আমাদের এবারের যাত্রা খুব কাছের আর অনেক-অনেক গল্প-কথা-কবিতা-উপন্যাস সৃষ্টির সাতকাহনের স্বর্গীয় পাহাড়ে ঘেরা ও পাহাড়ে মোড়া ডার্লিং (প্রেয়সী) দার্জিলিং এর দিকে। চলুন এই আঁতেলের কিছু আতলামি আর বেশ কিছু ফাজলামি ও ভুলভাল, উৎকট উপমায় সেই গল্পটা শুনি।
পড়তে-পড়তে বমি পেলে আমার ইনবক্সেই যা কিছু ঝাড়ার বা গালি দেবার দিয়ে দিয়েন, কোন আপত্তি বা অভিযোগ করবোনা।
আমাদের এমনই একটা টিম যাতে সাধারণত ছয়জন সব সময়-ই থাকি আর বাকি থাকে দুই-একজন কখনো-সখোনো যোগ-বিয়োগ হয়ে থাকে। তো এই ছয়জন আবার ছয় চরিত্রের।
রাত খুব সম্ভবত ১০ টায় বাস ছেড়েছিল কল্যানপুর থেকে, বাস ছাড়ার আগে সবাই একত্রে এক জায়গায় হতেই একটা অন্য রকম আনন্দ আর উত্তেজনার বিভা ছড়িয়ে পড়েছিল সবার চোখে-মুখে আর কথা-বার্তায়। মধ্য রাতে পৌছালাম বগুড়ার ফুড ভিলেজ। সেখানে হালকা খাবার আর চায়ের পর্ব শেষ করে আবার বাসে উঠে ঘুম, এবার আর কোন কথা নয়, এই ঘুম সেই ঘুম, যেন অনন্ত ঘুম! কাক ডাকা আর সূর্যের লালা আভা ছড়ানো ভোঁরে বুড়িমারি সীমান্ত।
সেখানে প্রাতরাশ-নাস্তা আর বেশ খানিক বিশ্রাম, বর্ডার পার হবার নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতা শেষে আবার ওপারে গিয়ে আর এক দফা ভিসা-পাসপোর্ট এর যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে বাসে উঠে শিলিগুড়ির পথে।
শিলিগুড়ি পৌঁছেই রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেল সারা শরীর জুড়ে! আরে এই তো সেই শিলিগুড়ি যে জায়গার কথা পড়েছি কত-শত গল্প আর উপন্যাসে, সেই প্রিয় সুনীল ও সমরেশের বহু লেখায়, লেখা পড়ে-পড়ে প্রেমে পড়েছিলাম এই সব জায়গার! আর আজ সেই জায়গায়-ই দাড়িয়ে?
কিছুক্ষণ পরে আমাদের নিজেদের ভাড়া করা টাটা সুমো এসে হাজির। আমরাও চেপে বসলাম আগামীর রোমাঞ্চের নেশায় বুঁদ হয়ে। মিহি পীচ ঢালা পথ বেঁয়ে চলছে আমাদের জীপ সাথে আমাদের আরও একটি ভ্রমণ স্বপ্ন সত্য হবার আনন্দে আত্নহারা আমরা সবাই। সব ভুলে সামনের অবারিত পথের দিকে। দুই পাশের নির্মল সবুজ প্রকৃতি আর দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত নান্দনিক চা বাগান আমাদের মন্ত্র মুগ্ধর মত মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল সমতলের সব টুকু পথ!
হ্যাঁ সমতল পর্যন্তই , কারণ এর পরেই তো শুরু হয়েছিল পরম প্রার্থিত প্রেয়সীর হাতছানি আর দূর থেকে উঁকি দিয়ে বারে-বারে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসার মত আকুল আকর্ষণ! মানে পাহাড়দের আঁকিবুঁকি কাছে-দূরে-দূর দুরান্তে যতদূর চোখ যায় পাহাড়-পাহাড় আর পাহাড়, মেঘের-সবুজের যে এতো রকম ফের সে সেবারই প্রথম দেখেছিলাম বা বুঝেছিলাম।
চারপাশের সবুজে ছাওয়া চা বাগান আর সেনা বাহিনীর আচ্ছাদন পেরিয়ে ডানে বাঁক নিতেই সমতল পথ হঠাৎ উঁচু হতে শুরু করলো! কোন রকম পূর্ব ঘোষণা বা অনুমান ছাড়াই জীপ যেন ওই নিল আকাশ আর সাদা মেঘ ছুতে চাইলো! আমরা হা...... হয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতি আর বাস্তবতার এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখে!
সমতল থেকে উঁচুতে উঠার সাথে সাথেই জীপ এক-একটা ভয়াবহ বাঁক নিতে শুরু করলো, এটাও কোন রকম পূর্ব অনুমান ছাড়াই, আমরা বিস্মিত আর বিস্মিত! সেই সাথে আকাশের মেঘেদের খুব কাছ থেকে আমাদের অভিবাদন। এই প্রায় গাঁ ছুঁয়ে-ছুঁয়ে! কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে এখনো!
