ভোরে উঠে জানালার ব্লাইন্ড খুলতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বিষন্ন একটা বৃষ্টি ভেজা দিন!! চারিদিকে ছাই রঙ মাখামাখি। ক্যালিফোর্নিয়ার শীতকালের বৃষ্টি পাহাড় থেকে শীত নিয়ে আসে; হঠাৎই তাপমাত্রা নেমে যায়। ব্যাক ইয়ার্ডের ভেজা ফেন্সের কালচে বাদামী রং বলে দিচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে অনেকক্ষন ধরে। সম্ভবত রাতশেষে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি এখানে ঢাকার মতো পাড়ায় রাস্তায় মিছিলের শ্লোগান দিয়ে আসে না। এখানে বৃষ্টি নামে নিঃশব্দ বিড়ালের পায়ে। সে এখানে জল ডাকাত নয়। এখানে বৃষ্টি সেই কিশোরী মেয়েটার মতো যে চুপচাপ রাতের গভীরে গোপন দুঃখে বালিশ ভেজায়।
ইশশ্ এই বৃষ্টি ভেজা দুঃখী দিনটাতে আমার কাজে যেতেই হবে!!! দরজা খুলে বেরোতেই হালকা বাতাস ঝিরঝিরে বৃষ্টি সারা গায়ে মেখে দিল। সারা আকাশ জুড়ে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মতো মেঘ। মনে পড়ে গেল শীতকালের সন্ধ্যায় গ্রামে দাদার বাড়িতে পাটের শিনটা পোড়ানোর কথা; পাটকাঠির মাথা দিয়ে ঠিক এমনই ছাই রঙা ধোঁয়ার সারি। বাইরে বেশ ঠান্ডা। এমন দিনে যদি পাতলা লেপের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা যেত, আকাশ কুসুম কল্পনা, আর সব হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গ। একসময় বেলা বাড়লে বিছানার পাশের টেবিলে ধুমায়িত চায়ের পেয়ালা, হাতে শীর্ষেন্দুর কড়কড়ে নতুন উপন্যাস, কাগজের গন্ধের সাথে বৃষ্টির গন্ধ মেশামেশি। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কথা ভাবতেই একটু উষ্ণ লাগলো।
ক্লাস শেষ করে দুপুর নাগাদ বের হলাম। একটু ফার্মেসী থেকে ওষূধ তুলতে হবে। ফার্মেসী যাবার পথের রাস্তাটা অদ্ভুত সুন্দর!! রাস্তার নাম Foothill Drive, আসলেই দুপাশের পাহাড়ের পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে রাস্তাটা। পাহাড়ের গায়ে ফার্ম, ফার্মের বাড়ির ওপরে ধোঁয়া উঠছে; কর্মব্যস্ত দিন, ঘোড়া আর গরু দেখা যাচ্ছে; সবুজ পাহাড়ে ফার্মের সীমানা বেঁধে দিয়েছে আঁকাবাঁকা সাদা পিকেট ফেন্স। রাস্তার দুপাশে একটু পরে পরে পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। গাড়ি রেখে হাইকিংয়ে যাওয়া যায়; চুলের সিঁথির মত হাইকিং ট্রেইল গুলো দেখা যাচ্ছে।
ডানে মোড় নিতেই পাহাড়গুলো দূরে সরে গেলো। রাস্তাটা হঠাৎই ছড়িয়ে গেলো; হরিয়ালি পাহাড়ের সারি এখন দিগন্ত রেখায়। পাহাড়ের সামনে বিস্তীর্ণ খোলা ক্ষেত, শাকের, লেটুসের, বিভিন্ন সবজীর। মনে হয় ক্যালেন্ডারের পাতার ভিতর দিয়ে ড্রাইভ করছি। কলাপাতা সবুজ পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজ টুকরো তৈরী করেছে গাছেরা; ঠিক গতরাত্রের স্বামী সোহাগী বউয়ের গলায় ফুটে থাকা চুমুর মতো। সামনে রাস্তা যুবতীর পিঠে মোটা বিনুনীর মতো খেলছে। মোটামুটি সমতল, একটু ঢেউ খেলানো; তবে দু এক জায়গায় টোল খেয়েছে, রোলার কোস্টার রাইড।
বেশ অনেকক্ষন পরে ট্রাফিক লাইট। আমাদের এই ইউনিভার্সিটি টাউন সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত; Scenic Highway 1 এর পাশের এই শহরকে বলা হয় “Heaven on Earth”… “পৃথিবীর বুকে স্বর্গ”। আমি এখন তাকিয়ে আছি সেই স্বর্গের এক ফালির দিকে। কিন্তু খারাপ লাগতো না যদি এই স্বর্গদৃশ্য ঢেকে যেত টানা বৃষ্টির পর্দায়; বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে শোনা যেত মানুষের কথা, গাড়ির হর্ন, বাসের তীক্ষ হর্ন, রিক্সার আর সাইকেলের টুং টাং; বৃষ্টির সোদা গন্ধের সাথে মিশে থাকত পেট্রোলের আর ডিজেলের পোড়া গন্ধ, ঘামের গন্ধ, ড্রেনের নোংরা পানি আর ডাস্টবিনের ময়লার গন্ধ। হঠাৎ করেই মনে হল এখন যদি অনেক গুলো কচি কচি মুখ গাড়ির জানালা ছুঁয়ে ঠুকঠাক তবলা বাজিয়ে গোলাপ কলি বা বকুল মালা কিনতে বলতো তাহলে ভালোই লাগতো। রাস্তার পাশের ফুটপাতের হকাররা সব পন্য ঢেকে ফেলেছে রঙ বেরঙের প্লাস্টিকে। এই হুজুগে বৃষ্টির জন্য আজ বিক্রি বাটা কিছু হলে হয়!! এই বৃষ্টি অনাসৃষ্টি ফুটপাত রাঙ্গিয়ে দিয়েছে।
