মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরি, হঠাৎ বৃষ্টির হালকা অবগাহন আর সহস্র পাহাড়ের সবুজ হাতছানি এড়িয়ে এক পাহাড়ের বুকে এসে দাঁড়ালো আমাদের টাটা সুমো। গোয়াইনকা রোড এর উপর, ঠিক পাহাড়কে ব্যারিকেড দিয়ে পর্যটকদের জন্য নির্মিত কাঠের রেলিং এর এক পাশে। সেখানে দাড়াতেই আরও একবার আমাদেরকে ভিজিয়ে দেয়া হল! এক ঝটকার মেঘেদের আলিঙ্গনে! ক্ষণিকের জন্য ঢেকে দেয়া হল ঘন কুয়াশার চাদরে আর আদরে গাল টিপে দেয়া হল হিম শীতল বাতাসের পরশে! এসব গদ্য আরও হবে এবার রাতে থাকার জন্য মাথা গোজার ঠাই খুঁজে পেতে হবে।
সুতরাং সবার সংকুলান আর স্বল্প খরচে থাকার মত মোটামুটি আরাম দায়ক একটা জায়গা তো চাই। তাই শুরু হল অপর্যাপ্ত বাজেটের সম্ভব্য হোটেলের খোঁজ। কয়েকটা হোটেল দেখে শুনে সবই ভালো লাগে কিন্তু ওই বাজেটে গিয়েই আটকে যাই বার-বার! তাই আবারো খোঁজ, আবারো ছুঁটে চলা আবারো পাহাড়ের কাঁধ বেঁয়ে একেবেঁকে উঠা-নামা।
এবার তিনজন করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কাছাকাছি হোটেলের খোঁজ। এটা দেখি-ওটা দেখি-সেটা দেখি কিন্তু এতো সহজেই মিলছেনা! এবার আর একটু নিচে নেমে চারজন উপরে বসে থেকে দুইজন নেমে গেল এক হোটেলের ভিতরে! হোটেলের নিচে নেমে গেল মানে কি! জি হ্যাঁ, পৃথিবীর যেথায় যেমনই হোক না কেন, দার্জিলিং এ হোটেলের উপরে না উঠে, নিচেই নামতে হয়! (অধিকাংশই)। এটাই দার্জিলিং এটাই আকর্ষণ আর এটাই রোমাঞ্চকর সেই সাথে......। দার্জিলিং এর অধিকাংশ হোটেলই নিচ থেকে উপরে না উঠে, উপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত! অদ্ভুত আর অনন্য সব ব্যাপার-স্যাপার।
কয়েক মিনিট পরেই আমাদের দুই সঙ্গী হোটেলের নিচ থেকে উপরে উঠেই চোখ টিপে আর হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরম প্রাপ্তিময় সংবাদ দিল! যে তারা বাজেটের ও সদস্যদের স্বস্তি দায়ক একটা ঘর পেয়েছে, যেখানে দুইটি বেশ বড় বেড সাথে অন্যান্য আনুসঙ্গিক সব কিছু তো আছেই! উপরন্ত আছে রান্না ঘর ও রান্নার সকল সরঞ্জাম! চাইলে কেউ রেঁধেই খেতে পারে যেন! এবং সেটাও অতি অল্প, এই মানে আমাদের বাজেটের চেয়েও প্রায় অর্ধেক খরচে, প্রতি রাত মাত্র...... (বলবো না, অবিশ্বাস লাগবে তাই!) আহা, আহা কি দারুণ! তাহলে চল যাই......
এবার সবাই যেতেই হোটেল সুপারভাইজার বেঁকে বসলো, রুম দেবেনা! কেন? কারণ, তিনি দুইজন মনে করে রুমের ভাড়া বলেছেন, ছয়জনকে এই ভাড়ায় দেবেন না! অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, এবার আমরা যুক্তি-তর্কে অবতীর্ণ হলাম... আমার তো রুম ভাড়া বলেছি, কতজন থাকবো সেটাতো বিলিনি আর আপনিও জিজ্ঞাসা করেননি? তো আমরা এই রুমে থাকতে পারলে আপনার সমস্যা কোথায়? আমরা তো আপনার কাছে রুমের চেয়ে বাড়তি কোন সুযোগ-সুবিধা চাইনি, তাহলে সমস্যা কোথায়?
এবার মহাশয় আমাদের যুক্তি-তর্কের সাথে আর পেরে না উঠে ইনিয়ে-বিনিয়ে আরও একটু বেশী ভাড়া দেবার আকুতি জানালেন। তা না হলে ওনার মূল মালিকের কাছে গাল মন্দ শুনতে হবে বলে, তাই আমরা এক ঝটকায় ১০০ রুপী! বাড়িয়ে প্রস্তাব দিলাম! এবং উনি এতেই রাজী! আর আমরাও হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম আমাদের রুমে। বাহ বেশ চমৎকার বড়সড় একটি রুম, মাঝখানে পর্দা আর পর্দার দুই পাশে বড়সড় দুই ইয়া খাট, যেখানে তিন-তিন ছয় জনের আরামের আয়েশ হয়ে যাবে। তার উপর আমাদের দেশের মাঘ মাসের চেয়েও জেঁকে ধরা শীত! সুতরাং কোন সমস্যা নাই।
এর পরেই ঘটতে থাকলো হোটেল আখ্যানের মূল পর্ব! হোটেল সুপারভাইজার আমাদের সাথে আর তেমন কো-অরডিনেট করেনা। আমাদেরকে যেন চেনেই না, এমন ভাব বা আচার-আচরণ! যেন দয়া করে থাকতে দিয়েছে আমাদের! সে যাই হোক, ওতে কার কি এসে যায় জানিনা, আমাদের তো অন্তত কিছুই এসে-যায় না! এতো অল্প খরচে, এমন একটা থাকার জায়গা পৃথিবীর আর কোথায় পাবো? তাই সেই আনন্দেই আমরা একটা বিশেষ ভোজ দিয়ে দিলাম, সেই রাতেই!
এরপর পরবর্তী পাঁচদিন শত উপেক্ষা-বাঁকাকথা আর কিছু মন বেদনা সত্যেও সেই রুম আমরা ছাড়িনি! কারণ, এই রুম একবার ছাড়লে এমন খরচে বা এর দ্বিগুণ দিয়েও এমন রুম পাবোনা! তাই......
“তোরা যে যা বলিস ভাই, আমাদের এই রুমটাই চাই!”
কবি গুরুর এই গানকে একটু এডিট করে মনে-মনে গুনগুনিয়ে মানিয়ে নিলাম সেই পরিস্থিতির সাথে! সেই সাথে পরবর্তী দিন গুলোও কাটিয়ে দিলাম হেলে-দুলে, পাল তুলে, মেঘ-কুয়াশা-মিহি বৃষ্টি-পাহাড় সারিতে চা বাগানের মাখামাখি আর অজস্র সবুজ অরণ্যে হারিয়ে।
চোখ মেললে কাঞ্চনজঙ্ঘা......! (পরবর্তী গল্প)