সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি। আমি যে বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি সেটা হলো কনের বাড়ি অর্থাৎ আমি ঐ বাড়িতে কনে পক্ষ। কনের বাড়ি বলে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে একটু বেশি। যেহেতু বিয়ে বাড়ি তাই লোকজনও ভুড়িভুড়ি।
গ্রাম বাংলার বিয়ে তাই আমি আগ্রহ নিয়ে প্রতিটা বিষয় অতিশয় উপভোগ করি।
রাত হওয়ার আগে এক সময় বর তার সহদর এবং সহচরদের সাথে নিয়ে কনের বাড়িতে মাইক্রো গাড়িতে আগমন করে। কিশোর-কিশোরীরা বর আসার সাথে সাথে দৌড়ে হুড়োহুড়ি করে গেটের কাছে যায়। রীতি অনুযায়ী নীতি না মেনে গেটে প্রবেশ মূল্য নিয়ে দু'পক্ষের মধ্যে কিছু সময় দর কষাকষি হলেও সম্প্রীতির ইতি হয় না। কারণ, দু'পক্ষের লোকদেরই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভক্তি থাকে। কনে পক্ষের দাবি নিষ্পত্তি করে গেট দিয়ে প্রবেশ করে আয়েশ করে খেতে বসে যায়। সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর বিয়ের মূল আকর্ষণ অর্থাৎ কলমা পড়ানো এবং কন্যা সম্প্রদান।
রীতি অনুযায়ী আগে মেয়েকে কলমা পড়ানো হয়। ছোট বেলায় দেখেছি, বিয়ের কলমা পড়ানোর সময় বিয়েরপাত্রী কেঁদে একেবারে অস্থির হয়ে গেছে। কলমা পড়াতে আসা মৌলভি সাহেব, শুনতে আসা দু'জন সাক্ষি আর দেখতে আসা দু'পক্ষের দর্শকেরাও অতিষ্টে অস্থির হয়ে গেছে। কারণ, তিনটা কবুল তিনঘণ্টা ধরেও বলেছে অনেকে। কিন্তু এখন অতি আধুনিকতার কারণে বিয়েরপাত্রী কলমা পড়ার সময় কাঁদে না বা বলতে বিলম্ব করে সময়ও নষ্ট করে না।
তাই আমাদের শিক্ষিত কনেও কলমা পড়ানোর সময় কেঁদে বা বলতে বিলম্ব করে সময় নষ্ট করে না। এতে নানী-দাদীরা "ওরে ছিঃ, কলমা পড়ানোর সময় একটু কাঁদলেও না। টপাটপ বলে দিল।" এমন অনেক কটুকথা বলে কটাক্ষের সুরে আড়ালে আড়ালে নিকুচি করে। দাদি-নানী বা বড় ভাবী কিংবা পাশে বসে থাকা কাজিন বা বান্ধবীরা এমন অনেক কথাই কনেকে অহেতু লজ্জা দেওয়ার জন্য বলে থাকে। এমন লক্ষ্য অকথা অকারণে অযথা অপব্যয়ের পর বাদ মাগরিব কন্যা সম্প্রদানের সময় নির্ধারণ করে বাড়ির মুরুব্বি কনের দাদাজান দবির মন্ডল।
নির্দিষ্ট সময়ে বর আসন থেকে বরকে এবং কন্যা আসন থেকে কন্যাকে এনে সম্প্রদান আসনে একত্রিত করা হয়। মৌচাকে যেমন মৌমাছি ঘিরে রাখে ঠিক তেমনি ভাবে বর-কনের চারপাশে বিয়ে বাড়িতে অবস্থানরত ছোট-বড় নারী-পুরুষ সকল লোকজন কন্যাসম্প্রদান দেখার জন্য বর-বউকে ঘিরে রাখে।
কন্যা সম্প্রদান দেখতে আমিও সেই ভিড়ে কষ্ট করে অবস্থান করি সম্প্রদান আসনের পাশে।
প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নীতি মেনে বর-কনের সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধার জন্য কনের বাড়ির সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তি কনের দাদা দবির মন্ডল এসে চোখের পানি ছেড়ে বর মেহেদী হাসানের হাতে কনে আঁখি আক্তারের হাত রেখে টলমল চোখে বলে..........
- "ধর্ম মতে আজ হতে আমার নাতনির পতি তুমি; এখন তোমরা একে অপরের জন্য হালাল। সেহেতু আজ থেকে আমার নাতনির সমস্ত দায়দায়িত্ব তোমার। নিজে ধর্মকর্ম করবে এবং তাকেও করার জন্য উৎসাহ দিবে। সুখ-দুঃখ আনন্দ-উল্লাস কোনটা থেকেই হতভাগীকে বঞ্চিত করো না।"
চোখের পানি মুছে আবার বলে.....
