somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আকাশ তার ঘরে লন্ঠন জ্বালাচ্ছে; মেঘ গুলো সব সিঁদুরে রাঙ্গা। মস্ত বড় থালার মতো টকটকে লাল সূর্য তার লজ্জা রাঙ্গা মুখ লুকাচ্ছে পাহাড়ের পেছনে। সন্ধ্যা নামছে ধীর মন্থর পায়ে। অন্ধকারের কালো পর্দা নামলেই আকাশের ঘরে লন্ঠন নিভিয়ে শুরু হবে সূর্যদেবী আর চন্দ্রের বাসর। সারাদিনের কাজ শেষে বাসায় ফিরছি। সন্ধ্যা আমার ভালো লাগে না; আরেকটা দিনের মৃত্যু। সবাই সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে; রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে সোনালী ডানার শঙ্খচিলেরাও। এখনতো সবার বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার সময়; জীবনের সব লেনদেনের হিসাব মেলানো। আমি হিসাবী নই বলেই হয়তো সন্ধ্যা আমার ভালো লাগে না; উড়নচণ্ডী মনকে ঘরমুখী করতে আমার বেশ কষ্ট হয়।

যখন ছোট্ট ছিলাম তখনতো সন্ধ্যা আরো মন খারাপ করা ছিলো। মাগরিবের আজান পড়ার সাথে সাথে সব খেলা ভেঙ্গে বাসায় ফিরতে হতো। আজান শেষ হলেই পড়ার টেবিলে হাজিরা; পড়া থাকুক কি না থাকুক নিয়ম করে প্রতিদিন পড়ার টেবিলে সন্ধ্যায় বসতেই হতো; বাবা মায়ের কড়া নির্দেশ। ছেলেবেলার সন্ধ্যাগুলো অন্যরকম ছিলো; চুপচাপ শান্ত, তখনতো আর সারাক্ষন টেলিভিশন বা কম্পিউটার চলতো না। সন্ধ্যা হলে পাশের ঘরে বাবা মা সারাদিনের সময় গুলো আদান প্রদান করতেন; আর আমি পড়ার টেবিলে মুখ গুজে বসে। আমার স্কুল আর পড়াশোনা ভালো লাগে না; এখনো না। পরের দিন যদি ইংরেজি পড়া থাকতো তাহলে আমার ইচ্ছে করতো অঙ্ক করতে; আর যেদিন অঙ্ক বাড়ীর কাজ থাকতো সেদিন বসে বসে বাংলা পড়তাম। নিয়ম মানতে যে কি কষ্ট!!! স্রোতের উল্টো দিকেই সাঁতার কাটলাম সারাটা জীবন।

মাঝে মাঝে কিচ্ছুই পড়তে ইচ্ছে করতো না; এমনকি পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে গল্পের বইও না। বসে বসে বলাকা ব্লেড দিয়ে কাটতাম পেন্সিল, উদ্দেশ্যহীন, আনমনা। কোন কোন পেন্সিলের পুরো গায়ের ছাল তুলে ফেলতাম ব্লেড দিয়ে। একবার বাবা আমার টেবিল থেকে পেন্সিল নিতে এসে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন; সব পেন্সিলই কাঠরঙ্গা ছাল বাকলা বিহীন নগ্ন। সারাজীবন রঙ ভালোবাসা এই আমি শুধু সন্ধ্যাকে ভালো না বেসে সব পেন্সিল গুলোকে রঙহীন করে ফেলেছিলাম। কখনো লাল সাদা গুল্লি সুতা দিয়ে নিউজ প্রিন্ট বা সাদা দিস্তা খাতা সেলাই করতাম। কাঠের হাতলওয়ালা খাতা সেলাইয়ের লোহার কুরুস কাঠির মাথার বঁড়শীতে লাল সাদা সুতা আটকে দিস্তা কাগজের বুকে মাঝ বরাবর সেলাই। ভালো লাগতো নিউজ প্রিন্ট কাগজ, হালকা খয়েরী ছাই রঙ্গা এই কাগজের বুক এত্তো মোলায়েম যে মনে হোতো আঁকিবুঁকি কাটার সময়ে বলপেনের নিব ডুব দিচ্ছে।

একদিন সেই কুরুস কাঠি নিয়ে আনমনে খেলতে খেলতে বঁড়শী গেঁথে ফেললাম বাম হাতের তর্জনীতে। খুব অবাক হয়ে গেছিলাম, রক্ত পড়ছিলো না, আঙুলে ব্যথাও পাইনি। পাশের ড্রয়িং রুমে বাবা কাজ করছিলেন, মা সেদিন একটু বাইরে গেছেন। বাবার সাথে কাজের কথা শেষে আড্ডা দিচ্ছিলেন স্থপতি অঙ্কন; আমার প্রকৌশলী বাবার সাথে অনেক গুলো প্রজেক্টে কাজ করতেন। বাবার চেয়ে অনেক জুনিয়র, তারপরেও আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড় হবেন। আমি তখন ক্লাস নাইনে আর উনি তিরিশ ঘেঁষা ঝকঝকে যুবক। প্রায় সন্ধ্যাতেই উনি আসতেন আমাদের বাসায়, কাজের কথা শেষেও অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতেন। ঘাড় ছোঁয়া চুল, সারা মুখে ঘন চাপ দাড়ি, গোল চশমার ভারী কাঁচের আড়ালে বড় বড় শিশুসুলভ চোখ। খুব হাসি খুশী মানুষ, বাসায় আসলেই চুপচাপ সন্ধ্যাবেলা উচ্ছল হয়ে উঠতো; অঙ্কন না হাসলেও তার উজ্বল চোখগুলো সবসময় হাসতো। যেদিনই শুনতাম যে তার আসার কথা আমি মনে মনে অপেক্ষা করতাম; কান পেতে রাখতাম মোটর সাইকেলের আওয়াজের জন্য। শব্দ হলেই উঁকি দিতাম চারতলায় আমার ঘরের জানালা থেকে। মোটর সাইকেলে বসে থাকা ওই দৃপ্ত যুবককে আমার মনে হতো ঘোড়ায় চড়া অশ্বারোহী; বাতাসে চুল উড়ছে মেঘের মতো।

