somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিচারঃ- পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় এবং জগৎ বিখ্যাত কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র 'শার্লক হোমস্'-এর সাতকাহন। শার্লক হোমস্ সিরিজের পর্যালোচনা এবং উক্ত বিষয় সম্পর্কে অনেক জানা/অজানা মজার তথ্য!

০৭ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কজন গোয়েন্দা ভক্ত পাঠক, অথচ শার্লক হোমসে্র নাম শোনেননি; পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধ হয় সম্ভব না! শার্লক হোমস্ যে একটা কাল্পনিক চরিত্র ( বাংলা সাহিত্যের- ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরিটি, জয়ন্ত বা বিমল-এর মত), তা অবশ্য সবারই জানা। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র হিসাবে অনেক সাহিত্যিকরাই শার্লক হোমস্ কে এক নাম্বারে নির্বাচন করেছেন। বিখ্যাত লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলেরই একটি অমর সৃষ্টি হলো এই 'শার্লক হোমস্!'

একজন গোয়েন্দা ভক্ত পাঠককে যদি পৃথিবীর মধ্যে আজ অবধি সৃষ্টি সকল কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর নাম উল্লেখ করতে বলা হয়, এবং তার মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ট ব্যক্তিটাকে বাছাই করে নিতে বলা হয়, তাহলে আমার মনে হয় যে কোন পাঠকই কোন ধরনের দ্বিধা ছাড়াই অনায়াসে শার্লক হোমসকেই বেছে নেবেন। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এতটাই জনপ্রিয় একজন কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র যে, আজ অবধি লন্ডনের '২২১/বি-বেকার ষ্ট্রীটের' ঠিকানায় তার নামে বিভিন্ন ধরনের খোলা চিঠি আসে। এমনকি আমাদের আশে পাশেই এমন অনেক শার্লক ভক্ত পাঠক আছেন যারা এই চরিত্রটিকে ঠিক কাল্পনিক চরিত্র বলতে নারাজ। তাদের ধারনা অবশ্যই ১৮৮৭ সালে শার্লক হোমস্ বলতে লন্ডনে একজন মানুষ ছিলেন, যিনি বসবাস করতেন লন্ডনেরই একটি ছোট্ট শহর, বেকার ষ্ট্রীটে।

কিন্তু আমরা কেউ কি জানি, আসলে তার সৃষ্টির ইতিহাস কি? আর কেমন মানুষই বা ছিলেন তিনি? কিংবা সত্যিই কি শার্লক হোমস্ একটি কাল্পনিক চরিত্র (?) নাকি বাস্তবেও শার্লক হোমস্ নামে কেউ ছিল? অথবা পৃথিবীতে তার এই তুমুল জনপ্রিয়তার কারণই বা কি? আসুন আজ একের পর এক শার্লক হোমস্ সম্পর্কে সেই সমস্ত অজানা মজার তথ্যগুলো জেনে নিই। তবে এই যুগ শ্রেষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রটির সম্পর্কে জানার আগে তার শ্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সম্পর্কে একটু জেনে নিই...........!!


লেখক পরিচিতিঃ- স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, জন্ম-১৮৫৯ সালের ২২ শে মে, এডিনবারা, স্কটল্যান্ডে। তার পুরো নাম 'আর্থার ইগনেসিয়াস কোনান ডয়েল'। একজন মানুষ যে কত রকম প্রতিভার মালিক হতে পারেন সেটা কোনান ডয়েলকে না দেখলে বোঝা যায় না। তিনি একাধারে ছিলেন একজন আত্মিকবাদী, ইতিহাসজ্ঞ, তিমি শিকারী, ক্রীড়াবিদ, যুদ্ধ-সাংবাদিক, ডাক্তার, কবি, ঔপন্যাসিক এবং সর্বপরি একজন ছোট গল্পকার। যদিও তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার, কিন্তু ডাক্তারি পেশায় তিনি খুব একটা খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। জীবনের প্রথমভাগে, তিনি এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেষজবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং পড়াশুনা শেষ করে তিনি লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ভেষজ-ব্যবসায় গা-ছাড়া ভাবের কারণে তাঁর হাতে থাকত বিস্তর অবসর। আর এই অবসরের সুযোগে তিনি লিখতে শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় গল্প এবং কল্প-কাহিনী। প্রথম প্রথম তিনি অনেক গল্প, কল্প-কাহিনী এবং ইতিহাস-কেন্দ্রিক রোমাঞ্চ কাহিনী লিখলেও এগুলোতে তার ঠিক মন বসতো না। যার ফলে পরবর্তিতে এর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে কল্পিত গোয়েন্দা চরিত্র "শার্লক হোমস্" কে নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন একের পর এক দূধ্বর্ষ আর রোমহর্ষক রোমাঞ্চে ভরা সব কাহিনী।


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র ছিল এই শার্লক হোমস (Sherlock Holmes)। ১৮৮৭ সালে (Beeton's Christmas Annual) বীটনে বড়দিনের বার্ষিকীতে সর্বপ্রথম শার্লক হোমসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর্থার কোনান ডয়েলের সেই গল্পের নাম ছিল-A Tangled Skin। এই গল্পটাতে তিনি যে গোয়েন্দা চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন 'শেরিনফোর্ড হোমস' নামে, এবং উনার বয়স লেখা হয়-৩৩ বছর। কিন্তু এই গোয়েন্দা চরিত্রটিকে তার ঠিক মনঃপূত না হওয়ায় পরবর্তিতে সেটার নাম পরিবর্তন করে তিনি একটা নতুন নাম রাখেন। আর সেই নতুন নামের গোয়েন্দা চরিত্রটিই ছিল আমাদের সকলের প্রিয়, বিখ্যাত গোয়েন্দা 'শার্লক হোমস্'। এবং পরে উপন্যাসটিরও নাম বদলে নতুন নামকরণ করেন-( A Study in Scarlet-'রক্তসমীক্ষা' ) নামে।


শার্লক হোমস্'কে নিয়ে লেখা গল্পের পান্ডুলিপি।

তখন অবশ্য কেউ সেটাকে খুব একটা আমল দেয়নি। কিন্তু ১৮৯০ সাল থেকে বিখ্যাত স্ট্রান্ড ম্যাগাজিনে বের হতে লাগলো হোমস-ওয়াটসন জুটির অবাস্তব সব কান্ড কারখানা। ব্যাস, আর দেখে কে! অচিরেই বিশ্ব সাহিত্যের হল অব ফ্রেমে জায়গা করে নিলো ওরা। ১৮৯০ সালে ( The Sign of Four-চিহ্নচতুষ্টয় ) প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক সমাজে এর চাহিদা অনুভব করে, তিনি ভেষজ-ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং লেখা-লেখিতে পুরোমাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন।


শার্লক হোমস্ কে নিয়ে লেখা লেখকের বই সমূহঃ- বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র 'শার্লক হোমস্'কে নিয়ে তিনি সর্বমোট '০৪ টি উপন্যাস সহ প্রায় ৫৬ টি ছোট-বড় গল্প' লেখেন। যার সব গুলোই ছিল রহস্য রোমাঞ্চে ভরা এক একটা জঠিল কেস্। আর সেই সব কেস্ গুলোকে খুবই সুন্দর ভাবে সমাধান করে দিয়ে যেমন আজও শার্লক হোমস আমাদের হৃদয়ের মাঝখানে জায়গা করে বসে আছে। ঠিক তেমনি ভাবে সেই শার্লক হোমসের শ্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও আমাদের সকলের কাছে বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আজও চির অম্লান হয়ে আছেন।


শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা লেখকের উপন্যাস ০৪ টি হলোঃ-
০১। আ স্টাডি ইন স্কারলেট (রক্ত সমীক্ষা),
০২। দ্য সাইন অব দি ফোর(চিহ্ন চতুষ্টয়),
০৩। দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস্ (বাস্কারভিল পরিবারের শিকারী কুকুর) এবং
০৪। দ্য ভ্যালি অব ফিয়ার (আতংকের উপত্যকা)।


এছাড়াও শার্লককে নিয়ে লেখা লেখকের সর্বমোট-৫৬ টি গল্প সমূহ যথাক্রমেঃ-


খণ্ড (১)- দ্য এডভেঞ্চার অব শার্লক হোমস (শার্লক হোমসের অভিযান):-
০১। এ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া (বোহেমিয়ায় কেলেঙ্কারি)
০২। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য রেড-হেডেড লীগ (রক্তকেশ সংঘ)
০৩। এ কেস অব আইডেন্টিটি (পরিচয় রহস্য)
০৪। দ্য বসকোম্ব ভ্যালি মিস্ট্রি (বসকোম্ব উপত্যকার রহস্য)
০৫। দ্য ফাইভ অরেঞ্জ পিপস্ (কমলালেবুর পাঁচটি বীচি)
০৬। দ্য ম্যান উইদ্ দ্য টুইস্টেড্ লিপ (টিয়া পাখির ঠোঁটটি লাল)
০৭। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ব্লু কারবাঙ্কল (নীল পদ্মরাগ)
০৮। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য স্পেকলড্ ব্যান্ড (ডোরাকাটা ফিতে)
০৯। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ইঞ্জিনিয়ার'স থাম্ব (যন্ত্রবিদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ)
১০। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য নোবেল ব্যাচেলর (সম্ভ্রান্ত কুমার)
১১। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য বেরিল করোনেট (মরকত-মুকুট)
১২। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য কপার বীচেস


