জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা। একদিন তিনি পণ করলেন অনেক সম্পদ আয় করতে হবে। এজন্য তিনি এক কাজ করলেন। একটা চেকে এক লাখ ডলার লিখে দেয়ালের এমন একটি স্থানে লিখে রাখলেন, যাতে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। ঘুম থেকে উঠেই তিনি ওই চেকটি দেখতেন আর বলতেন আমাকে এই চেকটি পেতেই হতে। তিনি একটা বই লিখেছিলেন। প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে সেটি নিয়ে ঘুরছিলেন। তবে কেউ সেটি প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। বইটি ছিল মোটিভেশনাল ধরনের। সফলদের মোটিভেশন মানুষ শুনতে চায়। কেউ বেকার মানুষের মোটিভেশন শুনতে চায়না। তিনি প্রতিদিন ওই চেকটি দেখতেন আর কল্পনা করতেন। বইটির লাখ লাখ কপি বিক্রি হচ্ছে। তিনি অনেক সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। একদিন তিনি আরেকজনের সাথে ‘চিকেন স্যুপ ফর দ্যা সোল’ নামে একটি বই লেখার সুযোগ পান। তারপর অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যে বইটির বিক্রি ৫শ মিলিয়নের অঙ্ক ছুঁয়ে যায়। পরে এই বইয়ের সিরিজ লিখে যান। পরবর্তীতে তার জীবনে অর্থ খ্যাতি সবই এসেছে। একটি চেকেই তিনি এক লাখ ডলার পেয়েছিলেন। তিনি আরেকটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘দি সাকসেস প্রিন্সিপালস: হাউ টু গেট ফ্রম হোয়ার ইউ আর টু হোয়ার ইউ ওয়ান্ট টু বি’। আপনি যেখান থেকে যে স্থানে যেতে চান সেই সফলতার মূলনীতি। আজকে সেই মূলনীতি নিয়েই কথা হবে।
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনাটা ব্যাখ্যা করি। তিনি পণ করেছিলেন, তিনি মোটিভেশনাল স্পিকার হবেন। উদ্বুদ্ধকারী বক্তা হিসেবে বই লিখে লাখ লাখ ডলার আয় করবেন। তিনি লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো স্থির। তিনি বিশ্বাস করতেন এই সম্পদ তিনি অবশ্যই আয় করতে পারবেন। বিষয়টা তিনি কল্পনা করতেন। এরপর আইডিয়া উদ্ভাবন করলেন। সবশেষে সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি যে প্রক্রিয়ার মধ্যে সফলতার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিলেন, আসলে এটা একটি থিউরি।
কী সেই থিওরি! কোন জিনিস পেতে হলে সেটাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেটি জীবনে আসবে এই বিশ্বাস রাখতে হবে। তাকে বারবার কল্পনা করতে হবে। সেই অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। এতে একটি পজেটিভ ভাইব্রেশন তৈরি হবে। যে জিনিসটা প্রত্যাশা করা হয় সেটারও ভাইব্রেশন রয়েছে। সেও কারো কাছে যেতে চায়। এরপর প্রকৃতি বা অমোঘ বিধিই পরষ্পরকে ম্যাচিং করে দেয়। দুই প্রান্তের চাহিদার ম্যাচ হলেই অবশেষে তাকে পাওয়া যায়। এটাই হলো ল অব অ্যাট্রাকশন।
আপনার জীবনে যা কিছু আসছে আপনি নিজেই তাদের আকর্ষণ করে আনছেন। আপনার মনে ভেতরে যে ছবি আপনি ধরে রেখেছেন তার মাধ্যমেই আকর্ষিত হচ্ছে। আপনি যা চিন্তা করছেন ঠিক সেটাই হচ্ছে। আপনার মনের মধ্যে যা কিছু ঘটছে আপনি তাকেই নিজের কাছে আকর্ষণ করছেন। আসল কথা হলো- আপনার প্রতিটি ভাবনাই হলো সত্য প্রকৃত শক্তি।
কথা হলো- বিশ্বের বিখ্যাত ও সফল ব্যক্তিরা এ বিষয়টি জানতেন। তারা সে অনুযায়ী কাজ করে সফল হয়েছেন। তবে তারা সূত্রটা গোপন রেখেছিলেন। আমেরিকায় যে চিন্তাধারা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার পুরোধা ছিলেন প্রেন্টিস মুলফের্ড৷ তিনি ১৮৮৬ থেকে ১৮৯২ সালে ‘ইওর ফোর্সেস অ্যান্ড হাউ টু ইউজ দেম’ শীর্ষক লেখায় প্রথম ল অব অ্যাট্রাকশনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। প্রেন্টিস বলেছিলেন, যেসব মহান মানুষরা এসেছিলেন, তারা আমাদের বলে গেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ম হলো- ল অব অ্যাট্রাকশন। ১৯১২ সালে চার্লস হ্যানেল লিখেছিলেন, এই শ্রেষ্ঠ ও অভ্রান্ত নিয়মের ওপর সৃষ্টি ব্যবস্থা নির্ভর করে আছে।
১৯ শতকের গোড়ার দিকে ফিনিয়াস কুইম্বি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ সেসময় যক্ষ্মা রোগের কোন সুচিকিৎসা ছিলনা৷ কুইম্বি শারিরীক কষ্ট দূর করতে ঘোড় দৌড়ে অংশ নেন৷ ঘোড়ায় চড়ার তীব্র উত্তেজনা সাময়িকভাবে তার যক্ষ্মা রোগের কষ্ট উপশম করে৷ পরে তিনি দিনের পর দিন ঘোড়দৌড়ে পুরাপুরি মনোনিবেশ করেন৷ এতে একসময় তার যক্ষ্মা রোগ ভালো হয়ে যায়৷ এভাবে তিনি 'মাইন্ড ওভার বডি' থিওরি আবিস্কার করেন৷ প্রমাণ করেন মন দিয়েই শরীরসহ সব নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ এর ওপর ভিত্তি করে জাপানে একটা হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ সেখানে সেক্স থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়৷ নার্সসহ কোন স্টাফের শরীরে পোশাক থাকবেনা৷ যাতে রোগীদের ভেতরে কামনাভাব জাগ্রত হবে৷ রোগের তীব্রতা সাময়িকভাবে দূর হয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে রোগীরা যাতে ভালো হয়ে যান৷
