আমার হাতে কেঁচো। মোটা গাবদা গুবদা টাইপের কেঁচো। একটানা বর্ষায় উঠানের অর্ধেক তলিয়েছে। তলিয়েছে পুকুরের চারধার ঘিরে রাখা উঁচু ঢিবিও। শুধু আমাদেরই না, সকলের পুকুরই ডুবেছে। পুকুর ডুবে মাছেরা স্বাধীন হয়েছে, তারা এখন বিলের জলে ছলাৎ ছলাৎ এক্কাদোক্কা খেলে, টুপটাপ কানামাছি খেলে। আমরা লোভনীয় চোখে তাকিয়ে থাকি, 'ইশ, মাছ...!'
বু একটাকার বড়শি কিনে দিয়েছেন। এই বড়শির নাম চীনা বড়শি। চোখে দেখতে পাওয়া যায় না এমন সাইজের বড়শী। সেকালে এই বড়শি একটাকায় চারখানা পাওয়া যায়। সাথে কিনতে হয় মিহি সুতো, সুতোর মাথায় বড়শি বেঁধে বড়শির মাথায় টুক করে গেঁথে দিতে হয় ভাত, বা আটার সুক্ষ্ম দলা।তারপর জলে ডুবিয়ে দিলেই খলসে পুঁটি, চাপিলা মাছেরা ছোঁকছোঁক করে ছুটে আসে। আহা! টুপটাপ ধরা পড়ে। ক্রমশই ভঁরে ওঠে পাতিল।
কিন্তু আমার মন তাতে ভরে না। আমার বড় মাছ চাই। পঞ্চাশ পয়সা দরের বড় বড়শি। নীলচে সোনালি রঙের বড়শি। সেই বড়শিতে কেঁচো কিংবা ভিমরুলে চাক ভেঙে তাই দিয়ে টোপ গেঁথে জলে ডুবিয়ে দিলেই খানিক বড় মাছ ধরা যায়। টাকি, ছোট শোল, কই, বড় টেংরা, পুঁটি... আরও কত কি!
কিন্তু বু আমাকে কেঁচো ধরতে দেবেন না। কেঁচো ধরলে হাতে সাবান সোডা মাখিয়ে ঘসে ঘসে ছাল ছাড়াবেন, তারপর নাকের কাছে নিয়ে বলবেন, 'ইয়াক, কী গন্দ! গন্দ!'
আমি খিলখিল করে হাসি। কিন্তু মাছ ধরতে ওই কেঁচো আমার চাইই।
সেবার বাজারে গিয়ে বড়শি কিনে নিয়ে এলাম। বড় বড়শি। অনেক বড়। আস্ত একটাকা দামের বড়শি। এই বড়শিতে বড় মাছ ধরা পড়ে। অনেক বড় মাছ। বর্ষার জল তখন কমছে। বাড়ির পাশের মজা ডোবায় জল জমে আছে। সেই জলে মাঝেমাঝেই ঢেউ তোলে আটকে পড়া মাছ। সেদিন মক্তব থেকে ফেরার পথে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম। ঝপাৎ শব্দে ছিটকে উঠেছে শান্ত ডোবার জল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখি বিশালাকায় এক শোল। এতো বড়! এতো বড় মাছ!
আমি দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। সেই বড় বড়শিখানা তুলে নিয়ে বসে পড়লাম ডোবার পাশে। বর্ষা শেষে স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ জল সেই ডোবার। জলের খানিক নিচেই শোল মাছটা রাজকীয় ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তার মুখের কাছে বড়শিখানা ফেললাম। সে বার দুয়েক চোখ পিটপিট করে তাকালো, মুখ দিয়ে বারকয়েক ঢুস মেরে কিছু যেন পরখ করল, তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে ঠোকর বসাল বড়শিতে। তার সেই তীব্র ঠোকরে আমার হাত থেকে বড়শির ছিপখানা ছুটে গেল। আমি মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছিপখানা হাত থেকে ছুটে গিয়ে পড়েছে জলের ভেতর। শোল মাছটা টানছে প্রাণপণ। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিপখানা ধরলাম। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মুহূর্ত শেষে ছিপখানা টেনে তুললাম জল থেকে।
মাছটা বিশাল হা মেলে ভয়াল দাঁত বের করে আছে। আমি তাকে মাটির সাথে চেপে ধরে বরশিটা ছাড়ালাম, তারপর দুইহাতে মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম, 'আহ, অবশেষে! অবশেষে! সেই বড় মাছ! এতো বড়! বু দেখলে কি বলবেন! কি বলবেন তিনি'!
মুহূর্তকাল। মাছটা হঠাৎ সর্বশক্তিতে যেন লেজের ঝাঁপটা মারল। তারপর তার সেই ভয়াল দাঁত বসিয়ে দিল আমার হাতে। তীব্রগতিতে লেজের আঘাত আমার বুকে। কিছু বোঝার আগেই সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। তারপর দুই লাফে জলে। আমার হাত কেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। আর চোখ গড়িয়ে জল। আমি সেই জল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম জলে, 'আহারে মাছ, আমার মাছ! আমার অত্তবড় মাছ!'
তারপর থেকে রোজদিন আমি বড়শি পেতে বসে থাকি, কিন্তু মাছটা আর আসে না। একবারও আসে না। জলের ওপরে ভাসে না। কিন্তু আমি ঠায় বসে থাকি। নির্নিমেষ। সেদি হঠাৎ দেখি, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কী এক মাছের পোনারা ঝাঁক বেঁধে জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। কী এসব? ব্যাঙ্গাচি নয়তো? দেখে আমার কী যে বিরক্তি লাগে। আমি হুশহাশ তাড়াই। কিন্তু শোল মাছটা আর আসে না। আমি তবুও অপেক্ষায় থাকি, অপেক্ষায়। বসেই থাকি, আর একবার, একবার, কেবল একবার। কিন্তু সে আসে না। আসেই না। পাশের বাড়ির এছাক আমায় এমন বসে থাকতে দেখে বললেন, 'কি রে , হারাদিন বসশি লইয়া বইস্যা বইস্যা কি করছ?'
আমি বলি, 'মাছ ধরব?'
কাকা বলেন, 'মাছ ধরবি? না ধরস?'
আমি বলি, 'ধরব'।
তিনি বলেন, 'কি মাছ?'
আমি বলি, 'শোল'।
তিনি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। আমি তাকে সেদিনের ঘটনা খুলে বলি। এছাকা চাচা শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে জলের ভেতর কী দেখেন! তারপর মৃদু হেসে বলেন, 'বুঝছি।তুই খাড়া। আমি আইতেছি'।
আমি কিছু না বুঝেও কউতুহলি চোখে তাকিয়ে থাকি। খানিকবাদে এছাক কাকা লম্বা বাঁশের আগায় লোহার সূচালো ছ'খানা দাঁতওয়ালা কোচ (ট্যাডা-একধরনের মাছ মারার বর্শা) নিয়ে আসেন। তারপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন সেই ডোবার পাশে। আমিও। কাকা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী দেখেন আমি জানি না। কিন্তু আমিও তাকিয়ে থাকি... তাকিয়েই থাকি, কিন্তু বুঝি না। কিচ্ছু দেখিও না। কোথাও সেই শোল মাছের আর কোন সাড়া নেই, শব্দ নেই। কেবল ঝাঁক বেঁধে ভেসে চলা সেই ছোট্ট পোনারা। আর কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না।
হঠাৎ, একদম হঠাৎ, এছাক কাকার হাতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল! তিনি হাতের কোচখানা তীব্রবেগে ছুড়ে মারলেন জলে। ঝপাৎ শব্দে একখানা তীর যেন বিদ্ধ হল লক্ষ্যে। কিন্তু কোথায়? কি সেখানে? কি? এছাক কাকা মুহূর্তেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, 'পড়ছে রে পড়ছে, হৌল মাছখান পড়ছে! ধরা পড়ছে। এককালে গাইত্থা গ্যাছে রে, গাইত্থা গ্যাছে...!'
আমি কিছুই বুঝলাম না। কেবল বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে এছাক কাকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি ডোবার মাঝখান থেকে কোচখানা টেনে তুললেন। কোচের মাথার তীক্ষ্ণ ধারালো লোহার সূচগুলোতে গেঁথে আছে আজদাহা সেই শোল মাছখানা! আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম, প্রতিশোধানন্দে আমার চোয়াল যেন শক্ত হয়ে এলো, 'হুহ, শেষমেশ একদম উচিৎ শিক্ষা হইছে, সেইদিনতো আমারে খুব কামড়ে দিছিল না? খুব, না?'
কিন্তু এছাক কাকা কি করে বুঝল, ওইখানেই আছে মাছখান? কি করে বুঝল? কি করে? কোন মন্তর তন্তর না তো? আমারে শিখাবে? আমি আমি এছাহাক কাকার দিকে তাকিয়ে বললাম, 'কাকা, ওইখানে মাছ আছে বুঝলেন কেমনে? মাছতো দেখি নাই। পানির অনেক নিচে আছিল'।
এছাক কাকা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে গর্বিত ভঙ্গীতে বললেন, 'এইটা এছাক মেয়ার চৌখ, মাছ মারি আইজ কুড়ি বৎসর, কম জিনিষ কি আর শিখছি?'
আমি কৌতুহলি গলায় বল্লাম, 'কি কাকা, কি শিখছেন? কোন মন্তর তন্তর?'
এছাক কাকা রহস্যময় ভঙ্গীতে হাসলেন। তারপর বললেন, 'মন্তর আর কী রে ব্যাটা? এইটা হইল জ্ঞান! ওই যে ছোডছোড ঝাঁক বান্ধা পোনাগুলান দেখছস না? ওইগুলান হইল এই হৌল (শোল) মাছের পোনা। তো এই পোনাগুলা পানিতে থাকলে অন্য মাছে আইসা খাইয়া ফালায়। এইজন্য হৌল মাছ সবসময় তার পোনাগো পাহারা দেয়। আর পাহারা দিতে আইসাই সে ঝাঁক বাঁধা পোনার ঝাকের নিচে নিচে থাকে। যাতে পোনার ঝাকের আশেপাশে কোন বিপদ ঘেঁষতে না পারে! বুঝসইতো, মা না? দুনিয়ায়ায় সব জন্তু জানয়ারেরই মা আছে, আর সব মায়েগো মায়াও এক। সব মায়গোই তার ছানাপোনার জন্য মায়া। এই মায়া মানুষের মায়গো চাইতে কম কিছু না রে... এইজন্যই যহনই পানিতে ঝাঁক বাঁধা হৌল মাছের পোনা দেখবি, বুঝবি ওইগুলার নিচেই আছে আসল বড় হৌল। বুঝছস? এইডাই আসল মন্তর! ছুঃ মন্তর ছুঃ...'
এছাক কাকা বিরাট ফিলসফি কপচে দেয়ার আনন্দে খে খে করে হাসছেন। আমি এছাক কাকার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়েই আছি। একদৃষ্টিতে। অপলক। স্থির। আমার হঠাৎ কি হল, আমি চোখ ফেরালাম সেই স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ জলে। আমি মুহূর্তেই অবাক হয়ে দেখলাম ঝাঁক বাঁধা সেই পোনাগুলো আর নেই। তারা একটা দুটো করে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডোবার চারধারে। এখানে সেখানে। চারধারে। তারা যে যার মত ঘুরছে, দিশেহারা, এলোমেলো। কি করছে তারা? তারা কি তাদের মা কে খুঁজছে? তারা কি কাঁদছে? তাদের চোখে কি জল আছে? তাদের চোখের সেই জল কি মিশে যাচ্ছে ডোবার জলে?
আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। তাদের মা কোচের সূচের মাথায় গেঁথে এখনও ছটফট করছে। আচ্ছা, সে কি শুনতে পাচ্ছে তার পোনাদের কান্না! সে কি জানে, তার ছানাপোনারা পাগলের মত তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পাগলের মত! তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখন অন্য মাছেরা এসে তাদের একটা দুটো করে খেয়ে ফেলবে। একটা দুটো করে। সবাইকে খেয়ে ফেলবে? সে কী জানে? জানে সে? সেতো মা! মা তো জানেই, নিশ্চয়ই জানে, জানেই। নিশ্চয়ই জানে...'
কে জানে, জানে কি না, তবে বুকের ভেতর ছ'ছটা ধারালো, তীব্র, তীক্ষ্ণ সূচে বিদ্ধ হয়েও মা মাছটা যেন তাকিয়ে আছে জলে। তার সেই তাকানো জুড়ে জগতের ভয়ঙ্করতম কষ্ট, তিব্রতম কান্না। আমি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমার মনে হল সেই চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল। সেই জল মিশে যাবে জলে। যেই জলে মিশে আছে তার মাতৃহারা সন্তানদের কান্নাও। কান্নার জল।
হয়তো এই জলই খুঁজে পাবে জল, খুঁজে পাবে মা আর তার ছানাদের। জলে ও জ্বলে। জল মিশে যাবে জলে...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৭