ওই যে রাস্তার পাশে বাস ষ্ট্যান্ডের নীচে সবুজপাড় নীল শাড়ি পড়া শ্যামলা মেয়েটা হঠাৎ বৃষ্টিতে ছাতা নেই বলে আটকে গেছে, তাকে আজ দেখাচ্ছে জলভারে নত একটা মেঘের মত। এই প্রায়ান্ধকার দিনেও ছেলেটা সানগ্লাস পড়ে আছে, চুল বেশ কায়দা করে আচড়ানো, চোখ ঢাকা থাকলেও ধারালো চিবুক বলে দিচ্ছে সে বেশ সুদর্শন। ছেলেটা চিন্তিত, কপাল কুচকে আছে, আজ তার ফেসবুকের সেই আসমানী প্রেমের সাথে প্রথম দেখা হবার কথা, এই বৃষ্টিতে যদি সে না আসে।
স্কুল ছুটি, একগাদা নীল সাদা উনিফরম পরা বাচ্চার কলকাকলী। কি যে মিস্টি মেয়েটা!! রিক্সায় উঠার আগে রাস্তার পাশে জমে থাকা পানিতে একটা ছোট্ট লাফ, মায়ের বিরক্ত মুখ, তারপরেও বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ মেয়েটার চোখে মুখে। জংলাছাপা কামিজে মেয়েটা বর্ষাস্নাত পাতাবাহার যেন; বার বার মুঠো ফোনে সময় দেখছে; তাকে যে সেই কখন ভ্রাম্যমান অক্ষরে বার্তা পাঠিয়েছে; দেরী হলে আজ মার কাছে ঠিক ঠিক বকা খাবে।
মলিন মুখের সদ্য যৌবনে পা দেয়া ওই ছেলেটা ভাবছে “ইশশ মেঘ থেকে কি আজ কাদা ঝরছে!!! একটাই ভালো প্যান্ট, কে এখন ধোয়ার পয়সা দেবে?” মধ্যবয়সী কেরানীর পোড় খাওয়া মুখে চিন্তার ছাপ, রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে ডালভাত খেয়ে অফিসে ফিরতে না দেরী হয়ে যায়। বাসের জানালায় বিষন্ন যে ছেলেটা গাড়ির সুন্দরী মেয়েটার সাথে চোখাচুখি হওয়া মাত্র একটু খুশী, সে ভাবছিলো “কে জানে আজও কি টিউশনির পয়সা দেরীর জন্য কেটে নেবে কিনা!!!” রিক্সায় নীল প্লাস্টিকের আড়ালে প্রেমিক যুগল; বৃষ্টি নামাতে ওদের মতো খুশী আর কেউ নয়। নীল প্লাস্টিক মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে ওদের মুখ; পর্দার গায়ে আকাবুকি করছে উষ্ণ বাষ্পের ভালোবাসা।
ক্যালিফোর্নিয়ার এই শীতার্ত বিরহী বৃষ্টি আমার একটুও ভালো লাগে না। যদিও খরাপ্রবন ক্যালিফোর্নিয়ার বৃষ্টি খুব দরকার, তারপরেও আমার স্টুডেন্টরা সবাই জানে এখানকার বৃষ্টি আমার কত্তো অপছন্দ। বাংলাদেশে গরমকালের ঝুম বৃষ্টি, বৃষ্টির দিনে কাজ ফাঁকি দিয়ে আমার এক খটমটে নামের লেখকের বই পড়া আর বিছানায় শুয়ে গরম চায়ের কথা শুনতে শুনতে ওরা বলে “Shikha, you are crazy… we can’t imagine how rain in summer would be!”
আজ এই নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় মনে হল আসলে আমি বৃষ্টি না, বৃষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকেই ভালোবাসি। বাংলাদেশের বৃষ্টি আক্রান্ত মানুষগুলো আমার চেনা, ওদের গল্প আমি জানি, আমিতো ওদেরই একজন। যে মেয়েটা ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া সাদা গাড়িতে বসে বসে এই মানুষ গুলোর গল্প ভাবছে, সে তো আমিই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রাস্তার পাশে যে সুঠাম দেহী যুবক খালি গায়ে দৌড়াচ্ছে অথবা সবুজ চোখের যে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে এই বৃষ্টিতে গাড়ি চালাচ্ছে বা হেলমেট পড়া নিয়ন রঙের যে সাইক্লিস্টের দল বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে পথে নেমেছে, তাদের গল্পতো আমি জানি না। মানুষ মনুষ্যহীন প্রকৃতিকে কবেই বা ভালোবেসেছে? আমিও বাসিনি।
(০৫/১১/২০১৫)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:০৭