somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

রমনীয় তকমা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“ডঃ রহমান কোথায়?” নক শুনে অফিসের দরজা খুলতেই প্রশ্ন। “আমিই ডঃ রহমান!!” সামনে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে সে আমার কোন ক্লাসে নেই বা আগেও ছিলো না। হাতে একটা ফর্ম দেখেই বুঝলাম “Academic probation…Please come in!!” পুরকৌশলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে ক্লাসে আমার দেখা হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে। তার আগে Engineering Advising Center তাদের ক্লাস এবং অন্যান্য একাডেমিক সমস্যা সামলায়। ক্লাস নেবার আগে এরা তখনি দেখা করতে আসে যখন জিপিএ দুইয়ের নীচে নেমে যায়। কোন কোয়ার্টারে বা সামগ্রিক ভাবে জিপিএ দুইয়ের নীচে নেমে গেলে এদের একাডেমিক প্রবেশন চুক্তি সাক্ষর করতে হয় আর সেখানে Departmental Faculty Advisorএর সাথে দেখা করে সাক্ষর নিতে হয়। যে কোয়ার্টারে একাডেমিক প্রবেশন সে কোয়ার্টার শেষে জিপিএ আবারো দুইয়ের নীচে থাকলে চুক্তি অনুযায়ী সে ছাত্র বা ছাত্রীকে ইউনিভারসিটি বহিষ্কার করে।

এই ছেলেটার কান্ড দেখে অবশ্য মজা লাগলো। সে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে যেন আমি ডঃ রহমান হতেই পারি না; আসল ডঃ রহমান ঘরের কোথাও লুকিয়ে আছে। এমনটা বছরে দু’একবার হয়। অন্যদেশের নাম হওয়াতে আমেরিকানরা বুঝতে পারে না ডঃ রহমান ছেলে নাকি মেয়ে। ডিপার্টমেন্টে দুটো প্রোগ্রাম, Civil Engineering আর Environmental Engineering। পুরকৌশল (Civil Engineering) প্রোগ্রামে আমিই একমাত্র মেয়ে ফ্যাকাল্টি; আমার অবশ্য নিজেকে রমণীয় ফ্যাকাল্টি ভাবতেই ভালো লাগে। আরো দু’জন রমণীয় ফ্যাকাল্টি আছেন, তারা পরিবেশ কৌশল(Environmental Engineering) প্রোগ্রামে। প্রায় ত্রিশ জন ফ্যাকাল্টি নিয়ে পুরকৌশল বিভাগ; তার মাঝে মাত্র শতকরা দশভাগ রমনীয়।

বাকী দুজন মেয়ে ককেশিয়ান হলেও আমরা তিনজন সবসময়েই বলাবলি করি যে “It is hard to get into the White Boys Club!!” and It truly is! খুব ভালো করেই জানি ছাত্রছাত্রীদের সাথে যখন প্রথনবারের মতো ক্লাসে দেখা হবে আমাদেরকে বার বার প্রমান করতে হবে যে আমরা আসলেই এই পদের যোগ্য। এই তিনজনের মধ্যেও স্বভাবতই আমি অন্যরকম; তার ওপরে আবার যেমন ইচ্ছে তেমন সাজগোজ আর বেশভূষা। বাকী দুজন যেখানে জিন্সের প্যান্ট বা ড্রেস প্যান্ট দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে সেখানে আমি Arabiran pants, MC Hammer pants, Bell Bottom, Hippi pants, or tights ছাড়াও স্কারট পরি, তাও আবার রঙ বেরঙের। সেদিন ক্যাথি আমার স্কারটের প্রশংসা করছিলো; জিজ্ঞাসা করলাম কেন ও কখনো স্কারট পরে না। “আমি অনেক আগেই ঠিক করেছি যে স্কারট পরবো না। স্কারট পড়লে লোকজন আমাকে অফিস এসিস্টেণ্ট বা সেক্রেটারী ভাববে!!” একটু মনখারাপ হয়েছিলো কথাটা শুনে; কথাটায় লিঙ্গবৈষম্য আছে। “ক্যাথি!! সবাই এমন ভাবে বলেই কি আমাদের স্কারট বা যা ইচ্ছা তাই পড়া উচিত না?”

প্রথম চাকরী আর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যুক্ত্ররাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে; পুরো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমিই একমাত্র নারী ফ্যাকাল্টি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বিল্ডিঙয়ে ঢোকার দুটো দরজা ছিলো; সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেই রিসেপসন ডেস্ক; আর অন্য দরজা দিয়ে এলে করিডোরে সার দিয়ে ফ্যাকাল্টিদের অফিস। তিনজন ফ্যাকাল্টির পরে আমার অফিস; অথচ তারপরেও যখনই কেউ ভুলে করে অন্য দরজা দিয়ে এসেছে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে কোথায় ডিন বা হেড বা অন্যদের অফিস কোথায়। ভিজিটররা ধরেই নিয়েছে যে আমি রিসেপসনিস্ট বা কোন ধরনের অফিস এসিস্টেণ্ট। কারণটা অবশ্যই রমনীয়!!

