somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

রঞ্জনের প্রেমিকারা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“ইশশ!! কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি? এতো দেরী করলি!!” দরজা খুলেই জড়িয়ে ধরলো বন্দনা। “ছাড়তো...দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে!!” ছেড়ে দিয়েই দু’পা পিছিয়ে গেল বন্দনা “দাঁড়া...দাঁড়া!! আগে তোকে ভালো করে দেখি। ওমা অরু...তুইতো দিন দিন আরো সুন্দর হচ্ছিস...বিদেশের বাতাসে কি আছে রে?"

- বন্যা!! এইসব পাগলামি ছাড়তো...বাসায় ঢুকতে দিবি না?
- আয়...আয়...কতোদিন পরে তোকে দেখলাম বলতো...দশ বছর নাকি আরো বেশী?
- বছর দশেকই হবে...ঢাকা এতো বদলে গিয়েছে...চিনতেই পারছি না জানিস?
- আমাকে চিনতে পারছিস তো?
- তোদের দেখতেই আসা...তাই না? বাহ!! তোর বাসাতো খুব সুন্দর সাজিয়েছিস।

ড্রইংরুমে সোফায় বসতে যেতেই বন্দনা বলে ওঠে “এখানে এসি নেই...চল বেডরুমে বসে কথা বলি...আর তাছাড়া ওখানে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজও অপেক্ষা করছে...”

“কিসের সারপ্রাইজ বলতো?” বলতে বলতে শোবার ঘরে ঢুকেই অরনী থমকে গেলো। বিছানার ওপরে বসা দীপালী; একটু অভিমানী মুখে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে আছে। “হারামজাদী!!” বলতেই একছুটে গিয়ে ওকে এবার জড়িয়ে ধরলো অরনী। “দেশে এসেছিস এতোদিন পরে...যোগাযোগ করিসনি শয়তান!! খররদার জড়াজড়ি করবি না...” “কতোদিন তোর গালি শুনি না...গালিগালাজ না করলে তোকে মানায় না...” “থাপ্পড় খাবি...” বলতে বলতেই অরনীকে জড়িয়ে ধরলো দীপা “অরু...কতোদিন পরে আমরা তিনজন একসাথে...তোকে অনেক মিস করি রে!!”

একদফা কান্নাকাটি হলো; আনন্দের কান্না...কিন্তু সে কান্নায় কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলার দুঃখও মিশে আছে। তিনজন একসাথে বড় হয়েছে; বাবাদের চাকরীর সুবাদে একই কলোনীতে পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে। স্কুল কলেজ একসাথে; রুপকথা শৈশব, স্বপ্নময় কৈশোর, অস্থির তারুণ্য...চিন্তাবিহীন সরল সময়গুলো!! জীবনের সবচেয়ে সুখী আর জাদুকরী সময়টা কেটেছে ওদের সাথে। মা বলতেন “নদীতে নদীতে দেখা হয় কিন্তু বোনে বোনে দেখা হয় না।“ অরু একসময় এই প্রবাদবাক্য শুনে খুব হাসতো। এখন জানে আসলেই তাই! জীবন এখানে ওখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্রোত পালটে দেয়...সমান্তরালে চলা নদীরা দূরে সরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যায়।

- যোগাযোগ করতাম রে পাগলী!! মাত্র এক সপ্তাহ হলো এসেছি। বন্যার কাছে সেদিনই জানলাম যে তুই চিটাগাং থেকে এখানে মুভ করেছিস। তোর গালি না খেয়ে প্লেনে উঠতাম নাকি?

অরনীর হঠাত খেয়াল হলো “এই বন্যা!! হাসান ভাই কই? দেখলাম না তো...“

- আর বলিস না রিটায়ার করার পরে যে চাকরী নিয়েছে সেটাতে মাঝে সাঝে ঢাকার বাইরে যেতে হয়...দু’দিন পরে আসবে। তুই আসবি শুনে আফসোস করছিলো!!

দীপালী ফোড়ন কাটলো “তা আর বলতে...পরীতো এখন স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা...সাত সাগর আর তের নদীর ওপারে...”
“ঘরে এমন ডানাকাটা পরী থাকতে পৃথিবীর রাজকন্যাদের কে খোঁজে বল!!” অরনী কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই বাঁধভাঙ্গা হাসি। বিয়ের পরে নতুন জামাই হাসান ভাই ওদেরকে দুষ্টুমি করে বলেছিলেন “পরীবাগেতো দেখি অনেক পরীর ছড়াছড়ি!!”

কলেজ শেষ হতেই না হতেই বন্দনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। বন্দনা বড্ড সুন্দর...চোখ ধাঁধানো সুন্দর!! কিছু কিছু সৌন্দর্য অস্থিরতা তৈরী করে...রক্তের মাঝে নিভৃতে পাল তুলে দেয় যুদ্ধজাহাজ...বন্দনা তেমনটাই। আশেপাশের পুরো এলাকা ওকে চিনতো। বিয়ে না দিয়ে উপায় ছিলো না; যত্রতত্র বিয়ের প্রস্তাবে বাবা মা অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। তার ওপরে আছে পাড়ার ছেলেদের প্রেমময় চিঠি, চিরকুট, এখানে ওখানে উদাস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা, কায়দা করে পাড়াতুতো বড় ভাইদের সিগারেট ধরানো, না চাইতেই মহা সমারোহে রিক্সা ঠিক করে দেয়া। এখন ওই ব্যাপারগুলোকে খুব ছেলেমানুষি মনে হয়। অথচ তখন কি ভয় লাগতো...মাঝে মাঝে অপরাধী ভালোলাগাও উঁকি দিতো।

বন্যাটা অবশ্য খুব শান্ত, খুব ভীতু মেয়ে...কেউ একটা চিঠি পাঠালেই পড়ে মহা কান্নাকাটি। এটা ঠিক যে কিছু কিছু চিঠির ভাষা শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করতো। দীপা কাঁদতে দেখলে খুব রাগতো “কাঁদছিস কেন? ওরা অসভ্য...তুইতো না...নাকি তোর এমনটা করতে ইচ্ছা করছে...পারছিস না বলে কান্না...যত্তোসব ভ্যা ভ্যা পার্টি!!” বন্দনার কান্না আরো বেড়ে যেতো। দীপালী বেশ সাহসী মেয়ে; মুখের ওপরে ঠাস ঠাস কথা বলতে পারতো; খুব মিষ্টি আর শান্ত চেহারার মেয়েটা মুখ খুললে পুরোই ঝড়ো হাওয়া বইতো। ও সাথে থাকলে এই ত্রয়ীকে কেউ ঘাটাতো না। তবে এই মারদাঙ্গা মেয়েটা কি যে দারুন গান গাইতো!! পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে ওর জায়গা বাঁধা ছিলো। দীপার কন্ঠস্বর, গায়কী অপার্থিব ছিলো...মনে হতো গানগুলো অন্য কোন ভুবন থেকে ভেসে আসছে। এই থ্রি মাস্কোটিয়ারসকে পাড়ার সবাই চিনতো। অরনীর পরিচিতি ছিলো মেধাবী ছাত্রী হিসেবে; পড়াশোনায় ও খুব ভালো ছিলো। নীচু ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো বাবা মায়ের কাছে ওর রেজাল্টের কথা শুনে শুনে পুরোই ত্যাক্ত বিরক্ত থাকতো।

ছেলেমেয়ে, সংসার, প্রিয়জন হারানোর দুঃখ, আর সেই পরীবাগ......অজস্র গল্প জমে আছে। আড্ডা জমে উঠতেই দুপুরের খাওয়া। বিশাল আয়োজন; খাওয়ার পরে বিছানায় অরনী এলিয়ে বসলো “বন্যা তুই কি সংসারী হয়েছিস বাব্বা!! এতো রকম রান্না...বেশী খেয়ে ফেলেছি...আইঢাই লাগছে রে!” পাশে কোলবালিশ জড়িয়ে দীপা শুয়ে ছিলো; চোখ খুলে বললো “আমার বাসায় এতো খাওয়া পাবি না!! রান্না করতে মোটেও ভালো লাগে না!”

“আচ্ছা অরু...তোর রঞ্জনভাইকে মনে আছে?” বন্দনার প্রশ্নে অরনী একটু চমকে গেলো। “পরীবাগের রঞ্জন ভাই? ওই যে...খুব দারুন ছবি আঁকত?” অরনীর স্থপতি হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো; তবে ও আকাঁআকিঁতে দুর্বল। শেষমেশ ইঞ্জিনীয়ারিং পড়েছে। রঞ্জন ভাইকে খুব হিংসা হতো ওর তখন। উনি অবশ্য চারুকলায় পড়তেন। বছর দশেকের বড়...কি অদ্ভুত সুন্দর আঁকার হাত ছিলো ওনার!!

বন্দনা মাথা নেড়ে সায় দিতেই অরনী বুকের ধুকপুকুনি কমিয়ে বললো “কেন বলতো? কেমন আছেন উনি?” বন্দনার মুখটা করুণ হয়ে গেলো “মাসখানেকের ওপরে হলো রঞ্জন ভাই মারা গেছেন। ম্যাসিভ হার্ট এটাক। তেমন আর কি বয়স বল? হাসানের সমসাময়িক।“ আসলেই পঁয়ষট্টি এখন আর তেমন বেশী বয়স মনে হয় না। দীপা বললো “আজ বিকেলে ওনার চল্লিশার মিলাদ আছে...যাবি অরু? চল না যাই!! পুরোনো চেনা অনেকের সাথে দেখা হবে।“

- যাহ!! এমন হুট করে কারো মিলাদে যাওয়া যায় বুঝি?
- আমাদের তো বলেছে...ওনার ছোটবোন মিলিআপার সাথে আমাদের আসা যাওয়া আছে। ওনার বাসাতেই মিলাদ...তোকেতো চেনে...গেলে খুশী হবে...চল না রে!!
- আচ্ছা রঞ্জন ভাই কি চাকরী করতেন? বিয়ে করেছিলেন? বাচ্চা কাচ্চা?
- খুব ভালো ছবি আঁকতেন। কিন্তু ছবি এঁকে কি আর জীবন চালানো যায়? পরে একটা শিপিং কোম্পানীতে ছোটখাট চাকরী করতেন...ছবি আকাআকি বন্ধ করে্ননি শুনেছিলাম। বিয়ে করেছেন অনেক বয়সে...বছর দশেক হলো। বাচ্চা নেই...নেয়নি নাকি হয়নি কে জানে? বউটাও বয়সে অনেক ছোট...শুনেছি কুড়ি বছরের তফাত।

দীপা উৎসাহে শোয়া ছেড়ে উঠে বসলো “আমি যেতাম মিলাদে...পরে তুই আসবি শুনে এখানে। বন্যারও যাওয়ার ইচ্ছে। তুই রাজী হলে তিনজনেই যাবো...চল না!! ওনার বউটাকে দেখার ইচ্ছে খুব...দেখতে ইচ্ছে করে পরীবাগের প্রিন্সের বউটা কেমন...”

রঞ্জন ভাই পরীবাগের না হলেও ওদের ছেলেবেলার রাজকুমার। আসলেই বেশ সুন্দর ছিলেন উনি। নাক চোখ মুখ বা শরীরের গড়ন খুঁটিয়ে না দেখলেও কোথায় জানি একটা মাদকতা ছিলো। বড় রাজকীয় ছিলেন; রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বা কোন ঘরে ঢুকলে তাকাতেই হতো। তবে মানুষটা বড় দুরের ছিলো...এতো অমায়িক, সবসময়ে হেসে কথা বললেও কোথাও যেন দূরত্ব রয়েই যেতো। অথবা কে জানে সুন্দর হয়তো এমনটাই...সুন্দরের সীমা ছুঁয়ে হাঁটা যায় কিন্তু সুন্দর যে অধরা!!

“তোদের একটা কথা বলা হয়নি...” বিছানায় পদ্মাসন হয়ে বসা বন্দনার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো অরনী। এমন কি কথা যে বন্দনার কানের ডগা আর ফর্সাগাল লালচে হয়ে গেছে!! বন্দনা এখনো খুব সুন্দর। মধ্যদুপুরের তেজী ঝাঝাঁলো সূর্যের চেয়ে দিগন্তরেখায় অস্তগামী সূর্যতো কম মনমুগ্ধকর নয়। “রঞ্জন ভাই আমাদের মুখোমুখি বিল্ডিংয়ে থাকতো মনে আছে? মাঝে মাঝেই বারান্দায় দেখতাম; ওনারা তিনতলায় আর আমরা দোতলায়। এক দুপুরে গোসল সেরে বেরোতেই মা বললেন ওনাদের বাসায় খাবার দিয়ে আসতে; মা সেদিন কাঁচা কাঁঠাল রান্না করেছিলেন। জেঠু মানে রঞ্জন ভাইয়ের বাবা কাঁচা কাঁঠাল খুব পছন্দ করতেন। জেঠিমাকে রান্নাঘরে খাবার দিয়ে বেরোবার পথে উনি রঞ্জনভাইকে ডেকে বলেছিলেন দরজাটা বন্ধ করে দিতে; বাসায় আর কেউ ছিলো না।