খণ্ড (২)- দ্য মেমোয়ার্স অব শার্লক হোমস (শার্লক হোমসের স্মৃতিকথা):-
১৩। সিলভার ব্লেজ
১৪। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য কার্ডবোর্ড বক্স (কার্ডবোর্ড-বাক্সের বিচিত্র ঘটনা)
১৫। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ইয়েলো ফেস (হল্দে মুখ)
১৬। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য স্টকব্রোকার'স ক্লার্ক (শেয়ার-দালালের কেরাণী)
১৭। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য গ্লোরিয়া স্কট
১৮। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল (মাসগ্রেভ তন্ত্র)
১৯। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য রেইগেট স্কয়ার (রেইগেটের জমিদারবাবুরা)
২০। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ক্রুকড্ ম্যান (অষ্টাবক্র মানুষটি)
২১। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য রেসিডেন্ট প্যাসেন্ট (আবাসিক রোগী)
২২। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য গ্রীক ইন্টারপ্রিটার (গ্রীক ভাষান্তরিক)
২৩। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ন্যাভাল ট্রিটি (নৌ-চুক্তি)
২৪। দ্য ফাইনাল প্রবলেম (শেষ সমস্যা)


খণ্ড (৩)- দ্য রিটার্ন অব শার্লক হোমস (শার্লক হোমস ফিরে এলো):-
২৫। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য এম্পটি হাউস (খালি বাড়ি)
২৬। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য নরউড বিল্ডার (নরউডের স্থপতির রহস্য)
২৭। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ড্যানসিং ম্যান (নাচুনে মানুষ)
২৮। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট (নিঃসঙ্গ সাইকেল আরোহী)
২৯। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য প্রায়োরি স্কুল (মঠ-বিদ্যালয়)
৩০। দ্য এডভেঞ্চার অব ব্ল্যাক পিটার (কালো পিটার)
৩১। দ্য এডভেঞ্চার অব চার্লস্ অগাস্টাস মিলভাটর্ন
৩২। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য সিক্স নেপোলিয়ানস্ (ছয় নেপোলিয়ন)
৩৩। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য থ্রী স্টুডেন্টস (তিন বিদ্যার্থী)
৩৪। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য গোল্ডেন পিন্স-নেজ (সোনার চশ্মা)
৩৫। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য মিসিং থ্রী-কোয়ার্টার (থ্রী-কোয়ার্টার নিরুদ্দেশ)
৩৬। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য অ্যাবি গ্রেঞ্জ (মঠ কৃষিশালা)
৩৭। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য সেকেন্ড স্টেইন্ (দ্বিতীয় দাগ)


খণ্ড (৪)- হিজ লাস্ট বাউ (তার শেষ অভিবাদন):-

৩৮। দ্য এডভেঞ্চার অব উইস্টেরিয়া লজ (উইস্টেরিয়া লজ-এর বিচিত্র ঘটনা)
৩৯। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য রেড সার্কেল (লাল বৃত্তের বিচিত্র ঘটনা)
৪০। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যানস্ (ব্রুস-পার্টিংটন নক্সার বিচিত্র ঘটনা)
৪১। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ডাইয়িং ডিটেক্টিভ (মুমূর্ষু গোয়েন্দার বিচিত্র ঘটনা)
৪২। দ্য ডিসাপিয়ারেন্স অব লেডি ফ্রান্সেস কারফ্যাক্স ( লেডি ফ্রান্সেস কারফ্যাক্সের অন্তর্ধান)
৪৩। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ডেভিল'স ফুট (দানব-পদের বিচিত্র ঘটনা)
৪৪। হিজ লাস্ট বাউ (তার শেষ অভিবাদন)


খণ্ড (৫)- দ্য কেস-বুক অব শার্লক হোমস (শার্লক হোমসের ঘটনা-পঞ্জী):-
৪৫। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ম্যাজারিন স্টোন (ম্যাজারিন রত্ন-মণির রহস্য)
৪৬। দ্য প্রবলেম অব থর ব্রীজ (থর সেতুর সমস্যা)
৪৭। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ক্রিপিং ম্যান (অথ অধ্যাপক রহস্য)
৪৮। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য সাসেক্স ভ্যাম্পায়ার (সাসেক্সের রক্তচোষা)
৪৯। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য থ্রী গ্যারিডেবস্ (তিন গ্যারিডেব)
৫০। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ইলাস্ট্রিয়াস ক্লায়েন্ট (প্রখ্যাত মক্কেলের বিচিত্র ঘটনা)
৫১। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য থ্রী গ্যাবলস্
৫২। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ব্ল্যাঞ্চেড সোলজার (সাদা-মুখ সৈনিক)
৫৩। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য লায়ন'স মেন (সিংহের কেশর)
৫৪। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য রিটায়ার্ড কালারম্যান (রঙের গন্ধ)
৫৫। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য ভেইলড্ লজার (ঘোমটা রহস্য)
৫৬। দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য সসকোম্ব ওল্ড প্লেস।


কোনান ডয়েলের ভাষায়, 'এডগার এলেন পোই, জুলিস ভেরনি, রবার্ট লুইস স্টিভেনসন'দের মত বিখ্যাত লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই নাকি তিনি মূলত লেখা-লেখি করার উৎসাহ পান! শার্লক হোমস্ ছাড়াও "প্রফেসর চ্যালেঞ্জার" নামে উনার আরও একটি বিখ্যাত চরিত্র আছে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে এই বিখ্যাত চরিত্র 'শার্লক হোম্স'কে নিয়ে লেখা গোয়েন্দা-কাহিনীগুলিই মূলত তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। শোনা যায় কোনান ডয়েল নকি দু'বার ব্রিটেনে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন! যদিও তিনি দু'বারই হেরেছিলেন, তবে প্রতিবারই তিনি মোটামুটি ভালো-ই ভোট পেয়েছিলেন।


কোনান ডয়েল সম্পর্কে কিছু মজার ঘটনাঃ- স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে অনেক মজার ঘটনা প্রচলিত আছে, যার অনেক গুলোই আমরা কম-বেশি অনেকেই জানি। কোনান ডয়েলের জীবনিতে পাওয়া যায়, বাস্তব জীবনে তিনি দু-দুবার গোয়েন্দাগিরি করে অন্যায়ভাবে দোষী-সাব্যস্ত ব্যক্তিদের নির্দোষ প্রমাণ করতে সফল হন! আর উক্ত কেসে তিনি উন্মোচন করেছিলেন দুটি সত্যিকার রহস্য। বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দু'জন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে। প্রথম রহস্যটিতে ভুক্তভোগী ছিলেন 'জর্জ এডালজি' নামের এক ভদ্রলোক। আরেকটিতে ভুক্তভোগী ছিলেন 'অস্কার স্ল্যাটার' নামের একজন ব্যক্তি।

জর্জ এডালজির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি ছিল পশু নির্যাতনের। পরে কোনান ডয়েল দেখালেন, এডালজির বিরুদ্ধে যে সব পশু নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব পশুদের নির্যাতন করার মতো শারীরিক শক্তি-ই নেই এডালজির। তাছাড়াও, তার বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও ঠিক না। জর্জ এডালজির ভাগ্য ভালো ছিল। কোনান ডয়েলের বদৌলতে তিনি বেঁচে যান। তবে অস্কার স্ল্যাটারের ভাগ্য ততটাও ভালো ছিল না। তার বিরুদ্ধে ছিল এক মহিলাকে খুন করার অভিযোগ। কোনান ডয়েল এখানেও দেখালেন, প্রমাণগুলো সবই ভুল। খুনের সময় ভিকটিম অন্যত্র ছিলেন। কিন্তু ততদিনে স্ল্যাটারের রায় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাড়ে ১৮ বছর কারাভোগের পর ছাড়া পান স্ল্যাটার।


এছাড়াও কোন এক সন্ধ্যায় প্যারিসের একটি ট্যাক্সিতে সবে চড়ে বসেছেন আর্থার কোনান ডয়েল। চালক মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- 'কোথায় যাবেন মিস্টার ডয়েল?' ডয়েল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- 'যতদূর মনে হয়, তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি? তাহলে কীভাবে চিনলে আমাকে?' মুচকি হেসে চালক বললেন- 'এটা তো জলের মতো সোজা! সকালের কাগজে দেখলাম আপনি মার্সেইতে এসেছেন ছুটি কাটাতে। যে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, মার্সেই ফেরত যাত্রীরা সেখান থেকেই ট্যাক্সিতে উঠেন। আপনার চামড়ার পোড়া দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কয়েকদিন ধরে আপনি বেশ ঘোরাঘুরির মধ্যে আছেন। আঙুলের কোণে লেগে থাকা কালি বলে দিচ্ছে আপনি একজন লেখক। তাছাড়া আপনার পোশাক-আশাকও ইংরেজদের মতো। সুতরাং সবমিলিয়ে আমি বের করে ফেললাম যে, আপনি আর্থার কোনান ডয়েল না হয়ে পারেন না!' এটুকু শুনে ডয়েল তো অভিভূত! বললেন- 'তুমি তো দেখি বুদ্ধিতে আমার শার্লক হোমসকেও ছাড়িয়ে গেছ!' শুনে চালক বললেন, 'অবশ্য আরো একটি ব্যাপার আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আপনার নাম। ওটা বড় বড় করে আপনার স্যুটকেসের সামনেই লেখা আছে!'


