somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

একটি চেনা চেনা গল্প -২ (সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে) (শেষ পর্ব)

০৩ রা জুলাই, ২০১৮ ভোর ৬:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্পের প্রথম পর্বের লিঙ্ক এখানে দিলাম। একটি চেনা চেনা গল্প -১ (সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

৫.
দেরী হয়ে গেলো। আসার পথে মিন্টুর পারফিউম খুঁজতে সময় লেগে গেলো; বেশ কড়া গন্ধের একটা পারফিউম কিনেছে। বাবুর পছন্দ হলেই হয়। দামটাও নিয়ে নিতে হবে। মিন্টু মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে; তার বাবাতো আর বাবুর বাপের মতো নেতা না। বাবু এইসময় আউট হাউসে থাকে; বিশাল জায়গা নিয়ে ওদের বাসা আর বাগান। বাগানের এক কোনায় আউট হাউস; দুটো বেডরুম, বাথরুমও আছে। গেষ্ট থাকার জন্য তৈরী করা হলেও বেশীর ভাগ সময়ে এখানে বাবুই থাকে।

আউট হাউসের কাছাকাছি আসতেই মিন্টু আগরবাতির গন্ধ পেলো। দরজা ভেজানো ছিলো।

- কি রে দোস্ত? কি খবর?
- দেরী করলি ক্যান? কখন থেকে বইস্যা আছি।
- সরি রে...তোর সেন্ট কিনতে গিয়ে দেরী হলো। দ্যাখ গন্ধ পছন্দ হয় কিনা!!

বাবু হাতে নিয়ে বাতাসে একটু স্প্রে করে শুঁকল।

- বাহ...কড়া আছে। ভালো কিনছিস।
- দামটা দিয়া দিস দোস্ত...মাসের শেষ, হাতে একদমই ট্যাকা নাই।
- এই নে তিন হাজার...চলবে? ঠিক আছে?

বাবু মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে মিন্টুর হাতে দিয়ে দিলো। পারফিউমের দাম পড়েছে পনেরশ; পুরাই আসলের সমান লাভ। মিন্টুর এইজন্যই বাবুকে ভালো লাগে; টাকা নিয়ে সে ছোটলোকি করে না।

খুশী খুশী ভাবটা থিতিয়ে যেতেই মিন্টুর নাকে একটু ভ্যাপসা পচা গন্ধ ধাক্কা দিলো। ও আড়চোখে তাকিয়ে খাটের নীচে রাখা ট্রাঙ্কটা দেখলো। বাবুকে এইসব নিয়ে বলতে ওর ভয় লাগে। তারপরেও ঢোক গিলে বললো “দোস্ত একমাসতো প্রায় হয়ে গেলো...ট্রাঙ্কটার একটা গতি করা দরকার না?”

বাবুর পা নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেলো; শরীরটা চিতাবাঘের মতো একটু টান টান হয়ে গেলো ঠিক যেমনটা শিকার অন্য বাঘ নিয়ে গেলে হয়। বাবু এই ট্রাঙ্ক কাছ ছাড়া করতে পারবে না; রাত্রে মাঝে মাঝে ও এই ট্রাঙ্ক জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। কিন্তু এও ঠিক যে শীত চলে গিয়ে গরম পড়া শুরু হয়েছে; আগরবাতি আর কড়া সুগন্ধী দিয়েও পচনের গন্ধ পুরোপুরি ঢাকা যাচ্ছে না; এই গন্ধ আরও বাড়বে। যে মানুষটা বেঁচে থাকতে এতো সুন্দর ছিলো, পাশ দিয়ে গেলে যার শরীরের গন্ধে বাবুর শরীর মন ঝনঝন করে উঠতো, সে মরে গেলে এমন পচা গন্ধ কিভাবে হয়? এইসব কথাতো মিন্টুকে বলা যায় না।

- হুউউ...তা ঠিক বলছিস। দেখি সাজ্জাদ আসার কথা। সবাই মিলে পরামর্শ করে ঠিক করবো।
- সাজ্জাদ কখন আসবে? আমার একটু অন্য কাজ ছিলো।
- আরে বস...দুপুরে খেয়ে যা। এর মধ্যেই সাজ্জাদ চলে আসবে।

মিন্টুর আসলে দমবন্ধ হয়ে আসছে; বাবু যে কি ভাবে এই ঘরে ওই ট্রাঙ্ক নিয়ে রাত কাটায়? মিন্টু বাবুকে বুঝতে পারে না; ভয় পায়। নীহারকে বাবু পছন্দ করতো; আগে মনে হতো বাবু প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে; এখন মিন্টু ঠিক জানে না বাবু কি আসলেই নীহারকে ভালোবাসতো কিনা!!

