somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা (প্রথম পর্ব)
৫.
বিছানার পাশে রাখা গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি খেতেই শীলা খেয়াল করলো আসলেই বৃষ্টি নেমেছে। বিছানা থেকে কয়েক হাত দূরে প্রায় পুরো দেয়াল জোড়া জানালা। জোর বৃষ্টি নেমেছে। সব জানালাই বন্ধ অবশ্য। এসি অন তাই ঘরের ভেতরে বোঝাই যায় না। মেজাজটা একটু খারাপ হলো। এই বৃষ্টির জন্য দেশ ছেড়ে এলো কিন্তু বৃষ্টি ওর পিছু ছাড়লো না। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের এই অঙ্গরাজ্য অ্যালাবামাতে সারাবছরই দেশের মতো ঝুম বৃষ্টি হয়, এমনকি শীতের সময়টাতেও।

অথচ একসময় শীলা বৃষ্টি কি অসম্ভব ভালোবাসতো। বৃষ্টি নামলেই ছাদে গিয়ে ভেজার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। কত্তোদিন ছাতা থাকার পরেও বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটপাতে হেঁটেছে। আর বৃষ্টিতে রিক্সায় ঘোরা; ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে হুডতোল…ও আর রঞ্জন। শীলার আবার নীল প্লাস্টিকের চাদর ছাড়া চলবে না। রঞ্জু খুব রেগে যেতো; বৃষ্টির সময় এমনিতেই রিকসা পাওয়া কঠিন; নীল চাদর খুঁজতে খুঁজতে বৃষ্টিতে ভিজে শেষ। আহ্ রঞ্জন...রঞ্জু...কত্তোদিন পরে ওর কথা ইচ্ছে করে ভাবলো।

পরের দিকে শীলার এই বৃষ্টি বিলাসে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও প্রথমদিন রঞ্জু খুব রেগেছিলো। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রিকসাতে উঠলেও যখন অঝোর বৃষ্টি নেমেছিলো শীলা আচমকা হুড নামিয়ে দিয়েছিলো। রঞ্জু মোটেও প্রস্তুত ছিলো না এই বরষাধারায় অবগাহনের জন্য। চেঁচামেচি করে রিকসা থেকে নেমে গিয়েছিলো; কথা বন্ধ করে দিয়েছিলো। সেই অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য শীলাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিলো। রঞ্জু একটু রাগী আর অভিমানী।

- প্লিজ রঞ্জু আর এমন হবে না...এবারের মতো মাপ করে দে...
- তুই পাগল...তোর সাথে আমি থাকবো না...নিউমোনিয়া হয়ে মারা যাবো...
- আমি বুঝিনি যে তুই রাগ হবি...বৃষ্টি নামলে না আমার মাথা ঠিক থাকে না...
- মাপ করতে পারি যদি...
- যদি? কি করতে হবে বল...
- আরেকদিন বৃষ্টি নামুক উসুল করে নেবো...এখন ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ করতো...
- রাগ কমেছে?
- রাগ মুলতুবী রাখলাম...আরেকদিন বৃষ্টির অপেক্ষায়...একটা জলরঙা বিকেলের অপেক্ষায়...

এরপরে কোন একদিন বৃষ্টি নেমেছিলো...ওরা দুজনে রিক্সায়। রঞ্জু নিজেই ঝুম বৃষ্টি নামতেই হুড নামিয়ে দিয়েছিলো। রঞ্জুর চোখ মাতাল হয়েছিল…সেই প্রথম চুমু। শীলার এখনও মনে আছে...উহহ!! ওর সমস্ত শরীর নদী হয়ে গিয়েছিলো…জোড়া ঠোঁটের মাঝে ভালোবাসা সেদিন বৃষ্টির জল হয়ে ঝরছে। সমস্ত পৃথিবী মুছে গিয়েছিলো,সমস্ত শরীরও। শীলা শুধু একজোড়া ঠোঁট হয়ে গিয়েছিলো, যারা নীল শীতল বৃষ্টিতে আরেক জোড়া জ্বর তপ্ত ঠোঁটে ডুব দিয়ে আছে। সমস্ত অনুভূতি, সব ভালোবাসা, সম্পূর্ণ অস্তিত্ব একটা চুমুতে কেন্দ্রীভুত...এমন কি হয়? কি ভাবে হয়?

