১৯ শে ফেব্রুয়ারী ২০১২। অফিস থেকে ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে ট্রেনে করে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফিরছি। অবশ্য এই অসময়ে আমার কিছুতেই বাড়িতে ফেরার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য যেভাবে চাপাচাপি শুরু করেছে তাতে, বিয়ে বুঝি এবার আমাকে করতেই হয়! বেশ কয়েক বছর যাবত নানান ছল ছুতো করে বাড়ির লোকদেরকে ম্যানেজ করে আসলেও, এবার হয়তো সেটা আর সম্ভব হবে না। কারণ ইতোমধ্যে বয়স প্রায় বিপদ সীমার কাছাকাছি চলে এসেছে তাছাড়া মাথার চুলের যা অবস্থা। এরপর যদি বিয়ে করতে চাই, তাহলে মেয়ের বাবাই আমার বেল মাথা দেখে হয়তো ভয়ে আঁতকে উঠে বলবে- 'নারে বাবা; দরকার নেই আমার এমন জামাইয়ের!' সুতরাং বাড়ির লোকদের এখন একটাই কথা, 'যদি থাকে কাজ, তো সকাল করে সাঁজ'!
আমার বাড়ির লোকজন তুলনামূলক ভাবে অন্যদের থেকে একটু বেশি এ্যাডভ্যান্স। এটা বললাম এই জন্য কারণ মাঝে-মাঝে তাদের কার্যকলাপ গুলো আমাকে এতটাই অবাক করে যে এটা বলতে আমি বাধ্য। খবর পেয়েছি তারা নাকি ইতোমধ্যে মেয়ে-টেয়ে দেখে সব পছন্দ করে বিয়ে এক প্রকার ফাইনাল করে রেখেছে। পাত্রির মা-বাবাও নাকি খাপে খাপ। এখন শুধু আমি যেয়ে মত দিলেই হয়! তাই ট্রেনে বসে বসে আমি নিজের আগামী জীবনের পরিণতির কথা ভাবছি আর চিন্তা করছি, 'এবার বুঝি আমার জীবনে স্বাধীনতার বারটা বাজবে......?'
ট্রেনটি খুলনা পৌঁছানোর কথা বিকাল পাঁচটায়। কিন্তু যাচ্ছি যাবো করে অবশেষে রাত সাড়ে আটটায় সে খুলনা রেল স্টেশনে পৌঁছালো। তড়িঘড়ি করে ট্রেন থেকে নেমে একটা ইজি বাইক নিয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটলাম খুলনা বাস টার্মিনাল। কপাল গুণে শেষ বাসটা যদি পেয়ে যাই সেই আশায়। ভাগ্য মোটামুটি সুপ্রসন্ন। কারণ বাস একটা আছে, তবে তাতে বসার যায়গা দূরে থাক দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। ভেতরে, বাইরে এবং ছাদে তার সর্বাঙ্গে মানুষ কিলবিল করছে। আমিও কাউন্টার থেকে একটা টিকিট কেটে সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে টুপ করে বাসের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। যতটা না নিজের চেষ্টায় তার থেকে বেশি মানুষের ধাক্কায়। কিন্তু এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বাস তবুও ছাড়ে না। আরো লোক উঠায়। অবশেষে রাত সাড়ে ন'টায় ছাড়লো মুড়ির টিন মার্কা সেই বাসটি। এবং সম্ভবত গাধার মত দুলকি চালেই সে এগুতে থাকে তার গন্তব্যস্থলের দিকে।
ভিড়ের ঠেলায় নিজের হাতের ঘড়িতে সময়টাও পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিনা। তবে আনুমানিক রাত দশটা বিশ-ত্রিশ এমন হবে। আশেপাশের নাগরিক কোলাহল একটু কমে এলে বুঝতে পারি যে শহর এলাকা পার হয়ে এলাম। আরও প্রায় ঘন্টাদেড়েক চলার পর ২/৪ জন করে লোক নামতে শুরু করে। ফলে কিছুক্ষন পর, আঙ্গুলের পরিবর্তে পায়ের পাতার উপরে দাঁড়াতে পারি। আর একটু পরে অবাক কান্ড, বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম! যাক বাবা, এতক্ষন পর বাইরের পৃথিবীটাকে একটু দেখতে পাচ্ছি!
