
বিগত কয়েক দশক আগে, তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হিসাবে পরিচিত ছিল "চিঠি বা পত্র"। তৎকালীন সময়ে চিঠি ছাড়া দূরবর্তি কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির চাপে, সেই চিঠির কথা কল্পনা করা আর আমাবশ্যার রাতে আকাশে চাঁদ দেখতে পাওয়ার আশা করা প্রায় সমান কথা হয়ে দাড়িয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে দেশের প্রায় সবগুলো ডাকঘর এবং ডাকবাক্সের যে বেহাল দশা, তাতে ডাকবাক্স বলে কোন বস্তু যে একসময় এই বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিল সেটা জানা বা বোঝার জন্য, আমাদের নতুন প্রজন্মকে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোন মিউজিয়াম কিংবা জাদুঘরে যেয়ে দেখতে হবে।

তবে আমার যতটুকু মনে হয়, একটি চিঠির মধ্যে যে আবেগ, যে ভালবাসা লুকিয়ে থাকে কিংবা একটি চিঠির মাধ্যমে যে ভালবাসাকে প্রকাশ করা সম্ভব হয়, তা বৈজ্ঞানীক অন্য কোন মাধ্যম দিয়ে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। তাই সেই জিনিসটা মানুষের কাছে চিঠির চেয়ে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন। স্বীকার করি যে, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কে দিয়েছে বেগ, কিন্তু সেই সাথে আমাদের কাছ থেকে সে কেড়ে নিয়ে গেছে আমাদের আবেগ আমাদের ভালবাসাকে। একটা চিঠির ভিতরে যে, কতটুকু প্রেম-ভালবাসা এবং আবেগ বিদ্যমান থাকে, তা নিচের এই চিঠিটা না পড়লে কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। তাহলে আসুন আর দেরিনা করে ঝটপট চিঠিটা একবার মনযোগ দিয়ে পড়ে ফেলি!!

প্রিয় হাদারাম,
আজও আপনাকে দেখলাম; কলাভবনের সামনের রাস্তা ধরে প্রতিদিনকার মতোই মাথা নিচু করে ভ্যাবলার মতো হেঁটে যাচ্ছেন লাইব্রেরির দিকে। পিঠে সেই বহুল পরিচিত ছাইরঙা ব্যাগ আর গায়ে সেই ফতুয়াটা। আচ্ছা, আপনি সব সময় ফতুয়া পরেন কেন একটু বলতে পারেন? আপনার কোন শার্ট নেই? আপনি কি জানেন, ফতুয়া পরলে আপনাকে মেয়েদের মত লাগে? আপনার চোখের গড়নটাও অনেকটা মেয়েদের মত, লম্বা টানা টানা ভ্রু। এমন ছেলে আমার একদম পছন্দ না! ছেলেরা কেন মেয়েদের মত হবে! কাল থেকে আপনি আর ফতুয়া পরবেন না! আর হাঁটার সময় অত মাথা নিচু করে হাঁটতে হবে কেন? আশে পাশে কে আছে সেটা দেখলে খুব অন্যায় হয়ে যায় বুঝি? কি ভাবেন নিজেকে?? খুব 'নরম-সরম' মানুষ ভেবে মেয়েরা আপনার প্রেমে পড়ে যাবে? মেয়েরা এত বে-আক্কেল না, বুঝেছেন? আপনি যতই ভাব নেন না কেন, আপনার মত হাদারাম ছেলের প্রেমে কোন মেয়েই পড়বে না! এমনিতেই তো খুব ভাব নিয়ে থাকেন।
ওহঃ, আর একটা কথা! আপনার ক্লাসমেট জিনিয়া আপুর সাথে এত হেসে কথা বলা হয় কেন? আর কোন দিন যদি ঐ মেয়ের সাথে হাসাহাসি করতে দেখি, তাহলে মুখে চুলের কাঁটা গেঁথে দেব। সেদিনই বুঝবেন, হাসি কোথা দিয়ে কেমন করে বের হয়!
দেখেন, আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ মেয়ে না। দেখতে তো মোটামুটি ভালই। নাইবা হলাম জিনিয়া আপুর মত এত ফরসা! তাতে কি (?) আমিতো আর লম্বা মুখো না। আমার চোখ দুটো নাকি অসম্ভব সুন্দর! আমি না, অনেক ছেলেই এটা বলেছে। কি, বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি? আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আমার ক্লাসমেটদের কাছে আপনি শুনে দেখেন। তাছাড়া আমার চুলের কারনে তো আমার রুমমেটরা সবাই আমাকে 'বনলতা সেন' বলেই ডাকে।
আচ্ছা ক্লাসের ব্যালকনিতে যখন দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন একবার একটু আশে পাশে তাকালে কি হয়? আমার চোখে চোখ পড়লে বুঝি আপনার চোখ উঠবে? সেদিন তো শেষ রাতে ঠিকই আমার স্বপ্নের মধ্যে আসলেন! ছি! ছি! কি লজ্জা! সে কথা ভাবলে তো এখনো আমার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি জানেন (?) তার পরের দুই দিন আমি আয়নায় তাকাতে পারিনি! এমনকি আপনার দিকেও তাকাতে পারিনি।
ওহঃ পরশু সকালে ডিপার্টমেন্টের সামনে এত মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? আপনাকে এত মন খারাপ অবস্থায় দেখলে, অন্য কারও বুঝি খারাপ লাগে না? জানেন, আপনার হাসি মুখটা দেখলে আমার বুকের ভিতরের প্রজাপতিটা উড়ে উড়ে রং ছড়ায়, জীবনটাই যেন রঙ্গীন হয়ে ওঠে! আমি কিন্তু ঠিকই ঐদিনে আপনার মন খারাপের কারণ বের করে ফেলেছি। আচ্ছা একটা পরীক্ষায় একটু কম নাম্বার পেলে বুঝি এতটা মন খারাপ করতে হয়? আপনি না, এখনো পর্যন্ত সেই বাচ্চাদের মতই রয়ে গেলেন! কেন, বড় হবেন না?
একটা কথা, ক্লাস শেষে বারান্দায় আর ওভাবে দাঁড়াবেন না। জুনিয়র মেয়েরা নোট চাইলেই বুঝি সঙ্গে সঙ্গে গলে যেতে হয়? এরপর নোট হাতে কোন দিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে না, সব নোট পুড়িয়ে দেব! খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কিন্তু আপনাকে বেশ লাগে! এত ঘন ঘন শেভ করার কি আছে! বেশি রাত জাগবেন না, আপনার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে! আর এখন থেকে নীল রঙের জিনস্ প্যান্টটা আর পরবেন না! পায়ের নিচের অংশে ছিঁড়ে সুতো বেরিয়ে গেছে। এখন থেকে সব সময় টি-শার্ট পরবেন! মাঝে মাঝে ফতুয়াও পরতে পারেন, কোন অসুবিধা নেই। ফতুয়াতে আপনাকে সামান্য একটু মেয়ে মেয়ে লাগলেও, দেখতে কিন্তু হেব্বি লাগে!!
মাস্টার্স তো প্রায় শেষের দিকে। এবার একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করুন। নাকি সারা জীবন ঐভাবেই কাটিয়ে দেবেন? দেখেন, আমাকে কিন্তু অনার্স পড়া শেষ হলেই বিয়ে দিয়ে দেবে। তখন সারা জীবন কে সামলাবে আপনার মত হাদারামকে? শুনেছি সংসার জীবন নাকি খুবই কঠিন হয়। আমি অন্য কারও উপরে ভরসা করে তো আর আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি না! সত্যি বলছি, আপনার চাকরি পাওয়াটা না খুবই জরুরী। আমি জানি, আমাকে ছাড়া আপনারও এক মুহুর্ত্ব চলবে না! তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দু'জনকে তো এক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে! ভাল থাকবেন!!
ইতি আপনার
'বনলতা সেন'

পুনশ্চঃ- "চিঠিটা পাওয়ার পর এই বোকা মেয়েটাকে খুঁজে নিয়েন। এই বোকা মেয়েটা আপনার কাঁধে মাথা রেখে শরতের চাঁদ দেখতে চায়। আপনার বুকে মাথা রেখে শান্তির নীড় রচনা করতে চায়। আমাকে আপনি সেই সুযোগ টুকু দেবেন না? সত্যি বলছি, আপনি খুঁজে না নিলে, আর কোন দিনও আড়াল থেকে দেখব না আপনাকে! ভালবাসি বলে সব দায় কি শুধুই আমার"???
বিঃ দ্রঃ- গত তিন বছর আগে কোন এক সন্ধ্যায় মল চত্বরে হাঁটতে গিয়ে ঠিকানাবিহীন একটা নীল খামসমেত এই চিঠিটা কুড়িয়ে পাই। জানি না, সেই ছেলেটা বোকা মেয়েটাকে খুঁজে পেয়েছিল কিনা! জানি না, মেয়েটির এই পবিত্র ভালবাসা পূর্নতা লাভ করতে পেরেছিল কিনা! পৃথিবীতে কত ঘটনাইতো অজানা থেকে যায়................!!!
সূত্রঃ- 'চিঠিটা প্রথম আলোর ম্যাগাজিন পেপার "ছুটির দিন" হতে সংগৃহীত এবং সামান্য সংযোজিত!'
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