ওদের সম্পর্কটা সবাই জানত...কখনোই লুকানোর চেষ্টা করেনিতো। শীলার মনে হয়েছিলো এই মানুষটার সাথে বোধহয় সারাটা জীবন কাটানো যায়। রঞ্জুর চোখগুলোর দীঘল পাপঁড়িতে বৃষ্টির জল জমে যখন ছায়া ফেলে তখন সেই জল চুমুতে চুমুতে শুষে নিতে পারবে ও সারাটা জীবন।

রঞ্জু প্রথম থেকেই একটু বেশী অধিকারপরায়ন; অল্পতেই ঈর্ষান্বিত হয়। শিলার খারাপ লাগতো না; বরং মজাই লাগতো যখন সামান্য কারনে মুখভার করতো। শীলা খুব মিশুক। বন্ধুরাতো ওকে ডাকেই “পাগলী” বলে। মেয়েদের পাশাপাশি ওর অনেক ভালো ছেলে বন্ধু। ওদের সাথে একটু বেশী কথা বলতে দেখলে বা হাসাহাসি করলে রঞ্জু মন খারাপ করতো। কিন্তু শীলার বুকে সে সময়টা সুখের মতো ব্যথা চিনচিন করতো এই ভেবে যে একটা মানুষ ওকে পাবার জন্য এত্তো ব্যাকুল হয়ে আছে।

শীলা একবার রঞ্জুকে ওর স্বপ্নের কথা লিখেছিলো। ওর স্বপ্নের গ্লাসহাউসের কথ...শহর থেকে দূরে। চারিদিকে কাঁচের দেয়াল; বাইরে শুধুই সবুজ গাছের সারি; বৃষ্টি নামলেই কাঁচের ওপাশে অ্যালুমিনিয়াম রঙা বৃষ্টির চাদর। ওরা কি তীব্রভাবেই না প্রেমে পড়েছিল...বড্ড বেশীই আবেগ ছিলো, আর ছেলেমানুষী আর পাগলামি। সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে ওরা আসলেই একটা গ্লাসহাউসে ছিলো। শীলা আর রঞ্জন পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলো পরষ্পরের মধ্যে, ‘শিলাবৃষ্টি’ আর ‘মেঘ’ এর নিজস্ব ভুবনে।

৬.
- এই শোন তুই কি এতোক্ষন কারো সাথে কথা বলছিলি?
- হুউউ...বলছিলাম তো রুহুলের সাথে...কেনরে?
- নাহ...মানে রঞ্জু আমাকে ফোন করেছিলো্‌...কথায় মনে হলো চেক করছে যে তুই কার সাথে কথা বলছিস...
- বীথি তোর না এখনও এই সব ফালতু চিন্তা করার অভ্যাস গেলো না...রঞ্জু বুঝি এমনি তোকে ফোন করতে পারে না?
- শীলা কিছু মনে করিস না একটা কথা বলি...রঞ্জুকে আমার ঠিক নরমাল মনে হয় না...তোকে খুব বেশী আগলে আগলে রাখে...
- ফালতু কথা বলিস নাতো!!!
- খেয়াল করে দ্যাখ তুই ওর সাথে সম্পর্কের পরে কত্তো বদলে গেছিস...আগের মতো নেই...
- হুউউ...বলেছে তোকে?
- সেদিন তানভীরের জন্মদিনে আমরা সবাই খেতে গেলাম...তুই গেলি না রঞ্জু মানা করলো বলে...ও কেন মানা করবে?
- আরে রঞ্জু না একটু জেলাস টাইপের...ওই যে তানভীর আমাকে চিঠি দিয়েছিলো তাই...
- সে তো কবেকার কথা...আর তুইতো রঞ্জুর সাথেই আছিস তাই না?
- বাদ দে তো অন্য কথা বল...

বীথির কাছে অস্বীকার করলেও শীলা টের পাচ্ছিল রঞ্জুর সাথে সম্পর্কটা বদলে যাচ্ছে। যে ব্যাপার গুলো প্রথম প্রথম ভালোবাসার স্বাভাবিক ঈর্ষা মনে হতো সে গুলো এখন ভালবাসার অত্যাচার মনে হয়। যে কথা গুলো প্রথমে ভালোবাসার অনুরোধ মনে হতো সেগুলো এখন অধিকারের অনুরনন মনে হয়। শীলা ভেবে নিয়েছিলো সম্পর্ক এগোলে সময়ের সাথে সাথে রঞ্জু আশ্বস্ত হবে, এই ব্যাপারগুলো কমে যাবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রঞ্জুর ইন্সিকিউরিটি বাড়ছে। কমছে কই? যতোই রঞ্জুর নজরদারী বাড়ছে ততোই শীলার দমবন্ধ ভাব বাড়ছে। রঞ্জু তো ও কেমন জেনেই কাছে এসেছে...জোছনাকে কি হাতের মুঠোয় ধরা যায়? নদীর জলকে পুকুরে বন্দী করলে সে কি আর নদী থাকে?

শীলা ভাবছিলো যে রঞ্জুর সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি কথা বলবে। কিন্তু কি ভাবে বলবে ভাবতে না ভাবতেই অঘটন ঘটে গেলো। তখন পরীক্ষার আগে প্রিপারেটরী লিভ চলছে...শেষ টার্ম।

- তুমি কি এতোক্ষন তানভীরের সাথে কথা বলছিলে?
- নাতো...কেন বলতো?
- মিথ্যা কথা বলবে না আমি তোমাদের দুজনের ফোন ঘণ্টা খানেক ধরে ট্রাই করে দেখেছি...এনগেজড ছিলো আর এখন দুটোই ফ্রি...
- আশ্চর্য!!! পড়া বাদ দিয়ে তুমি সবার ফোন চেক করে বেড়াচ্ছো নাকি?

ফোনের ওপাশে রঞ্জুর রাগান্বিত কন্ঠ বলে দিচ্ছিলো সে খুবই ক্রুদ্ধ। শীলা বুঝতে পারছিলো না যে সে যদি তানভীরের সাথে কথা বলেও থাকে সমস্যা কোথায়...রঞ্জু কেন কাউকেই লুকানোর মতো তো ওর কিছু নেই। মায়ের ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ছোট খালা তাই শীলার ফোনে কল দিয়ে মার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলো। কিন্তু শীলা এই কথাটা বলার আগেই রঞ্জু ঠাস করে ফোন কেটে দিয়েছিলো। সেই প্রথম শীলা রঞ্জুকে আর ফোন ব্যাক করেনি। বড্ড বিরক্ত হয়েছিলো ও; অনুনয় করে রঞ্জুর রাগ ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করেনি। ভীষণ ক্লান্ত লেগেছিলো; রঞ্জুর কথা না ভেবে পড়ায় মন দিয়েছিলো। আর ভেবে রেখেছিলো যে পরীক্ষা শেষ হলে রঞ্জুর সাথে কথা বলবে। পরীক্ষার মাঝে এই সব নাটকীয়তা ভাল লাগে না।

এর দুদিন পরে পরীক্ষা শেষ হতে সামনের বেঞ্চে বসা রুহুলের সাথে প্রশ্ন নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো। হঠাৎ বীথি এসে বললো “শীলা...তাড়াতাড়ি বারান্দায় আয়...প্লিজ...একটু রঞ্জুকে থামা...” শীলা কিছু না বুঝেই রুমের বাইরে এসে দেখে রঞ্জু তানভীরের কলার ধরে আছে “তোর শীলার সাথে এতো কি কথা থাকে? শালা! খালি ছোঁক ছোঁক!!” শীলা এমন অবাক হয়ে গিয়েছিলো।