১৯০২ সালে তিনি ব্রিটেনের রানির কাছ থেকে সম্মানসূচক 'নাইট' উপাধি লাভ করতে পেয়েছিলেন। এই উপাধি পেলে নামের আগে সাধারণত ‘স্যার’বলা হয়। আর এই কারণেই নাইটহুড পেয়েছিলেন বলেই আমরা তাকে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল বলে ডাকি। অনেকের ধারণা তিনি নাইটহুড উপাধিটা লাভ করেছিলেন সম্ভাবত 'শার্লক হোমসের' জন্য। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসলে তিনি শার্লক হোমসের জন্য নাইটহুড পাননি। বরং নাইটহুড পেয়েছিলেন বোয়ের যুদ্ধের সময় দক্ষিণ আফ্রিকান এক মাঠ-চিকিৎসাকেন্দ্রে অবদান রাখার জন্য। অবশেষে আত্মিকবাদীএই বিখ্যাত রহস্য রোমাঞ্চ লেখক- ১৯৩০ সালের ৭ জুলাই, ৭১ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যের ইস্ট সাসেক্স, ক্রোবোরাফ শহরে মৃত্যুবরণ করেন।


বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস্ পরিচিতিঃ- শার্লক হোমস {(ইংরেজিঃ Sherlock Holmes, (ইংরেজি উচ্চারণঃ /ˈʃɜrlɒk ˈhoʊmz/ (বাংলা অর্থঃ অসমর্থিত টেমপ্লেট)} ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র। ১৮৮৭ সালে A Study in Scarlet 'রক্তসমীক্ষা' গল্পটার মাধ্যমে তিনি সর্ব প্রথম আবির্ভূত হন।শার্লক হোমস ছিলেন একজন উচ্চমেধাসম্পন্ন লন্ডন-ভিত্তিক "পরামর্শদাতা গোয়েন্দা"। তিনি তাঁর নির্ভুল যুক্তিসঙ্গত কার্যকারণ অনুধাবন, যে কোনো প্রকার ছদ্মবেশ ধারণ এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানে দক্ষতাবলে জটিল আইনি মামলার নিষ্পত্তি করে দেওয়ার জন্য তাঁর খ্যাতি ভুবনজোড়া। ডয়েলের শিক্ষক ডাক্তার জোসেফ বেল ছিলেন সত্যিকারের একজন অপরাধবিজ্ঞানী; যাঁর কাজ গুলো ডয়েলের অনুপ্রেরণা হিসেবে অসাধারণ কাজ করেছিলো। এ সম্পর্কে কোনান ডয়েলে নিজ মুখে বলেছিলেন যে, 'হোমসের চরিত্রটির অনুপ্রেরণা হলেন ডা. জোসেফ বেল।' যাঁর অধীনে এডিনবারা রয়্যাল ইনফার্মারিতে করণিক হিসেবে ডয়েল কাজ করতেন। হোমসের মতো বেলও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ থেকে বিরাট বিরাট সিদ্ধান্ত বের করতে পারতেন।


পুরো নাম 'উইলিয়াম শার্লক স্কট হোমস'। শার্লক হোমসের জন্ম- '১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার' বিকেল বেলায়। বাবা সাইগার হোমস আর মা ভায়োলেট শেরিন ফোর্ড। এছাড়াও তার একজন বড় ভাই ছিলেন। যার কাছে তিনি মাঝে মাঝে বুদ্ধি বা পরামর্শের জন্য যেতেন। তার নাম ছিল মাইক্রফট হোমস। বাবার যদিও ইচ্ছে ছিলো শার্লক বড় হয়ে হবেন ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু শার্লক হয়ে গেলেন বিশ্বের একমাত্র "কনসাল্টিং গোয়েন্দা"। তাঁর সঙ্গী এবং যোগ্য সহকারী বন্ধুবর লেখক ডাক্তার জন ওয়াটসন রহস্যোদঘাটনের চেষ্টা করেছেন কেন তিনি এই পেশায় এলেন। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। পরে অবশ্য একদিন শার্লক নিজের মুখেই বলেছেন সেকথা।

ডাঃ ওয়াটসনের দৃষ্টিতে শার্লক হোমসের জ্ঞানের পরিচয়ঃ-
০১। সাহিত্য জ্ঞান- শূণ্য!
০২। দর্শণ জ্ঞান- শূণ্য!
০৩। জ্যোতির্বিজ্ঞান- শূণ্য!
০৪। রাজনীতি জ্ঞান- নগণ্য!
০৫। উদ্ভিদ বিদ্যা জ্ঞান- বিবিধ! বেলেডোনা, আফিং আর বিষ বিজ্ঞানে তুখোড়। কিন্তু বাগান করার ব্যাপারে ডাহা আনাড়ি।
০৬। ভূ-তত্ত্ব জ্ঞান- যদিও বাস্তব জ্ঞান আছে, তবে সেটা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। রকমারি মাটির চেহারা দেখে সে অনায়াসে বলে দিতে পারে যে, কোনটা কী মাটি। এমনকি কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসার পর ট্রাউজার্সে লেগে থাকা মাটির দাগ দেখে সে বলে দিতে পারে, লন্ডন শহরের কোন জায়গা থেকে ঠিক এই মাটির দাগটা লেগেছে।
০৭। রসায়ন বিদ্যা জ্ঞান- সুগভীর।
০৮। শরীর বিদ্যা জ্ঞান- নির্ভূল, তবে সম্পূর্ণ পদ্ধতী বিহীন।
০৯। চাঞ্চল্যকর সাহিত্য জ্ঞান- প্রচুর। এমনকি সেই সময়কার সাহিত্যে যে সমস্থা চাঞ্চল্যকর কাহিনী ছিল সব যেন তার কণ্ঠস্থ।
১০। ভালো বেহালা বাজাতে পারতো।
১১। তরবারি খেলা, লাঠি আর মুষ্টিযুদ্ধে সে ছিল ওস্তাদ এবং
১২। ব্রিটিশ আইনের বাস্তব জ্ঞানে তার বেশ দখল আছে।


ডাঃ ওয়াটসনের ভাষায়, "লিস্টটা এই পর্যন্ত লেখার পর ভীষণ ভাবে হতাস হয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিলাম আগুণে। তারপর অনেকটা নিজের মনেই বললাম, এই জাতীয় জ্ঞানের ফিরিস্তির মাপকাঠি দিয়ে জীবনের লক্ষ্য আবিষ্কার করার চেষ্টাই সম্পূর্ণ পণ্ডশ্রম।"


ছেলেবেলা থেকেই শার্লক শিখে গিয়েছিলেন কী করে দুই চোখের ক্ষমতা দিয়ে, এক নজরেই দেখে ফেলা জিনিসের খুঁটিনাটি বের করে ফেলা যায়। ১৮ বছর বয়সে যখন তিনি অক্সফোর্ড কলেজে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের ছাত্র, তখন তিনি সম্পূর্ণ বন্ধুবান্ধবহীন হয়ে পড়েন। চেহারা তেমন একটা সুন্দর না হলেও তাঁর দিকে চোখ না ফিরিয়ে থাকা যেত না। কারণ তাঁর মধ্যে অন্যকে আকর্ষণ করার একটা অসাধারণ আকর্ষণীয় ক্ষমতা ছিলো। তবে দ্বিতীয় বছরেই ভিক্টর ট্রেভর নামে তার জীবনে এক বন্ধু জুটে গেলো। ভিক্টরও ছিল শার্লকের মতো নিঃসঙ্গ।


শার্লক হোমসের ব্যবহৃত ভিজিটিং কার্ড।

১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই বন্ধু ভিক্টর তাঁর বাবার সাথে শার্লককে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সাথে শার্লকের অসাধারণ বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথাটাও বললেন। এতে বৃদ্ধ ভিক্টর শার্লককে পরীক্ষা করার জন্য তিনি শার্লকে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে বললেন। কিন্তু শার্লক যা বললেন, তাতে বৃদ্ধের হাসি হাসি চেহারা নিমেষেই মলিন হয়ে গেলো। আর তার কপালে দেখা দিলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। এমনকি বৃদ্ধ ভদ্রলোক শার্লকের কথা সহ্য করতে না পেরে সাথে সাথে সেখানে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তারপর থেকেই শার্লক নিজেই নিজের মেধার পরিচয় পেয়ে যার পরনাই ভীষণ উচ্চসিত হয়ে ওঠেন। এবং সেই থেকেই শখের কাজটি শার্লক পেশা হিসেবেই নিয়ে নিলেন।


শার্লক হোমস্-এর ব্যক্তিগত শোয়ার ঘর।

শার্লক হোমস ছিলেন অবিবাহিত। জীবনে কখনো কারো সাথে প্রেমও করেননি, এমনকি কোন মেয়েকে সামান্যতম ভাল লাগা টুকুও তার জীবনে ছিল না। তবে 'এ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া' গল্পের নায়িকা 'আইরিন এ্যাডলার'কে তিনি একটু ভিন্ন নজরে দেখতেন। কিন্তু সেটা ঠিক প্রেম ছিল না। শার্লকের মতে, আইরিন এ্যাডলারের মত মেয়ে নাকি এই পৃথিবীতে খুব কমই জন্মায়। মেয়েটি এতটাই বুদ্ধিমতী ছিল যে, স্বয়ং শার্লক নিজে তার কাছে ঘোল খেয়ে যায়। আর শার্লকের জীবনে ঐ একমাত্র মেয়ে ছিল, যার ক্ষুরধার বুদ্ধির কাছে শেষ পর্যন্ত শার্লকও হেরে যায়। আর একারণেই শার্লক মেয়েটিকে অন্যান্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা নজরে দেখতেন। লন্ডনের যে ভাড়া বাড়িটিতে তিনি ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকতেন, তার ঠিকানা ছিলঃ '২২১/বি বেকার স্ট্রীট, লন্ডন'। বাড়ির গৃহকর্ত্রী ছিলেন মিসেস হাডসন। যদিও হোমসের সাথে তার পরিবারের খুব একটা যোগসূত্র ছিল না। কিন্তু তারপরেও তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন পরামর্শের জন্য বড়ভাই 'মাইক্রফটের' সাথে কদাচিৎ যোগাযোগ করতেন।


মিসেস হার্ডসনের সেই বিখ্যাত রেস্তোরা।

কোনান ডয়েল, ১৯২৭ সাল পর্যন্ত হোমসকে নিয়ে একগুচ্ছ ছোটোগল্পের সিরিজ ও আরও দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশ করেন। হোমস কাহিনীর পটভূমির সময়কাল ছিল '১৮৮০ থেকে ১৯০৭ সাল' পর্যন্ত। কিন্তু শেষ ঘটনাটির সময়কাল ছিল অবশ্য ১৯১৪ সাল। চারটি বাদে আর সব কটি কাহিনীই হোমসের বন্ধু তথা জীবনীকার ডা. জন ওয়াটসনের জবানিতেই লেখা। দুটি গল্প ("দ্য ব্লাঞ্চেড সোলজার্স" ও "দ্য লায়ন’স মেন") হোমসের নিজের জবানিতে এবং অন্য দুটি গল্প ("দ্য ম্যাজারিন স্টোন" ও "হিজ লাস্ট বো") তৃতীয় পুরুষে লেখা। দুটি গল্প আবার ("দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল" ও "দ্য "গ্লোরিয়া স্কট") হোমস ওয়াটসনকে নিজের স্মৃতি থেকে শুনিয়েছেন, এবং ওয়াটসন সেখানে কাহিনীর কাঠামোটিই শুধু মাত্র বর্ণনা করেছেন। প্রথম উপন্যাস অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট-এর মধ্যবর্তী অংশে হোমস ও ওয়াটসনের অজ্ঞাত ঘটনার দীর্ঘ বর্ণনা করা হয়েছে এক সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর জবানিতেই।


আর্থার কোনান ডয়েল ডাক্তারি পাশ করে প্লাইমাউথের সাউথ সী'র ১ নম্বর বুশ ভিলাতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ডাক্তারি করার পাশাপাশি শার্লক হোমস সিরিজের লেখায় হাত দেন। জুলাই ১৮৮১ সাল থেকে শুরু করে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত একটানা হোমস সিরিজ বের হলেও মজার ব্যাপার হল, এই শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখতে লিখতে কোনান ডয়েল একসময় খুবই বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে পড়েন। যেটা তিনি তার মাকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছিলেন। ১৮৯১ সালে কোনান ডয়েল সেই চিঠিতে তার মাকে লিখেছিলেন, "আমি হোমসকে খুন করানোর চিন্তা ভাবনা করছি.......। সে আমার মাথা থেকে অন্যান্য জিনিসগুলোকে বের করে দিচ্ছে।"


কোনান ডয়েলের মাও ছিলেন শার্লকের একজন একনিষ্ট ভক্ত। যার কারণে তিনি কোনানের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারেননি। এমনকি তিনি শার্লককে মেরে ফেলতে তার সন্তান কোনান ডয়েলকে অনেক নিষেধও করেছিলেন। কিন্তু ডয়েল অনেকটা নিজের প্রতি বিতশ্রুদ্ধ এবং এক ঘেয়েমী লেখার প্রতি খানিকটা বিরক্ত ও বোর হয়েই কোনান ডয়েল শার্লক হোমস কে মেরে ফেললেন, 'দ্যা ফাইনাল প্রবলেম' গল্পটিতে। যেখানে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন মরিয়ার্টি। তবে এই তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দার হঠাৎ এমন মৃত্যুকে তার ভক্ত সমাজ ঠিক সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। বরং শার্লকের আকস্মিক এই মৃত্যুতে পাঠক সমাজ কোনান ডয়েলের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এমনকি ভক্ত সমাজের একটাই মাত্র দাবি ছিল পূণরায় শার্লক হোমসকে জীবিত করে তুলতে হবে, অন্যথায় কোনান ডয়েলকে প্রাণ নাশের হুমকিও প্রদান করা হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতার এই দাবির মুখে কোনান ডয়েল অবশেষে 'দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য এম্পটি হাউস' গল্পটির মাধ্যমে তিনি হোমস চরিত্রটিকে আবারও অলৌকিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে বাধ্য হন।


শার্লক হোমস্ সিরিজের পর্যালোচনাঃ- কোনান ডয়েল যদিও শার্লক হোমস-এর গল্পকে নিজের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে মনে করতেন না, কিন্তু এটা তো ঠিক যে কোনান ডয়েলের বিশ্ব পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা এসেছিল ঐ শার্লক হোমস্-এর দৌলতেই। কোনান ডয়েলের বাবা, একাধিক জ্যাঠা এবং ঠাকুর্দা ছিলেন ওস্তাদ চিত্রশিল্পী। তিনি নিজে কিন্তু সে পথে গেলেন না। হলেন পুরো দস্তুর একজন ডাক্তার। যদিও খুব সহজে নয়; দারিদ্র্যের সঙ্গে যথেষ্ট লড়াই করেই তাকে ডাক্তার হতে হয়েছিল। দারিদ্রতার মাঝে বসবাস করতে করতে এক সময় রোজগার বাড়ানোর তাগিদে তিনি লিখতে শুরু করলেন বিভিন্ন ছোট গল্প। কিন্তু এর পরেও তিনি দারিদ্রতাকে কিছুতেই জয় করতে পারছিলেন না।


শার্লক হোমস্-এর ব্যক্তিগত রুম।

তখন তিনি উপন্যাস লেখার কথা ভাবতে শুরু করেন। তবে, অপরাধ-কাহিনীর কথা কেন যে তিনি ভাবতে গেলেন, তা ঠিক বোঝা যায় না! হয়তো এর দুটো কারণ থাকতে পারেঃ-
প্রথম কারণঃ- ফরাসী লেখক, 'এমিল গ্যাবোরিয়' আর আমেরিকান লেখক, 'এড্গার অ্যালান পো'র গল্পে রহস্য-বিশ্লেষণ ভঙ্গীই সম্ভাবত তাকে বিশেষ আকর্ষণ করেছিল এবং গল্প লিখতে উৎসাহ প্রদান করেছিল। এবং
দ্বিতীয় কারণঃ- কোনান ডয়েলের ভাষায়, তাঁর ডাক্তারী-কলেজের অধ্যাপক যোসেফ বেল্-এর কথাবার্তায় এক ধরণের ডিটেক্টিভগিরি সব ছাত্রকেই বেশ মুগ্ধ করত। এমনকি রোগী এসে ঘরে ঢুকে কোন কথা বলার আগেই, ডঃ বেল রোগীর ব্যক্তিগত জীবনের এবং রোগের নানা কথা বলতে শুরু করতেন, যাতে করে ডাক্তার বেলের উপর রোগীদের ভরসাও অনেক বেড়ে যেত। পরে ডঃ বেল তাঁর ছাত্রদের কাছে ব্যাখ্যা করে দিতেন- খুবই সহজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কিভাবে তিনি রুগিদের মাঝ থেকে নানা কথা বার করে আনলেন! এই দুই প্রেরণা থেকেই কোন্যান ডয়েল তাঁর মানস-গোয়েন্দা চরিত্র 'শার্লক হোমস'কে সৃষ্টি করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। অধ্যাপক বেল-এর কাছে তাঁর ঋণের কথা তিনি নিজেও অনেক বার বলেছেন।


