১.
- মনেতো হচ্ছে কামড়ের দাগ!!
- শালী এমন কামড় দিছে...উহহ্!!
ডাঃ আহমেদ হাতের কনুই থেকে চোখ উঠিয়ে সাজ্জাদের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। সাজ্জাদ একটু ঘাবড়ে গেলো। বাবু আর মিন্টু ঠিকই বলে ওর মুখ পাতলা।
- নাহ মানে কুত্তা...মানে মহিলা কুত্তা...মানে কুত্তী কামড়াইছে!!!
- তুমি কামড়ানোর সময় আবার খেয়াল করেছো কুকুরটা মেয়ে না ছেলে... আশ্চর্য!!!
- না মানে ইয়ে ডাক্তার সাহেব...আসলে এমন মরন কামড় দিছে যে মাটিতে পইড়া গেছিলাম। তখন খেয়াল করসিলাম আর কি!!
- হুউউউ...মরন কামড়ই। খুবই বাজে ঘা হয়েছে... অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। আরো আগেই তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত ছিলো। কবে কামড়ালো?
- তা ধরেন প্রায় মাসখানেক হয়ে গেলো।
- বলো কি? ওষুধ লিখে দিচ্ছি...আজ থেকেই শুরু করবে। দশদিনের কোর্স দিলাম। না কমলে আরো স্ট্রং অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। আর শোনো ওষুধ নেবার সময় ইনজেকশনটা দিয়ে নেবে। বাইরের ডিসপেনসারিতে বলে দিচ্ছি।
- হে হে...অবশ্যই অবশ্যই...
ইঞ্জেকশন নিতে গিয়ে সাজ্জাদের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো “শালা...কুত্তার কথা বললাম ক্যান?”
২.
সালমা বানু প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেলো থানায় বসে আছেন। বসে বসে থানায় আসা রকমারী মানুষ দেখতে খারাপ লাগছে না। অন্তত কিছুক্ষনের জন্য হলেও দুঃস্বপ্ন ভুলে থাকা, বাসায় থাকলে সেই একই চিন্তা। এখানে অপেক্ষা করার সময় মনে হয় আজ নিশ্চয়ই কোন সুসংবাদ অপেক্ষা করে আছে। একটাই খারাপ লাগে যে মেয়েটা কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ওনার সাথে বসে আছে।
- মেহের!!!
- জী মা...কি? বলো...শরীর খারাপ লাগছে নাতো?
মেয়েটা বড় শরীর নিয়ে চিন্তা করে, তার ওপরে আবার ডাক্তার। নীহার নিখোঁজ হবার পরে থেকে সারাক্ষণ মাকে পাখির বাচ্চার মতো বুকে আগলে রাখে। মেয়েটা বড্ড মায়াবতী হয়েছে; সালমা বানু নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন তার দুইটা মেয়েই বড় মায়াবতী হয়েছে। নীহারতো ছোট বলে বড় আদুরীও; পেছন থেকে যখন তখন জড়িয়ে ধরতো আর ছাড়তে চাইতো না।
- রান্না করছিতো...ছাড় বলছি...
- উহু ছাড়বো না...রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধরে থাকবো...
- পাগলী...এভাবে কাজ করা যায়?
- কাজ কোরো না...ধরে থাকি...মা তোমার গায়ে এতো সুন্দর গন্ধ!!! এতো নরম কেন তুমি? আমার লক্ষীসোনা মাআআআ...
“মা কি হলো? কথা বলছো না কেন?” মেহেরের উদ্বিগ্ন স্বরে সালমার সম্বিৎ ফিরে এলো।
- না না শরীর ঠিক আছে। তোর কাজের দেরী হয়ে যাচ্ছে না তো?
- না মা...স্যারকে বলে এসেছি অনেকক্ষণ লাগতে পারে। থানায় আসবো বলেছি...সবাইতো জানে ব্যাপারটা।
ওসি লোকমানকে বেশ ব্যস্ত মনে হচ্ছে; সামনে লোক নেই কিন্তু একটা খাতায় খুব লেখালেখি করছেন মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে অবশ্য চোখ তুলে ওদেরকে দেখছেন; সালমা আর মেহেরকে আরেকজন করিডোরে চেয়ারে বসিয়ে রেখে গেছে। বসার জায়গা থেকে ওসি সাহেবকে দেখা যায়। লোকমানের একটু মেজাজ খারাপ লাগছে। এই মহিলা সপ্তাহে দু’তিনবার থানায় এসে নিখোঁজ মেয়ের কেসের খবর নেয়। ফোন করলেই হয়; তা না যত্তোসব!!!