২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান টিভি উপস্থাপক Rhonda Byrne সাতজন ‘ল অব অ্যাট্রাকশন’ বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিয়ে টেলিভিশনে একটি ডকুমেন্টারি অনএয়ার করে বিষয়টি প্রকাশ করে দেন। এতে সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। পরে এটি নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম রাখা হয় দি সিক্রেট। সাথে সাথেই ত্রিশ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় এবং বিশ্বের পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হয়। এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে চারদিক থেকে ল অব অ্যাট্রাকশনের সফলতার গল্প আসতে শুরু করে।
প্রথমে যে সফলতার গল্পটি বললাম- সেটাও ল অব অ্যাট্রাকশনের একটি ঘটনা। আমার জীবনেও এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। এর আগেও আমি কোনো একটি লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। বলেছিলাম, আমার পড়ার টেবিলে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কয়েকটি লাইন লিখে রেখেছিলাম। গানের লাইনগুলো ছিল-নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে। যদি পণ করে থাকিস, সে পণ তোমার রবেই রবে। ওরে মন, হবেই হবে ॥ তার মানে রবীন্দ্রনাথও ল অব অ্যাট্রাকশনের কথা জানতেন। আর আমি না জেনেই সেটা অনুসরণ করেছিলাম৷
দি সিক্রেট বইতে কী রয়েছে- চলুন জেনে আসি। একই রকম বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এর মাধ্যমে ভালোকে আকর্ষণ করা যায় আর মন্দকে দূরে রাখা যায়। এজন্য মনের শক্তিটাই আসল। আপনার বর্তমান ভাবনাটাই ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করছে। যেটি আপনি সবচেয়ে বেশি ভাবেন, যার প্রতি আপনি সবচেয়ে বেশি নজর দেন, সেটাই একসময় আপনার জীবনে আবির্ভাব হয়। এটি মধ্যাকর্ষণের নীতির মতোই নিরপেক্ষ। ভালোবাসার অনুভূতিটাকেই সবচেয়ে বেশি প্রেরণ করা যায়। আপনি যতবেশি ভালোবাসা অনুভব ও প্রেরণ করবেন তত নিজের শক্তি বাড়িয়ে তুলতে পারবেন।
কথা হলো- এই রহস্যটা কীভাবে প্রয়োগ করবেন। এটা আলাদীন ও তার চেরাগের মতো। প্রদীপ থেকে জ্বিন বেরিয়ে এসে একটা কথাই বলতো- আপনার ইচ্ছাই আমার কাছে আদেশ। মানুষের জীবনের রহস্যের উন্মোচনটা রাতের অন্ধকারে গাড়ি চালানোর মতো। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে সর্বোচ্চ দুইশ ফুট সামনে দেখা যায়। চলতে শুরু করলে পরবর্তী পথ উন্মাচিত হয়। এজন্যই আমি বলতাম, ‘পথে নেমে পড়ুন। পথই আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবে’। মার্টিন লুথার কিং বলতেন, ‘প্রথম ধাপটিকে বিশ্বাস করুন। আপনার পুরা সিড়িটা দেখার দরকার নেই। আপনার কাজ প্রথম ধাপে পা রাখা’। এখানে দৃষ্টিভঙ্গিটা আসল। কেউ শরীরের ওজন কমানোর জন্য ওজন কমানোর ওপর মনসংযোগ করবেন না। তার বদলে সুন্দর স্বাস্থ্যের প্রতি নিজেকে ব্যপৃত রাখুন। আকর্ষণের নিয়মে ছোট চাওয়া দিয়ে শুরু করা সহজ। নিজের আকর্ষণের ক্ষমতা বুঝতে পারলে আরো বড় কিছু আকর্ষণের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে যান। যেগুলো আপনার মনমতো হয়নি, আপনার মনমতো যেটা হতে পারতো মনে মনে তার অভিনয় করতে হবে। সুখি অনুভব করাই হলো আপনার জীবনে ধন সম্পদকে কাছে টানার দ্রুততম উপায়।
লেখাটা দীর্ঘায়িত করবোনা। এই থিওরির বহু বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে অপবৈজ্ঞানিক আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। মেডিটেশনের মনের জোর মানুষকে বহুদূরে পৌঁছে দেয়।
কেউ যদি এ তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন তাহলে মনে রাখতে হবে, মানুষ মাত্রই তার প্রয়োজন আছে। আর এই পৃথিবী সবার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম৷ তবে লোভ ভিন্ন বিষয়। কোনো একজনের লোভ মহাবিশ্ব তার সবকিছু দিয়েও মেটাতে সক্ষম নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