নামকরণঃ- কথায় আছে 'A beautiful name is greater than a lot of wealth'। অর্থাৎ- এক গাদা ধন সম্পদের চেয়ে একটি সুন্দর নামই অধিকতরই ভাল। কোনান ডয়েল খুব ভাল ভাবেই জানতেন যে, একটা সুন্দর নাম কিভাবে একটা গল্পের সৌন্দর্য্য বহন করে। আর তাই তিনি তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রটির জন্য মনে মনে একটা চমৎকার নাম খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু গোয়েন্দা চরিত্রের নাম করণ করাটা চারটে খানি কথা নয়। কারণ বিশেষ করে গোয়েন্দা চরিত্রের ক্ষেত্রে, চরিত্র চিত্রায়ণের পরে যদি সেই চরিত্রের নামটা পাঠকের পছন্দ না হয়, তাহলে পাঠক সমাজে খুব একটা নাম করা বেশ মুস্কিল হয়ে যায়। যদিও 'শার্লক হোমস্' নামে কোনান ডয়েল তৎকালিন সময়ে কাউকেই চিনতেন না। কিন্তু অনেক 'শার্লক' এবং একাধিক 'হোমস্'কে তিনি খুব ভাল ভাবেই চিনতেন। আর এই দুই পছন্দের অংশ বিশেষ জোড়া দিয়ে তিনি তৈরি করলেন যুগের শ্রেষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র 'শার্লক হোমস্'


শার্লক হোমস্-এর বাসার ঠিকানা।

বাসস্থানঃ- কোনান ডয়েল চাকরি জীবনে লণ্ডনের বহু এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। লন্ডনের অধিকাংশ অলি-গলিই ছিল তার নখ দর্পণে। কিন্তু তার এই মানস-গোয়েন্দার বাসস্থানটা কোথায় করা যায়, এটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে শার্লকের থাকার জন্য তিনি 'বেকার ষ্ট্রীট'-কেই পছন্দ করলেন এবং কাল্পনিক ভাবে বাড়ীর নম্বরটা করে দিলেন '২২১/বি'। যদিও বেকার ষ্ট্রীট ছিল একটা ছোট গলির মধ্যে। আর অত ছোট গলিতে একশোর বেশী নাম্বার ছিলই না। নিশ্চয়ই কোনান ডয়েল সেটা লক্ষ করেছিলেন! তবে, বেকার ষ্ট্রীটের পরে নিকটবর্তী আরেকটি রাস্তা এর সঙ্গে জুড়ে দিলেই বেকার ষ্ট্রীট অনেক লম্বা হয়ে যায়। আর তখন ২২১ নম্বরটাও এসে যায়। মজার ব্যাপার হলো, সেই সময় উক্ত নাম্বারে 'Abbey National' নামে একটি বাণিজ্য-সংস্থার অফিস ছিল।


আর তারা শার্লক হোমস- এর প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে, বাড়ীর এক অংশে '২২১ বি' নম্বরের একটি ফলক বসিয়ে সেটি হোমস্-এর জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। এবং হোমস-এর নামে আসা চিঠিপত্র সামলাতে একজন সেক্রেটারিও নিয়োগ করেন! তখন হোমস-ভক্তরা বিপুল সংখ্যক চিঠি লিখতেন ঐ কাল্পনিক ঠিকানায়। কিন্তু তখনও ঐ নম্বর মিউনিসিপ্যালিটির অনুমোদন পায়নি। কাহিনী অনুসারে হোমস্ ১৮৮১ থেকে ১৯০৩ অবধি ঐ বাড়ীতেই ছিলেন (যদিও প্রথম হোমস-কাহিনী লেখা হয় ১৮৮৭ সালে)। ২০০৫ সালে সংস্থাটি ঐ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলে, হোমস-এর বাসস্থান নিয়ে নানা আইনগত জটিলতা দেখা দেয়, যা আজও কাটেনি।


শার্লক হোমস-এর গুণাগুণঃ- বর্ণনা অনুসারে সখের গোয়েন্দা তো তিনি বটেই, সেই সঙ্গে রসায়নবিদ, বেহালাবাদক, মুষ্টিযোদ্ধা ও তলোয়ারবাজও ছিলেন শার্লক! ডক্টর ওয়াটসন তাঁর নিকটতম বন্ধু, যিনি শার্লকের অধিকাংশ গল্পই পাঠকের উদ্দেশ্যে লিখে থাকতেন। ওয়াটসন প্রথম দিকে ঐ বাড়ীতে হোমস্-এর সাথে এক সঙ্গে থাকলেও পরে বিবাব করে অন্য অঞ্চলে চলে যান। সাধারণ বিচারে ওয়াটসনকে 'সহকারী' না বলে হয়তো বন্ধু বা সঙ্গী বলাই ঠিক হবে। কারণ সহকারী হবার মত পরিষ্কার মাথা তাঁর ছিল না। যদিও এক-আধ বার সহকারীর কাজ তিনি সত্যই করেছেন। কিন্তু সেটা ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র ব্যাপার। হোমস তাঁকে বলতেন- 'তুমি আলো নও; আলোর পরিবাহী।' আর এই 'পরিবাহী'র সঙ্গে খোদ 'আলো'র দেখা হয় শার্লক সিরিজের প্রথম কাহিনী 'অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট্'-এর গোড়াতেই।


ডাঃ ওয়াটসনের ব্যক্তিগত স্টাডি রুম। যেখানে সাজানো আছে ভিক্টোরীয় আমলের বইপত্র, খবরের কাগজ, ভাস্কর্য, পেইন্টিং ও ফটোগ্রাফ।

আফগানিস্থান-যুদ্ধে একজন ডাক্তার হিসেবে যান ওয়াটসন। গুলি লেগে আহতও হন। পরে সুস্থ হয়ে লণ্ডনে ফিরে এসে একা একা খুব অসহায় বোধ করতে থাকেন তিনি। ঠিক এমনই সময়ে হঠাৎ তার দেখা হয়ে যায় বন্ধু 'স্ট্যামফোর্ড'-এর সঙ্গে। স্ট্যামফোর্ডকে বলেন - তিনি লণ্ডনে থাকতে চান, কিন্তু বাড়ী ভাড়া এ শহরে বড়ই চড়া। সুতরাং কারও সঙ্গে একটা ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নিতে পারলে বেশ ভাল হতো। স্ট্যামফোর্ড বলেন, 'তাঁর আর এক বন্ধু শার্লক হোমস্-এরও ঐ একই সমস্যা।' সুতরাং বন্ধু স্ট্যামফোর্ড ওয়াটসনকে নিয়ে যান তাঁর আর এক বন্ধু শার্লকের কাছে। আলাপ হতেই করমর্দন করে হোমস্ ওয়াটসনকে দেখে বলেন, 'আফগানিস্থানে ছিলেন মনে হয়?' প্রচন্ড অবাক হয়ে ওয়াটসন কিংকর্তব্যবিমূড়র মত হয়ে পড়েন। এই এক কৌতুহলেই শার্লককে ভাল লেগে যায় ওয়াটসনের। আর অনায়াসেই তিনি শার্লকের সাথে একঘরে দিন পার করার মনস্থির করে ফেলেন।

কাহিনী অনুসারে হোমস সহস্রাধিক রহস্যের সমাধান করলেও কোনান ডয়েল তাকে নিয়ে লিখেছেন মোট ষাটটি গল্প। পাঠকের দুঃখ হয় বাকী গল্প শুনতে পেলেন না বলে। এর মধ্যে ছাপ্পান্নটি গল্প শুনিয়েছেন ওয়াটসন, দুটি বলেছেন হোমস নিজেই, আর বাকি দুটি অনির্দিষ্ট কোনো দ্রষ্টা। যিনি আবহামান কাল ধরে আমাদের গল্প শুনিয়ে আসছেন। হোমস কাহিনীর ঘটনাকাল ছিল ১৮৮০ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। যদিও ১৯১৪ তে হোমসকে শেষ বারের জন্য আরও একটি ঘটনায় দেখা যায়।