সাতক্ষীরা পলিটেকনিক কলেজ। প্রায় অর্ধেক পথ এলাম। আরও ঘন্টা খানেকের পথ বাকি। মনে মনে বাড়ির লোকদের উপর ভীষন রাগ হচ্ছিল। কি দরকার এই শীতে বিয়ে করার? তার চেয়ে বিয়ে না করলেই তো হতো? কি হয় বিয়ে না করলে? হঠাৎ একটা প্রচন্ড ধাক্কায় সম্ভিত ফিরে পেলাম। কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে বাসটি যে আর চলছে না সেটা ঠিকই বুঝতে পারছি। একবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে, কিছুক্ষন পর তা আবার চালু হলো। স্ট্রাট হওয়ার সময় ইঞ্জিনের শব্দটা আমার কাছে খুব একটা সুবিধার বলে মনে হলো না। নিশ্চই কোন গন্ডগোল হয়েছে! এবং হলোও ঠিক তাই। ইঞ্জিনটি বেশ কয়েকবার খক খক করে গলা পরিষ্কারের চেষ্টা করে সেই যে হাল ছেড়ে দিল তার আর ঠিক হওয়ার নামটি নেই। ড্রাইভারকে কারণটা জিজ্ঞাসা করতেই উনি যা উত্তর দিলেন তার ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যে, 'ইঞ্জিনে কি একটা সমস্য হয়েছে, তবে সে সারাবার চেষ্টা করছে। এবং তার হেল্পার কে পাঠিয়েছে শান্তির হাট। সেখান থেকে মেকানিক নিয়ে আসবে।'
এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে, কত দূরে সেই শান্তির হাট? আর এত রাতে কোথায় পাবে মেকানিক? আমাদের সুখ-শান্তি কি আর ফিরে আসবে তা আল্লাহই মালুম!
এই ফাঁকে জমে যাওয়া হাত-পা গুলোকে একটু সোজা করে নেওয়ার জন্য ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে আমিও সবার সাথে রাস্তায় নেমে পড়ি। জোৎস্না রাত, সমস্থ আকাশ জুড়ে কোটি কোটি তাঁরার মেলা। যা মনের আকাশে স্মৃতির এ্যালবাম মেলে ধরে। সেই স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমি কতটা পথ হেঁটে এসেছি ঠিক খেয়ালই করিনি। হঠাৎ একটা গাড়ির হেড লাইটের তীব্র আলোয় আমার দীর্ঘ ছায়া পড়ে সামনের রাস্তায়। কি ভেবে হাত তুলে গাড়িটাকে থামার ইঙ্গিত দিই। ভেবেছিলাম সম্ভাবত আমাদের বাসটা ঠিক হয়ে গেছে এবং আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এতো দেখছি বাস নয়। বেশ পুরানো মডেলের একটি ফ্যামিলি কার। আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘ্যাচ করে থেমে যায় গাড়িটা। জানালার কাঁচ নামিয়ে চালক তার অস্বাভাবিক ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করেন- 'কি ব্যাপার?'
দুই শব্দের এই ছোট্ট বাক্যতেই বুঝতে পারি যে, মামুলী ড্রাইভার তিনি নন। সম্ভাবত গাড়ির মালিক হবেন। নিজের এই বোকামীর জন্য প্রথমে একটু বিব্রত হলেও পরক্ষনে সেটা সামলে নিয়ে আমিও যতটা সম্ভব অনুনয়ের সুরে বলে ফেলি- 'দয়াকরে একটা লিফট দেবেন?' কথাটা বললেও লিফট যে পাবো সে রকম কোন আশা আমার ছিল না। কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে অবাক করে দিয়ে বাম হাত দিয়ে দরজাটা মেলে ধরে বললেন- 'উঠুন'!
আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে টুপ করে বসে পড়ি। উঠার সময় আঁড় চোখে লক্ষ করি, পেছনের ছিটে একজন ভদ্রোমহিলা দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন।
গাড়িতে উঠেই কিসের জানি একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম! কিন্তু গন্ধটা যে কিসের সেটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। কিছুক্ষন পর অবশ্য গন্ধটাকে চিনতে পারি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ঘরের ভিতরে এক ধরনের গন্ধ হয়, এটাও ঠিক তেমন একটা গন্ধ। গাড়ির কাঁচ গুলো বন্ধ থাকার পরেও শীতটা যেন বাইরের থেকে ভিতরেই বেশি! কিন্তু কেন? বুঝতে পারছি না! পরিবেশটাকে সহনীয় করে তোলার জন্য ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম- 'আপনি কি শ্যামনগরের কোথাও থাকেন?'
উত্তরে তিনি তার পরিচয় দিলেন। 'আবিদ হাসান, সুন্দরবন ৩৯ রাইফেলস ব্যাটেলিয়নের সিনিয়র অফিসার পোস্টে চাকুরি করেন'। আমিও আমার পরিচয় দিই। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভিতরে-ভিতরে বেশ তোলপাড় করতে থাকে। সেটা হলো, ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা আমার কাছে বেশ পরিচিত বলে মনে হচ্ছে, অথচ কোথায় কিভাবে পরিচয় তা কিছুতেই ধরতে পারছি না? বন্ধুদের কাছে নিজের একটা প্রশংসা প্রায়ই শুনতাম যে, কোন মানুষের চেহারা একবার দেখলে নাকি তা আর সহজে ভুলি না। অবশ্য বন্ধুরা হয়তো কিছুটা বাড়িয়ে বলতো। কিন্তু তাই বলে এতে একটুও কি সত্যি নেই? অথচ এই আবিদ সাহেবের সাথে আমার কখন, কোথায় এবং কিভাবে পরিচয় তা মনের মধ্যে আঁতি-পাতি করে খুঁজেও স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারলাম না! পরিচয় যে হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই! কারণ তিনি নিজের সম্পর্কে যতটুকু বলেছেন, তার থেকে অনেক বেশি আমি জানি। এই যেমন, 'তিনি ৩৯ রাইফেলস ব্যাটেলিয়নের চীফ হিসাবে ওখানে আছেন প্রায় সাড়ে তিন বছর যাবত। তিনি চাকরিতে জয়েন্ট করেন ১৯৯৭ সালে। বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। উনার দুইজন ছেলে-মেয়ে আছে ইত্যাদী।' তার চেহারা ভাল করে দেখলেও হয়তো চিনতে পারবো। কিন্তু এই মূহুর্ত্বে গাড়ির ভিতরের আবছা আলো আঁধারিতে তার চেহারা সঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
আমার ভাবনার ছেদ পড়ে গাড়ির চাকার আকস্মিক শব্দ পরিবর্তনে। বুঝতে পারছি কালিগঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছি। গাজীরহাট পার হয়ে দূর্ভেদ্য কুয়াশার জন্য দুই হাত দূরে কিছুই ভাল মত দেখা যাচ্ছে না। হেড লাইটের তীব্র আলো যেন ইস্পাতের দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছে। অথচ আমাদের চালক গাড়ির গতি একটুও না কমিয়ে নির্বাক চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কারন স্প্রীডো মিটারের কাঁটা তখন ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটারের মধ্যে উঠা-নামা করছে। মনে মনে ভাবি, ভদ্রলোক জেগে আছেন তো? পরীক্ষা করার জন্য বলি- 'এ বছর বেশ শীত পড়ছে তাই না?
উত্তরে আবিদ সাহেব বললেন- 'না, আমার মনে হয় গত বছর এর থেকে বেশি শীত পড়েছিল! আপনার হয়তো মনে নেই?'
আমি ওনার কথার প্রতিবাদ করে বসি- 'আমার কাছে কিন্তু তেমন টা মনে হয় না? কারন গত বছরতো আমি এখানেই ছিলাম, কৈ শীত তো খুব একটা অনুভূত হয়নি? আপনি নিশ্চই এর আগের বছরের কথা বলতে চাচ্ছেন?'
আমার কথা শুনে আবিদ সাহেব অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন- 'জ্বি না, আমি গত বছরের কথাই বলতে চাচ্ছি!'