ওরা তিনজন একই ডিপার্টমেন্টে; নীহারকে পুরো ইউনিভার্সিটিতেই সবাই ডাকসাইটে সুন্দরী বলে চেনে। মিন্টু ওর ছেলেবেলার বন্ধু আর প্রতিবেশী বলে অনেকেই খাতির করতো। নীহারকে ভালো লাগলেও ও ঠিক বাবুর মতো এতো পাগল হয়নি। বাবু যা চায় তাই পায়, সেটাই সমস্যা তৈরী করলো। না হলে কতো ছেলেপিলেই তো নীহারের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করতো।

৬.
- দোস্ত প্লিজ প্লিজ তুই ডাকলে ঠিক আসবে।
- তোকেতো মানা করে দিয়েছে...আর কি কথা বাকী আছে?
- দোস্ত আমি নীহারকে ছাড়া বাঁচবো না...একটু চেষ্টা করতে কি দোষ?
- আচ্ছা ক্লাসের পরে আজ ওকে বলবো তোর কথা...

- না না...আমার কথা বলিস না...ওকে রিক্সায় তুলে দেবার কথা বলে বাইরে নিয়ে আসিস। তারপরে আমি গাড়িতে লিফট দেবার জন্য হাজির হলে ওকে বুঝিয়ে একটু গাড়ীতে উঠাস।
- যদি না উঠে?
- না উঠলে নাই...তুই কথায় কথায় জায়গামতো নিয়ে আসিস...

মিন্টু নিয়ে এসেছিলো। নীহারকে সাথে নিয়ে মিন্টুও সেই গাড়ীতে উঠেছিলো। গাড়ীতে সাজ্জাদও ছিলো। সাজ্জাদ ওদের স্কুল ফ্রেন্ড; ইন্টারমেডিয়েটের পরে পড়া ছেড়ে দিলো, এখন ওর কন্ট্রাকটার মামার বিজনেসে কাজ করে। মিন্টুর ছেলেটাকে ভালো লাগে না কিন্তু ও বাবুর আশেপাশে প্রায়ই থাকে।

এরপরের ঘটনাগুলো মিন্টুর কেমন যেন বিশ্বাস হয় না, এখনও মনে হয় সত্যি না। নীহারের সাথে বাবুর বাকবিতন্ডা পাশের ঘরে শোনা যাচ্ছিল। নীহার আউট হাউসে আসতে চায়নি, কিন্তু সাজ্জাদ ছুরি ধরাতে কোন উপায় ছিলো না। একটু পরেই মারের আওয়াজ; নীহারের চাপা চীৎকার।

পনের বিশ মিনিট পরে বাবু দরজা খুলে প্যান্টের জিপার লাগাতে লাগাতে বলেছিলো “শালীর কত্তো সাহস...মুখে থুতু দেয়।“ হতচকিত মিন্টু কিছু বলার আগেই সাজ্জাদের চোখ চকচক করে উঠেছিলো “বস তুমি যখন উদ্বোধন কইরা ফেলছো...আমি কি বিল্ডিংয়ে একটু ঢুকতে পারি?” বাবু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়েছিলো।

সাজ্জাদ পাশের বেডরুম থেকে বের হয়ে তৃপ্ত মুখে বলেছিলো “বসের চয়েস ভালো...মাল মাশাল্লা খুবই জোশ। তবে মাগীর জিদ বেশী...শালী হাতে এমন কামড় দিসে...যাউক গা কোন ব্যাপার না!!! বন্যঘোড়া পোষ মানানোতেও মজা আছে।“ হালকা গোঙ্গানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। “তুইও ঢুঁ মেরে আয়...আমার ট্রিট।“ বাবু বলার সময় এমন ভাবে হাসলো যে মিন্টুর ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেলো।