এই রকম পাহাড়ের গাঁ ঘেঁসে-ঘেঁসে কয়েকটা পাহাড় ডিঙিয়ে আর এক পাহাড়ের কোলে গিয়ে খানিক অবসর। যেখানে আবার আরও অনেক উঁচু পাহাড়েরা তাদের আঁচলের ছায়া দিয়ে রেখেছিল আমাদের, সেই সাথে গরমের যেন একটু যাই-যাই ভাব! কিছু খেয়ে আর সামান্ন একটু পানীয় নিয়ে আবার জীপে উঠে পড়লাম।
কয়েক মিনিট যেতেই আরও বিস্ময় নিয়ে আমাদের স্তব্ধ করে দিল মায়াময় মেঘ আর ভিজিয়ে দেয়া কুয়াশা! আর শেষ এপ্রিলের গরম, সে কোথায়? একটু আগেই তো ছিল আমাদের কাছেই, বাতাস খাব বলে গাড়ির জানালার কাঁচ খুলে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এ যে দেখছি শীত লাগছে! কি আজব দেশ রে বাবা! এই তো ছিল গরম, মাত্র কয়েক মিনিট আগেই, হঠাৎ পালালো কোথায়? এই মেঘ, এই কুয়াশা আবার মিহি বৃষ্টি! এগুলো কোত্থেকে এলো? কিভাবে এলো? কেন এলো? নাকি আমাদের স্বাগত জানাতে?
এই ভাবতে-ভাবতেই গাড়ি যেন মেঘ-কুয়াশা আর বৃষ্টিকে ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চাইলো! একেবারে খাড়া পাহাড় বেঁয়ে যেন ট্রেক করা শুরু করলো! সেই সাথে বেশ গাঁ ছমছমে সব বাঁক! একেবারেই আঁকাবাঁকা কিন্তু মসৃণ, পাহাড়ের পিঠ কেটে বানানো রাস্তা!
হঠাৎ করে মেঘ ও কুয়াশা এতটা সজোরে আঁকড়ে ধরলো যে চোখ-মুখ সব ঝাপসা হয়ে গেল। আর সেই সাথে ঝুম-ঝুম বৃষ্টি! কিন্তু আমাদের ড্রাইভার এরই মাঝে তার স্বাভাবিক গতিতেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন! ভঁয়ে আমরা হিম হয়ে গেলাম, আরে সামনে তো কিছুই দেখা যায়না! যে কোন মুহূর্তেই তো গাড়ি পাহাড়ের খাঁদে পরে যেতে পারে! তাহলে?
ড্রাইভার আশ্বস্ত করলো যে এভাবেই ওনারা চালিয়ে অভ্যস্ত। পথ দেখে চালানোর কিছুই নাই! কি বলে রে বাবা? যদি সামনে থেকে কেউ এসে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়! তখন? এমনকি হর্ন পর্যন্ত দিচ্ছেনা! পাগল নাকি? নাকি নেশায় চূড় হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে? নাহ, তা হয়নি যে কদিন ছিলাম। সে কদিনের জন্য একটি বারের জন্যও! না কোন হর্ন, না কোন ওভার টেক, না কোন দুর্ঘটনা বা তার এতটুকু সম্ভাবনা!
কেউ কখনো অযথা ওভার টেক করেনা, অযথা হর্ন দেয়না, লেন পরিবর্তন করেনা, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশী গতিতে গাড়ি চালায় না, কেউই, কখনোই না! দার্জিলিং এর এই ব্যাপারটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ করেছে, যার আমি প্রেমে পড়েছি!
আর মেঘ-পাহাড়-ঝর্ণা-ক্ষণে ক্ষণে ঢেকে যাওয়া আর ছেকে ধরা কুয়াশা তো আছেই। আর আছে দারুণ রোমাঞ্চ আর শরীরে হিম ধরানো সব বিপদ সংকুল কিন্তু উপভোগ্য বাঁক, পাহাড়ের ভাজ-খাঁজ আর লাজ!
এই সব মিলিয়েই প্রেয়সী (ডার্লিং) দার্জিলিং। স্বল্প আর সংক্ষিপ্ত খরচে ভ্রমণের এক অপার্থিব আকর্ষণ। যেখানে বারে-বারে গিয়েও মন ভরেনা, তৃষ্ণা মেটেনা, আত্মার তৃপ্তি হয়না, দেখার শেষ হয়না, উপভোগের রেশ কাটেনা, শরীরে ক্লান্তি আসেনা, ফিরে আসার তাগিদ জাগেনা, ভালোলাগায় একাকার হয়ে যাই, ডুবে যাই গহীন গহ্বরে, ভেসে যাই কল্পনার রঙিন মেঘে, ভিজে যাই ভাবনার কুয়াশায়, হারিয়ে যাই সবুজের অরণ্যে।
তাই তুই আমার ডার্লিং দার্জিলিং......!
দার্জিলিং এর হোটেল আখ্যান (পরের গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩২