somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বজয় করা বাংলাদেশী গাড়ির জাদুকরের গল্প

০৩ রা মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেকেই হয়ত জানেন না যে সারা বিশ্বে মোটর গাড়ি ডিজাইন এবং কোচ বিল্ডিং এর পথিকৃত লিপু আউলিয়া একজন বাংলাদেশের সন্তান। সাধারণত পুরোনো গাড়ি ভেঙ্গে নতুন স্পোর্টস কার প্রস্তুত করার দক্ষতার জন্যে উনি সারা বিশ্বে সমাদৃত এবং বহুল আলোচিত।
পুরো নাম নিজামুদ্দিন আউলিয়া লিপু। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় তার জন্ম। ঢাকাতেই তার শৈশব কেটেছে। ক্লাস নাইন পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র। বাল্যকাল থেকেই লিপুর রেসিং কারের প্রতি ছিলো তীব্র আগ্রহ। কিন্তু দেশে তখনো সেই মানের কোন রেসিং কার ছিলোনা। লিপুর বয়স যখন ১৬ তখন বাবার চাকরির সুবাধে লিপুকে পাড়ি জমাতে হয় সৌদি আরবে। সেখানেই তিনি প্রথমবারের মত মোটর গাড়ি প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পান। তবে নামী-দামী ব্র্যান্ডের ভীড়ে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বিভিন্ন ডিজাইনের স্পোর্টস কারগুলো। বিশেষ করে 'ফেরারি' ব্র্যান্ডের গাড়ি দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তখন থেকেই মূলত তিনি একজন কার ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সৌদি আরবে থাকাকালীন বাবা তাকে কিনে দিয়েছিলেন একটি জাপানি মাজদা গাড়ি। সেই থেকেই শুরু লিপুর গাড়ির জীবন। বাংলাদেশে তখন খেলা বলতে একমাত্র ক্রেজ ছিলো ফুটবলের। ক্রিকেট তখনো আমাদের মানুষের মনে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। লিপুর ভাই-বোন ও বন্ধুরা যখন ফুটবল,ক্রিকেট আর ভলিবল নিয়ে ব্যাস্ত তখন থেকেই লিপুর মন পড়ে থাকতো গাড়ির দিকে। তখন থেকেই তিনি নতুন নতুন গাড়ি খুঁজতে শুরু করেন। বেশি দামি গাড়ির নকশা কেমন হয়, কেমন হয় কম দামি গাড়ির নকশা এই নিয়েই চলে তার দিনমান। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন কমবেশি ১৪ ফুট বাই ৬ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটা জায়গায় কিভাবে মানুষের, জিনিসপত্রের, ইঞ্জিনের জায়গা হয়ে যায়? এর মধ্যেই আবার নানান ধরনের নকশা! দেখেন এর ইঞ্জিন, আসনবিন্যাস, মালামাল রাখার জায়গা। তিনি একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির তুলনা করে দেখতে থাকেন। টয়োটা এক রকম করে তো মাজদা, হোন্ডা আরেক রকম। রোলস রয়েস, মার্সিডিজ যায় আরো দূর। ফেরারি, অডি, ল্যাম্বরজিনি তো দেখার মতো।



ছবিঃ নিজের তৈরী করা গাড়ির সামনে গাড়ির জাদুকর নিজামুদ্দিন আউলিয়া লিপু।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে হাতুরি-বাটাল দিয়ে লিমো-বিল নামে একটি গাড়ি তৈরী করে সবাইকে চমকে দেন। অথচ তখন পর্যন্ত গাড়ির বডি ওয়ার্ক ও পেইন্টের কাজ কি করে করতে হয় সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞ্যান ছিলোনা তার। গাড়িটি ডিজাইন করার জন্য লিপুর একমাত্র অবলম্বন ছিল শুধুমাত্র ল্যাম্বর্গিনি কাউনটেচের একটি পোস্টার। পোষ্টারের সাথে মিল রেখে তিনি গাড়ি তৈরী করে ফেলেন পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই।
নিজামুদ্দীন লিপু প্রথম আলোচনায় আসেন "৮২ মডেলের হোন্ডা সিভিক গাড়িকে ফেরারি কোইজিন টেসটারোসাতে রুপান্তরের মাধ্যমে। নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে তাকে নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে লিপুর তৈরী করা ফেরারি গাড়ি প্রদর্শন করা হয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই প্রথম লিপু সবার নজর কাড়ে।
সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর লিপু অটোমোবাইল প্রযুক্তিতে উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানস্থ জেনারেল মোটরস ইনস্টিটিউটে। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষাব্যাবস্থা আর তত্ত্বীয় জ্ঞ্যানের প্রচুর চাপ থাকায় দ্রুতই হাল ছেড়ে দেন তিনি। তারপর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে নিজের নামেই চালু করে একটি ওয়ার্কশপ। সেখানে তিন বছর কাজ করার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং লোকজনকে পছন্দমত গাড়ি বানিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেন। এই কাজে তিনি ব্যাবহার করতেন জাপানি ডাইহাটসু ও টয়োটা গাড়ি।

২০০০ সালে লিপু ঢাকায় তাঁর গাড়ি প্রস্তুত করার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেইসময় তিনি ল্যাম্বর্গিনি ডিয়াবলোর অনুকরণে লিপু নামে একটি গাড়ি প্রস্তুত করেন। যেটি পরে লিপুজিন নামে পরিচিতি পায়। ২০০২ সালের শেষের দিকে লিপু ফেরারি নির্মাণ শুরু করে। এ সময় বিবিসি তাকে নিয়ে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রচার করে। এই রিপোর্টের সূত্র ধরে ফেরারি ওনার্স ক্লাব তাকে স্থান দেয় তাদের ওয়েবসাইটে। লিপুর বানানো স্বাধীনতা এফ-সেভেন্টি ওয়ান নামে একটি গাড়িকে এই সাইটে 'দ্য বাংলাদেশ ফেরারি' উপাধি দেয়া হয়। ২০০৪ সালে ইন্টারসেকশন ম্যাগাজিনের মাধ্যমে প্রধানত লিপু নজরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান। নিজেকে দিনে দিনে বিভিন্ন জায়গায় মেলে ধরার সুযোগ পান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- যুক্তরাজ্যের ঢাকা সিটি এক্সিবিশন। ২০০৬ সালে ডিসকভারি চ্যানেল লিপুকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করেন এবং তাকে আট সপ্তাহের মধ্যে দুটি গাড়ি তৈরি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। ককনি কার মেকানিক বার্নি ফাইনম্যানের সাহায্যে মাত্র সাত সপ্তাহেই তিনি এই কাজ সম্পন্ন করেন। ওই বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম গাড়িটি বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) আয়োজিত ঢাকা মোটর শোতে প্রদর্শিত হয়। যেটি ছিলো এম টোয়েন্টিসিক্স নামে একটি স্পোর্টস কার। এই কারটি বানানো হয়েছিল ২২ বছরের পুরনো একটি টয়োটা স্প্রিন্টার থেকে। যা বানাতে লিপু সময় নিয়েছিলেন মাত্র চার সপ্তাহ।
দিনে দিনে এই গাড়ির জাদুকরের নাম যখন চারদিকে ছড়িতে পড়তে থাকলে তাকে নিয়ে বিবিসি, ডিসকভারি, হিস্টোরি চ্যালেনসহ আরো বেশ কয়েকটি চ্যানেলে লিপুকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করে। হিস্টোরি চ্যানেলের সাথে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লিপু বলেন "আমি একজন স্বাধীনচেতা মানুষ যে কিনা সকল কাজে নিজের ইচ্ছের প্রতিচ্ছবি দেখতে পছন্দ করি। আমি নিজেই গাড়ির ডিজাইন করি এবং নিজেই বানাই। যখন আপনি নিজের ডিজাইন করা গাড়ি নিজেই বানাচ্ছেন তখন আশেপাশের লোকজন কি ভাবলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয় না। একজন শিল্পি যখন কাজ করেন, সে কেবল তার সৃষ্টি নিয়েই ভাবেন। এটা তার নিজের ভুবন যেখানে তিনি হারিয়ে যেতে পারেন ইচ্ছেমত।"
লিপুকে নিয়ে তৈরী করা সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম হলো 'লিপু অ্যান্ড পিটবুল শো'। এটি মূলত হিস্টোরি চ্যানেল নির্মিত একটি রিয়ালিটি শো। এই শোতে লিপু গাড়ির নকশা করেন আর পিটবুল কারিগরি দিকটি সামলান। পিটবুল হচ্ছেন আমেরিকার একজন মাস্টার কার মেকানিক। 'স্টিভস পিটবুল মোটরস ইনকরপোরেটেড' নামে একটি অটোমোটিভ গ্যারেজ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হিস্টোরি চ্যানেলে এখন পর্যন্ত 'লিপু অ্যান্ড পিটবুল শো'র ৮টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে।
বর্তমানে আমেরিকান প্রবাসী লিপু তাঁর ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরিতে ৪ জন সহকারী মেকানিককে নিয়ে কাজ করেছেন। এখানে তিনি পুরনো মরচে পড়া টয়োটা আর হোন্ডা গাড়ির বডি কাটছাঁট করে গাড়ি গুলোকে ফেরারি ও ল্যাম্বর্গিনির মত দামি ও বিলাসবহুল স্পোর্টস কারে রূপান্তর করেন। সাধারণত যেসব গাড়ি ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন হয় না কিন্তু ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত গাড়ির অনুকরণে প্রস্তুত করা হয় সেইসব গাড়িকে ইমিটেশন গাড়ি বলা হয়। লিপু তার ফ্যাক্টরিতে প্রধানত ইমিটেশন কার নির্মাণ করেন।
অটোমোবাইল ডিজাইনার হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন লিপু। এখন পর্যন্ত তার নকশা করা গাড়ির সংখ্যা একশ'র বেশি। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন এই বাংলাদেশীর কৃতিত্ব নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যত না আলোচনা হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও হয়নি তার নিজের দেশে। দেশের বেশীর ভাগ মানুষই সঠিক ভাবে নামটাও জানেন না তার!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩২
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×