আঙ্গুলে কুরুস কাঠি বেঁধা হতভম্ব আমি বাবার কাছে যেতেই বাবা অস্থির হয়ে পড়লেন। অঙ্কন বাবাকে বললেন ডেটল, তুলা আর ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। লোহার হুক টেনে বের করার চেষ্টা করতেই এত্তোক্ষনে ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলাম। অঙ্কন বললেন “এই মেয়ে!!! হাতের দিকে না, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকো।“ ছায়া ছায়া পল্লবে ঘেরা তার গভীর চোখে ডুব সাঁতার দিয়ে ভেসে উঠতেই হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত; কুরুস কাঠি উনার হাতে। বাবা আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ করে দেয়ার পরেও সাদা রঙের ব্যান্ডেজ লাল হয়ে যাচ্ছিলো। উনি সোফায় পাশে বসে অনেকক্ষন আমার তর্জনী শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিলেন। বাবা বকছিলেন এত্তো অসাবধান হবার জন্য; আমি কিচ্ছুই শুনিনি। ওনার গা থেকে ভেসে আসা পুরুষালি কোলনের গন্ধ; চেক চেক শার্টের ওপরের বোতাম খোলা; গলার রুপালী চেনের নীচে উঁকি দেয়া বুকের অরন্য। আমি সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম; মাত্র নিষিদ্ধ জগত বুঝতে শেখা আমি প্রথমবারের মতো প্রেমের অনুভূতি টের পেয়েছিলাম; ঠিক প্রেমে পড়িনি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম প্রেমে পড়লে কেমনটা লাগতে পারে। উনি আমাকে বার বার বলছিলেন যে ভয় না পেতে, সব ঠিক হয়েযাবে। আর আমি একদমই চাইনি কিচ্ছু ঠিক হয়ে যাক; ঝরুক আমার সব রক্ত আর সে অনন্তকাল আমার হাত ধরে থাকুক।

ওনাকে ভালো লেগেছিলো; একটু বেশীই; জীবনের প্রথম ভালোবাসা ঘেঁষা ভালোলাগা। কখনো অঙ্কনকে আমার করে চাইনি; আমি জানতাম সেটা বাস্তববাদী নয়; মেয়েরা খুব কম বয়সেই অনেক কিছু বুঝতে শেখে। একসময় শুনলাম উনি বিয়ে করবেন, হবু বউ আর প্রেমিকাকে নিয়ে বেড়াতে আসলেন। সীমা সাংবাদিক; ভীষন তুখোর ববকাট চুলের সুন্দরী তরুনী, চাবুকের মতো শরীর। পুরোটা সময় আমি মুগ্ধ হয়ে সীমাকে দেখেছিলাম; আশ্চর্য হয়েছিলাম ওই যুগলকে পরষ্পরকে তুই সম্বোধন করতে দেখে; দারুন অবাক আর ভালো লেগেছিলো!!! যাবার সময় আবারো চারতলার জানালায় উঁকি; আমার ভালোলাগার অশ্বারোহীর পেছনে কোমর জড়িয়ে ধরে বসা সীমাকে ভীষন মানিয়েছিলো। আমার স্বপ্নের রাজপুত্র তার রাজকন্যা খুঁজে পেয়েছে; খারাপ লাগেনি কিন্তু। কিশোরী আমি সেই প্রথমবারের মতো না চেয়েই ভালোবাসতে শিখলাম; সুন্দরকে শুধু সৌন্দর্য্যের জন্যই ভালবাসলাম।

কিশোরীকালের সেই হঠাৎ ভালোবেসে ফেলার অভ্যাসটা এখোনো আছে; যখন তখন প্রেমে পড়ি; কথার প্রেমে; কারও চোখের প্রেমে; কবিতার প্রেমে; গানের প্রেমে; খুব সুন্দর কিছুর প্রেমে; কাছে যেতে ইচ্ছা করে না; পেতে ইচ্ছা করে না; শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। বাসার সামনে গাড়ী পার্ক করে বসে আছি; পারকিং লটে গাড়ীতে বসে থাকার অভ্যেসটা পুরোনো; বসে বসে শিশিরের শব্দে সন্ধ্যা নামা দেখছি। আমার যে আর কোথাও যাবার নেই; কিন্তু আজকের হিসেব মেলাতেও ইচ্ছা করছে না। মাকে ফোন করলাম; হ্যালো বলা মাত্র মা বললো “পাগলী!! আবারো কি গাড়ীতে বসে আছিস?” অনেক বছর আগে ছোট্টবেলার সেই হারিয়ে যাওয়া আমিকে মা একদিন খুব বকেছিলো সন্ধ্যা নামার পরে দেরীতে বাসায় এসেছিলাম বলে। এখোনো আমার সারাদিনের খেলা শেষে ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না; মা আমাকে আবারো খুব করে বকে দাওতো!!!!

০৫/২০/২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×