পাশে গিয়ে দাড়াতেই রঞ্জু কলার ছেড়ে দিয়েছিলো। চারপাশে মজা দেখতে জড়ো হওয়া সারি সারি মুখ। ও শুধু আস্তে করে রঞ্জুকে বলেছিলো “আমাদের মনে হয় একটু ব্রেক নেয়া উচিত...প্লিজ পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তুমি আর আমার সাথে যোগাযোগ করো না...” চলে যেতে যেতে পিছু ফিরে বলেছিলো “আর আমার বন্ধুদের সাথেও তুমি যোগাযোগ করবে না...” শীলার কন্ঠে একটা আশ্চর্য শীতলতা ছিলো আর দৃঢ়তা। রঞ্জু ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো।

৭.
“রূপালি মানবী, সন্ধ্যায় আজ শ্রাবণ ধারায়
ভিজিও না মুখ, রূপালী চক্ষু, বরং বারান্দায় উঠে এসো
ঘরের ভিতরে বেতের চেয়ার, জানলা বন্ধ দরজা বন্ধ
রূপালী মানবী, তালা খুলে নাও, দেয়ালে বোতাম আলো জ্বেলে নাও,
অথবা অন্ধকারেই বসবে, কাচের শার্সি থাকুক বন্ধ
দূর থেকে আজ বৃষ্টি দেখবে, ঘরের ভিতরে বেতের চেয়ার, তালা খুলে নাও।“

মেসেঞ্জারে টুং করতেই শীলা কবিতাটা দেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। আসলেই বৃষ্টি নেমেছে। রঞ্জু সেদিনের পরে আর ফোন না করলেও ফেসবুকে মাঝে সাঝেই কবিতা পাঠিয়েছে। শীলা অবশ্য কোন উত্তর দেয়নি। পরীক্ষা শেষ করার আগে ও এসব নিয়ে ভাবতে চায় না; ভাবলে বড় অস্থির লাগে।

আবারো টুং... “রূপালী মানবী, আজ তুমি ঐ জানলার পাশে বেতের চেয়ারে
একলা এসব আঁধারে অথবা দেয়ালে বোতাম আলো জ্বেলে নাও
ঠান্ডা কাঁচের শার্সিতে রাখো ও রূপালী মুখ, দুই উৎসুক চোখ মেলে দাও।
বাইরে বৃষ্টি, বিষম বৃষ্টি, আজ তুমি ঐ রূপালী শরীরে
বৃষ্টি দেখবে প্রান্তরময়, আকাশ মুচড়ে বৃষ্টির ধারা…”

সুনীলের এই কবিতাটা শীলার খুব ভালো লেগেছিলো; রঞ্জু পাঠানোর আগে ও এটা পড়েনি। পড়ে বলেছিলো “আচ্ছা আমি কি তোমার রুপালী মানবী?” “হুম...তোমার জন্য আমি ঠিক ঠিক একদিন বৃষ্টির পর্দা ঘেরা একটা গ্লাসহাউস গড়ে দেবো...ঠিক তোমার স্বপ্নের মতো...বৃষ্টি ভেজা দিনে তুমি আর আমি.....সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা!!” আবারো টুং শব্দে শীলার ভাবনায় ছেদ পড়ে।

“আমি দূরে এক বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একলা রয়েছি,
ভিজেছে আমার সর্ব শরীর, লোহার শরীর, ভিজুক আজকে
বাজ বিদ্যুৎ একলা দাঁড়িয়ে মানি না, সকাল বিকেল
খরচোখে আমি চেয়ে আছি ঐ জানলার দিকে, কাচের এপাশে
যতই বাতাস আঘাত করুক, তবুও তোমার রূপালী চক্ষু-
আজ আমি একা বৃষ্টিতে ভিজে, রূপালী মানবী, দেখবো তোমার
বৃষ্টি না ভেজা একা বসে থাকা।–“

মেসেজটা পড়েই কেন যেন শীলার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ওর ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে যে জানালার ওপাশে রঞ্জু আছে। ও জানালার পাশে গিয়ে দাড়াতেই দেখলো রঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে বাসার সামনে রাস্তার ওপাশে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে এক সাঁ; জল গড়িয়ে পড়ছে ওর মুখ বেয়ে; চুলের ডগা বেয়ে টুপটাপ অবিশ্রান্ত জলের ফোঁটা ঝরছে।

ও একটুও নড়ছে না; ঠান্ডায় নীল নীল ঠোঁট। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে; পলক ফেলছে না। শীলা মনে মনে দেখতে পাচ্ছে ওর চোখের দীঘল পাপড়িতে জল জমেছে। রঞ্জু একটুও নড়ছে না; ঠিক যেন জলছবিতে আঁকা একটা অদ্ভুত সুন্দর মানুষ। কিন্তু এই দারুন সুন্দর ছবিটার দিকে তাকিয়ে শীলার ভয় লাগছে কেন? ও জানে...ও জানে খুব ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে...কি করবে এখন? ভীষন আতঙ্কে শীলা জমে গেছে; ওই অমানবিক চোখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না...খুব ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে এখনি...

শীলার চোখে চোখ রেখেই রঞ্জু ডান পকেট থেকে ছুরি বের করলো; আলো আঁধারীতে ঝলসে উঠলো ইস্পাতের ফলা। বাম হাতের কব্জিতে কাটাকুটি। শীলার কথা বলতে পারছে না কেন? চোখ দুটো কি শীতল...কি অমানবিক...চোখ দুটো মরে গেছে। একি বৃষ্টির পানি রং বদলালো কেন? চারপাশ এমন রক্ত লাল!! শীলা অস্ফুট শব্দ করে উঠলো...পৃথিবীটা দুলে উঠলো।

৮.
শীলা জ্ঞান হারিয়েছিলো। তখন ভোর চারটা। পড়ে যাওয়ার শব্দে বাসার মানুষেরা জেগে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পরে ও সাথে সাথেই রঞ্জুর কথা জানতে চেয়েছিলো। বাবা মা ওদের সম্পর্কের কথা জানতেন; জানালার বাইরে রঞ্জুকে দেখে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বাবা বুয়েটে ডি এস ডাব্লিউ(ডিরেকক্টর অফ স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার) স্যারের সাথে কথা বলেছিলেন। রঞ্জু পুরোই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো; স্যার ওর বাবা মার সাথে কথা বলে হল থেকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

একটাই পরীক্ষা বাকী ছিলো; শীলা কোনমতে পাশ করলো। সারা বুয়েটে ওকে নিয়ে কানাকানি। কি ভাবে যেন ওরই বদনাম হয়ে গেলো। কোন মেয়ের জন্য যখন একটা ছেলের মাথা খারাপ হয়ে যায় তখন কেউতো কিছু জানতে চায় না। মেয়েরাতো এমনিতেই ছেলেদের মাথা খারাপ করার জন্য দায়ী তাই না?

কাছের বন্ধুরা অনেক কিছু জানলেও কেন যেন দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেলো; একদল ওর পক্ষে, আর অন্যদল রঞ্জুর পক্ষে। একসাথে হলেই প্রথমে ফিসফাস...তারপরে বাক বিতন্ডা যে কার দোষ...কেন এমন হলো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। শীলার এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না; ও শুধু একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। ওর স্বপ্নে যে ওই রক্তলাল বৃষ্টিতে একজোড়া মরা চোখ হানা দেয়। আস্তে আস্তে ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো।

কেমন আছে রঞ্জু এখন? কোথায় আছে? অনেক অনেক দিন শীলা বৃষ্টি সহ্য করতে পারতো না। তাকালে কিছুক্ষণ পরেই মনে হতো বৃষ্টির রং রুপালী থেকে বদলে রক্ত লাল হয়ে গেছে। বৃষ্টি নামলে জানালায় ভারী পর্দা টেনে দিতো। মনে হতো শার্সির ওপাশে এক জোড়া শীতল পলকহীন চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

সারা পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো শীলা। বাসা থেকে বের হতে ভয় করতো; যদি দেখে কোথাও রঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। যাকে একসময় এক পলক দেখার জন্য এমন অস্থির লাগতো তার কথা ভাবা মাত্র এমন তীব্র ভয়, এমন প্রচন্ড আতঙ্ক হতে পারে? ভালোবাসা কখনো কখনো ঘৃনায় বদলে যায় শীলা জানতো, কিন্তু ভালোবাসা কি এমন তীব্র ভয়ের জন্ম দিতে পারে?