ওদের বাসায় বাইরের দরজার কাছে ড্রয়িংরুমের লাগোয়া ঘরটা রঞ্জনভাইয়ের ছিলো। দরজার কাছে যেতেই ঘরের ভেতর থেকে রঞ্জন ভাই বলেছিলেন ‘বন্যা...এদিকে এসো...দেখতো এই ছবিটা কেমন হয়েছে?’ চেয়ারে এক পা মুড়ে বসে ছিলেন; সামনের টেবিলে পেন্সিল স্কেচ করা একটা ছবি। তাকাতেই আমার দমবন্ধ হয়ে গিয়েছিলো...একটা মেয়ে বারান্দায় ভেজাচুল ঝাড়ছে। মেয়েটা আমি...কি যে আশ্চর্য সুন্দর একটা ছবি! সেই প্রথম নিজেকে খুব সুন্দর মনে হয়েছিলো। এতো ছেলেরা, এতো লোক বলেছে...অথচ আমার কখনো নিজেকে এমন সুন্দর মনে হয়নি জানিস?

হঠাৎ রঞ্জন ভাই উঠে দাড়াঁলেন। এতো কাছে, মুখোমুখি আমরা। ওর শরীর থেকে কেমন একটা পুরুষালী বুনো ঘ্রাণ আসছিলো; মাতাল চোখ। জানতাম কি হবে...কি হতে যাচ্ছে। জানতাম ওর ঠোঁট নেমে আসবে আমার ঠোটে; অথচ পা মেঝেতে আটকে গিয়েছিলো। আমি পালাতে চাইনি। আমি, এই ভীতু আমি, তীব্রভাবে ওনার ঠোঁটের স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কোথায় যেন দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ; নেশা কেটে গেলো।

ওই মুহূর্তটা কতোবার যে ভেবেছি!! বিয়ের আগে, বিয়ের পরে অনেকবার। ভেবেছি কেমন হতো রঞ্জনের স্পর্শ, ওই ঠোঁটের ছোঁয়া। এখনো মাঝে মাঝে ভাবি। না ছুঁয়েই একটা মানুষ কেমন করে আমাকে অধিকার করে আছে এতোটা বছর...আশ্চর্য!!”

দীপালী নিঃশ্বাস ফেলে বললো “আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই পারতি...বলে দিতাম কেমন?” বন্দনা চমকে গেলো “তুই রঞ্জনকে চুমু দিয়েছিস? কিভাবে? কখন? কেন?” ওর গলায় কি একটু ঈর্ষার ছোঁয়া? দীপালী অবশ্য সেটা খেয়াল করেনি “বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান ছিলো। কলোনীর ভেতরেই ক্লাবঘরে প্রোগ্রাম; বাবা মা আগেই বাসায় চলে গিয়েছিলেন। গান গাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। আমার হারমোনিয়ামটা অন্যেরা ব্যবহার করছে বলে একাই প্রোগ্রাম শেষ হওয়া পর্যন্ত ছিলাম। নতুন কিছুতো নয়; কেউ হারমোনিয়াম আর আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। দশটার দিকে সব গুছানোর পরে রঞ্জনভাই হারমোনিয়াম নিয়ে আমার সাথে চললেন।

শীতের রাত; ঝকঝকে আকাশে তারা থাকলেও কাস্তে চাঁদের আলো তেমন জোরালো ছিলো না। হাঁটাপথে আলো আধারির ঘোলাটে আলোয়ান; টুকটাক কথা হচ্ছিলো। বিল্ডিংয়ের নীচে এসে রঞ্জন ভাই হারমোনিয়াম নামিয়ে বললেন ‘একটু দাড়াই...হাপিয়ে গেছি...তোমার বাসাতো আবার সেই চারতলায়!!’ সিড়ির কাছে আলো নেই; বাল্বটা মাঝে মাঝেই দপদপ করে নিভে যায়, আবার নিজেই জ্বলে ওঠে। শীতকালে সবাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরে; ঘড়ি না এগুতেই রাত গভীর মনে হয়।