ঘরে ঢুকে নীহারের দিকে তাকাতেই দেখলো ওর চোখে অবিশ্বাস আর কি প্রচন্ড ঘৃণা!!! ওই চোখ থেকে চোখ সরিয়ে প্রায় নগ্ন নারী শরীরের দিকে তাকাতেই মিন্টুর শরীর জেগে উঠলো। মিন্টুকে নীহার কোন বাঁধা দেয়নি; একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলো।

মাত্র খুবলে খাওয়া শরীর থেকে শরীর তুলে মিন্টু আবার ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালো। চোখ দুটো মরে গেছে; কিচ্ছু নেই ওই চোখে, না অবিশ্বাস, না ঘৃণা, না প্রতিরোধ। একজন মৃত মানুষের সাথে সঙ্গম; শরীরের আনন্দ ছাপিয়ে মিন্টুর বমি বমি ভাব হলো। বাবু আরো কয়েকবার ওই মৃতদেহ নিয়ে খেলার পরে শাড়ী গলায় পেঁচিয়ে নীহারকে মেরে ফেললো। নীহার বাঁধা দেয়নি; কোন আওয়াজ করেনি; শুধু ওই অদ্ভুত সুন্দর পাপড়ি ঘেরা চোখগুলো নিঃশ্বাস না নিতে পেরে একটু বিস্ফোরিত হয়েছিলো, ঘনকালো মনির চারপাশে ছোটবড় লাল লাল রক্তের ফুটকি।

ট্রাঙ্কের দিকে তাকালেই মিন্টুর মনে হয় ওই চোখ দুটো তাকিয়ে আছে, ঠান্ডা শীতল অনুভূতি বিহীন মৃত দুটো চোখ।

৭.
রাত কয়টা বাজে কে জানে? মিন্টু আর সাজ্জাদ ধরাধরি করে গাড়ী থেকে ট্রাঙ্কটা নামালো। মানুষ মরে যাবার পরে কি ওজন বেড়ে যায় নাকি অপরাধবোধের কারনেই মিন্টুর ওজন বেশী মনে হচ্ছে? অনেক বলেকয়ে বাবুকে রাজী করানো গেছে; সাজ্জাদের মামা এই বিল্ডিংয়ের কাজ করছে। আগামী দু’এক দিনের মধ্যেই একতলার মেঝে ঢালাই হবে। ওরা কন্ট্রাকশন সাইটে এসেছে রাত দশটার দিকে। গর্ত খুড়তে বেশ সময় লেগে গেছে। আবার ট্রাঙ্কটা গর্তে রাখার পরে মাটি লেভেল করতে হবে। আজতো মনে হচ্ছে এইখানেই রাত ভোর হয়ে যাবে।

“দোস্ত বুঝছোস...এই মেঝের উপরে যে শুইয়া থাকবো তার তো রাজ কপাল...জানে ও না কিন্তু এতো সুন্দরী একটা মাইয়ার উপরে সারাক্ষন আছে...হা হা হা!!” সাজ্জাদ এমন একটা অবস্থায় কি ভাবে আদি রসাত্বক কথা বলে মিন্টু বুঝতে পারে না; বাবুর মুখও দেখি হাসি হাসি। এরা কি মানুষ? নাকি নীহারের মতো এরাও ভেতরে ভেতরে মরে গেছে?

- কয়টা বাজে রে?
- এখন প্রায় চারটা...আজ আমার আউট হাউসে থাক তোরা...এখন আর বাসায় ফিরবি ক্যান?
- না না বাবু...আমাকে বাসায় নামিয়ে দে।

মিন্টু বাসায় নেমে গেলো। ওই আউট হাউসে ও কোনদিনই থাকতে পারবে না। ট্রাঙ্কটা না থাকলেও ওখানে এক জোড়া মৃতচোখ ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সেদিন ভোরেই প্রথম সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখলো মিন্টু।

- কিরে মিন্টু কাঁদছিস কেন?
- আমার পছন্দের বলটা না নিয়ে গেছে...
- বলিস কি? কে নিলো?
- পেছনের মাঠে খেলতে গেছিলাম...ওই পাশের পাড়ার বড় ছেলেগুলো নিয়ে গেলো। ওদের সাথে গাঁয়ের জোরে পারিনি রে...

