somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন রুপালী মানবী

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দরজা খুলে বের হয়েই মনে হল ভুল করেছি। এখন রাত দশটা; ছুটির দিন, আজ রবিবার। সারাদিন সংসারের কাজ করেছি, বের হইনি। আমার মানুষটাকে বললাম যে একটু বাইরে এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে আসি, দমবন্ধ লাগছে। এই ইউনিভার্সিটি টাউন বেশ নিরাপদ; সপ্তাহের দিন গুলোতে ক্লাসই তো হয় রাত দশটা পর্যন্ত। আজ পূর্ণিমা বা পূর্ণিমার আগের দিন। এই ব্যস্ত জীবনে সূর্যের দিন গুনে চলা; চাঁদের হিসাব আর রাখা হলো কই!!!

বাইরে তরল পারদ থই থই করছে। পাহাড়ের চূড়াগুলো চাঁদের আলোয় নীলাভ রুপালী। বড় শহরে চাঁদ বিজলী বাতির আড়ালে ঢাকা পড়ে; মিটিমিটি তারাদের চেয়ে নিয়ন বাতির ধিকিধিকিই চোখে পড়ে বেশী। পাহাড়ী এই ছোট্ট শহরে চাঁদ ওঠে রাজার মতো। লক্ষ কোটি তারা খচিত নিকষ কালো আকাশ। রাতের সৌন্দর্য্যের কাছে মানুষকে এখানে প্রজার মতো নতজানু হতেই হয়। পূর্ণ চন্দ্র; প্রকান্ড থালার মতো চাঁদ; আকাশের তারা খচিত চাঁদোয়া আজ নীচে নেমে এসেছে। চারিদিকে সব রুপালী; আকাশ থেকে চুইয়ে পড়ছে তরল জোছনা। বাতাসে ঘর ছাড়ার গন্ধ; জোছনা সংসার ত্যাগী করে, মাতাল করে। এমন রাতে আমার মতো উড়নচন্ডী মানুষের ঘর ছেড়ে বের না হওয়াই ভালো। কিন্তু এখনতো আর ফেরার উপায় নেই, আটকে গেছি জোছনাজালে।

ডাউন টাউনের দিকে গাড়ি ছুটালাম। প্রায় জনহীন রাস্তা; বেশীর ভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। ফাস্ট ফুডের দোকান গুলোও বন্ধ হবে হবে করছে। কয়েকটার সামনে দু এক জন ভাসমান মানুষ তাদের ট্রলী নিয়ে দাঁড়িয়ে; ট্রলীতেই তাদের পুরো সংসার, ইহকালের যাবতীয় সম্পত্তি। কাল সপ্তাহের প্রথম দিন; উইকএন্ডের সব পাগলামি, রাত জাগা, শেষ করে শহর আবারো নিয়মের বেড়াজালে বন্দী। পারকিং লটগুলোকে দুঃখী দেখাচ্ছে; একদম খালি, শুধু হঠাৎ দু’একটা গাড়ি। জোছনা ভেজা এই নির্জন শহর যেন চাঁদের আলোয় নিরাভরন এক রমনী; অপেক্ষায় আছে উইকেন্ডের যখন সে অপরুপা সাজবে তার ভালোবাসার জন্য।

আমাদের শহরটা খুবই ছোট, পাঁচ মাইলের পরিধি। পনের/ বিশ মিনিট অলিগলিতে ঘুরোঘুরি করে ভাবলাম ফিরে যাই। গাড়ির কাঁচ নামানো; রাতের শীতার্ত বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার চিবুক, কাঁপছে চোখের পাপড়ি; বাতাসে খোলা চুল লুকোচুরি খেলছে কপোলের সাথে। বাতাসের সাথে আজ এই জোছনাময়ী রাতে আমার খেলা; কানের পেছনে দেয়া চুল বার বার গালে আর গলায় এনে দিচ্ছে। ভালো লাগছিল; বাসা পেরিয়ে Highway 1 ধরে একটু উত্তরে চলে গেলাম; সামনে কিছু দূর গিয়েই ঘুরে আসব। Highway 1 বেশ অন্ধকার; স্ট্রীটলাইট নেই। চাঁদের আলোয় দুরের হালকা রুপালী পাহাড়ের সারি। রাস্তার পাশের হালকা জঙ্গল জোছনার ছোঁয়ায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। সুনসান রাস্তায় মাঝে মাঝে গাড়ি। চাঁদ পাল্লা দিয়ে দৌড়ুচ্ছে আমার পাশাপাশি, জোছনার কোমল আলোয় অপার্থিব রাত। চাঁদটা এত্ত নীচে নেমে এসেছে; নিজেকে মনে হচ্ছে ঘোড়ায় সওয়ার দুরন্ত কাউগার্ল; ইচ্ছে হচ্ছে ল্যাসো ছুড়ে চাঁদটাকে বেঁধে নিয়ে পোষ মানাই। একটু ধীর গতিতে যাচ্ছি চাঁদটার সাথে থাকে; বাতাসের সাথে খেলতে খেলতে। উল্টো দিকের গাড়িরা বেশ জোরে হুশহাশ শব্দ তুলে রাতের নীরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছে। অন্যদের এত্তো আমার মতো চন্দ্রাহত হবার সময় নেই।

