আমাদের এই পৃথিবীটা সত্যিই একটা আশ্চার্যজনক এবং রহস্যময় জায়গা। আর তার থেকেও রহস্যজনক হলো তার বিভিন্ন সময়ে করা কিছু খাম খেয়ালী কাজ কারবার। প্রকৃতি যে কতটা সুন্দর আর বিস্ময়কর সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এই বিস্ময়কর প্রকৃতিরই কিছু খামখেয়ালীপনা আছে যা দেখে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। গোটা বিশ্বের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন অনেক অজানা চমকপ্রদ সব দৃশ্য। যে দৃশ্যগুলো দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে আসলেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে! ঠিক তেমনই কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে আমার আজকের আয়োজনঃ-
০১। মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহাঃ- খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে মাটিরাঙ্গা উপজলা। সেখানকার আলুটিলা খাগড়াছড়ির একটি নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের নাম আলুটিলা। আলুটিলার আগের নাম ছিল আড়বাড়ি পর্বত। এই পর্বতের সীমানা বিশাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়ি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এলাকার মানুষ খাদ্যের সন্ধানে এই পাহাড় থেকে বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে জীবন রক্ষা করেছিল। সেই থেকে এই পর্বতের নাম হয়ে যায় আলুটিলা। এখনো এই টিলায় প্রচুর বুনো আলু পাওয়া যায়। আলুটিলায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি রয়েছে একটি প্রাকৃতিক গুহা। গুহাটার নাম 'মাতাই হাকর বা দেবতা গুহা'। তবে এটি বর্তমানে আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ নামেই পরিচিত। গুহাটির তলদেশে একটি প্রবহমান ঝরনা রয়েছে। সুরঙ্গের ভীতরে কোন আলো নেই। সুরঙ্গের তলদেশ পিচ্ছিল এবং পাথুরে। আলুটিলার এই মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা সত্যিই প্রকৃতির একটি আশ্চর্য খেয়াল। দেখতে অনেকটা ভূগর্ভস্থ টানেলের মত যার দৈর্ঘ প্রায় ৩৫০ ফুট। গুহার ভীতরে জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে, রয়েছে বড় বড় পাথর। বিশ্বের হাতে গোনা যে কটি প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বা গুহা রয়েছে আলুটিলার দেবতা গুহা তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে কীভাবে এই গুহাটি তৈরি হয়েছে তা আজও জানা যায়নি।
০২। দানবীয় ক্রিস্টাল গুহাঃ-
এটি মেক্সিকোর নাসিয়া নামক জায়গায় অবস্থিত। ক্রিস্টালগুলোর প্রধান উপাদান জিপসাম(প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে বড় ক্রিস্টাল), এবং এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই তৈরী হয়েছে। এক একটি ক্রিস্টাল বীমের গড় দৈর্ঘ্য ৩৬ ফিট(১১মিটার) এবং ওজন আনুমানিক ৫৫ টন। গুহার ভেতরের তাপমাত্রা প্রায় ৫৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং আর্দ্রতা ৯৯ শতাংশ। যে কারনে উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যতীত এই গুহার ভেতর কোন মানুষ ১০ মিনিটও টিকতে পারবে না।
০৩। সমুদ্রের নীল ঢেউঃ-