কলা বেনী করা গোলাপী লাল ফ্রক পরা ছোট্ট নীহার ওর চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে।

- কাঁদিস না...আমার মাটির ব্যাঙ্কটা ভেঙ্গে ফেলবো...দেখি কতো পয়সা আছে।
- তুই গত এক বছর ধরে জমাচ্ছিস...আমার জন্য ভেঙ্গে ফেলবি?
- বাহ...তুই আমার বন্ধু না!!! মন ভালো করতো...আরেকটা বল কিনে নিস!!!

“আয়তো...কান্না বন্ধ কর!!” নীহার ওর হাত ধরে টানতেই একি!!! ওর দুহাত নীহারের গলায় কেন? ফ্রকটা বদলে গেছে জারুল রঙ্গা শাড়িতে, লাল লাল ফুলগুলো কি রক্তের দাগ? মৃত দুটো চোখ, ঠান্ডা শীতল অনুভূতি বিহীন, চোখের সাদায় লাল লাল রক্তের ফুটকি। মিন্টু গোঙাচ্ছে; মা এসে দরজায় ধাক্কা দিতে ঘুম ভাঙল।

ঘুম ভাঙ্গার পরে এই প্রথম নীহারের জন্য মিন্টু কাঁদল “নীহার আমাকে মাপ করে দিস...আমি বুঝতে পারিনি ওরা তোকে মেরে ফেলবে... বিশ্বাস কর আমি সত্যিই জানতাম না...” ওই মরা চোখ দুটোতে এই প্রথম বিদ্রুপের আভাস দেখা গেলো “ওরা??? তুই কি আমাকে মারিসনি? আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম...তুই আমার না বন্ধু...হা হা হা!!!” মিন্টু কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? ওই চোখ দুটো কি ওকে সারাক্ষন তাড়া করে ফিরবে?

৮.
সকালে অফিসে এসে খবরের কাগজের ভাঁজ খুলেই ওসি লোকমানের মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেলো। বড় বড় করে হেডলাইন “শহীদকন্যা নীহার বানু হত্যাকান্ডঃ পুলিশের আশ্চর্য নিষ্ক্রিয়তা!” পুলিশের নাম হেডলাইনে ক্যান? আর নিষ্ক্রিয়তা তাও আবার আশ্চর্য? মেজাজটা বেশী খারাপ হয়েছে “শহীদকন্যা” দেখে; এই সব শহীদ আর মুক্তিযোদ্ধা জড়িত থাকলে খুবই ঝামেলা হয়। কথায় বলে “পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা”। ব্যাটারা যদি জানতো যে আসলে “মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদে ছুঁলে হয় একশ ছত্রিশ ঘা!”

কাগজের রিপোর্ট পড়তে পড়তে লোকমান কয়েকবারই মুখ খারাপ করলো। “ওই শালা বাঞ্চোত ডাক্তার তুই ক্যান কাগজের লোকের সাথে কথা বলতে গেলি? পুলিশের ইনভেস্টিগেশন চলতেছে...তুই কথা বলবি পুলিশের সাথে। হ্যা...তুই ওই কনুইতে কামড়ের কথা জানাইছস। তো কি হইছে? ব্যাটা আবার বলে কনুইয়ের দাঁতের দাগ সময়মতো তদন্ত করলে নীহারের ডেন্টাল রেকর্ডের সাথে তুলনা করা যাইতো। আরে ব্যাটা ওই ছেমরির ডেন্টাল রেকর্ড তোর কাছে আছে?”

লোকমানের খুব টেনশন হচ্ছে। রিপোর্টারগুলা খুবই হারামী; কালকে বা আজকেই দেখা যাবে থানার আশে পাশে ঘুরাঘুরি করতেছে। এরা হচ্ছে ভীমরুলের মতো; একা আসে না ঝাঁকে ঝাঁকে আসে।

কাগজ পড়া শেষ করতে না করতেই টেলিফোন বেজে উঠলো। লোকমান হতাশ চোখে ফোনের দিকে তাকালো; সে জানে কে ফোন করতে পারে।

- জী স্যার...জী জী অবশ্যই!!!
- না মানে আসলে স্যার ডঃ আহমেদ আমাদেরকে বললেও কোন লিখিত ষ্টেটমেণ্ট দেননি তো...
- জী জী...আমি জানতাম না যে নিখোঁজের বাবা একজন শহীদ...
- আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার...আমি এখনই ব্যাপারটা দেখছি...

