somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

একজন দ্বিচারিণীর গল্প

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“শিখা…তুমি কি এখানে আসার আগে গাড়ি চালাতে?” “নাহ!! পি এইচ ডি শেষ করে যখন চাকরী শুরু করলাম তখন ড্রাইভিং শুরু করেছি…তার আগে গাড়ি চালাতে জানতাম না।“ ল্যাব ক্লাসে প্রশ্ন করা জনের পাশে বসা ববি আস্তে করে বললো “তোমাকে বলেছিলাম না ওইসব দেশে সবার শোফার থাকে!!” ববি হচ্ছে বিশ্বজিৎয়ের আমেরিকান ডাকনাম। ববির বাবা মা ভারতীয় হওয়ার সুবাদে তার এইসব তথ্য জানা আছে।

“তুমি কি খুব ধনী ছিলে তোমার দেশে? শোফার ছিলো!!” “আরে না!! বাংলাদেশে যাদের গাড়ি আছে তাদের গাড়ী চালানোর মানুষ রাখারও সামর্থ্য আছে। আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনতো আছেই। তাই অনেক মানুষই ড্রাইভিং করে না।“ ববি আবারো বিজ্ঞ মুখে ফোঁড়ন কাটে “ওদের দেশে না বাসায় রান্না করার লোকও থাকে…নিজেদের রান্না করতে হয় না…ঠিক না শিখা?” হেসে সায় দিতেই জনের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করলো “And you left that country!! Why the hell would you want to be here?” আসলেইতো আমি এখানে কেন? উত্তর এড়িয়ে আবারো হাসলাম। এই হাসি অবশ্য অন্যরকম; কোথাও একটু বেদনা আছে, একটু অপরাধবোধ। একজন পলায়নপর মানুষের হাসি!!

দু’দশক পরেও কেন যেন প্রবাসে শেকড় ছড়াতে পারলাম না। আজও “My country” বললে ছাত্র ছাত্রী সহকর্মীরা বুঝে নেয় বাংলাদেশের কথাই বলছি। আমেরিকা এখনো শুধু বাসভূমি হয়েই থাকলো; ‘আমার দেশ’ হয়ে উঠতে পারলো না। দেশের কথা ভাবলেই বুকের মাঝে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে; ভুলে যাওয়া নামের সারি; ভুলে থাকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রিয় মুখেরা। সমুদ্রের বিশালতার সামনে বাতাসের নোনাগন্ধ বেয়ে ছুটে আসে পাহাড়ের মৌন অনুভূতি। কষ্ট বাড়লে বিশ্বাসঘাতক মন কখনো কখনো ভুলে যাবার মন্ত্র জপে।

“All this delusion in our heads
Is gonna bring us to our knees…
Everything that's broke
Leave it to the breeze
So come on, let it go
Just let it be…”

কোন কোন কাজের দিনে অফিসে, সারা শহরে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াই; কপালে দু’ভুরুর মাঝে ছোট্ট বিন্দুতে আমার দেশ; শাড়ির কোমলতায় আমার সারা শরীরে দেশ জড়িয়ে থাকে। এমনই কোন একদিনে ডাক্তারের অফিসে চার বৃদ্ধার পাশে বসে গল্প শুনছিলাম। টেরেসার মেয়ে ট্রুডি, আইরিন আর লেসলি। ট্রুডির বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও বাকী তিনজনের বয়স আশী থেকে নব্বুয়েই কোঠায়।
“আচ্ছা!! তুমি কি কপালে ডট দিয়েছো কারণ তুমি বিবাহিত?” প্রশ্ন শুনে তাকালাম “উহুউউ...আমাদের দেশের সাজের অংশ এটা...অবিবাহিত হলেও দিতাম!!” “তুমি কোন দেশের?” “বাংলাদেশ!!” দক্ষিনীদের তুলনায় পশ্চিম উপকূলের মানুষদের ভৌগলিক জ্ঞান ভালো; বাংলাদেশ কোথায় সেটা বোঝাতে গলদঘর্ম হতে হয় না।

ট্রুডি বললো “আমার ছেলে রেসেন্টলি ডিসিতে মুভ করেছে...he loves the multicultural environment there!! আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়ার সময়েই অন্য দেশের অনেক মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে। অন্য দেশের মানুষগুলো বেশ ভালো!!” একটু মজা লাগলো কথার ভঙ্গী দেখে; যেন অন্য দেশের মানুষগুলোর ভালো হওয়ার কথা নয় বা ভালো হওয়াটা আশ্চর্য একটা ব্যাপার। কথা গায়ে মাখলাম না; আমি দ্বিতীয় সারির মানুষ এখানে, শিকড়হীন; তাছাড়া এই মানুষগুলো অন্য শতাব্দীর। মনে পড়লো যে বছর আটেক আগে আমেরিকা কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার পরে আমার এক ছাত্র বলেছিলো “শিখা!! ইদানিং আমার দাদা যখন টিভিতে খবর দেখে তুমি তার আশেপাশে থাকতে চাইবে না…He constantly swears…hard for my racist Grandpa to accept an African American as the President!!”