‘সরাসরি কথার জন্য অনেকেই তোমাকে ভয় পায়...’ বাচাল আমি বলেছিলাম ‘আপনি পান না বুঝি?’ রঞ্জন এমন সুন্দর করে হেসেছিলো। মনে হচ্ছিলো ওর নিঃশ্বাস পড়ছে আমার কানের লতিতে; কানের কাছে কথারা ফিসফিসয়ে লুকোচুরি খেলছে। ‘তোমার চোখগুলো এমন সুন্দর!! তাকালে মনে হয় ছায়াঘেরা শান্ত শীতল দীঘির পাশে...ইচ্ছে করে শ্যাওলা পিছল সিঁড়িতে পা জড়িয়ে জলে ডুব দেই। যার এমন চোখ তাকে ভালোবাসা যায়...ভয় না!!’ কেউ এমন করে আমাকে বলেনি জানিস?

ওই কন্ঠস্বরে কি ছিলো কে জানে!! জেনে গিয়েছিলাম তীব্র সুন্দর কিছু ঘটবে এক্ষুনি; চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে ছিলাম। জমাটবাঁধা অন্ধকারে দৃষ্টিরা মেলেনি বলেই হয়তো অন্য ইন্দ্রিয়রা তীক্ষ হয়ে উঠেছিলো। ঠোঁট নেমে এসেছিলো...কোমল, অপার্থিব একজোড়া ঠোঁট...মনে হচ্ছিল মেঘেরা ছুঁয়ে দিচ্ছে। ‘চলো...’ শুনে চমকে চোখ খুলতেই দেখি আলো জ্বলে উঠেছে। বাল্বটার ওপরে খুব রাগ হয়েছিলো সেদিন। লজ্জাও পেয়েছিলাম ভীষন; চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় ছিলাম যে!! আরেকটু চেয়েছিলাম আমি। চেয়েছিলাম ওর আঙ্গুলেরা কানের পাশের চুল সরিয়ে দিক; আরেকবার ঠোটেরা ছুঁয়ে দিক...আরেকটু তীব্র, আরেকটু বন্যভাবে, আরেকটু দীর্ঘ সময় নিয়ে ও আদর করুক!!

কোন কোন রাতে এখনো বন্ধ চোখে অপেক্ষা করি...অন্ধকারে একজোড়া ঠোটের অপেক্ষা!!”

- এরপরে রঞ্জনের সাথে আর তোর কথা হয়নি? প্রেম করে ফেললেই পারতি!!
- কথা হবে না কেন? প্রেম হতো কিনা কে জানে...ভালোবাসে বলেতো আর চুমু দেয়নি। রঞ্জন অন্যরকম। আলোতে যখন ওর দিকে তাকালাম মনে হলো ও আসলে আমাকে দেখছে না; ঝুঁকে কোন শান্ত সুন্দর দিঘীর জলে নিজের ছায়া দেখছে। ঠিক আমাকে নয়...রঞ্জন ওই মুহূর্তে নিজেকেই ভালোবেসেছে...

ঘরে অস্বস্তিকর নীরবতা। অরনী বললো “দীপা...কতোদিন তোর গান শুনি না...একটা গান শোনা না!!”
“সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়?…”
দীপার কিন্নর কণ্ঠে কি তীব্র বিষাদ!! ওর গানটা কেন যেন কান্নার মতো শোনাচ্ছে!!

ঘরের বিষন্ন বাতাস খুব ভারী লাগছে অরনীর। সেই সন্ধ্যাটা...বাবা মা বিয়েতে গেছেন। সামনে পরীক্ষা তাই অরনী যায়নি। দরজায় কলিংবেল বাজাতে ও ভেবেছিলো ভাইয়া; ভাইয়া অন্যদিন এসময়ে বাসায় চলে আসে। জিজ্ঞাসা করতেই রঞ্জন ভাইয়ের গলা শুনে ও অবাক হয়েছিলো “উদয়ের কাছে একটু দরকার ছিলো...বাসায় নেই?” দরজা খুলে বলেছিলো “বাসায় কেউ নেই!! ভাইয়ার অবশ্য এতোক্ষণে ফেরার কথা।“ “একটু অপেক্ষা করি তাহলে...”