"- ভাই রে, বিধির বিধান অনুযায়ী আমার কলিজার একপাশ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছো। ওরে কোনো সময় কষ্ট দিওনা।"
"- দোয়া করবেন"
বর মেহেদী হাসান অত্যান্ত সরল সুরে নম্রভাবে বলে।
চোখের পানি হাতের আঙুল দিয়ে মুছতে মুছতে দবির মন্ডল নাতনি আঁখিকে উদ্দেশ্য করে বলে..........
-"শ্বশুর বাড়িতে এমন কোনো আচরণ করিস না যার কারণে আমাদের বদনাম হয়।
মনে রাখিস, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। লাল শাড়িতে জড়িয়ে আজকে তোকে যেখানে পাঠাচ্ছি কাফনের সাদা কাপড় না পড়া পর্যন্ত ঐ বাড়ি থেকে বের হবি না।
জানিস-ই তো, তুই মন্ডল বাড়ির মেয়ে; আর মন্ডল বাড়ির মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়।"
আঁখি কিছু বলে না; শুধু ফ্যালফ্যাল করে দাদাজানের দিকে চেয়ে থাকে। মুখে বিরক্তির ছায়া পড়ে আঁখির। তবে দাদাজানের কথাগুলো মনোযোগসহই শ্রবণ করে সে।
বাবা আজগর মন্ডল আর মা শাহানা বানু থাকে পাশেই। আজগর মন্ডল মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে........
- "মা রে, এই আঠারটি বছরে তুই হয়তো অনেক সময় অনেক কষ্ট পেয়েছিস। বেশি কিছু চাসনি। যেগুলো চেয়েচিস সেগুলোও অনেক সময় দিতে পারিনি। দোয়া করি, স্বামী সংসারে তুই যেন রাজরাণী হোস।"
আজগর মন্ডল আর কিছু বলতে পারে না। আঁখিকে সম্প্রদান করতে আঁখিজলে আঁখি ঝাপসা হয়ে যায়। বুকের ভেতর দম জমাট বদ্ধ হয়ে থাকে। তাই কিছু বলতে না পেরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। আজগর মন্ডলের স্ত্রী শাহানা বানু কান্নায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে রোদন করে।
কন্যাসম্প্রদানে আজগর মন্ডলের চেয়ে শাহানা বানুর কষ্টটা সবচেয়ে বেশি। আঁখি জন্মগ্রহণের পূর্বে শাহানা বানুর ইকলামশিয়া হয়। উপজেলা হাসপাতালের ডাক্তার বলে, "মৃত্যু বাচ্চা হবে আর না হয় মা-সন্তানের দু'জনের একজন মারা যাবে।" সন্তান প্রসবের পর ডাক্তারেরা শাহানা বানুকে মৃত্যু ঘোষণা করে।
হাসপাতালে উপস্থিত তার বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। মৃত্যু শাহানা বানুকে স্টেচারে করে যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় তখন মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় পা নাড়া দিয়ে ওঠে শাহানা বানু।
ডাক্তারদের মৃত্যু ধারণা ভুল হলেও তিন মাস শাহানা বানু প্রায় মৃতের মতই হাসপাতালের বেডে অবস্থান করে। আঁখিকে জন্মদানে জীবনের ঝুঁকিতেও আঁখিকে সম্প্রদানে আজকের মত এত কষ্ট হয়নি তার। যেহেতু মেয়ে তাই শ্বশুর বাড়িতে তো যেতেই হবে। শাহানা বানুও তো একদিন এমনি ভাবে সকল মায়া-মমতার বাঁধন ছিঁড়ে নতুন বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিল। জগতের এই ধ্রুব সত্য মেনে নিয়ে নিরব ভাবে শাহানা বানু নাড়ি ছিঁড়া ধন আঁখির গলা জড়িয়ে ধরে রোদন করতে থাকে।
এতে আঁখি মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হয়। মুখে বিষন্নতার ছায়া স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কারণ, আঁখি তার মেকাপ নিয়ে খুবই সচেতন। যদি কোনো কারণে মেকাপ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো এখন আর পার্লারে যাওয়া যাবে না। দাদাজান দরিব মন্ডল, বাপজান আজগর মন্ডল আঁখি ভিজিয়ে আঁখিকে তার স্বামীর হাতে সম্প্রদান করলেও আঁখির আঁখিতে জল আসে না। চোখের জলে যেন মুখের মেকাপ নষ্ট না হয় তাই আঁখির আঁখি শুষ্কই থাকে।
-সোহাগ তানভীর সাকিব
তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩০