; রেলিঙ্গে ঝুঁকে দেখতাম কিসের ফেরীওয়ালা, কেমন ফেরীওয়ালা। মন কেমন করা...ক্লান্ত সুরেলা ওই ডাকের মাঝে কোথাও ঘর পালানোর কথা আছে। গভীর অন্ধকার বা জ্যোৎস্নারাত মোহ তৈরী করে; মানুষ মাতাল হয়ে ঘর ছাড়ে। কিন্তু দুপুর...সে অন্যরকম..ঝকঝকে রোদে মানুষ হঠাৎই তার নিজের মাঝে যে যাযাবর বাউলের বসবাস তার চোখে চোখ রাখে।
বাসায় কাঁচের গ্লাস প্লেট ভাঙ্গলে সবার মুখ অন্ধকার; শুধু দুরন্ত আমার চোখে আনন্দ ঝিলমিল। ভাঙ্গা কাঁচের বদলে ভরদুপুরে একটু পোড়া তিতকুটে মিষ্টি কটকটি। সেই ছোট্টবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম কখনো কখনো ভাঙ্গাচোরাই অমুল্য; নিখুঁত কারো চাইতে একটু ভাঙ্গাচোরা মানুষগুলোই ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধের কালচে মুচমুচে লোভনীয় কটকটি। তবে আশেপাশের সব বাসার গৃহকর্মীদের মাঝে সোরগোল পড়ে যেত যখন লেসফিতা ওয়ালা আসতো। ঝুড়ি নামিয়ে বসতেই রঙ্গীন সব চুলের ফিতা, ক্লিপ, কমদামী স্নো পাউডার লিপষ্টিক, তাঁতের শাড়ী। কোন যাদুমন্ত্রে ঝুড়ি থেকে একের পর এক দারুন সব জিনিষ বেরুতো; ফেরীওয়ালাদের ঝুড়িতে যেন সমস্ত পৃথিবী আঁটা।
আয়া মা কখনো ক্লিপ কিনে দিতেন; তবে রেজীর মা বুয়া প্রায়ই রেজীর জন্য চুলের ফিতা কিনতেন। রেজীর বয়স মধ্যকুড়িতে; কম বয়সে বিয়ে হলেও বাচ্চা হয়নি বলে স্বামী পরিত্যক্ত। ঢাকাতেই অন্য আরেক বাসায় কাজ করতো; মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে দু’তিন দিনের জন্য বেড়াতে আসতো। কেন যেন মনে হতো রেজী ঠিক অন্যদের মতো নয়। সৌন্দর্যের সামাজিক সংজ্ঞা জানতাম; মেয়েদের জানতেই হয়। তিনতলার আপু যেমনটা; খুব সুন্দর; বেশ ফর্সা, ধারালো নাক আর চিবুক, গাঢ় বাদামী চুল, ঘন চোখের পাপড়ি; রুপকথার সব রাজকন্যাতেই আমি আপুকে খুঁজে পেতাম।
রেজী অন্যরকম; একটু বড় কালো গভীর চোখ; চাপা নাক; গাঢ় বাদামী পুরু ঠোঁট; দু’গালে বিন্দু বিন্দু কালো মেচেতার দাগ। দুধ চা রঙের গোলগাল মুখের দু’পাশে লাল ফিতার হৃষ্টপুষ্ট কলাবেনী। খুটিয়ে দেখলে তেমন সুন্দর কিছু নয় কিন্তু হাসলে ওর চোখে বিদ্যুৎ চমকাতো; হাটার সময় লাস্য ছলকে পড়তো। রাজকন্যার থেকে চোখ ফেরাতে পারলেও রেজীর থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। ও বেড়াতে আসলেই আশেপাশের বাসার গাড়ীচালক, আর পুরুষ গৃহকর্মীদের মাঝে একটু সাড়া পড়ে যেত। এই সৌন্দর্যকে কোন ছকে ফেলা যায় না বলেই হয়তো রেজী আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। ঝাড়বাতি সুন্দর কিন্তু উল্টোপথে হাঁটা আমার মতো কারো কারো যে দাবানলের আলোই পছন্দ।
সত্তুরের শেষে শহরটা এতো যান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি; হঠাৎ হঠাৎই রোদেলা দুপুরের ঝকঝকে নীল আকাশে টিয়ার সবুজ ঝাঁক ঝলসে উঠতো। বাবাকে গল্প করতেই একদিন খাঁচায় করে এক সবুজ টিয়া নিয়ে হাজির। এমন সতেজ সুন্দর সবুজ বৃষ্টির পরে পাতারাও নয়; লাল ঠোঁটের টিয়া অবশ্য বেশ রাগী রাগী চোখে তাকালো। দুপুরের দৃশ্যপট একটু বদলালো; এখন আর দুপুরগুলোতে একা নই। বারান্দার শেষ প্রান্তে যেখানে পেয়ারা গাছের ডাল মুখ বাড়িয়েছে সেখানে পাখির খাঁচা ঝুললো।
কয়েকদিনের মধ্যেই আঙ্গুলে ওই টুকটুকে লাল ঠোঁটের কামড়; দুপুরগুলো আবার চুপচাপ। অভিমানী আমি টিয়ার সাথে আবোল তালোল কথা বন্ধ করে দিয়েছি। তপ্ত রেলিঙ্গে গাল রেখে সুনসান দুপুরের বাতাসে অলস রোদের খেলা দেখছিলাম; মনটা যে কোথায় ছিলো...মনটা যে কি বলছিলো? হঠাৎ ডানা ঝাপটানির আওয়াজ; একটু গোঙ্গানির মতো কষ্টের শব্দ; চমকে উঠে খাঁচার দিকে তাকাতেই দেখি পাখিটা অস্থির। আকাশে সবুজ টিয়ার ঝাঁক। খাঁচা খুলে দিয়েছিলাম; এই প্রথম পাখিটা আমার দিকে রাগী চোখে তাকায়নি। একটু অবাক চোখেরা; একটু দ্বিধায় খাঁচার বাইরে মাথা আগানো; তারপরে বাতাসে সবুজ ডানা মেলা। কি অপার্থিব সুন্দর!! বন্ধনহীনতার মতো সুন্দর আর কোন দৃশ্য আছে?
এখনো দুপুর এলে খাঁচার দরজা খুলি; এলোমেলো ভাবনারা পাখা মেলে। নির্জন দুপুর এলেই উড়ি, যাযাবর আমি, বাউল আমি। ফিসফিসিয়ে বলি “দুপুর, তোমার হাতে একফোঁটা কবিতা ফেললাম/ দুপুর, আমার হাত নাও, ধরে বলো তো---গরম?” কাউকে বলিনি, শুধু দুপুরই জানে মনে মনে কার সাথে দুষ্টুমি আমার, মান-অভিমানের নোনা কবিতা। শুধু দুপুরই জানে কে আমার সেই বেওয়ারিশ আবেগের ফেরীওয়ালা যে দূরে কোথাও ঘর পালানোর ডাক দিয়ে যায়।
(০১/২৫/২০১৭)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:১০