রঞ্জনভাইকে বসতে দিয়ে অরনী একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলো। কি কথা বলবে এই লোকের সাথে? ওর মন পড়ে আছে পড়ার টেবিলে। “তোমাকে শাড়িতে বেশ মানিয়েছে...অনেক বড় মনে হচ্ছে!!” অরনী ভুলেই গিয়েছিলো। মা বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরী হওয়ার সময়ে ও শখ করে মায়ের একটা শাড়ী পড়েছিলো। রুপালী পাড়ের হালকা গোলাপী তাঁতের শাড়ী। “আমিতো বড়ই...বড় লাগবে না কেন?” অরনী তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। রঞ্জন ভাই হেসে ফেললেন “বড় মানে তোমাকে রমনী মনে হচ্ছে...” “বাহ!! আমি বুঝি রমনী নই!!” “তুমি রমনী অবশ্যই...আজ শাড়ীতে বেশী রমনীয় লাগছে...” অরনী আর কথা বাড়ায়নি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করার জন্য তাকাতেই অরনী চমকে গেলো; সামনে একজোড়া মুগ্ধ চোখ। “তোমাকে ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছে অরনী। অন্যরকম সুন্দর...তোমাকে ছুঁতে হলে অনেক গভীরে যেতে হয়। তোমার শরীরের ভাজে ভাজে আরব্য রজনীর গল্প...অথচ তুমি রাজকন্যা নও!!” অরনীর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ এখন একজোড়া চোখের কাছে। রঞ্জন ওকে আদর করেছিলো...বন্যভাবে...আদিম পুরুষেরা যেমন করে...তীব্রভাবে!!

অরনী বাঁধা দেয়নি; এখনো মাঝে মাঝে ভাবে...কেন? মানুষটা সুন্দর; চোখে তার মোহনবাঁশী; তার কথায় বোনা শব্দের জাল অদ্ভুত মোহময়......তারপরেও? অরনী জানে মানুষটা ওকে ভালোবাসেনি। রঞ্জন ওকে দেখেইনি; ওর শরীরের প্রতিটা বাঁক সে মুগ্ধচোখে দেখেছে...যেভাবে শিল্পী দেখে ভাস্কর্যকে!! আদরশেষে অরনীর নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো “তোমার শরীরটা আশ্চর্য!! গির্জার রঙ বেরঙের জানালার কাঁচের মতো...যতোবারই আলো পড়ে নতুন আলোর নক্সা তৈরী হয়!! ধরা যায় না...ধরতে ইচ্ছেও করে না...এমন সুন্দর!! তুমি কখনো পুরোনো হবে না অরনী...কখনো না!!”

মনখারাপ হলেই অরনী নিজেকে যে কতোবার মনে মনে বলেছে “তুমি কখনো পুরোনো হবে না অরনী...কখনো না!!”

গান শেষ হতেই অরনী বললো “চল যাই মিলাদে...” মিলাদে পৌছাতে একটু দেরী হয়ে গেলো; মোনাজাত শেষ। শাদা শাড়ী পড়া একটা শ্যামলা মেয়েকে বিদায়ের আগে সবাই গিয়ে স্বান্তনা জানাচ্ছে। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে; খুব মিষ্টি চেহারার, বড় বড় চোখ দিয়ে জল পড়ছে, কান্নার আওয়াজ নেই। মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলাবার চেষ্টা করছে; বোঝাই যাচ্ছে এই মেয়েটা রঞ্জনের সহধর্মিণী।

রঞ্জনের কাছে ওরা তিনজন কেবলই ক্যানভাস ছিলো; ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হতেই শিল্পীর মোহ কেটে গিয়েছিলো। শব্দের আর স্পর্শের আঁচড়ে কোথাও সেই নারীস্বত্বা জেগে উঠেছিলো.....খাজুরাহোর সেই চিরন্তন চিরসুন্দর নারীভাস্কর্য!!

ওরা তিনজন তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ঈর্ষা নয়, কৌতূহল। এই মেয়েটা কি পেরেছিলো শিল্পীকে ভেঙ্গেচুড়ে মানুষ খোদাই করতে? পেরেছিলো কি?

শিখা (৮ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭) (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:০৭
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×