বর্ণনা অনুসারে তিনি ছিলেন 'বোহেমিয়ান', অর্থাৎ ঠিক নিয়মে বাঁধা জীবন তাঁর নয়। অনেকটা মর্জি শাসিত ছিল তাঁর জীবন। লম্বা, রোগা, রুক্ষ চেহারা; কিন্তু শরীরে ছিল অবিশ্বাস্য শক্তি। কোনো সমস্যা যখন তাঁকে ভাবনার গভীরে বেঁধে রাখতো, তখন প্রায়ই তিনি অনাহারে থাকতেন। তামাকে আসক্ত; পাইপ, সিগার ইত্যাদি অনেক কিছুই তাঁর চলে। বাড়ীতে তিনি তামাক রাখতেন তাকের উপর একটি চটি-জুতোর ভিতরে। এমনকি ৭ কোকেন-দ্রবণের ইঞ্জেকসন নিতেও তাঁকে দেখা যায়। তার ধারনা এতে নাকি মাথা পরিষ্কার করা এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়! কদাচিৎ নিজের উপরে 'মর্ফিন'ও তিনি প্রয়োগ করেন। আর্থিক অবস্থা তাঁর খারাপ ছিল না। মনে হয়, রহস্যভেদ করে উপার্জন তার খারাপ হতো না। কিন্তু কোন লেখার মধ্যেই তাঁর নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তিনি যথেষ্ট পুরস্কার লাভ করেছিলেন। প্রথম দিকে একটি রহস্যভেদ করার পরে তাঁকে এক হাজার পাউণ্ড পেতে দেখা যায়, যা তখনকার হিসেবে অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওয়াটসনের সঙ্গে কয়েক বছর অবশ্য থেকেছেন; তা ছাড়া বরাবরই তিনি একাই থাকতেন। তাঁর এক দাদা ছাড়া তাঁর পরিবারের আর কারও কথা জানা যায় না। ঐ দাদাও ছিলেন একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি; তবে তার আবার হোমসের মত এতটা দৌড়-ঝাঁপে রুচি ছিল না। হোমস দু'এক বার বুদ্ধি বা পরামর্শ চাইতে ঐ দাদার দ্বারস্থও হয়েছেন। কিন্তু তিনি সব শুনে চেয়ারে বসেই হোমসকে উনার মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করতেন।


হোমস-এর ষাটটি গল্পের ভিতরে দীর্ঘ কাহিনী বা উপন্যাস হলো চারটি, যার এক-একটি গল্পেই এক-একটি বই হয়ে গিয়েছে। হোমস-এর প্রথম গল্প 'অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট' ঐ রকম দীর্ঘ এক কাহিনী। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে 'বীটন ক্রিসমাস অ্যানুয়াল'-এ। সেই সময় হোমসের ছবি এঁকেছিলেন চিত্রকর ডি. এইচ. ফ্রিস্টন, যিনি হোমসকে একটু মোটাসোটা করে আঁকায় কোনান ডয়েল ভীষণ ভাবে বিরক্ত হয়েছিলেন। পরের বছর এই একই গল্প আলাদা বই হিসেবেও বের হয়। কোনান ডয়েলের বাবা তখন মানসিক অসুস্থতায় হাসপাতালে ছিলেন। তিনি সেখানে বসেই এই বইয়ের জন্য কয়েকটা ছবি এঁকেছিলেন। আর সেই ছবিতে তিনি আবার হোমস-এর মুখে আধুনিক ফ্যাশন হিসাবে চাপদাঁড়িও রেখেছিলেন! কিন্তু যত শিল্পীই শার্লক হোমস-এর যত ছবি এঁকেছেন, তার কোনোটাই গল্পের বর্ণনার সঙ্গে মেলেনি। আর লেখকও এই ব্যাপারে বরাবর ছিলেন খুবই অসন্তুষ্ট। হোমস-এর এই প্রথম কাহিনী পাঠক সমাজে তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু প্রথমবারে ফ্লপে কোনান ডয়েল মন খারাপ করে হাল ছেড়ে দিলেন না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে তিনি আবারও লিখতে শুরু করেন। কিন্তু দ্বিতীয় কাহিনী 'দ্যা সাইন ওব ফোর' (The Sign of Four) আরেকটি দীর্ঘ কাহিনী, আগেরটার থেকে আরও কম জনপ্রিয় হয়েছিল। এই দুই ব্যর্থতার পরেও লেখক যে শার্লক হোমসকে নিয়ে পরবর্তিতে আরো গল্প লিখবেন এমনটা তখন কেউই ভাবেনি।


ঠিক তখনই ১৮৯১ সালে লণ্ডনে 'The Standard magazine' নামে নতুন একটি মাসিক পত্রিকা বেরিয়েছিল। এবার কোনান ডয়েল হোমসকে নিয়ে ছোট মাপের দুটি গল্প লিখে ঐ পত্রিকায় পাঠালেন। আর এটাই ছিল শার্লক হোমস-এর বিশ্বজয়ের শুভ সূচনা। শার্লককে নিয়ে কোনান ডয়েল মোট ছ'টি গল্প লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। জুলাই থেকে ডিসেম্বর অবধি এই ছ'টি গল্পই পরপর প্রকাশিত হতে থাকে। যার প্রত্যেকটা গল্পেই শার্লকের ছবি থাকত। তৎকালিন সময়ে 'ওয়াল্টার প্যাগেট আর সিডনি প্যাগেট' নামের দুই সহদর ছিলেন উক্ত পত্রিকার সম্পাদক। দুজনেই ছিলেন ভাল চিত্রকর। যদিও কোনান ডয়েল সম্পাদক ওয়াল্টারকে দিয়েই ছবি আঁকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে দায়িত্বটা পেয়ে যান ছোট ভাই সিডনি। তিনি আবার ভাই ওয়াল্টারকে মডেল করেই শার্লক হোমসকে আঁকেন! সেই ছবিতে হোমসকে ছিপছিপে এবং সতেজ দেখালেও তার মুখের কমনীয়তাকে লেখক খুব একটা পছন্দ করেননি। কিন্তু এত কিছুর পরেও হোমস-এর ছবি এঁকেই সিডনি ততদিনে বিখ্যাত হয়ে যান। এমনকি ১৯০৮ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হোমস কাহিনীর সকল ছবি তিনিই এঁকেছিলেন।


শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা, মোরিয়ার্টির পরিচয় এবং দু'জনেরই অকাল মৃত্যুঃ- দ্যা স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে লেখা বের হওয়ার প্রথম দু-তিন মাসেই শার্লক হোমস্ এবং কোনান ডয়েলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়। এছাড়াও পাঠকের কাছে স্ট্র্যান্ড পত্রিকার চাহিদাও বেড়ে যায়। ফলে নিজেদের ব্যবসা সফল করার জন্য পত্রিকার সম্পাদক কোনান ডয়েলের কাছে আরও হোমস কাহিনীর দাবী করতে থাকেন। কিন্তু কোনান ডয়েল তখন চাইছিলেন ঐতিহাসিক উপন্যাসে মন দিতে, যা লিখতে তিনি সব থেকে বেশি ভালবাসতেন। তবুও কিছুটা আর্থিক কারণেই তিনি ঐ গল্পমালায় আরও ছ'টি গল্প যোগ করতে রাজী হয়ে যান। এর পরে শার্লক হোমসকে মেরে ফেলে নিজের একটু শান্তি পেতে চাইছিলেন লেখক। কিন্তু প্রধানত তাঁর মায়ের নিষেধের কারণে তা আর করা হয় না। তবে এর পরে আবারও সম্পাদকীয় তাগাদায় হোমসকে নিয়ে গল্প ফাঁদতে যখন বাধ্য হন লেখক, তখন শার্লককে নিয়ে পরপর আরও প্রায় এগারটি গল্প লিখে ফেলেন কোনান ডয়েল। ততদিনে শার্লক হোমস আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তার মালিক হয়ে গেছেন। কিন্তু নিজের সৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে লেখক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।


অনেকেই হয়তো এখানে প্রশ্ন করতে পারেন যে, তৎকালিন সময়ে শার্লকের এই জনপ্রিয়তা হওয়া সত্ত্বেও লেখক কোনান ডয়েল কেন শার্লককে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন? সে সময়ে শার্লক হোমস ছিলেন ঐ দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় একটি নাম। প্রতিদিন প্রচুর চিঠিপত্র আসতো তাঁর নামে। এসব চিঠি পত্রের মধ্যে 'ফ্যান লেটার' তো আছেই, এছাড়াও বিপন্ন মানুষের চিঠিও কিছু কম আসতো না। কোন কেসের চুরি, ডাকাতি বা খুনের কিনারা করতে পুলিশ যখন ব্যর্থ হতো, তখন অনেকেই চিঠি লিখে বলতো ঐ মামলা শার্লক হোমসকে দিতে। যে কোনো লেখকের পক্ষেই এ রকম হওয়াটা ছিল মহা তৃপ্তির ব্যাপার। তাহলে কোনান ডয়েল কেন এ থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন?