৯.
- আমি কেন তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি তা বোধহয় জানো…
- জানি...আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন কিন্তু আপনি কি আমার বিষয়ে সব জানেন?
- তোমাদের বাসায় প্রোপজাল পাঠানোর আগে শাহীন আমাকে বলেছে তোমার সমস্যার কথা।
- আপনি ভাইয়ার স্কুল ফ্রেন্ড…ইন্টারমিডিয়েটর পর থেকে অনেক বছর হলো বিদেশে আছেন। জানি না ভাইয়া আপনাকে কতোখানি খুলে বলেছে।
- আমি জানি একটা ছেলে তোমাকে ভালোবেসে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। And after that incident you have detached yourself from the rest of the world. I can only guess how terrifying that incident must be for you.
- আপনি ঠিক বলেছেন শুধু একটা তথ্য বাদ পড়ে গেছে। আমিও ওই ছেলেটাকে ভালোবাসতাম, পাগলের মতো ভালোবাসতাম। এটা জানার পরেও কি আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান?
- হ্যাঁ চাই...তোমাকে দেখার সাথে সাথেই আমার মনে হয়েছে তোমাকে পাশে পেলে জীবনটা সুন্দর হতো। মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম। ওই ছেলেটাকে ভালোবাসতে বলে আমাকে তুমি ভালোবাসবে না বলে মনে হয় না...দেখো আমি দারুন একজন মানুষ। গ্যারান্টি দিচ্ছি ভালোবাসার...

মাহীনের চোখে মুখে হাসির ঝলক; শীলার হঠাৎ করেই মানুষটাকে ভালো লেগে গেলো। সেই প্রথম শীলা কাউকে ওর দুঃস্বপ্নের কথা, ওর তন্দ্রাহীনটার কথা বলেছিলো। কেন যেন মনে হলো এই মানুষটা ওকে কখনো রঞ্জুর কথা বলে খোঁটা দেবে না; এই মানুষটার বুকেই আছে ওর “স্বর্ণচাঁপার গাছ, আকাশের মতো বড়ো নীল পোষ্টাপিস...অরণ্যের চিত্রকলা, গোপন স্টুডিও; তার বুকে আছে দেরি করে ঘরে ফিরে ডাক দিলে যে দেয় দুয়ার খুলে সেই ভালোবাসা, যে এসে ভীষণ জ্বরে মাথায় কোমল হাত রাখে সেই দুঃখবোধ...আকশের মতো সেই বড়ো নীল পোস্টাপিস, তার বুকে আছে গোপনীয় খাম হাতে সোনালি পিয়ন।“

বৃষ্টির শহর ছেড়ে শীলা রোদের তৃষ্ণা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালো। বিয়ে হয়েছে মাস সাতেক; শীলা অনেক দিন পরে আজ আবার ওই স্বপ্নটা দেখলো। পাশে মাহীন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ও পিঠে মাথা রাখতেই মাহীন ওর দিকে ঘুরে জড়িয়ে ধরলো; ঘুম ঘুম আদুরে স্বরে বললো “শীলু কি ভয় পেয়েছো?” বুকে মাথা রেখে শীলা বাইরে জানালায় চোখ রাখলো। বাইরে বৃষ্টির রং বদলাক; বজ্রপাতে ঝলসে উঠুক ইস্পাতের ফলা; শীলার আর ভয় করছে না, ওর আছে মুখ লুকানোর জায়গা, আর ভয় পেলে জড়িয়ে ধরার জন্য দুটো বলিষ্ঠ হাত।

(সমাপ্ত)

© শিখা রহমান
(ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:৩৫
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×