একেতো মালদার পার্টি না...কোন উপরি আয় নাই তার উপরে মহিলাকে বার বার বলতে খারাপ লাগে যে কেসে কোন প্রগ্রেস হয় নাই। এসে যখন সামনে বসেন চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে আগ্রহে। তারপরে লোকমান যখন বলে যে কোন খবর নেই ওনার চোখের আলো দপ করে নিভে যায়। ওই মুহূর্তে লোকমানের নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
একমাত্র লাভ হচ্ছে মহিলার মেয়েটা বড় সুন্দর দেখতে। এই জন্যই লোকমান বসিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ চোখের আনন্দ!!! যে মেয়েটা নিখোঁজ, নীহার, সে মেয়েটাও খুবই সুন্দরী। এইসব সুন্দরীদের কোন ঠিক আছে...কেউ হয়তো তুলে নিয়ে গেছে বা কে জানে মেয়ে নিজেই পালায়ে গেছে কিনা। দুনিয়াতে সুন্দরী মেয়েগুলা না থাকলে পুলিশের কামকাজ অর্ধেক কমে যেত।
৩.
রিক্সায় মেহের পেছনে হাত দিয়ে মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। সালমা একটু একটু কাপঁছেন। ও যেই কাজে চলে যাবে মা একা বাসায় চোখের জল ঝরাবেন। ইচ্ছা না করলেও মেহের শুধু এইজন্যই এই দিনগুলোতে অফিসে যায়; মা কেঁদে কেঁদে হালকা হোক। মায়ের যে বড় কষ্ট, একাত্তরে বাবা নিখোঁজ হওয়ার পরেও মা সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। মেহেরের কি ওর কাছের মানুষগুলোর সাথে কোনদিনই বুড়ো হওয়া হবে না? মেহের এখন মাঝে মাঝে শুধু ওর প্রিয় মানুষগুলোকে কবর দিতে চায়, তাদের মৃত্যুর সময়ে পাশে থাকতে চায়, তাদের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায়। খুব সামান্য চাওয়া...তাও পুরণ হলো কই?
নীহার ছাড়া বাসাটা যে কি নীরব লাগে!!! খুব ছেলেমানুষ, খুব উচ্ছল ছিলো মেয়েটা, যদিও মেহেরের চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট। গত বছর যখন ও ডাক্তারী পড়া শেষ করে হাসপাতালে চাকরী নিলো নীহার একটা শাড়ীর আবদার করেছিলো। বাবা ছাড়া সংসারে ওর সব আবদার অনুযোগই মেহেরের কাছে।
- আপুনি বলতো কে?
মেয়েটা পাগল!!! পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করার কোন মানে আছে; সেই ছোট বেলার অভ্যাস।
- ঠিক সিউর না...বুঝতে পারছি না!!!
- যে চোখ ধরে আছে সে খুব লক্ষী একটা মেয়ে...
- আর...
- আর সে তোকে খুব ভালোবাসে...
- নীরুমনি নাকি? নীরুমনির মত তো আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না...
বলার সাথে সাথেই মেয়েটা ঠিক ছোট্টবেলার মতো জড়িয়ে ধরতো।
- তো নীরুর কি কিছু চাই?
- আপুনি তুই চাকরী পেলি আমাকে একটা শাড়ি কিনে দে না...
- আচ্ছা দেবো...কেমন শাড়ি চাই তোর?
- বেগুনী বেগুনী জাম রঙ্গা...
- এটা আবার কেমন রং...
- সেদিন মার্কেটে এমন একটা শাড়ি দেখেছি...পরলে দেখিস আমাকে একটা শাপলা ফুলের মতো দেখাবে...
- আমার নীরুমনিতো এমনিতেই একটা ফুল...