সেই প্রথম চাকরীতে যখনই ডিনের নিজস্ব এসিস্টেণ্ট ছুটিতে থাকতো বা চলে যেত উনি আমাকে বলতেন উনাকে টাইপে সাহায্য করতে। এমন না যে আমি খুব ভালো টাইপিংয়ে; এক হাতে টাইপিং করি। কিন্তু ওই যে কারণটা বড্ড রমণীয়!! আমি কখনোই মানা করিনি; সাহায্য করেছি সুবিধামতো। প্রথম চাকরী, তারওপরে গ্রীণকার্ড প্রসেস করছি এবং সন্তান সম্ভবা; আপোষ করেছিলাম। একটু সুবিধা অবশ্য ছিলো; সবার আগেই অনেক কনফিডেন্সিয়াল কথা টাইপ করার সুবাদে জেনে যাচ্ছিলাম; ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন অনুষদের রাজনীতির মারপ্যাচ আর সুবিধা আদায়ের খেলা। ডিন যখন আগামী পাঁচ বছরের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান করছিলেন উনি হয়তো বুঝতেই পারেননি যে আমি কথায় কথায় উনার চিন্তা কতোখানি বদলে দিয়েছিলাম। যখন ওখানকার চাকরী ছেড়ে দিলাম রেজিগনেশন লেটার দেবার সময়ে বলেছিলাম “Getting another temp assistant with doctoral degree is not gonna be easy!!” উনি হেসেছিলেন, আমিও!! ততোদিনে আমি আমার রমনীয় অবস্থান থেকেই পাওনা আদায় করা শিখে গেছি।

আমার জীবন তেমন সংগ্রামমুখর নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ ভাবে মানুষ হওয়া একজন; বেশ সচ্ছল না হলেও তেমন আর্থিক কষ্টে পড়িনি; খুব উচ্চাকাংখী নই আর তাই কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থান নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই। কিন্তু তারপরেও কোথাও সেই অদৃশ্য রমনীয় লেবেলতো সারাজীবন রয়েই গেলো। যারা এমন সব খুব সাধারন দৈনন্দিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি তাদের বোঝানো কঠিন ব্যাপারটা কেমন।

যখন কোন ছেলে সহকর্মী বলে “তোমাকে ঠিক ইঞ্জিনীয়ারিং ফ্যাকাল্টির মতো দেখায় না!!” হাসিমুখে বললেও কথাটা গায়ে লাগে। ব্রেকরুমে যখন দুই কলিগ নিজেদের মধ্যে ফাজলামি করে বলে “আমরাতো মেয়ে ফ্যাকাল্টি সব বাচ্চাকাচ্চা সহ বয়স্ক দেখে নিয়োগ দিয়েছি…নাহলে ম্যাটারনিটি লিভ দিতে দিতে ডিপার্টমেন্টের বারোটা বেজে যেত!!” অথবা যখন কোন মেয়ে ফ্যাকাল্টিকে জোক করে বলা হয় “তুমি বরং কনসিভ করে ফেলো…প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ষ্টুডেন্ট এভালুয়েশন খুব ভালো আসে!!” তখন কিন্তু ওই রমনীয় তকমাটা টের পাওয়া যায়।

সেদিন এক সহকর্মী হাসিমুখে বলছিলো “শিখা...কলেজ অফ ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ফ্যাশন এ্যাওয়ার্ড থাকলে ঠিক ঠিক তুমি পেতে!!” কথাটায় খোঁচা ছিলো; তার হাসি হাসি চোখে ব্যঙ্গ ছিলো। তাই বলতেই হলো “হুউউউ...দুঃখজনক!!! টিচিং এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি দু’বার, ফ্যাশন এ্যাওয়ার্ডও পাবো...কিন্তু তুমি যে ফ্যাশন এ্যাওয়ার্ড কখনোই পাবে না!”

শুধু একজন মানুষ, কোনরকম লেবেল ছাড়া একজন মানুষ, হওয়ার জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করে আছি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, নিজের ওপরে, সমস্ত পৃথিবীর ওপরে…মনে মনে বলি

“আমি খুব গাঢ় ধ্বংসের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বুকের মাটিতে
পৃথিবীর মতো সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকা অবিচল তনু
আমাকে এতটা অসহায়, এতো ম্রিয়মান ভাবো কেন?”
আমি নই, আসলেই অসহায় নই!!

© শিখা (২৮শে মার্চ, ২০১৭)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:১৭
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×