এই জায়গা থেকে বদলি না করে দেয় আবার; পোষ্টিংয়ের জন্য দেয়া ঘুষটা জলে গেলো। তাড়াতাড়ি এই কেস সলভ করতে না পারলে সোজা বান্দরবান!!!

লোকমান দ্রুত চিন্তা করছে; সে আগেই আন্দাজ করেছে যে এই সাজ্জাদ ছেলেটা জড়িত। ডঃ আহমেদ বলার পরে খবর নিয়ে যখন জেনেছে যে সাজ্জাদের সাথে বাবুর খুব উঠাবসা তখনি বুঝেছে। কিন্তু বাবুকে ওসি সাহেব ঘাটাতে চাননি...তার বাবা এলাকার প্রভাবশালী লোক; তার বদনজরে পড়ে বদলী না হয়ে যায়। অবশ্য এখন খেলা আরেকটু ওপরের লেভেলে চলে গেছে; হাঙ্গর আসলে আর রাঘব বোয়াল রে কে তোয়াক্কা করে?

৯.
সাজ্জাদ ধড়মড় করে জেগে উঠলো; চোখে মুখে পানি ঢুকে গেছে। কে যেন এক বালতি পানি ছুড়ে মেরেছে; জ্ঞান ফিরে প্রথমে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না। ওহ এটা তাহলে দুঃস্বপ্ন নয়...সত্যি সত্যি ঘটছে। আবারো মারবে নাকি? সাজ্জাদের ভয় লাগছে। ওসি সাহেব এত্তো চড় থাপ্পড় লাথি মেরেছেন...আর লাঠির বাড়িতো আছেই।

কষ্ট হয়েছে প্রচন্ড যখন আঙ্গুলের নীচে পেন্সিল বসিয়ে চাপ দিয়েছেন...আর বার বার পানিতে চুবানো আর ওঠানো। পানির নীচে চেপে ধরে রাখলে বাতাসের অভাবে বুক মনে হয় ফেটে যাবে...যখন প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবে যাবে, একটু ছটফট কমে আসে, ঠিক তক্ষুনি আবার পানি থেকে উঠিয়ে আনে। প্রত্যেকবারই বাতাসের অভাবে ছটফট করতে করতে সাজ্জাদের নীহারের মুখ মনে পড়েছে। পানির নীচে মেয়েটার শান্ত সুন্দর মুখ, কি ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে!!! মেয়েটা কিভাবে এতো শান্ত ছিলো মরার সময়? গলায় ফাঁস দিলে তো এমনই বাতাসের অভাব হওয়ার কথা...একটুও ছটফট করেনি...একটা টুঁ শব্দও করেনি!!

সাজ্জাদ সামনে কিছু দেখতে পারছে না। এতো কড়া একটা বাতি মুখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। আলো বড্ড চোখে লাগছে...ও চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু বাতিটা এতো কাছে...মুখে বেশ গরম লাগছে...এভাবে বেশীক্ষন থাকলেতো মনে হচ্ছে ফ্রাই হয়ে যাবে। ফ্রাইয়ের কথা মনে পড়তেই সাজ্জাদের পেটে খিদে মোচড় দিলো। পিপাসাও লেগেছে প্রচন্ড...বাতির গরমে এর মধ্যেই ভেজা মুখ শুকিয়ে গলা পর্যন্ত চিড়বিড় করছে।

“ওই হারামী বল নীহারকে কি করেছিস?” পুরোই দৈববাণী...সাজ্জাদ চমকে উঠলো; ও তো কড়া আলোতে কিছুই দেখতে পারছে না। কোথা থেকে আওয়াজ আসছে ঠাহর করতে না করতে চুল ধরে কষে চড়।
- ওসি সাহেব বিশ্বাস করেন...আমি কিচ্ছু জানি না...
- তুই জানিস না...

আবারো কষে কয়েকটা থাপ্পড়।

- স্যার নীহার কে? সেটাই তো জানি না...
- তোকে হাতে কে কামড় দিয়েছিলো?
- স্যার সেইটা তো একটা কুত্তা...তার সাথে খুনের কি সম্পর্ক?

- ওই শালা নীহার খুন হইছে কে বললো?
- আপনি না স্যার বললেন যে সে মারা গেছে?
- হারামীর পো...আমি বলছি নীহার রে কি করছোস? খুনের কথা আসলো ক্যান?