যেদিন নীহার হারিয়ে গেলো ওই শাড়ীটাই পরে ছিলো। ওকে আসলেই শাড়ীটা খুব মানিয়েছিলো; মেয়েটা বড্ড সুন্দর ছিলো। মেহের সুন্দর কিন্তু বড় শান্ত সমাহিত, মানুষ ওর সাথে কথা বলার আগে চিন্তা করে। আর নীহার ছিলো দমকা হাওয়া; ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ংকর সুন্দর। ওকে দেখলে কেমন যেন জ্বালা ধরে, অধরা জেনেও পেতে ইচ্ছা করে। মেহের মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতো ছেলেরা ওকে বিরক্ত করে কিনা। নীহার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে “কি যে বলিস না আপুনি!!! ছেলেগুলো না খুব গাধা...কেমন বোকা বোকা চেহারা করে ভালোবাসার কথা বলে...শুনেতো আমি হাসতে হাসতে শেষ...”
৪.
বাসার কাছে রিক্সা থামতেই মেহের দেখলো মিন্টু আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলছে; কেন যেন মনে হচ্ছে মিন্টু ওদেরকে দেখেও না দেখার ভান করছে। এড়িয়ে যেতেই পারে; মা যে ওকে দেখলেই অস্থির হয়ে ওঠেন, বার বার নীহারের কথা জিজ্ঞাসা করেন। মিন্টু নীহারের সাথে পড়ে, রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্সের শেষবর্ষে। নিখোঁজ হওয়ার দিন মিন্টুর সাথে নীহারকে ক্লাস শেষে কথা বলতে দেখা গেছে।
মিন্টুকে পুলিশও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে; নীহার নাকি ওর কাছে কোন একটা ক্লাসের নোট চেয়েছিলো। মিণ্টু আর ওরা অনেক বছরের প্রতিবেশী; ছোটবেলা থেকে নীহার আর মিন্টু একসাথে খেলেছে; ভাই বোনের মতোই, ওরা তো পরষ্পরকে তুই করে সম্বোধন করে।
মা ঠিকই মিন্টুকে দেখে ফেলেছেন। সালমা হাতের ইশারায় ডাকলেও ও তাকাচ্ছে না। মেহের নাম ধরে ডাকতেই মিন্টু এগিয়ে আসলো।
- স্লামালেকুম খালা! মেহের আপু কি ডাকছিলেন?
মেহের কিছু বলার আগেই সালমা বলে উঠলেন “নীহারের কোন খবর পেয়েছো বাবা? পুলিশতো কিছু খোঁজ পাচ্ছে না।“
- না খালা। আমিতো যতোটুকু জানি আপনাদের আর পুলিশকে বলেছি।
- না ভাবলাম যদি নতুন কিছু জানতে পারো...একসাথে পড়তে। অন্যদের জিজ্ঞাসা করেছিলে?
- জিজ্ঞাসা করেছি। কেউ কিছু বলতে পারে না।
- আচ্ছা তুমিতো নীহারকে খুব ভালো ভাবে চিনতে...ও কোথায় যেতে পারে?
- খালা প্লিজ আপনি চিন্তা করবেন না। নিশ্চয়ই ওকে পাওয়া যাবে। একটু কাজ ছিলো। যাই খালা, মেহের আপু। পরে কথা হবে।
সালমার কিছু ভালো লাগছে না। কথা বলার সময়ে মিন্টু একবারও চোখের দিকে তাকায়নি, পুরোটা সময় মাথা নীচু করে রেখেছে। নীহার নিখোঁজ হবার পরে যতোবারই কথা বলেছেন সালমা একবারও মিন্টুর চোখ দেখতে পাননি; চোখে চোখ রাখার জন্যই উনি বার বার ছেলেটার সাথে কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ছেলেগুলো এসে মেহেরের বাবাকে মিথ্যা কথা বলে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো ওরাও মাথা এমনটাই নীচু করে রেখেছিলো।
সালমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে নীহারের সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে, খুব ভয়ংকর কিছু। নীহার কি আর কখনই ফিরে আসবে না?
চলবে................................................................................................................................................
© শিখা রহমান (২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫)
গল্পটার দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের লিঙ্ক এখানে দিলাম। একটি চেনা চেনা গল্প -২ (সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে) (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৮ ভোর ৬:৩৭