যারা মূলত সমুদ্রসৈকত দেখতে ভালবাসেন তারা নিশ্চয় সাগরের নীল পানি দেখেছেন! কিন্তু রাতের বেলা সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউগুলো এসে যখন তীরে আছড়ে পড়ে, তখনও যদি সেই ঢেউয়ের পানি নীল হয়ে জ্বলে তবে সেটি কেমন দেখাবে! নিশ্চয় সেটা মানুষের চোখে নয়নাভিরাম দৃশ্য হিসাবে ধরা দেবে। পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু সাগরের পানি আছে যেগুলোর ঢেউ যখন তীরে আছড়ে পড়ে, ঠিক তখনই এমন নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারনা ঘটে। এর কারন হলো সমুদ্রের গভীরে কিছু ফাইটোপ্লাংটন আছে, যাদেরকে বলা হয় বায়ো-লুমিনেসেন্স। এরা বিপদের সম্মুখীন হলেই শত্রুকে ভয় দেখাতে আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা হিসেবে হালকা নীল আলোর বিচ্চুরণ ঘটায়। আর যখন সমুদ্রের পানি তীরে আছড়ে পড়ে তখন এই ফাইটোপ্লাংটন গুলিও পানির সাথে সাথে তীরে উঠে আসে। যার ফলে এমনটি ঘটে থাকে। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন পানিতে থাকা ফসফরাস বাতাসের সংস্পর্শে এসে এমন নীল আলোর বিচ্চুরণ ঘটায়। আটলান্টিক এবং প্যাসিফিক মহাসাগরে এটি সব থেকে বেশী দেখা যায়। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও রাতের বেলা এমন দৃশ্য ঘটে থাকে।
০৪। নোংরা বজ্রপাতঃ-
আগ্নেয়গিরীর উদগিরনের সময় এর উপর মাঝে মাঝে বজ্রপাত হয়, আর একেই বলা হয় ভলকানিক লাইটনিং বা ডার্টি থান্ডারস্ট্রম। জার্নাল সাইন্সের এক গবেষনায় দেখা গেছে, উদগিরণে নির্গত কুচি কুচি পাথরের কণা, গ্যাস এবং ছাইয়ের ঘর্ষণে একটা স্থির চার্জের উৎপত্তি হয় যা একসাথে সংমিশৃত হয়ে আগ্নেয়গিরির উপরে প্রচন্ড বজ্রপাতের সৃষ্টি করে। আগ্নেয়গিরির উদগিরিত বিভিন্ন কণা থেকে এর উৎপত্তির জন্য একে 'ডার্টি থান্ডারস্ট্রম বা নোংরা বজ্রপাত' হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে।
০৫। জমাট বাধা বুদবুদঃ-
কানাডার পশ্চিম এলবার্টার উত্তর সাস্কাচিবান নদীতে আব্রাহাম নামে এই কৃত্তিম লেকটি অবস্থিত। ১৯৭২ সালে এটি তৈরী করা হয় এবং সিলাস আব্রাহামের নামে তার নামকরণ করা হয়। এই লেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস নির্গত হয় যা পানিতে বুদবুদ আকারের সৃষ্টি করে। শীতকালে যখন পানি জমে যায় আর তার সাথে এই বুদবুদগুলোও আটকে যায়। ফলে একসময় সেই আটকে থাকা বুদবুদ গুলোই এমন জমাট বাধা বুদবুদে পরিণত হয়।
০৬। মেক্সিকোর ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক ঝরণাঃ- এর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পায়নি। তাই সুধুমাত্র ছবিটা পোস্ট করলাম।
০৭। বেইজিং এর দৈত্যাকৃতির মেঘঃ- চীনের রাজধানী বেইজিং এর আকাশে ২০১২ সালে হঠাৎ করে ঠিক এমনই একটা মেঘ খন্ডকে ভাসতে দেখা গিয়েছিল। যা দেখতে অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মত। সাধারনত নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ বা এ্যাটম বোমা বিস্ফোরনের পর যেমনটা দেখা যায় ঠিক তেমন। চীনের জাতীয় বায়ুমন্ডলীয় পরিষদের গবেষণায় পরবর্তীতে জানা যায় এটি স্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি পুঞ্জীভূত মেঘখন্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বায়ুস্থরের উপরের দিকের উষ্ণতাই এই মেঘের এমন অদ্ভূদ আকার সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
০৮। বলিভিয়ার সল্ট ফ্ল্যাটঃ- দক্ষিণ পশ্চিম বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার কাছে এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটি অবস্থিত। প্রায় ১০ হাজার ৫ শত ৮২ কিলোমিটার জুড়ে এটি বিস্তৃত এবং সমুদ্রের তলদেশ থেকে এর উচ্চতা ৩ হাজার ৬ শত ৫৬ মিটার। বলা হয়, এটি এমন একটা জায়গা যেখানে আকাশকে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার মত দেখায়। অথ্যাৎ এখানে দাড়িয়ে এর শেষ প্রান্তের দিকে নজর দিলে মনে হবে যেন, আকাশ সেখানে মাটির সাথে মিশে গেছে।