যদিও শার্লকই কোনান ডয়েলকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু আসলে শার্লক হোমস্-এর গল্প লিখে কোনান ডয়েল তেমন একটা তৃপ্তি লাভ করতে পারেননি। কোনান ডয়েল মনে করতেন ঐ চরিত্রটি কেবল কাঠখোট্টা বুদ্ধিরই কারবার করে। মানুষের নানা কোমল বৃত্তির সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়ানো যায় না। হোমস্ নিজেই এক বার ওয়াটসনকে বলেন - 'আমি কেবল মস্তিষ্ক, ওয়াটসন; আমার আর সব কিছু অ্যাপেনডিক্স!' সুতরাং একে নিয়ে লেখক আর কদ্দুরই বা যাবেন?


যদিও হোমস্ নানা রকমের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন, কিন্তু তাঁর এক চির প্রতিদ্বন্দী চরিত্র ছিল। যাকে বলে 'ভিলেন' বা খলনায়ক। উনি ছিলেন গণিত এবং মহাকাশ-বিজ্ঞানের পণ্ডিত, অধ্যাপক মোরিয়ার্টি। অল্পবয়সেই অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অপরাধ-জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের খবর খুব একটা গোপন ছিল না। অন্তত শার্লকের কাছে তো নয়ই। সেই দুর্নামের কারণেই তিনি নিজে থেকে অধ্যাপনার কাজ থেকে সরে আসেন এবং পুরোপুরি অপরাধ-জগতের সম্রাট হয়ে বসেন। কিন্তু তার এই সম্রাট হওয়ার পিছনে প্রতি পদক্ষেপে শার্লক হোমসই তাঁর পথের একমাত্র কাঁটা হয়ে দাঁড়ান। আবার অন্যদিকে, হোমস্ও কেবলমাত্র ঐ মোরিয়ার্টির সঙ্গেই পুরোপুরি এঁটে উঠতে পারতেন না। এমনকি আইনের কাঠগড়ায় তাকে তুলে শাস্তির ব্যবস্থা করে সমাজকে স্বস্তি দিতেও হোমস্ বারবার ব্যর্থ হন। আর এই দ্বন্দেই শার্লক হোমস্-এর মৃত্যু ঘটাতে মনস্থ করলেন তাঁর স্রষ্টা। কিন্তু খলনায়ককে জিতিয়ে নিশ্চয়ই নয়! সুতরাং মৃত্যু হবে দু'জনেরই। কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব?


এর কিছু দিন আগে কোনান ডয়েল তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ড ভ্রমণের সময় সেখানে রিখেনবাখ্ নামক একটি জলপ্রপাত দেখেছিলেন। জলপ্রপাতটিতে কয়েকশো ফুট উঁচু থেকে বিপুল পরিমাণ জল গভীর খাদে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এমনকি জলের গর্জনে কানে কিছুই শোনা যায় না। খাদের মাঝ বরাবর সরু তাকের মত একটা জায়গা, যেখান দিয়ে জলের ধারাকে পাশ কাটিয়ে একজন মানুষ খুব সাবধানে এগোতে পারে। কিন্তু একবার পা ফসকালেই নিশ্চিত মরণ। আর কোনান ডয়েলের গল্পের ধারা অনুসারে এখানেই দুই প্রতিদ্বন্দীর শেষ বার দেখা হয়। মোরিয়ার্টির কৌশলেই হোমস এখানে একাকী আসেন। এবং এসেই বুঝতে পারেন যে, এটা একটা মৃত্যু ফাঁদ। কিন্তু কিছুতেই শার্লক ভীতু হন না। বরং তাড়াতাড়ি এক টুকরো কাগজে ওয়াটসনের উদ্দেশ্যে কয়েক তিনি লাইন লিখে রেখে যান।


বন্ধুর খোঁজে ওয়াটসন যখন উক্ত স্থানে আসেন, তখন সেখানে কেউ নেই। কেবল ঐ কাগজটাই তিনি উদ্ধার করতে পারেন, আর আন্দাজ করে নিতে পারেন ঘটনাটি। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তিনি খাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে সফেদ জলরাশির তলায় পরস্পরের বাহুলগ্ন হয়ে চিরশয্যায় শায়িত হয়ে আছে এ যুগের সবচেয়ে বড় অপরাধী আর আইনের শ্রেষ্ঠতম রক্ষক। ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসের সংখ্যায় উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পেই এটি ঘটানো হয়েছিল। যে গল্পটার নাম ছিল 'দ্যা ফাইনাল প্রবলেম'। আর এই ভাবেই কোনান ডয়েল শার্লকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করলেন। উক্ত লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর দেশের পাঠক সমাজের সর্বস্তরে তখন সেকি হাহাকার!


শার্লক হোমস্-এর স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা।

যে যুগে শার্লক হোমস্-এর গল্প লেখা হয়েছিল, তখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তপদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। যে কারণে একজন কাল্পনিক মানুষ হলেও শার্লক হোমস্ যুক্তিবাদী অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাঠককে একটা পথ দেখাতে পেরেছিলেন। তখনকার পুলিশ এবং 'ফোরেনসিক' বিভাগ হোমস্ কাহিনী থেকে অনেক ভাবনার খোরাক পেয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে অনেক তুচ্ছ বস্তুকেও বুদ্ধি আর যুক্তি দিয়ে দেখতে পারলে তা থেকে যে কত কথা বের করে আনা যায়, শার্লক তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে ঐ প্রথম দেখিয়ে দিল। শার্লক হোমস্ মূলত একজন কড়া ধূমপায়ী বা তামাকসেবী ছিলেন। সিগারের বা পাইপের ছাই পর্যবেক্ষণ করে কীভাবে মূল্যবান তথ্য বের করে আনা যায়, সে বিষয়ে তিনি একটি পুস্তিকাও লিখেছিলেন। বস্তুত, এই ধরণের পুস্তিকা তিনি অনেক লিখেছেন। পদচিহ্ণের ছাঁচ তোলার জন্য 'প্লাস্টার অব পারী'র উপযোগীতার কথাও এই সূত্রের মাধ্যমেই প্রথম জানা যায়। ওয়াটসনকে তিনি প্রায়ই বলতেন - 'যা কিছু অসম্ভব তা যখন তুমি বাদ দিয়ে দেবে, তখন যা পড়ে থাকবে তা যতই অদ্ভুত হোক, তাই-ই সত্য হতে বাধ্য।'


পূনরায় শার্লক হোমস্-এর আত্মপ্রকাশঃ- ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শার্লক হোমসকে মেরে কোনান ডয়েল পাঠক আর প্রকাশকদের চাহিদাকে ক্রমান্নয়ে অগ্রাহ্য করে চললেন। কিন্তু ১৮৯৬ সালে এক বার তাঁকে অনেক বড় ধরনের একটা মুস্কিলে পড়তে হল। তিনি ডাক্তারি পাশ্ করেছিলেন এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানকার ছাত্ররা তাঁকে জানালো, 'তারা তাদের ক্রিকেট মাঠটা বড় এবং উন্নত করতে চায়; কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদেরই যোগাড় করতে হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। তাই ছাত্রদের দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকা ( 'The Student' ) তারা বিক্রী করতে চায়। আর এই কাজটা সহজ হয় যদি কোনান ডয়েল শার্লক হোমস-এর একটি গল্প লিখে দেন!'

কীভাবেই বা তিনি তখন ছাত্রদেরকে ফেরান। আবার কী ভাবেই বা নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙেন! তাছাড়া একজন মরা মানুষকে পুনোরুজ্জীবিত করাটাতো আর চারটেখানি কথা নয়? তখন ছাত্রদের দাবির মুখে অনেক ভেবে তিনি হোমসকে নিয়ে একটি ছোট লেখা তৈরী করে দিয়েছিলেন। যাকে ঠিক গল্প বলা চলে না। অবশ্য তারপর নিজের উৎসাহতেই শার্লককে নিয়ে ১৯০২ সালে তিনি 'দ্যা হাউণ্ড ওব দা বাস্কারভিলস্' উপন্যাসটি লেখেন। তবে সেই উপন্যাসে হোমসকে ঠিক বাঁচিয়ে দেওয়া হল না। বরং ঐ ঘটনাকে পূর্ববর্তী একটি ঘটনা হিসেবে দেখান হল।


কিন্তু পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯০৩ সালে অবিশ্বাস্য ভাবে শার্লক হোমস সত্যই বেঁচে ফিরে আসলেন। 'দ্য এডভেঞ্চার অব দ্য এম্পটি হাউস' গল্পটিতে শার্লকের এই প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটিকে সে নিজে যেভাবে বর্ণনা করেছে সেটা থেকে জানা যায় যে, তিনি নাকি ঐ জলপ্রপাতের খাদে তলিয়ে যাননি! বরং পড়ে যেতে যেতে একটি সুবিধাজনক মধ্যপথে তিনি আটকে গিয়েছিলেন। তারপর এত দিন অজ্ঞাতবাসে ছিলেন শাখা-প্রশাখায় ছড়ানো শত্রুপক্ষকে কাবু করবার উদ্দেশ্যেই। এমনকি বন্ধু ওয়াটসনকেও তিনি কিছুই জানতে দেননি। অতএব হোমস কাহিনী আবারও প্রকাশিত হতে থাকে, ঠিক আগের মতোই। বরং লেখকের কাছ থেকে এই দ্বিতীয় দফায় আরও অনেক বেশি গল্প পাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশী সমালোচকরা এই দ্বিতীয় দফার গল্পকে ঠিক ততটা স্বাগত জানাতে পারেননি। তাঁদের মতে, গল্পের সেই মেজাজ, সেই সাহিত্যগুণ দ্বিতীয়বারে আর একদমই নেই। তাদের ধারনা এই হোমস আগের সেই হোমস নয় ! অবশ্য, ক্ষুধাতুর ভক্তরা এ সব সমালোচনাকে খুব একটা গ্রাহ্য করেনি।