হঠাৎ পঁচিশ বছর আগের এক এমনি রাতের কথা মনে পড়ে গেল। ছাদে না উঠলে কি আর ঢাকায় জোছনা মাখা যায়!! ছাদ ভেসে যাচ্ছিল পারদ জ্যোৎস্নায়; ছাদের মেঝেতে পানির পাইপ; পানির ট্যাঙ্কি; আরো এক তলা হবার প্রস্তুতিতে যেখানে সেখানে ছাদ ফুড়ে বের হওয়া রডের বান্ডিল। রডে এলোমেলো বাঁধা কাপড় শুকানোর দড়িগুলো বাতাসে দুলছিলো, আর উড়ছিলো আমার কোমর ছোঁয়া চুল। বাতাসতো চুলের সাথে একটা খেলাই জানে; ঠিক আজকের মতোই হাওয়ার দুষ্টূমি। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ছাদের এককোনে, ডুবে গেছিলাম জোছনা দেখাতে। পিছনে একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনে চমকে তাকালাম “কে?” “আমি রুদ্র। সরি, হঠাৎ দেখে চমকে গিয়েছিলাম।“ রুদ্র আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে; আমার মতোই ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আমিও এত্তো চমকে গিয়েছিলাম যে বোকার মতো বললাম “ওহহ...আমি শিখা।“ ও একটু চুপ করে থেকে বললো “না, তুমি রুপালী মানবী।“ রুদ্র দেখতে বেশ সুদর্শন, খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট; গভীর কালো চোখ গুলো খুব বড়ো না, কিন্তু কেমন জানি একটা উড়ু উড়ু ভাব আছে। সে মনে করিয়ে দেয় মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর শ্যামলা ডেভিডকে। ওর উড়ন্ত চোখের আকাশ হতে যে মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেনি তা নয়, কিন্তু আমিতো হাত পেতে কারো কাছে কিছু চাই না। ও দাড়ায়নি, চলে গিয়েছিলো। সে রাতটা এই রুপালী মানবীর একটুও ঘুম হয়নি; আমি চন্দ্রাহত হয়েছিলাম।

এরপরে আমার সাথে রুদ্রর দেখা হয়েছে, সিড়িতে, রাস্তায়, বা কোন অনুষ্ঠানে। ও আর কিছু বলেনি, আমিও। আমাদের মধ্যে জ্যোৎস্নার যে অদৃশ্য সেতু রহস্যময়ী চাঁদ তৈরী করে দেয়েছিল, তা আমরা কখোনোই অতিক্রম করিনি। ইন্টারমেডিয়েটর পরে আমি বুয়েটে, আর ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই শুনলাম রুদ্র বিয়ে করেছে। মেয়েটা ইন্টারমেডিয়েট পড়ে, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বাসায় আনার পরে একদিন দেখলাম, নাম সুমনা, কি যে মিষ্টি দেখতে! ওদের দুজনকে খুব মানিয়েছে। এরও বছর চারেক পরে আমার বিয়ে, বুয়েটে পড়ার পর্ব শেষ; চাকরি করছি। পানচিনির আগের দিন বাসার কাজের ছেলেটা এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। আমি খুব অবাক হয়ে খুললাম। “তুমি আসলেই রুপালী মানবী। তোমাকে ধরতে চেষ্টা করিনি। জোছনা কি ধরা যায়?” একই সাথে তীব্র ভালোলাগা আর কষ্ট আমাকে ঘিরে ধরল; না পাওয়ার কষ্ট আর ভালোলাগা, আর এই জেনে যে ওর কোথাও আমার জন্য জায়গা আছে।

এর তিন মাস পরে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আশ্চর্য যে বিয়ের রাতেও থালার মতো বিশাল চাঁদ উঠেছিল। বাসর রাতে দোতালার যে ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো, সে ঘরের জানালা দিয়ে পেছনের পুকুর দেখা যায়। জানালার পাশেই বিছানা। চাঁদের ছায়া পুকুরের টলটলে জলে, মনে হচ্ছে চাঁদটা পুকুরে ডুব দিয়েছে। আমার মানুষটা ঘুমিয়ে গেছিলো, একাই জেগে ছিলাম। জানালা দিয়ে সেই অপার্থিব জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে তীব্র মন খারাপ হলো; ছেড়ে আসা পুরোনো জীবন; সামনের অজানা অনিশ্চিত যাত্রা । চারপাশে গোলাপের পাপড়ি, ফুলের সুবাস; নতুন চাদরের আর মানুষটার গন্ধ মাখা আমি; একা একা জেগে থাকা আমি সেই মোহময় জোছনার দিকে তাকিয়ে কাদঁলাম। হঠাৎ করেই আমার মানুষটা জেগে গেল; উঠে বসে বললো “মন খারাপ লাগছে?” তারপরেই কন্ঠে মুগ্ধতা ঝরে পড়ল “ইশশ্…চাদের আলোয়তো তোমাকে রাজকন্যার মতো লাগছে!!!”

আমার মানুষটা তেমন কবিতা পড়ে না।আমাকে সে রুপালী মানবী বলবে না কখনোই। কিন্ত আমাকে সে যখনই পড়েছে নিজেকে আমার মনে হয়েছে একটা সম্পূর্ণ কবিতার মতো, যার প্রতেকটা পংক্তি ভালোবাসায় লেখা। আমি গাড়ি ঘুরালাম। এই জোছনাময়ী রাতে আমাকে ঘরে ফিরতেই হবে। ঘরছাড়ানো চাঁদকে পেছনে ফেলে আমি ঘরে ফিরছি। আজ রাতে থই থই চাঁদের আলোয় আমার মানুষটাকে যে আমার বলতেই হবে “এই শোনো… আজ আমি রুপালী মানবী, শুধু তোমার রুপালী মানবী।

(০৫/০৪/২০১৫) ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:২০
১৮টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×