তার কন্ঠে কি যেন রয়েছে, আমি ঠিক ধরতে পারছি না! তবে তার এই কথার প্রতিবাদ করার মত উৎসাহ বা সাহস অথবা দু'টোই আমি হারিয়ে ফেলি। রাস্তায় কুয়াশা কোথাও একটু কম, আবার কোথাও একটু বেশি। কুয়াশার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে দেখার চেষ্টা করি যে কতদূর এলাম। কখন যে মৌতলা টার্মিনাল ছাড়িয়ে এলাম তা বুঝতেই পারলাম না।
পথের এই দিকটাতে কুয়াশার পরিমাণটা যেন আরও বেশি। যেন কুয়াশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। সামনের দিকে প্রাণপনে তাকিয়ে আছি রাস্তার একটু আভাস দেখার জন্য। মাঝে-মাঝে একটু আধটু যে দেখা যাচ্ছে না তা বলবো না, তবে কোন কিছুই ঠিক-ঠাক মত পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে না। সময়ের আন্দাজে মনে হচ্ছে 'শ্যামনগর মেঘনা তেল পাম্প'-এর কাছে এসে পড়েছি। হঠাৎ কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই কুয়াশা ফুঁড়ে ঝাঁ করে কিছু একটা বেরিয়ে গেল। চিৎকার দেওয়ার জন্য মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু তার আগেই প্রচন্ড বেগে আছড়ে পড়লাম গাড়ির 'উইন্ডো শিল্ডের' উপর। গাড়িটি শুন্যে কয়েকটি পাঁক দিয়ে রাস্তার পাশে আছড়ে পড়লো। আমার চোখের সামনে যেন অশংখ্য তাঁরকা রাজি ফ্লাড লাইটের মত জ্বলছে আর নিভছে। আশ-পাশ থেকে প্রচুর মানুষের হট্টোগোল আর চিৎকার চেচামেচির শব্দ কানে ভেসে আসছে। কিন্তু আমি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছি না। এক সময় সব শব্দ, সব আলো যেন নিকষ অন্ধকারে বিলিন হয়ে গেল!
জ্ঞান ফিরলো সকাল বেলা। আর জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে আমি এখন হাসপাতালে আছি। আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি আম্মু বেডের পাশে বসে আছে, আর ঘন ঘন কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট ভাই। ওর চোখেও পানি ছলছল করছে। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে বললেন- 'এইতো জ্ঞান ফিরেছে দেখছি! তো কেমন লাগছে এখন?'
আমি শুকনো এবং ভারী জিভটা নাড়িয়ে অনেক কষ্টে কোন রকমে বললাম- 'ভালই'!
নার্স হয়তো আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম- 'গাড়ি চালাচ্ছিলেন উনি কেমন আছেন? উনার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ওরা? সবাই ভাল আছেন তো?'
আমার কথা শুনে নার্স একটু অবাক হয়ে বললেন- 'আপনি গাড়িতে আসছিলেন নাকি? কিন্তু আপনাকে যারা হাসপাতালো নিয়ে এসেছিল তারা তো বলল আপনি রাস্তার পাশে খাদে পড়েছিলেন? গাড়ি বা অন্য কারো কথা তো তারা কিছুই বলেনি?'
নার্সের কথা শুনেতো এবার আমার অবাক হওয়ার পালা! ভাবছি, 'একটা গাড়ি প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে কোন কিছুতে ধাক্কা খেলো এবং বড় ধরনের একটা এ্যাক্সিডেন্টও হলো, কিন্তু তারপরেও ওটার কিছুই হলো না!? অথচ ভদ্রলোক আমার প্রতি সামান্যতম করুনাও বোধ করলেন না? অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে চলে গেলেন? কথা বার্তায় কিন্তু তাকে মোটেও এরকমটা মনে হয়নি?'
ঠিক এই সময়ে রুমে ঢুকলো আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু সুজন, তার স্বভাব সুলভ হৈহৈ করতে করতে। আর ঢুকেই বলল- 'আরে দোস্ত তোর এই অবস্থা? কি করে হলো বলতো? নিশ্চই হাইজ্যাকাররা ধরেছিল, তাই না?
আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ ওর মেশিন গানের বুলি গুলো শেষ হবার সময় দিয়ে শান্ত এবং ধীর কন্ঠে বলি- 'নারে দোস্ত, ওসব কিছু না! গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট।'
-গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট(!)? তার মানে বাস দূর্ঘটনা? কিন্তু গাড়িতে কি তুই একাই ছিলি? তা না হলে তুই একাই রাস্তার পাশে পড়ে থাকলি কেন?
আমি তার অসংখ্য প্রশ্ন বানের ফাঁকে বিস্তারিত ঘটনাটা ওকে খুলে বলি এবং ওকে অনুরোধ করি- 'দোস্ত, তোর তো বিজিবি/ফরেষ্টারদের সাথে বেশ জানা শোনা আছে? একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতো ভদ্রলোক ঠিক-ঠাক মত পৌঁছেছেন কিনা?'
সুজন আমার কাছে ভদ্রলোকের নাম জানতে চাইলো? আমি 'আবিদ হাসান' উচ্চারন করতেই সে এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো যেন, একটা বড়-সড় আস্ত হতিকে সে আকাশে উড়তে দেখছে! অবশেষে সুজন ওর স্বভাব ফিরে পেয়ে আমাকে বিদ্রুপ করে বলল- 'আরে গাধা, তুই বলিস কি? এত তাড়াতাড়ি ভুলেই বা গেলি কি করে? তোর স্মৃতি শক্তি নিয়েতো আমাদের মধ্যে একটা অন্যরকম ধারনা ছিল! গত বছর এই সময়ই তো, হ্যা ১৯ শে ফেব্রুয়ারী রাতে গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করে স্ব-পরিবারে মারা গেলেন না ভদ্রলোক? আন্ত্রজাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন পত্রিকায় ছবিসহ খবরটা বের হয়েছিল? এই যাহঃ.....! গত কালই তো ছিল ১৯ শে ফেব্রুয়ারী!
সুজনের শেষ উচ্চারিত কথাটা শুনে আমার শির দাঁড়ার ভিতর দিয়ে একটা স্বরীসৃপ যেন কিলবিলিয়ে চলে গেল! সেই সাথে কাল রাতের সব অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর গুলো মনের মধ্যে এসে ভিড় করতে লাগলো। সম্ভিত ফিরে পেয়ে আমি আবারও সুজনকে জিজ্ঞাসা করি- 'আচ্ছা, আমাকে ঠিক কোন জায়গাটা থেকে হাসপাতালে আনা হয়েছে তুই কি বলতে পারিস?'
সুজন বলল- 'হ্যা পারি! তেল পাম্পের একটু পূর্বে, যেখানে মূল রাস্তাটা একটা কাঁচা রাস্তার সাথে মিলে একটু ত্রিকোনের আকৃতি নিয়েছে; তারই দুই শাখার মাঝের ডোবা থেকে। অথ্যাৎ ঠিক এক বছর আগে যেখানে আবিদ সাহেবের গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করেছিল ঠিক সেখান থেকে। আর সেখান থেকে তোকে কয়েকজন লোক উদ্ধার করে হাসপাতালাতে নিয়ে আসে এবং চিনতে পেরে তারা তোদের বাসায় এবং আমার অফিসে খবর দেয়।'
সুজনের কথার দিকে এখন আর আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার মনে মধ্যে এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তাটা ব্রেনে ঢোকার সাথে সাথে, মাথার মধ্যে সব কিছুই যেন তালগোল পাঁকিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভেবেও আমি কিছুতেই তার সমাধান করে উঠতে পারছি না.......!
ভাবছি, এটাও কি সম্ভব? আমাদের বাস নষ্ট হয়ে গেল পলিটেকনিক্যাল কলেজের কাছে। আমাকে পাওয়া গেল তেল পাম্পের পূর্বে! আর আবিদ হাসান সাহেব যদি এক বছর আগে মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে এই ৪৫ কিলোমিটার রাস্তার লিফট দিল কে............?
.....................................সমাপ্ত.....................................
বিঃ দ্রঃ- এই গল্পের বিষয়বস্তু সহ যাবতিয় চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক। যদি কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে যায়, তাহলে সেটা একান্তই কাকতালীয় মাত্র। সেজন্য লেখক কোন অংশেই দ্বায়ী থাকবে না। তাছাড়া টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৩৯