এখানে একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়! কোনান ডয়েল একদা তাঁর সৃষ্ট সেই বিখ্যাত মানস-গোয়েন্দার উপরে এতটা বিরক্ত হয়ে তাকে মেরে ফেলার পরে, কেন আবার তাকে তিনি বাঁচিয়ে তুলেছিলেন? এটাকি শুধুই চাহিদার চাপে (?) নাকি টাকার লোভে? এর আগে চাহিদার চাপ কিন্তু তিনি প্রায় দশ বছর ধরে অগ্রাহ্য করে আসছিলেন। সুতরাং শার্লককে বাঁচিয়ে তোলার ক্ষেত্রে একদমই চাহিদার চাপ হতেই পারে না! তাহলে কি? টাকা? কিন্তু যখন তিনি হোমসকে মেরে ফেলেছিলেন, তখনকার তুলনায় এখন তিনি অনেক বেশী ধনী। বোধহয় তৎকালিন সময়ে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লেখক ছিলেন। সুতরাং এটাকেও বাদ দিতে হচ্ছে। তাহলে আসলেই এর মূল কারণটা কি ছিল? তবে ঘটনা যাই থাক, এ ব্যাপারটাকে অনেকেই লেখকের একটা খেয়াল বলেই ধরে নিয়েছিলেন।


বলা বাহুল্য, শার্লক হোমস্ সমাজের সর্বস্তরের অনেক ভালোবাসা, অনেক সম্মান পেয়েছিলেন। গল্পে দেখা যায়, ১৯০২ সালের জুন মাসে সরকারী সম্মান 'নাইট'-এর মত একটা সর্বোচ্চ উপধিও তাঁকে দেবার প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু হোমস তা প্রত্যাখান করেন। তবে এই ব্যাপারটা বেশ মিলে যায় তাঁর স্রষ্টা কোনান ডয়েলের সঙ্গে। তাঁকেও ১৯০২ সালে ইংল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ 'নাইট' উপাধি দিতে চাওয়া হয়, কিন্তু তিনিও তা প্রত্যাখান করতেই মনস্থ করেছিলেন। পরবর্তিতে যদিও তার মা আর স্ত্রীর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সেটাকে তার গ্রহণ করতে হয়।

মোটামুটি এই সময়ে খবরের কাগজ পড়ে জানা যায়, হোমস্ এইবার অবসর নিতে চলেছেন। এবার তিনি গ্রামাঞ্চলে থাকবেন; মৌমাছি পালন করে শান্ত জীবন কাটাবেন। যাঁহাতক এই খবর পত্রিকায় বের হলো, অমনি তার নামে বিচলিত ভক্তদের নানা চিঠি আসতে শুরু করলো! এমনকি মৌমাছি পালনে দক্ষ অনেক ব্যক্তিও তাকে সাহায্য করতে আগ্রহী হন। এর মধ্যে একজন অধ্যাপকও ছিলেন! হোমস কাহিনী পড়ে সেই অধ্যাপক যে আনন্দ লাভ করেছিলেন, তার প্রতিদানেই তিনি শার্লককে সাহায্য করতে চান।


আধুনিক যুগের ফিল্মে শার্লক হোমস্ঃ- জনপ্রিয় চরিত্র অনেক তৈরী হয়েছে; কিন্তু আজ অবধি শার্লক হোমসকে কেউ টেক্কা দিতে পারেনি। আজ অবধি শার্লক হোমসকে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে থিয়েটার এবং সিনেমা তৈরী হয়েছে। হোমস প্রথম মঞ্চে ওঠেন ১৮৯৯ সালে। আর সিনেমার পর্দায় আসেন ১৯০৫ সালে ( তখন অবশ্য বড় দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরী হত না )। মঞ্চে প্রথম হোমস সেঁজে ( ১৮৯৯ - ১৯৩২ ) বিখ্যাত হয়েছিলেন উইলিয়াম গিলেট নামে একজন নাট্যকর্মী এবং একটানা প্রায় আটাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ঐ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। 'গিনেস বুক অব ওয়্যাল্ড'-এর তথ্য অনুসারে এখন অবধি সর্বমোট ২১১ টি হোমস্-চিত্র তৈরী হয়েছে, এবং ৭৫ জন অভিনেতা হোমসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তবে তাদের মধ্যে নিজের অভিনয় শৈলি দ্বারা সবচেয়ে খ্যাতিমান হয়েছিলেন ব্যাসিল রথবোন। কিন্তু বর্তমান সময়ে হোমসকে নিয়ে এমন অনেক সিনেমা তৈরী হয়েছে যেগুলো সত্যিকার অর্থে কোনান ডয়েলের লেখা নয়। এমনকি জনপ্রিয়তার প্রেরণায় নব্য যুগের অনেক লেখকই হোমসকে নিয়ে নতুন নতুন গল্প লিখেছেন। যার মধ্যে কোনান ডয়েলের এক ছেলেও ছিল।


শার্লক হোমস্'কে উদ্দেশ্য করে লেখা ভক্তের চিঠি।

পুনশ্চঃ- কোনান ডয়েল ভেবেছিলেন- একজন বিখ্যাত লেখক হিসাবে পাঠকের হৃদয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাসের জন্যই তিনি বেঁচে থাকবেন। কিন্তু শার্লক হোমস্ সেটা হতে দেননি। বরং স্রষ্টার চেয়ে বড় হয়ে তিনিই তাঁর সৃষ্টিকর্তার ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন। যুগের শ্রেষ্ট আজব চরিত্র এই শার্লক হোমস্, যার নামে আজও ২২১/বি বেকার ষ্ট্রীটের ঠিকানায় তার ভক্তরা চিঠি পাঠান! যে কিনা এই সু-দীর্ঘকাল পরে আজও পৃথিবীর সকল গোয়েন্দা প্রেমীদের হৃদয়ের মাঝখানে এখনও অমর হয়ে বেঁচে আছেন.......!!

শার্লক হোমস সমগ্র (বাংলা অনুবাদকৃত ই-বুক):- অনেক বাঙালি লেখকই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা 'শার্লক হোমস'কে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। যা গুগলে শার্লক হোমস লিখে সার্চ দিলে হাজার হাজার অনলাইন ঠিকানায় সেগুলোকে ই-বুক (পিডিএফ) ফাইল আকারে পাওয়া যায়। শার্লক ভক্ত পাঠকদের সুবিধার্থে আমি এখানে দুইটা ঠিকানা উল্লেখ করে দিলাম। ইচ্ছা করলে উক্ত ঠিকানা থেকে আপনারা শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা সবগুলো গল্পই ডাউনলোড করে নিয়ে পড়তে পারবেন।

০১। গল্প বাদে, শার্লক হোমস কে নিয়ে লেখা শুধুমাত্র চারটি উপন্যাস পাবেন এইখানে, বাংলা অনুবাদক- অদ্রীশ বর্ধন।
ফাইল সাইজঃ- ১৮.৯০ এম. বি।
০২। উপন্যাস সহ সবগুলো গল্পই পাবেন এইখানে, বাংলা অনুবাদক-মণীন্দ্র দত্ত।
ফাইল সাইজঃ- ৪৬.৩০ এম. বি।

তথ্যসূত্রঃ- যদিও "শার্লক হোমস্" কে নিয়ে আমার আজকের পোস্টের অধিকাংশ লেখাই আমার নিজস্ব জ্ঞান এবং মস্তিষ্ক প্রসূত ধারনা থেকেই নেওয়া। কিন্তু তারপরেও পোস্টের আনুসঙ্গিক কিছু তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বেশ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাছ থেকে অল্প কিছু সাহায্য নেওয়া হয়েছে। নিম্নে অনলাইন লিংক সহ সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হলোঃ-

০১। উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া-স্যার আর্থার কোনান ডয়েল।
০২। উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া-শার্লক হোমস।
০৩। উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া-বেকার ষ্ট্রীট।
০৪। কে এই শার্লক হোমস?
০৫। ছবি সূত্র-পোস্টে উল্লেখিত সবগুলো ছবিই এখান থেকে সংগ্রহ করা।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো! এতক্ষণ যাবত সাথে থেকে কষ্ট করে এতবড় একটা পোস্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন! হ্যাপি ব্লগিং.... !:#P
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৩
৪১টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×