০৯। মস্কোর লাইট পিলারঃ-
বরফের ক্রিস্টালে আলোর প্রতিফলনের ফলে যখন তা সোজা উপরে উঠে যায়, ঠিক তখনি এই অতীব সুন্দর দৃশ্যটি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর আইডাহোর শহরে আলোর প্রতিফলনের এই অপূর্ব দৃশ্যটি দেখার সুযোগ মেলে। এমনটা হওয়ার কারন হলো, মূলত সূর্যই এখানে আলোর অন্যতম প্রধান উৎস। আর সেই সূর্যের আলো যখন বরফের ক্রিস্টালে প্রতিফলিত হয় তখন তা আলোর বিচ্ছুরন ঘটিয়ে বিভিন্ন রেখা রেখা আকারে সোজা উপরে উঠে যায়। তাই একে সোলার পিলারও বলা হয়।
১০। এন্টার্কটিকার রক্তক্ষরণঃ-
সাধারনত বরফ আচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা মহাদেশের ভিক্টোরিয়া ল্যান্ডে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়। পানির রং এমন লাল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারন, লবণাক্ত পানিতে আইরন অক্সাইড দূষিত হয়ে একটা রক্তলালের মত প্রবাহের সৃষ্টি করে। যা আস্তে আস্তে এন্টার্কটিকার টেইলর গ্লাসিয়ার থেকে পশ্চিম বনি লেক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। লাল রংয়ের প্রবাহের জন্যেই একে এন্টার্কটিকার রক্তক্ষরণ নামে নামকরন করা হয়েছে।
১১। জলতলের ডুবো অরণ্যঃ- কাজাকিস্তানের কান্দেইজ লেকটি জলতলের ডুবো অরণ্য নামে পরিচিত। প্রায় ১ হাজার ৩ শত ফিট চওড়া এবং ৩০ ফিট গভীর এই ডুবো অরণ্যের সৃষ্টি হয় অত্যন্ত আশ্চার্য জনক ভাবে। ১৯১১ সালে কাজাকিস্তানে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। আর সেই ভূমিকম্পের মাধ্যমে মাটি সরে অনেকটা বাধের মত তৈরী হয় এবং সেখানে পানি জমে এই আশ্চার্য লেকটির সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্পের আগে এখানে যে গাছগুলো ছিল সেগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য্যজনকভাবে সেগুলো মরে না গিয়ে বরং আরো জীবিত হয়ে উঠে এবং সৃষ্টি হয় এই ডুবো অরণ্যের।
১২। দানবীয় ভালুকঃ-
নর্থ ক্যারোলিনার ব্লু রিজ মাউন্টেনস-এর মধ্যে অবস্থিত কেশিয়ারস শহর। অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে পরবর্তী আধা ঘণ্টা পর্যন্ত এই পাহাড়ের এমন একটা ছায়া পড়ে যা দেখতে অনেকটা দানব ভালুকের মতো।
১৩। রঙধনুর রঙঃ-
সার্কামহরাইজন্টাল আর্কস যা ফায়ার রেইনবো নামেও পরিচিত। উচ্চ মেঘের শীতল বরফকুচিতে সূর্যরশ্মি ঠিকরে পড়লে এমন অদ্ভুত দৃশ্যের সূচনা হয়। সাধারণত গ্রীষ্মের সময় এমন ঘটে। বিজ্ঞানীরা জানান, এই প্রাকৃতিক বিস্ময় সৃষ্টির জন্যে ৫৮ ডিগ্রি বা তারও বেশি তাপমাত্রা উৎপন্নের প্রয়োজন হয়।
১৪। নড়াচড়া করা পাথরঃ- ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের রেসট্র্যাক প্লায়াতে একটা খুব বড় আকারের পাথরখণ্ড আছে যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে। এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন, কয়েকদিন এক জায়গায় স্থির থাকার কারনে এবং আবহাওয়া অত্যন্ত শীতল হওয়ার কারনে এই পাথরখণ্ডটির নিচে পাতলা বরফ জমে এবং উক্ত বরফ সূর্যের তাপে গলে গেলে পাথরটি ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করে। তবে স্থান পরিবর্তন করলেও পাথরটি আশ্চার্যজনক ভাবে রেখে আসে তার অবস্থান পরিবর্তনের চিহ্ন।
তথ্য সূত্রঃ- ছবি গুলো সংগ্রহ করা গুগল থেকে। প্রত্যেকটা তথ্য সংগ্রহ করা ইন্টারনেট থেকে, তবে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ন গুলো হলো-http://nidorsonbd.blogspot.com; http://www.bigganprojukti.com; http://www.mujibsenanews.com ইত্যাদী।