আইরিনের চোখে একটু বিষন্নতা “জীবনে ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলাম না!! মাঝে মাঝে খুব সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে।“ ট্রুডি সাথে যোগ দিলো “তোমার মতো মানুষদের দেখে অবাক লাগে…কতো দেশ ঘুরেছো…কতো কিছু দেখেছো। মাঝে মাঝে এইসব মানুষদের খুব ঈর্ষা হয়!!” ট্রুডির দিকে তাকিয়ে আমি আবারো হাসলাম; সেই পলাতক মানুষের হাসি। মনে মনে বললাম “সারা পৃথিবী ঘুরলেও তুমি এখানেই ফিরে আসতে চাইতে…তুমি ঠিক জায়গাতেই আছো!! আমিই পথ ভুল করেছি…আমিই দিকভ্রষ্ট!!”

চেনা পরিচিত অথবা গল্প উপন্যাস নাটকে কোন কোন মেয়ে থাকে যারা অনেক দিন প্রেম করে; আবেগী কথা দেয় যে সারাজীবন একসাথে পথ চলবে। তারপরে সময় সুযোগ আসতেই মোটা বেতনে চাকরী করা কোন ছেলের হাত ধরে অভিজাত এলাকার বাড়িতে সংসার পাতে। মেয়েটা সেই প্রত্যাখ্যাত ছেলেটির কাছে থেকে অকাতরে সুবিধা নিয়েছে, দরকারে অর্থ সাহায্য, সময়; আর সেই সামান্য চাকুরে ছেলেটির সমস্ত ভালোবাসা!!

আমিই সেই সুবিধাবাদী মেয়েটা!! দেশ আমার কাছে এক প্রেমিক পুরুষ; যাকে পেছনে ফেলে আমি অন্য কোথাও সংসার পেতেছি। সাতমহলা বাড়িতে “শ্বেত পাথরে পা। সোনার পালঙ্কে গা...” অথচ “বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে/ রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে/ একটা সাপ...” আলিঙ্গনে জড়িয়ে থাকে আমাকে। ভুলতে পারিনি এখনো সেই ফেলে আসা প্রেমিককে; একান্ত গোপন সময়ে সে আমাকে অধিকার করে।

ভোররাতে যখন চাঁদ ডুবু ডুবু করে; নক্ষত্রেরা ফিকে হয়ে আসে, আনমনে ভাবি সন্ধ্যাগাঙ্গে ডুব সাঁতার দিয়ে দিগন্তরেখার ওপারে তার আকাশে কি এই একই চাঁদ উঠেছে! প্রেমিকের পুরোনো প্রেমপত্রের মতোই রাতের গভীরে বাংলা বইয়ের পাতা উল্টে পালটে দেশকে খুঁজি; প্রচন্ড হাওয়ার দিনে বাতাসে চুল উড়িয়ে মনে মনে রিক্সার হুড ফেলে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াই।

চারপাশে মানুষের কণ্ঠস্বর, প্রত্যাহিক ব্যস্ততার মাঝে আমার দেশ হঠাৎ হঠাৎ কোথাও কিভাবে যেন এক গভীর নৈঃশব্দের খাদ তৈরী করে; ভিড়ের মাঝে আচমকা খুলে দেয় একটা রঙিন ছাতা। ঠিক যেমন ফেলে আসা ভালোবাসার সাথে হঠাৎ কোথাও মতিঝিল বা মৌচাকে জনারন্যে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়, দেশের মুখ তেমনটাই প্রবাসের ব্যস্ততার মাঝে উঁকি দেয়।

কোনো বৃষ্টি আসি আসি ভোরবেলা, কোনো এক ব্যস্ত দিনে ঝলসে ওঠা রোদের মধ্যে, হেমন্তের মরে আসা বিকেলে উল্টে যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পেছনের দিকে। একজনকে মনে মনে ভালোবেসে আরেকজনের ঘর করার মতো কষ্ট আর কিছুতেই নেই। দ্বিচারিণী আমি!! সেই হাহাকার নিয়ে ঘরে ফেরা, ফেরা সেই একই বৃত্তাবদ্ধ জীবনে!!

মন আসলে হয়তো এমনটাই! ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে একটা দরজা-জানালা ছাড়া ভাঙা বাড়ির মতো করেই দেখতে চায়; শুনতে চায় সেই অস্তিত্বের মাঝে হাওয়ার একটানা আর্তনাদ। মাঝে মাঝে মন খুব বেশি করে বুঝে নিতে চায় জীবনের হিসেব নিকেশ। কিন্তু ভালোবাসার কি কোন পাটিগনিত থাকে?

“What am I supposed to do when the best part of me was always you,
And what am I supposed to say when I'm all choked up and you're OK
I'm falling to pieces, yeah,
I'm falling to pieces...”

আসলেই “What am I supposed to do when the best part of me was always you?”

শিখা (৯ই মে, ২০১৭)

বিঃ দ্রঃ লেখায় দুটো গানের কথা ব্যবাহার করেছি। প্রথমটা “Let it go” by James bay আর শেষের কথাগুলো “Breakeven” by The Script থেকে নেয়া। ছবি আমার তৈরী।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৩
৩৭টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×