মিন্টু আর বাবু ঠিকই বলে যে ও কথা পেটে রাখতে পারে না। সাজ্জাদ পুরোপুরি ঘাবড়ে গেছে; এখন কি হবে? মুখ ফসকে কি সব বলে ফেললো?

- ওই পানির বালতিটা ভইরা এদিকে আন...এই শালা রে আবারো চুবানি দিতে হইবো। ব্যাটা কথা বলতেছে না...
- ওসি সাহেব...প্লিজ পানিতে চুবায়েন না..আমি বলতেছি...সব বলতেছি...

সাজ্জাদ আরো আগেই বলতো কিন্তু ও বাবুকে ওসি সাহেবের চেয়েও বেশী ভয় পায়। কিন্তু আর ও পারছে না...শরীর আর নিতে পারছে না; দুই দিন হলো নাকি আরো বেশীদিন ধরে ও এই অন্ধকার ঘরে আলোর নীচে...আর পারছে না। মাইর খেয়ে মরে গেলেতো ভয়ও মরে যাবে...ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভালো...এখন পর্যন্ত সাজ্জাদ তো ভয়ে ভয়েই জীবন কাটালো।

১০.
শাবল দিয়ে একতলার কংক্রীটের মেঝে ভাঙ্গতেই একটু পরে টং করে আওয়াজ। ধুলো সরাতেই একটা কালো ট্রাঙ্ক। ডালা খুলতেই একটা বিকৃত গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো; লাশ পচা জৈবসার গন্ধের সাথে সুগন্ধের মিশ্রন বিবমিষা আনে। বেগুনী শাড়ী জড়ানো একটি কংকাল; বেশীর ভাগ মাংসই গলে পড়েছে।

কি আশ্চর্য!!! শুধু চোখ দুটি তেমনি আছে...অদ্ভুত সুন্দর পাপড়ি ঘেরা এক জোড়া চোখ, চোখের সাদায় ছোটবড় লাল লাল রক্তের ফুটকি। ঠান্ডা শীতল অনুভূতি বিহীন দুটো চোখ। কিচ্ছু নেই ওই চোখে, না অবিশ্বাস, না ঘৃণা, না প্রতিরোধ। চোখ দুটো মরে গেছে আর মানুষটাও।

© শিখা রহমান (২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৫)

বিঃদ্রঃ এই গল্পটা আসলে মোটেও গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। অবশ্যই লেখার সময়ে আমি অনেক কিছুই কল্পনায় এঁকে নিয়েছি। তথ্যগুলো খবরের কাগজ থেকে নিলেও মানুষগুলোকে আমার আকঁতে হয়েছে। আমি জানি কিছু কিছু মানুষ এই গল্পের চেয়েও বিকৃত আর ভয়ঙ্কর ছিলো। কয়েকটা নাম ঠিক রেখেছি, কিছু মানুষ আমার কল্পনা প্রসূত, আর কিছু মানুষকে গল্পে আনিনি।

যখন আমার ছয় বছর আমি বিচিত্রার কভার পেজে একটা মেয়ের মুখ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মেয়েটাকে আমার রাজকন্যা মনে হয়েছিলো; ধাক্কা খেয়েছিলাম প্রচ্ছদের ডান কোনায় একটা ট্রাঙ্কের পাশে মেয়েটার কংকালের ছবি দেখে। যা পাই তাই পড়ার সময় ছিলো সেটা।

মাকে লুকিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম; আমার পড়া প্রথম হত্যাকান্ড। নীহার বানু হত্যাকান্ড ১৯৭৬ সালে খুব সাড়া ফেলেছিলো। সেই রাজকন্যার মুখ আজো আমাকে মাঝে মাঝে বড্ড কষ্ট দেয়, এ মৃত্যু তার প্রাপ্য ছিলো না।

এ গল্পটা খুব চেনা, এজন্য না যে এটা নীহারের গল্প, একটি বিখ্যাত হত্যাকাহিনী। এ গল্পটা খুব চেনা কারণ আমরা এখন প্রতিদিন কয়েকটি করে এমন সংবাদ শুনি টিভিতে, পড়ি খবরের কাগজে। এইসব ঘটনা আর সাড়া জাগায় না বা হেড লাইন হয় না।

আমরা নীহারদের মরা চোখ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ সকাল ৮:৫৪
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×